বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখ দ্বিতীয় বিদ্যায়। ( কবি দ্বিজ কানাই ৩০০ বছর পূর্বে একটি পালাগান রচনা করেন মহুয়া সুন্দরী নামে। পালাগানটিতে মোট ৭৫৫ ছত্র আছে, যেগুলোকে দীনেশচন্দ্র সেন ২৪টি অধ্যায়ে বিভক্ত করেছেন। এই পালাগানের গদ্যরুপে এই সিরিজ পোস্ট লিখছি। )
এক।
প্রথম প্রহরের ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে চল্লিশোর্ধ্ব হুমরা সর্দার দাড়িয়ে আছেন ধনু নদীর তীরে। চোখ-মুখের গভীর চিন্তা উত্তেজনায় পরিণত হয়ে ছড়িয়ে পরেছে পেশীবহুল শক্তসমর্থ দেহে, যতো দ্রুত সম্ভব নদী পার হয়ে চলে যেতে হবে কাঞ্চনপুর গ্রাম ছেড়ে। কুঞ্চিত ভ্রূ'র চেয়েও কালো চোখ, তারচেয়ে কালো শরীর, আর তারচেয়েও কালো অন্ধকারে ছোট ভাই মানিকের দিকে মশাল উঁচিয়ে ইশারা করতেই খুঁটি তুলে বজরা ছেড়ে দেয়া হলো। লাফিয়ে নৌকোয় উঠে দ্রুত কিছু নির্দেশ দিয়ে নিজের ছোট প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করলেন। পঁচিশ-তিরিশ বছর ধরে আছেন এ পেশায়, উত্তেজনা আর সম্পদের লোভে আক্ষরিক অর্থেই অসংখ্য মানুষ মেরেকেটে লাশের পাহাড় গড়েছেন, গারো পাহাড় ছাড়িয়ে যাবে সেই লাশের পাহাড়।
তবুও আজকের রাতের মতোন অনুশোচনা মেশানো উত্তেজনা আগে কখনো বোধ করেননি। কিছুক্ষণ আগেই কাঞ্চনপুর গ্রাম হানা দিয়েছেন দলবল নিয়ে। ধনাঢ্য ব্রাহ্মনের বাড়িতে লুটপাট চালিয়ে যখন সবাই মোটামুটি ক্লান্ত হয়ে বের হতে যাবে, তখন তার চোখ পরলো বৃদ্ধ ব্রাহ্মনের ছয়মাস বয়সী কন্যার উপর, যার স্বর্গীয় সৌন্দর্য্যের কাছে এতোক্ষণের লুট করা ধনসম্পদ নিমিষেই তুচ্ছ হয়ে গ্যালো। এই দেবশিশু লুট করার সামর্থ্য তার নেই, তাই ব্রাহ্মনের অলক্ষ্যে চুরি করে নিয়ে এলেন।
দুই।
ষোল বছর কেটে গেছে। ডাকাতি ছেড়ে হুমরা বেদে হয়ে স্থায়ী হয়েছেন গারো পাহাড়ের অনেকটুকু উত্তরে যেখানে হিমানী পর্বত, তারও উত্তরে যেখানে বাঘ-ভাল্লুক ভিন্ন প্রানীর দ্যাখা মেলা ভার, সেই অন্ধকার জঙ্গলে। আর সেই শিশুকন্যা? সে থাকে হুমরা বেদের সাথেই, হুমরা তাকে খেলা শেখায়, বেদে'র কৌশল শেখায়। ষোড়শী কন্যাকে যেই দেখে সেই পাগল হয়- সাপের মাথায় যেমন থাইক্যা জলে মণি, যে দেখে পাগল হয় বাইদ্যার নন্দিনী। কাঁচা সোনা হয়ে হুমরা বেদের অন্ধকার ঘর আলোকিত করে রাখে সে, হাট্টীয়া না যাইতে কইন্যার পায়ে পরে চুল, মুখেতে ফুট্টা উঠে কনক চাম্পার ফুল।
তার ডাগর ডাগর চোখের তাঁরার আলোয় পথ খুঁজে হুমরা তাকে নিয়ে দেশবিদেশ ঘুরে বেড়ায়। পাইয়া সুন্দরী কইন্যা হুমরা বাইদ্যার নারী, ভাব্যা চিন্ত্যা নাম রাখল “মহুয়া সুন্দরী”। হুমরা বেদের খেয়াল হলো বিদেশে যাবে খেলা দ্যাখাতে। পরের শুক্রবার তোতা, ময়না, টিয়া, সোনামুখী দোয়েল, ঘোড়া, শিকারী কুকুর, চন্ডালের হাড় আরও কতো কী নিয়ে বের হলো হুমরা বেদের দল। আগে আগে হুমরা আর মানিক, পিছনে গলা ধরাধরি করে খুঁনসুটিতে মগ্ন মহুয়া আর তার সই পালঙ্ক।
একদিন দুইদিন তিনদিন করে মাস গুয়াইলো, বামনকান্দা গ্রামে যাইয়া উপস্থিত হইলো।
তিন।
বামনকান্দা গ্রামের জমিদারের দেওয়ান নদের চাঁদ আজ নিয়ম ভেঙে নিয়মিত সভা বসিয়েছেন সন্ধ্যার খোলা আকাশের নিচে। সভায় তার মন নেই, তাকিয়ে আছেন পূর্ন চাঁদ আর তাঁরা ভরা আকাশের দিকে। আস্থাভাজন একজনের কাছে খবর পেয়েছেন গ্রামে এক বেদের দল ভিড়েছে।
বেদের দলের হরেক তামশায় তার উৎসাহ নেই, শুনেছেন দলের সাথে এক অসম্ভব রূপবতী নারী এসেছে যার তূলনা নাকি বামনকান্দা তো বামনকান্দা, গোটা জমিদারীতেই নেই। একদিকে সুন্দরী নারীর মোহ, অন্যদিকে মায়ের আপত্তিতে নদের ঠাকুর বেদের দলকে আমন্ত্রণ জানাবেন নাকি জানাবেন না সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। সভা ভঙ্গ করে অন্দরমহলে পৌছে মায়ের কাছ থেকে বার-বাড়িতে বেদের আসর বসানোর অনুমতি নিয়েই ছুটলেন আয়োজন করতে। রাতে বামনকান্দা গ্রাম ভেঙে পরলো ঠাকুরবাড়ির বার-বাড়িতে। সাপের খেলা হলো, নাচ হলো, গান হলো, নদের চাঁদের অপেক্ষা আর ফুরোয় না।
অবশেষে যখন নাকি বাইদ্যার ছেরি বাশে মাইলো লাড়া, বইস্যা আছিল নদ্যার ঠাকুর উঠ্যা ঐল খাড়া। দড়ি বাইয়া উঠ্যা যখন বাশে বাজী করে, নইদ্যার ঠাকুর উঠ্যা কয় পইর্্যা নাকি মরে। মহুয়ার রূপে-গুণে মুগ্ধ নদের চাঁদ তৎক্ষণাৎ প্রেমে তো পরলেনই, হাজার টেকার শাল দিলেন আরো টেকা কড়ি, বসত করতে হুমড়া বাইদ্যারে দিলেন একখান বাড়ী। উদ্দেশ্য মহুয়া বামনকান্দায় স্থায়ী হোক। হুমরা বেদে উপহার গ্রহণ করলেন, পাশের গ্রাম উলুয়াকান্দায় গিয়ে বাড়ি বানালেন।
চার।
নয়া বাড়ী লইয়া রে বাইদ্যা বানলো জুইতের ঘর,
লীলুয়া বয়ারে কইন্যার গায়ে উঠলো জ্বর।
নয়া বাড়ী লইয়া রে বাইদ্যা লাগাইল বাইঙ্গন,
সেই বাইঙ্গন তুলতে কইন্যা জুড়িল কান্দন।
কাইন্দ না কাইন্দ না কইন্যা না কান্দিয়ো আর,
সেই বাইঙ্গন বেচ্যা দিয়াম তোমার গলায় হার।
নয়া বাড়ী লইয়ারে বাইদ্যা লাগাইলো উরি,
তুমি কইন্যা না থাকলে আবার গলায় ছুরি।
নয়া বাড়ী লইয়ারে বাইদ্যা লাগইলো কচু,
সেই কচু বেচ্যা দিয়াম তোমার হাতের বাজু।
নয়া বাড়ী লইয়ারে বাইদ্যা লাগাইলো কলা,
সেই কলা বেচ্যা দিয়াম তোমার গলার মালা।
নয়া বাড়ী লইয়ারে বাইদ্যা বানলো চৌকারী,
চৌদিগে মালঞ্চের বেড়া আয়না সাড়ি সাড়ি।
হাস মারলাম কইতর মারলাম বাচ্যা মারলাম টিয়া,
ভালা কইর্যা রাইন্দো বেনুন কাল্যাজিরা দিয়া।
( মহীনের ঘোড়াগুলি মূল পালাগানের উপরের অংশটুকু গীতিকার সুরে গেয়েছে।
গদ্যাকারে লেখায় মহুয়া-নইদ্যা ঠাকুরের পালাগানের যথেষ্ট সম্ভ্রমহানি হয়েছে, তাই এই অংশটুকু হুবহু তুলে দিলাম। পালাগানটির চব্বিশটি অধ্যায় আছে, সিরিজ নোটের এই প্রথম নোটটিতে প্রথম চার অধ্যায় সামান্য আগুপিছু করে শেষ করলাম। )
দ্বিতীয় পর্ব ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।