১৯৯১ সালের ঘটনা। আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। এক গ্রামে থাকতাম আমরা। আমি, আমার মা, দাদি আর এক ফুপু। বাবা থাকতেন বিদেশে।
আমাদের বাড়ির পাশ দিয়েই বয়ে গেছে একটা নদী। সঙ্গত কারণেই নদীটার নাম উল্লেখ করছি না।
আর আমাদের বাড়ির উঠোনের এক কোনে ছিল একটা আম গাছ। তবে সে গাছে ফলন হত না। বোধ হয় প্রতি বছর বন্যার ফলে নদীর পানি উপচে আমাদের বাড়ির উঠোন ভাসিয়ে নিত বলেই।
তবে আমার দাদীর মত ছিল ভিন্ন। তিনি আমার আমার দাদার বাবা অর্থাৎ তার শ্বশুরের মুখে শুনেছেন, তার বাপ-দাদারা নাকি জন্মের পর থেকেই গাছটাকে দেখে এসেছেন। তখন গাছটায় মোটামুটি প্রতি বছরই দু-চারটা আম হত। তবে কোন এক রাতে এক মহিলা নাকি তার ৩ বছরের বাচ্চা মেয়েসহ ওই গাছের সাথে গলায় দড়ি দিয়েছিলেন। সেই সময়ে একটা কুকুর তাদের দেখে চিৎকার জুড়ে দেয়।
কুকুরের চিৎকার শুনে গ্রামের লোকজন ছুটে এসে মহিলাকে বাঁচিয়েছিলেন, কিন্তু মেয়েটাকে বাঁচানো যায়নি। বাচ্চার শোকে মহিলা সপ্তাখানেক ওই গাছের তলায় গড়াগড়ি খেয়ে ওখানেই মারা যায়। ওই মহিলা যে কয়দিন গাছের তলায় গড়াগড়ি খেয়েছিল, সেই কয়দিন কুকুরটাকেও দেখা গেছে আম গাছটাকে বৃত্তাকারে চক্কর দিতে। মহিলা যেদিন মারা গেল, সেই থেকে নাকি আম গাছটায় আর কোনদিন ফলন হয়নি। মহিলা মারা যাবার পর কুকুরটাকেও আর দেখা যায়নি।
একটা আম গাছ এত বছর ধরে কিভাবে বেঁচে আছে, সেটা আমার কাছে একটা রহস্যই বটে। তবে গ্রামের মানুষ এসব নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না। তাদের মাথা ঘামাবার জিনিসের অভাব নেই।
এবার আমার সাথে ঘটা ঘটনায় আসি। তখন শীতকাল।
এক রাত্তিরে খেয়েদেয়ে সবে বিছানায় বিছানায় পিঠ ঠেকিয়েছি, বাইরে শুনি কুকুরের ঘেউ ঘেউ। প্রথমে খুব একটা গা করিনি। ভেবেছি ডাকছে ডাকুক। কিছুক্ষণ পর চলে যাবে। কিন্তু না।
কুকুরটা গেল না। আমার দাদি পাশের ঘর থেকে বিরক্ত হয়ে বললেন, 'ইস সি রে! রাত্তিরবেলা একটু ঘুমানোরও জো নেই। ওই মুনির, যেয়ে কুত্তাডারে খেদায় দিয়া আয় তো!'
আমিও ততক্ষণে বিরক্ত হয়ে গেছি। লেপের তল থেকে অনেক কষ্টে বেরোলাম বাইরে। আকাশে চাঁদ আছে তবে তার আলো খুব একটা উজ্জ্বল নয়।
আবছা আলোয় একটা কুকুর দেখলাম বটে, তবে সেটাকে আমাদের গ্রামে আগে কোনদিন দেখিনি। দুই একবার হেই হেই করলাম। কাজ হল না। তারপর একটা ঢিল হাতে নিয়ে কুকুরটার গায়ে মারলাম। কুকুরটার গায়ে ঢিলটা লাগতেই কোথা থেকে যেন একটা বাচ্চা মেয়ের কান্নার আওয়াজ ভেসে এল।
ভয়ই পেয়ে যেতাম ওই সময়। কিন্তু সেই মুহূর্তে আমার মা এসে বললেন, 'কি, কুত্তাটা এখনো যায় নাই?' আমি মার কথার উত্তর না দিয়ে বললাম, 'কোন বাচ্চার কান্নার আওয়াজ পেয়েছ?' মা অবাক হয়ে বলল, 'বাচ্চার কান্নার আওয়াজ পাব কেন? আমাদের বাড়ি কি কোন বাচ্চা আছে নাকি?'
আমি আর কোন উত্তর দিলাম না। ভাবলাম, হয়ত ভুল শুনেছি। তারপর পাশে তাকিয়ে দেখি কুকুরটা এখনো দাঁড়িয়ে আছে। ধাবড়িয়ে ওটাকে বাড়ির সীমানা ছাড়া করে এলাম।
তবে আম গাছটার দিকে একবারও তাকাইনি। কে জানে, তাকালে হয়ত ভয়ংকর কিছু দেখতে পেতাম!
এরপর মাসখানেক কেটে গেছে। আমার স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়ে এখন রেজাল্টের অপেক্ষা। গ্রামের স্কুল তো, তাই রেজাল্টের নির্দিষ্ট কোন ডেট দেয় নাই। স্কুল থেকে বলেছে রোজ স্কুলে গিয়ে খোঁজ নিতে, যেকোনদিন রেজাল্ট দিবে।
গত দুই সপ্তাহ ধরে নিয়মিত স্কুলে গিয়ে খবর নিচ্ছি, তবে রেজাল্ট আর দেয় না। অবশ্য ডিসেম্বর মাস শেষ হতে চলল। এখন দুই একদিনের মধ্যেই যে দেবে তাতে সন্দেহ নেই। অংক পরীক্ষাটা খুব একটা ভাল হয়নি। দুশ্চিন্তায় আছি, ফেলই করে বসি কিনা!
সেদিন রাত্তিরেও পাস ফেলের এই শঙ্কা নিয়েই মনে মনে বারবার আঁতকে উঠছিলাম।
ঘুম আসছিল না। সম্ভবত রাত ১২টার দিকে শুরু হল কুকুরের ডাক। আমি অবশ্য বিছানায় লেপের তল ছেড়ে নামলাম না। প্রায় আধা ঘণ্টা কি পৌনে এক ঘণ্টা এক নাগাড়ে কুকুরটা ডেকে চলল। শেষে আর না পেরে আমি বেরিয়ে এলাম কুকুরটাকে তাড়াতে।
বাইরে বেরিয়েই একটার বাচ্চার কান্নার মত আওয়াজ পেলাম। তবে সেদিকে খুব একটা মনোযোগ না দিয়ে কুকুরটার গায়ে ঢিল মারতে লাগলাম। তবে আজ ওতে কোন কাজ হল না। কুকুরটা আমার কাছে এসে আমার লুঙ্গি কামড়ে ধরে টেনে আমাকে কোথায় যেন নিয়ে যেতে লাগল। আমি বললাম, 'হেই! ছাড় ছাড়!'
তবে কুকুর তো আর আমার ভাষা বোঝে না।
জোর করে আমাকে সে টেনে নিয়ে এল আম গাছের সামনে। সেখানে এসে আমি যে দৃশ্য দেখলাম তাতে আমার হাত পা জমে কাঠ হয়ে গেল। দেখলাম, এক মহিলা তার বাচ্চা মেয়েসহ আম গাছের ডালের সাথে দড়ি পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস দিচ্ছে! আমি খুব একটা ভিতু নই। তবে এ দৃশ্য সহ্য করবার মত মনের জোরও আমার ছিল না। চিৎকার করে উঠে, মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম আমি।
তারপর এক মাসের কোন ঘটনা আমার স্মৃতিতে নেই। পরে শুনেছি, মাঝ রাত্তিরে নাকি ঘুমের ঘোরে আম গাছের কাছে চলে গিয়েছিলাম আমি। আর সেখানেই নাকি আমাকে পড়ে থাকতে দেখা যায়। তারপর ঘরে নিয়ে আসার পর থেকে প্রচণ্ড জ্বর। এই জ্বরের ফলে টানা এক মাস অসুস্থ ছিলাম আমি।
মাঝেমধ্যে জ্ঞান ফিরত কিন্তু তখন শুধুই ভুলভাল বকতাম। বারবার নাকি সবাই আমাকে একটা কুকুর, এক মহিলা আর একটা বাচ্চার কথা বলতে শুনেছে। এই এক মাসে অনেক ডাক্তার কবিরাজ দেখানো হয়েছে আমাকে। এক হুজুর এসে নাকি বলেছে, এই বাড়িতে খারাপ হাওয়া আছে। খুব সম্ভবত আম গাছটায় খারাপ কিছু আছে।
তাই হুজুর ওই গাছের একটা ডালে একটা তাবিজ ঝুলিয়ে দেন আর বলেন তিন মাস পর তাবিজটা খুলে রেখে গাছটা যেন কেটে ফেলা হয় আর তারপর সেখানের মাটিতে তাবিজটা পুঁতে ফেলা হয়।
হুজুরের কথা মতই সব করা হয়। আমি অবশ্য সুস্থ হওয়ার পরেও কাউকে বলিনি কি দেখে বা কিভাবে এরকম বড় অসুখ বাধিয়েছি। অনেকেই আমাকে জোর করেছে এটা জানার জন্য যে কিভাবে আমি মাঝ রাত্তিরে আম গাছের তলে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলাম। আমি কারো প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারিনি, কেবল হেসেছি।
তবে এটুকু জেনেছি যে আমাকে অজ্ঞান অবস্থায় সেদিন পাবার পর ওই কুকুরটাকে আর দেখা যায় নি। গোটা ঘটনার আমি নিজে নিজে একটা থিওরি তৈরি করেছিলাম, তবে সেটা এতদিন কারো সাথে শেয়ার করিনি।
সম্প্রতি এই ঘটনাটা আমার খুব ক্লোজ এক ফ্রেন্ডকে বলি। সে একজন মনোবিদ। সব শোনার পর সে বলল, 'এ ব্যাপারে তোর নিজের কি মতামত?'
আমি বললাম, 'আমিও অনেকটা ওই হুজুরের মতই একই জিনিস ভেবেছি।
হয়ত আম গাছে গলায় দড়ি দিয়ে যে বাচ্চা মেয়েটা আর তারপর যে মহিলাটা গাছের নিচে মারা গেছিল, তাদের অতৃপ্ত আত্মা ওই গাছে রয়ে গিয়েছিল। তাদের দেখাতেই ওই কুকুরটা আমাকে ডেকে বাইরে নিয়ে এসেছিল। '
আমার বন্ধুটি তখন হেসে বলল, 'এইখানেই তো যত গোলমাল!'
আমি বললাম, 'মানে?'
ও বলল, 'তোর দাদি তোকে যে কাহিনী শুনিয়েছিল, সে অনুযায়ী কেবল মহিলাটা আর বাচ্চাটা মারা গিয়েছিল। তাহলে তো কেবল ওই দুইজনের অতৃপ্ত আত্মার ফিরে আসবার কথা। কিন্তু তাহলে এখানে আবার কুকুরটার আগমন কেন ঘটল?'
আমি আমার বন্ধুটার যুক্তিতে হতভম্ব হয়ে গেলাম।
ওকে জিজ্ঞেস করলাম, 'তাহলে এবার তুই আমাকে বুঝিয়ে দে, আসলে আমার সাথে কি হয়েছিল। '
ও বলল, 'আসলে সবই তোর অবচেতন মনের কল্পনা। তুই তোর দাদীর কাছ থেকে একটা গল্প শুনেছিলি যা তোর মনে খুব দাগ কেটেছিল। তাই প্রথমবার কুকুর তাড়াতে বাইরে বেরিয়ে আসার পর তোর অবচেতন মন তোকে একটা ভুল সিগনাল দেয়, যাতে তোর মনে হয় তুই একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজ পাচ্ছিস। '
এ পর্যন্ত বলে বন্ধুটি থামল।
তারপর আবার বলতে শুরু করল, 'পরেরবার তোর মনে ছিল পরীক্ষার রেজাল্টের ভয়। এই ভয়টাই তোর অবচেতন মনকে আরও খানিকটা উস্কে দেয়। ওইদিন হয়ত তুই কুকুরের কোন ডাকই শুনিসনি কিন্তু তবু তোর মনে হয়েছে কোন কুকুর ডাকছে। '
আমি বললাম, 'কিন্তু ঘরের ভেতর বসে আমি কুকুরের ডাকটাও ভুল শুনব?'
ও বলল, 'শুনতেই পারিস। কারণ তোর ভাষ্য অনুযায়ী ওইদিন প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা কুকুরটা ডেকেছিল।
তাহলে এদিন তোর দাদী বা মায়ের কেন ঘুম ভাঙেনি? আগের দিন তো সামান্য সময় কুকুরের ডাকেই তাদের ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল। আসলে ওইদিনের সব ঘটনাই তোর কল্পনা। তুই প্রথমে কল্পনা করেছিস একটা কুকুর ডাকছে। তারপর বাইরে বেরিয়ে এসে তুই এগিয়ে গেলি আম গাছের দিকে। তখন তোর মনে ঘুরছিল তোর দাদীর মুখে শোনা ঘটনা।
এই সময় তুই একটা হেলুসিনেশনের মধ্যে চলে গেলি। গল্পে যা যা শুনেছিলি, বাস্তবেও তাই দেখতে পেলি। '
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। তারপর বললাম, 'এইছিল তাহলে তোর যুক্তি?'
ও বলল, 'শুধু তাই না, আমার তো মনে হয় তোর দাদী তোকে যে কাহিনী বলেছিল সেটাও আসলে মিথ্যা। '
আমি বললাম, 'মিথ্যা হবে কেন?'
ও বলল, 'তাই যদি না হবে, তাহলে তো গল্পের শেষে তোর দাদীর তোকে জানানো উচিত মহিলাটা আর বাচ্চাটার কবর দেয়া হয়েছিল কোথায়।
যে গ্রামে এতবছর ছিলি, সেই গ্রামের কোন একখানে ওই দুইজনের কবর দেওয়া হল আর তুই কোনদিন তা দেখতে পেলি না? এটা কিভাবে সম্ভব হয়?'
আমিও তখন মনে মনে ভাবলাম, আসলেই তো। দাদীর কাছে শোনা গল্পের এখানেও তো একটা মস্ত ঘাপলা আছে!
তাহলে কি আমি এতদিন একটা ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে ছিলাম?
আমার ওই বন্ধুটার সাথে এ বিষয়ে কথা বলার পরের সপ্তাহে গেলাম ওই গ্রামে। সৌভাগ্যক্রমে আমার দাদী এখনো জীবিত। তার কাছে জিজ্ঞেস করলাম, ওই মহিলা আর বাচ্চা মেয়েটার কবর হয়েছিল কোথায়?
আমার দাদী তখন যা জানালো, তাতে অবাক হয়ে গেলাম। ওরা দুজন নাকি হিন্দু ছিল।
তাই সনাতন নিয়মেই তাদের সৎকার হয়েছিল।
এই ঘটনা তৎক্ষণাৎ আমি আমার বন্ধুটিকে ফোন করে জানালাম। এবার আমার মত আমার বন্ধুটিরও অবাক হবার পালা। ও আমাকে বলল, ও নাকি কবর দেবার ব্যাপারটাকেই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়ে আমার সাথে ঘটা ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করেছিল। কিন্তু মহিলা আর বাচ্চাটা যদি হিন্দুই হয়ে থাকে, তাহলে তো ওর সব যুক্তিই অর্থহীন হয়ে পড়ে!
তাহলে কি আসলেই পৃথিবীতে এমন ঘটনাও আছে যাকে যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করা যায় না? ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।