ভালবাসি
সরকার উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাকে আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এজন্য সরকার উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা আইন-২০১১ করার উদ্যোগ নিয়েছে। এ আইন অনুযায়ী যারা উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করবেন তাদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষামানের সমান শিক্ষা সনদ দেয়া হবে। এ জন্য স্বায়ত্তশাসিত বা সরকার নির্ধারিত বোর্ডও থাকবে।
সূত্র জানায়, আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে থাকা জনগোষ্ঠীকে 'উপানুষ্ঠানিক' শিক্ষার আওতায় আনার জন্য সরকার এ উদ্যোগ নিচ্ছে।
এ শিক্ষার ব্যাপকতা বাড়াতে সরকার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকেও অন্তর্ভুক্ত করবে। এ শিক্ষা আনুষ্ঠানিক শিক্ষামানের সমান হবে। তবে শিক্ষাপদ্ধতি হবে ভিন্ন। তবে এ নিয়ে শিক্ষাবিদদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, খসড়া আইনে বলা হয়েছে, আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু, যুবক ও বয়স্কদের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার আওতায় আনা হবে।
তাদের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে জীবনব্যাপী শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা এবং স্বাক্ষরতা, মৌলিক শিক্ষা ও দক্ষতা, প্রশিক্ষণ এবং যথাযথ ও মানসম্মত শিক্ষার সুযোগ দেয়া হবে। একই সঙ্গে তাদের পর্যাপ্ত জ্ঞান ও জীবনমুখী দক্ষতা সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দেয়া হবে।
প্রস্তাবিত উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা আইন-২০১১-এর পরিধিতে বলা হয়েছে, এ কর্মকা-ে শিশু, কিশোর-কিশোরী এবং যুবক-যুবতিদের অগ্রাধিকার দেয়া হবে। মানসিক ও শারীরিক শিক্ষা
প্রতিবন্ধী শিশু ও যুবক-যুবতীদের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রেখে সব ধরনের সুবিধা বঞ্চিতদের- যেমন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, দুর্গম (হাওর, চর ও উপকূলীয়) অঞ্চলের মানুষ, দুঃস্থ (যেমন, পথশিশু, কর্মজীবী শিশু) এবং অন্যান্য যে কোনোভাবে সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য বিশেষ শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা হবে।
প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, মূলত দেশের সব নাগরিকের জন্য শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি এবং সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠাই হচ্ছে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থার লক্ষ্য।
যাতে শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে পিছিয়ে পড়া জনগণ নিজস্ব ক্ষমতাকে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করে পরিবারের এবং সম্প্রদায়ের জন্য অবদান রাখতে পারে। একই সঙ্গে যেন পরিবর্তনশীল বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় উৎপাদনক্ষম ও দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
সূত্র জানায়, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে সরকার অনুমোদিত একটি একক কারিকুলাম অনুসরণ করা হবে। বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধি এবং বিশেষজ্ঞদের সমম্বয়ে এ কারিকুলাম প্রণয়ন করা হবে। এ ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতির বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা হবে।
জানা গেছে, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা আইন-২০১১-এ আনুষ্ঠানিক শিক্ষার বিভিন্ন স্তরের (গ্রেড) সঙ্গে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মানের সমতা নিশ্চিত করতে আনুষ্ঠানিক প্রতিস্তরের জন্য নির্ধারিত মূল যোগ্যতার অনুরূপ মানের মূলযোগ্যতা উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য নির্ধারণ করা হবে। ওই যোগ্যতাগুলোর ওপর ভিত্তি করে কারিকুলাম প্রণীত হবে।
সূত্র আরো জানায়, আনুষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপনকারীদের যথাযথভাবে যোগ্যতা যাচাইয়ের পর তাদের আনুষ্ঠানিক মানের সনদ দেয়া হবে, যা সর্বত্রই গৃহীত হবে। উপানুষ্ঠানিক এবং আনুষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপনে প্রদত্ত প্রতি স্তরের সনদের একই গুরুত্ব, মর্যাদা এবং উপযোগিতা থাকবে। এ উভয়বিধ শিক্ষার সনদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে কোনো প্রভেদ করা হবে না।
আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় সনদ প্রদানের অনুরূপ উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপনে সমমানতা সনদ দেয়ার জন্য স্বায়ত্তশাসিত একটি বা সরকার নির্ধারিত বোর্ড থাকবে। যার সাংগঠনিক কাঠামো এবং জনবল সরকার কর্তৃক অনুমোদিত হবে। বোর্ড যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে নিজস্ব বিধিমালা ও কর্মপ্রণালী প্রণয়ন করবে।
উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা আইনে-২০১১ আরো বলা হয়েছে, সমমানতা সনদের বলে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার কোনো শিক্ষার্থী আনুষ্ঠানিক শিক্ষার যে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরবর্তী স্তরে ভর্তি হতে পারবে। একইভাবে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সনদ প্রাপ্ত কোনো শিক্ষার্থী উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার পরবর্তী স্তরে যোগ্য বলে বিবেচিত হবে।
আইন বাস্তবায়ন কাঠামোতে বলা হয়েছে, সরকারকে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা বিষয়ে পরামর্শ দেয়ার জন্য নীতি নির্ধারণ ও চলমান কাজ মূল্যায়নের জন্য সরকার প্রধান /সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর নেতৃত্বে পেশাজীবী, বিশেষজ্ঞ, রাজনৈতিক নেতারা, বেসরকারি সংস্থা এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে একটি জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি থাকবে।
সরকারের কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য সরকার অনুমোদিত সাংগঠনিক কাঠামো ও জনবল নিয়ে একটি জাতীয় সংস্থা থাকবে। স্থানীয় সরকারগুলোকে কার্যকরভাবে সংযুক্ত করা হবে।
কাজের পরিমাণ ও প্রয়োজন বিবেচনা করে জাতীয় সংস্থাকে সরকারের অনুমোদন নিয়ে সরকারের বিভিন্ন প্রশাসনিক স্তরে বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে। একইসঙ্গে বেসরকারি সংস্থাকেও উৎসাহিত করা হবে।
জাতীয় সংস্থা তাদের যোগ্যতা, দক্ষতা এবং কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে।
বাংলাদেশের সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশে বলা হয়েছে, (ক) একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সব বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা দানের জন্য, (খ) সমাজের প্রয়োজনের সঙ্গে শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করিবার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছা প্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য, (গ) আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।
এ বিষয়ে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কলা অনুষদের অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখরের সঙ্গে। তিনি বলেন, বর্তমানে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থার কারিকুলাম ও সিলেবাসের মান দুর্বল। তারপরও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থার মান আকাশ-পাতাল পার্থক্য।
আর উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা সমাজের ঝরে পড়া বা কর্মে নিয়োজিতরা শিক্ষাগ্রহণ করে থাকেন। তাই দুই শিক্ষা ব্যবস্থাকে এক করে দেয়া হলেও প্রকৃতপক্ষে পদ্মা-মেঘনার মতো দুটি পৃথক ধারাই থাকবে। যদি উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থার কারিকুলাম সিলেবাস উন্নত করা হয় অথবা আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থার কারিকুলাম সিলেবাসের মান কমিয়ে দেয়া হয় তাহলেও এটি সম্ভব হবে না। এমন কি পঞ্চম শ্রেণীর জন্যও না। এছাড়া এ ধরনের সিদ্ধান্ত বা শিক্ষাব্যবস্থা কারোরই কাম্য নয়।
তিনি বলেন, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থায় বয়সের কোনো পার্থক্য থাকে না, আনুষ্ঠানিকে তা আছে। তাদের নির্দিষ্ট বয়সে নির্দিষ্ট শিক্ষা শেষ করতে হয়। তাই দুই শিক্ষাব্যবস্থায় বয়সের তারতম্যও বাধা হয়ে দেখা দেবে। তাই সরকারের উচিত হবে এই দুই ধারাকে এক না করে শিক্ষার্থীদের চাকরিসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধায় প্রতিযোগিতা করতে পারার বিষয়টি নিশ্চিত করা। যাতে তারা যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে জায়গা করে নিতে পারে।
তা না হলে শিক্ষাব্যবস্থায় নৈরাজ্য সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা থাকবে।
ঢাবির ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সিকদার মনোয়ার মুর্শেদ বলেন, বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে আদিবাসীদের শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। সেখানে যারা পড়াশোনা করছে তাদের পঞ্চম শ্রেণী পাসের স্বীকৃতি দেয়া হবে যা ইতিবাচক। তবে ওপরের লেভেলে এ সুযোগ দেয়া ঠিক হবে না। কারণ ওপরের লেভেলে এমনিতেই বিভেদ তৈরি হয়ে আছে।
যেমন, একজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র যে সম্মান এবং সুযোগ পায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তা পায় না। চাকরির ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা গুরুত্ব বেশি পেয়ে থাকে। আর এটা শিক্ষার মানের কারণেই হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেসবাহ কামাল বলেন, শিক্ষা ব্যস্থার মানকে যদি সঠিক করা যায় তাহলে তা অবশ্যই ইতিবাচক।
তবে শিক্ষাকে এখনও গুণগত মানে উন্নত করা সম্ভব হয়নি। তাই মানকে কি করে উন্নত করা যায় তা ভাবা হচ্ছে। এখন দুই ব্যবস্থাকে নিয়েই ভাবতে হবে। এ দুই ব্যবস্থার সমন্বয় করতে গেলে কিছু সমস্যা হতে পারে। তাই বলে থেমে থাকলে হবে না।
রাষ্ট্র সময়মতো যাদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারেনি তাদের সে অধিকার দেয়া হচ্ছে। ফলে যারা সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছিল তাদের জন্য এটি নিঃসন্দেহে সুখবর। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।