আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুক্তিযুদ্ধের অবিস্মরণীয় কবিতা

এই যুদ্ধের শেষ কখন, তখনো তা জানা নেই। দেশ-জুড়ে নরমেধযজ্ঞ চলছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর। ২৫ মার্চের পর থেকেই প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে তাই মানুষ ছুটে চলেছে দিগ্বিদিক। সীমান্ত পেরিয়ে অসংখ্য মানুষ পিলপিল করে ঢুকছে ভারতে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি নাগাদ এই সংখ্যা ৯৯ লাখ ছুঁই ছুঁই করবে।

কিন্তু এখনো সেটা অনেক দূর। এখন চলছে সেপ্টেম্বর মাস। বাংলাদেশের বেনাপোল প্রান্ত দিয়ে যে রাস্তাটা ভারতে ঢুকে গেছে, সেখানে মানুষের মাথা মানুষে খাচ্ছে। কলকাতার দিকে চলে যাওয়া দীর্ঘ এই রাস্তাটার নাম যশোর রোড। রাস্তাটার দুই পাশ ঘরবাড়িতে তখনো ততটা ঘিঞ্জি নয়।

মাঝে মাঝে যেসব খেতি জমি আর ফাঁকা মাঠ, সব সয়লাব হয়ে আছে মানুষে। মাইলের পর মাইল তাঁবু খাটিয়ে থাকা মানুষ, খোলা মাঠে আশ্রয়হীন মানুষ, চলৎশক্তিহীন মুমূর্ষু স্বজনকে পিঠের ওপর বয়ে কুঁজো হয়ে হাঁটতে থাকা মানুষ। এর মধ্যে চারপাশ ভেসে গেছে বন্যায়। বন্যার সঙ্গে এসেছে কলেরাও। এই বিরূপ দৃশ্যপটের মধ্যেই বন্যার পানি ভেঙে বনগাঁ-বয়ড়া সীমান্তের শরণার্থী শিবিরে ঢুকেছেন একজন সাহেব।

তাঁবুতে তাঁবুতে ঘুরছেন। কথা বলছেন শরণার্থীদের সঙ্গে। দেখছেন, খাদ্যের অভাবে কীভাবে ধুঁকছে লাখ লাখ মানুষ, মরণাপন্ন বাবা-মায়ের জন্য ওষুধ না পেয়ে কীভাবে মাথা কুটছে সন্তান, বমি করতে করতে কীভাবে মরছে শিশুরা। নিউইয়র্কে ফিরে গিয়ে নভেম্বরের ১৪ থেকে ১৬ তারিখ পর্যন্ত এই অভিজ্ঞতা একটি কবিতায় রূপ দেবেন মার্কিন এই কবি। নিউইয়র্ক টাইমস ও ভিলেজ ভয়েস-এ ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ নামে বের হবে সেই কবিতা।

হুলুস্থুল পড়ে যাবে সর্বত্র। অ্যালেন গিন্স্বার্গ (১৯২৬-১৯৯৭) নামের মার্কিন সেই কবি তত দিনে পৃথিবীজুড়ে দারুণ নন্দিত ও নিন্দিত, তাঁর খোলামেলা কবিতা ও অকপট জীবনযাপনের জন্য। বিট সাহিত্য আন্দোলন, যুদ্ধবাজ মার্কিন প্রশাসনের তীব্র সমালোচনা, কিউবার পক্ষ সমর্থন এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরোধিতা তাঁকে তুমুল তর্কের কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে। সেই বিতর্কের ঘূর্ণিবাত্যার মধ্যেই তিনি এসেছেন কলকাতায়। অ্যালেন গিন্স্বার্গ এস্টেটের ওয়েবসাইট বলছে, ‘অনামা এক লোকের অনুদানের টিকিটে অ্যালেন ভারত, পশ্চিমবঙ্গ এবং পরে বন্যা ও দুর্ভিক্ষে প্রায় ৭০ লাখ লোকের উন্মূল দশা দেখতে যশোর রোডের শরণার্থী শিবিরে ঘুরতে যান।

’ সেই যাত্রায় গিন্স্বার্গের সফরসঙ্গী ছিলেন তিনজন। একজনের নাম কবিতাটির মধ্যেই আছে—‘সুনীল পোয়েট’, মানে পশ্চিমবঙ্গের কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বাকি দুজন কারা? সুনীল লিখেছেন, ‘একজন বিদেশি পর্যটক ও কলকাতার বাংলাদেশ মিশনের এক সুদর্শন বুদ্ধিমান যুবক—এঁদের দুজনেরই নাম মনে করতে পারছি না। ’ (‘একটি অসাধারণ কবিতা’, কবিতা কার জন্য?) গিন্স্বার্গের কবিতাসমগ্রে ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতার পাদটীকা থেকে জানা যাচ্ছে, সেই বিদেশি পর্যটক একজন মার্কিন বৌদ্ধ ছাত্র, কবি জন গিয়োর্নো। শরণার্থী শিবিরে গিয়োর্নো গিন্স্বার্গের ছবিও তুলেছিলেন।

তেমন একটি ছবি গিন্স্বার্গের ওয়েবসাইটে যত্ন করে রাখা আছে। বাংলাদেশ মিশনের কর্মকর্তাটির কোনো পরিচয় পাওয়া যায়নি। শরণার্থী শিবিরে যাওয়ার অভিজ্ঞতা মোটেই মধুর ছিল না। সুনীল লিখেছেন, ‘আমরা যখন যাই, তখনো সীমান্তে বিদেশিদের গমনাগমন নিষিদ্ধ হয়নি বটে, কিন্তু তখন ওখানে বন্যার দাপট চলছে। বনগাঁ শহরের মধ্যেই বড়ো রাস্তায় এক হাঁটু জল, বয়ড়ার রাস্তায় নৌকা চলছে—শরণার্থী শিবিরের মধ্যেও জলস্রোত।

তাতে অবশ্য ওই বেপরোয়া কবি নিরস্ত হননি। ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে আমরা জলের মধ্যেই হাঁটতে শুরু করি—প্রথমে পাৎলুন গুটিয়ে, তারপর মায়া ত্যাগ করে সর্বাঙ্গ ভিজিয়ে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘুরেছিলাম, কখনো কখনো নৌকায় কিছু পথ ঘুরেছি—ডাব ও সিগারেট ছাড়া আর কোনো খাদ্যপানীয় ছিল না। ’ বাংলাদেশি শরণার্থীদের যে দুর্ভোগ গিন্স্বার্গ দেখতে পান, তার বিশদ বিবরণ কবিতাটিতে উঠে আসে। ওই সময়টাতে গিন্স্বার্গ কবিতাও লিখছেন এক অদ্ভুত উপায়ে।

যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশনীতি সম্পর্কে সোচ্চার প্রথাবিরোধী এই কবি তখন চষে বেড়াচ্ছেন পৃথিবীর এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত। আর যা কিছু দেখছেন, টেপরেকর্ডারে ধরে রাখছেন সব। বিট সাহিত্য গবেষক টনি ট্রিজিলিও জানিয়েছেন, ‘কবির তাৎক্ষণিক ভাবনা বলা হয়ে যাচ্ছিল টেপরেকর্ডারে। একই সঙ্গে রেকর্ড হয়ে যাচ্ছিল চারপাশের আওয়াজ আর গাড়ির রেডিওতে চলতে থাকা খবর। ’ (এনসাইক্লোপিডিয়া অব বিট লিটারেচার, সম্পাদনা: কুর্ট হেমার) সুনীলও লিখেছেন একই কথা, ‘অ্যালেন গিন্স্বার্গের সঙ্গে একটা টেপরেকর্ডার ছিল, সর্বক্ষণ খোলা, যেকোনো ব্যাপারে তাঁর প্রতিক্রিয়া টেপরেকর্ডারকে শোনাচ্ছিলেন, কখনো আমরা সবাই মিলে যা আলোচনা করেছি, তা-ও টেপ-নিবদ্ধ হয়।

’ কবিতাটির বক্তব্য ছিল সরাসরি। টনি লিখেছেন, ‘গিন্স্বার্গ শরণার্থীদের খাদ্যাভাবের বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। একই সঙ্গে এই প্রশ্নও তুলেছেন, ভিয়েতনামে বিরামহীন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য মার্কিন তহবিলের টাকা ওই লাখ লাখ নিরাশ্রয় শিশুকে সাহায্যের জন্য কেন ব্যয় করা হবে না। ’ কবিতাটিতে জায়গা করে নিয়েছিল শরণার্থীদের আরও নানা দুর্দশার ছবি, অজানার পথে লক্ষ নিরাশ্রয় লোকের দেশত্যাগের মর্মন্তুদ বর্ণনা, বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামে মার্কিন যুদ্ধনীতির কঠোর সমালোচনা। প্রকাশের পরপরই কবিতাটি ব্যাপক সাড়া জাগায়।

কবি বেলাল চৌধুরী এই তথ্য দিয়েছেন যে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই ভারতে এই কবিতা একটি পোস্টার হয়ে বেরোয়। পোস্টারটির দামের জায়গায় ইংরেজিতে লেখা ছিল, ‘বাংলাদেশের শরণার্থীদের পুনর্বাসনে অংশ নিতে স্বেচ্ছায় যতটা সম্ভব সহযোগিতা করুন। ’ এর বিক্রি থেকে পাওয়া টাকা শরণার্থীদের তহবিলে জমা পড়ে। (গিন্স্বার্গের সঙ্গে, নির্মলেন্দু গুণ) গিন্স্বার্গ নিজেও কবিতাটির প্রেমে পড়েছিলেন। এই কবিতার প্রতি তাঁর দুর্বলতা কখনোই শেষ হয়ে যায়নি।

পরে তিনি এতে সুর দেন। কবিতা পাঠের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাদ্যযন্ত্র-সহযোগে প্রায়ই এটি পরিবেশনও করতেন। এই কবিতায় চিরকালের জন্য স্থির হয়ে আছে একাত্তরের হাহাকারভরা ছবি: ‘হাঁটছে পাঁকে লক্ষ পিতার কন্যারা/ অবোধ শিশু ভাসিয়ে নিল বন্যারা/ লক্ষ মেয়ে করছে বমন আর্তনাদ/ লক্ষ পরিবারের আশা চূর্ণসাধ। প্রথম আলো.......................... ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.