আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সুখবিলাস অথবা দুঃখবিলাস

মিজান সকাল নয়টায় চোখ মেলে তাকালো । সে কি আরো কিছুক্ষণ শুয়ে থাকবে না এখনই উঠে পড়বে বুঝতে পারছে না । তার কোনো কিছুতেই কোনো তাড়াহুড়া নেই । মিজান ভাবছে সে কি কাল রাতে ঘুমিয়েছিল । নাকি ঘুমায়নি কিন্তু সে ভাবছে ঘুমিয়েছে ।

এখন তাকে কে বলে দিবে সে রা্তে ঘুমিয়েছিল কিনা । আজ কি বাইরে রোদ উঠেছে ? ঘরের ভেতর এত শিশিরের গন্ধ কেন আজ ? মিজান ডান পাশ থেকে এবার বাম পাশে ফিরল । তখন সে যেন স্পষ্ট শুনতে পেলো তার হাড়ের মটমট শব্দ । এখন সে মনে করছে বাম পাশে ফেরা ঠিক হয়নি ডান পাশেই ভালো ছিল । অনেক আগে একবার তার জন্ডিস হয়েছিল ।

তখন তার গাঁয়ের রং হয়ে গিয়েছিল হলুদ । দেখতে কি বিচ্ছিরি লাগত । মিজান ভাবলো এখন তার এক কাপ চা খেতে হবে । তার বিলাসিতা বলতে চা আর সিগারেট । হঠাৎ তার সারা শরীর ঝিমঝিম করে উঠলো ।

মনে হচ্ছে কাল সারারাত সে ব্ল্যাক ডগ নামে বোতলটা খালি করে ফেলেছে । হয়তো সে রাতে খুব ভালো ঘুম দিয়েছে । কতদিন ধরে মিজানের কি হয়েছে সে কিছুই বুঝতে পারছে না । তার কোল বালিশ টাকে জড়িয়ে ধরলে তার মনে হয় সে একটা মেয়েকে জড়িয়ে ধরেছে । এজন্য সে কাল রাতে কোলবালিশ টা ছুড়ে মেঝেতে ফেলে দিয়েছে ।

মিজান ছটফট করতে লাগল । মনে হয় তার সারারাত ঘুম হয়নি । ছাই-পাশ ভাবতে ভাবতে দুপুর হয়ে গেলো । তবু মিজান বিছানা থেকে নামল না । খবরের কাগজ পড়ল না ।

চা খেলো না সিগারেট খেলো না । ঢক ঢক শব্দ করে কাচের গ্লাসে পানিও খেলো না । একবার আকাশের দিকে তাকালো না । তার মাথার মধ্যে একটা গান বাজছে- ' বউ আমার বাপের বাড়ি গেছে রে ,/ আমার উপর ভীষন রাগ করে / জামার বোতাম খোলা রে/ এখন আমি অফিস যাবো কি করে । ' মিজান আজ কাজে বের হলো না ।

মনে হচ্ছে তার অনেক জ্বর । কেন জানি মেঝে থেকে কোল বালিশ টা উঠিয়ে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করছে কিছুক্ষণ । ইদানিং মিজান ভাবছে তার মাথার সব চুল গুলো আইনষ্টাইনের মত সাদা করে ফেলবে । তখন হয়তো তার মধ্যে একটা জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব আসবে । তার মাথা ভর্তি চুল ।

কিন্তু তার দুঃখ হয় চুল গুলো সাদা নয় বলে । মিজান ভাবছে- তার গায়ের রং বিচ্ছিরি সাদা । তার হাতের শিরা গুলো সব সময় ফুলে ফুলে থাকে । তার একেবারেই সাহস নেই । সেদিন একটা রিকশাওয়ালা মিজানকে বলল রিকশায় যেতে হবে না হেঁটেই যান ।

তারপর বিচ্ছিরি হলুদ দাঁত বের করে হাসল । মিজান তাকে একটা চড় বসিয়ে দিতে পারলে আরাম পেতো । কিন্তু সাহসের অভাবে পারল না । সাহস নেই বলে তখন তার নিজের উপরই খুব রাগ লাগল । মিজান ইদানিং কবিতা লিখে ।

এবং সে ভাবে ভালোই লিখছে । তার কবিতা তে নারী-পুরুষের ভালোবাসার কথা থাকে । পাওয়া-না পাওয়ার কথা থাকে । অন্য একধরেন আনন্দময় বেদনা থাকে । মিজান ভাবে সে এক নিঃসঙ্গ যুবক ।

এটাই তার সবচেয়ে বড় সমস্যা । আবার ভাবে খারাপ মানুষের সঙ্গের চেয়ে একা থাকাই অনেক ভালো । দুনিয়া ভরে গেছে খারাপ মানুষে । সারা সকাল মিজান শুয়ে কাটাল । বিচিত্র সব গন্ধ শুনল ।

তার খুব অস্থির লাগার কারণে বিকেলে সে বাসা থেকে বের হলো কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করবে বলে । এই যে রাস্তায় এতো মানূষ হাঁটছে, মিজান এদের কাউকে চিনে না । মিজানকেও এরা কেউ চিনে না । চারিদিকে ময়লা । মানুষের ভীড় ।

বেশীর ভাগ মানূষের মুখই মিজানের কাছে এক রকম মনে হয় । দশ বার করে দেখলেও এইসব মুখ মনে থাকে না । নিজেকে মাঝে মাঝে রাস্তার কুকুর বলে মনে হয় । নিজের বলতে কিছু নেই তার শুধু দুঃখ ছাড়া । মিজান ভাবে দেশের ষোল কোটি মানূষ আমাকে চিনে না, তাতে আমার কি এই ভাবতে ভাবতে মিজান রাস্তার পাশের দোকান থেকে দু'কাপ চা খেল ।

দু'টা সিগারেট শেষ করলো । রাস্তা ভর্তি মানূষ-জন । একটা লোক অবাক চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে । মিজান রাস্তায় বের হলেই আশে-পাশের চার দিক খুব মনোযোগ দিয়ে দেখে । রাস্তা-ঘাট, আশে-পাশের মানূষ-জন, দোকান-পাট দেখে সে খুব আনন্দ পায় ।

আজ রাস্তায় এত মানূষ কেন ? আজ কি কোনো বিশেষ দিন ! নিজেকে যখন তার রাস্তার কুকুর বলে মনে হয় তখন তার মরে যেতে ইচ্ছা করে । মিজান আর একটা সিগারেট ধরিয়ে ভাবলো- আমি মিজান । কোনো কিছুর উপরই আমি প্রতিফলন ঘটাতে পারি না । মিজান আজ অনেকক্ষণ রাস্তায় হাঁটবে । রাস্তায় সে একটা মেয়েকে দেখতে পেলো ।

মেয়েটাকে তার চেনা মনে হচ্ছে । কিন্তু কোথায় দেখেছে কিছুতেই মনে করতে পারছে না । মেয়েটি দেখতে খুব সুন্দর । হাটছেও খুব সুন্দর করে । লাল সবুজ নীল শাড়িতে মেয়েটিকে দারুন লাগছে ।

মাথার চুল খোলা । মেয়েটির হাত ধরে মিজানের হাঁটতে ইচ্ছা করছে । মেয়েটিকে কোল বালিশের মতো জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করছে । মেয়েটি রাস্তায় হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল । রাস্তার নিয়ন বাতির আলো মেয়েটির চোখ মুখের উপর পড়ল ।

মিজান মেয়েটির পাশে গিয়ে দাড়ালো । মেয়েটি মিজানকে বলল- কিছু বলবেন । মিজান বলল- আমি কি আছি ? আপনি কি আমাকে দেখতে পারছেন ? আপনি কি আমার হাতটা একটু ছুঁয়ে দেখবেন সত্যিই আমি আছি কি না ! মেয়েটি কথা বলল না, চুপ করে আছে । মেয়েটি মুখ ফিরিয়ে নিল । মিজান বলল- এই রাস্তায় রিকশা পাওয়া যায় না ।

মেয়েটি এখন কোথায় চলে যাবে মিজান জানে না । মিজান চায় মেয়েটি কিছুক্ষণ তার হাত ধরে হাটুক । মেয়েটি খুব চালাক মিজান ভাবে । মিজান হাসি মুখে বলল- আমি কি তোমাকে একটা চুমু দিতে পারি ? চুমুর জন্য যদি তুমি টাকা চাও পাবে । আর যদি তুমি টাকা নাও তাহলে তোমাকে আমার অনেক জমানো কথা বলব, কারণ তোমাকে বিশ্বাস করা যায় ।

মেয়েটি চলে গেলো । মিজান একা দাঁড়িয়ে রইল । মিজান ভাবছে সত্যিই কি মেয়েটি এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল ? যদি মেয়েটি না যেত তাহলে ঘটনা এই রকম হতোঃ মিজান আর মেয়েটি একটি শিমুল গাছের নিচে বসত । মিজান মেয়েটির নাম জিজ্ঞেস করতো । ছন্দা ।

তারপর জানতে চাইত- তুমি কোথায় যাচ্ছিলে ? আমি রাস্তায় হাঁটতে বের হয়েছিলাম । তুমি কোথায় থাকো ? আমি পুরান ঢাকায় থাকি । সেখানে তোমার কে কে থাকে ? মা-বাবা আর ছোট ভাই । মেয়েটি মিজানকে বলত তুমি কই থাকো ? আমি জানি না আমি কই থাকি ! তোমার বাবা-মা ? জানি না তারা কোথায় । মেয়েটি বলল- ধুৎ তারপর হেসে মিজানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল ।

মিজান বলল- আমি সবার কথা ভাবি । মেয়েটি হেসে মিজানের পিঠে হাত রাখল । তারা দুইজন হাত ধরে হাঁটতে শুরু করলো । অনেকক্ষন হেঁটে একটা লেকের সামনে বসল দুজন পাশাপাশি । মিজান মেয়েটিকে ঠোঁটে চুমু দিলো ।

কোথাও কেউ নেই । মেয়েটি মিজানকে জড়িয়ে ধরল অন্ধকারে । মেয়েটি মিজানকে চুমু দিলো গলায় । দুইজন দুইজনকে মোট ৮২ টা চুমু দিলো । তাও কম মনেও হচ্ছে ।

কারো-ই মন ভরে নি । মেয়েটি দুই হাত দিয়ে মিজানের মুখ ধরল, খুব আবেগ নিয়ে বলল- দুঃখ পেও না । মিজান বলল আমি তো তোমাকে কোনো দুঃখের কথা বলিনি । মেয়েটি বলল- আমি টের পাই তোমার এক আকাশ দুঃখ । মিজান চুপ করে অন্ধকারের মধ্যে মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল ।

মেয়েটি বলল- আমার সময় শেষ, আমাকে বাসায় নামিয়ে দাও । মিজান বলল আবার কখন দেখা হবে ? মেয়েটি বলল- আর দেখা হবে না । তোমার মন খারাপ ছিল তাই কিছুক্ষন তোমাকে সময় দিলাম । সেই নিয়ন বাতির কাছেই মিজানের ঘোর কাটল । মেয়েটির উপর মিজানের খুব মায়া লাগছে ।

মেয়েটি হয়তো সবার বুকে মাথা রাখার মেয়ে নয় । মিজান ভাবে সে কি বেঁচে আছে ? মেয়েটি তা প্রমাণ না করে বিদায় নিলো । মিজান বাসায় ফিরল রাত ১২ টায় । সারা ঘর অন্ধকার করে বসে থাকল । হয়তো বসে নয় দাড়িয়েই থাকল ।

তাতে কার কি ! আজ সারারাত মিজান কাঁদবে । তাতে কার কি ? কেউ এসে তো আর তাকে জড়িয়ে ধরে দু'টো ভালোবাসার কথা বলবে না । অন্ধকারের মধ্যে মিজান কাকে যেন বাজে দু'টা গাল দিলো । তারপর লাথি দিলো অদৃশ্য কাউকে । ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।