আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নীলফামারীর ত্রাস আলবদর প্রধান আবদুল্লাহ

পঁচা মানুষ একাত্তরে নীলফামারী জেলার রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর প্রধান আবদুল্লাহ ছিলেন পাকিস্তানি সেনা ক্যাপ্টেন আল্লারাখা খানের অনুগত মোসাহেব। মুক্তিযুদ্ধে অসংখ্য স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষকে হত্যা-নির্যাতনের পাশাপাশি বহু নারীকে পাক সেনাদের ক্যাম্পে মনোরঞ্জনের জন্য ধরিয়ে দেওয়া, লুট, অগি্নসংযোগ করে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন তিনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার ৪০ বছরেও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো ভুলতে পারেনি রাজাকার আবদুল্লাহর হিংস্র নৃশংস ভূমিকার কথা। ২০১০ সালের মার্চে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হলেও বীরদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছেন রাজাকার আবদুল্লাহ। অভিযোগ রয়েছে, আবদুল্লাহ বিভিন্ন মহলে তদবির করে ট্রাইব্যুনালের বিচার ও তদন্ত প্রক্রিয়ায় তার নাম অন্তর্ভুক্তি বন্ধে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

তবে নীলফামারীর সর্বমহলের একটিই দাবি, 'একাত্তরের কুখ্যাত ঘাতক আবদুল্লাহসহ চিহ্নিত রাজাকার ও পাকিস্তানি বাহিনীর দোসরদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে বিচার করতে হবে। ' সূত্র জানায়, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাজাকার আবদুল্লাহ রংপুরে রাজা নাম ধারণ করে আশ্রয় গ্রহণ করেন। '৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর তিনি নীলফামারীতে ফিরে আসেন। হত্যা, সম্ভ্রম হরণ ও লুটপাটের অসংখ্য ঘটনার নায়ক আবদুল্লাহ এলাকায় আসার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় লোকজন তাকে ধরে ফেলে এবং শহরের বাবুপাড়া সড়কে থুথু ফেলে চেটে খাওয়ায় ও টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে একটি গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখে। তবে ওই সময় এলাকার একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি তাকে লোকজনের হাত থেকে উদ্ধার করে ছেড়ে দেন।

এভাবে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গিয়ে রাজাকার আবদুল্লাহ কিছুদিন চুপ মেরে থাকেলেও রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সুযোগে জিয়াউর রহমানের আমলে ধীরে ধীরে প্রভাব বিস্তার করে একাধারে সাংবাদিক ও রাতারাতি বিএনপি নেতা বনে যান। ২০০৭ সালে তাকে নীলফামারী প্রেস ক্লাব থেকে বহিষ্কার করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতির সহ-সভাপতি পরিচয়ে তিনি ট্রাইব্যুনালের তদন্ত থেকে তার নাম বাদ দিতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ক্ষতিগ্রস্ত ও প্রতক্ষদর্শীদের কাছ থেকে জানা যায়, রাজাকার আবদুল্লাহ নীলফামারীতে ত্রাসের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। নেপথ্যে তার মদদদাতা ছিলেন একাত্তরের শান্তি কমিটির সভাপতি ও বর্তমানে জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সদস্য অ্যাডভোকেট আবদুল লতিফ।

তারা দু'জন মিলেই পাকিস্তানি বাহিনীকে দিয়ে জেলার যে কোনো হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে সব রকম অপকর্মের সিদ্ধান্ত নিতেন। রাজাকার আবদুল্লাহ ও আবদুল লতিফের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একাত্তরের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হন নীলফামারী শহরের ব্যবসায়ী বোথা, তার বড় ছেলে স্বপন, মেজ ছেলে তপন, ছাত্রলীগ সভাপতি মাহফুজুর রহমান দুলু, হেমন্ত ডাক্তার, বিষ্ণু ডাক্তার, তরুণ ব্যবসায়ী সালাউদ্দিন শাহ, কুন্দুপুকুর গ্রামের জোতদার ঘিনাসহ অসংখ্য সাধারণ মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের ওপর রচিত একাধিক বই ও নথি থেকে জানা যায়, একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে নীলফামারী শহরের উপরোক্ত ব্যক্তিদের বাড়ি থেকে ডাকবাংলোর পাকিস্তানি ক্যাম্পে নিয়ে আটক রাখা হয়। পরে দারোয়ানি (বর্তমানে টেক্সটাইল মিল) এলাকায় নিয়ে তাদের একসঙ্গে লাইন করে দাঁড় করিয়ে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করা হয় এবং মাটি চাপা দেওয়া হয়। ব্যবসায়ী বোথার মেয়েকে আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে সালাউদ্দিনকে বাড়ি থেকে ধরে এনে গুলি করে হত্যা করা হয়।

উকিল পাড়ার আবুল হোসেন চৌধুরীর পুত্র ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি মাহফুজুর রহমান দুলুকে নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়। দুলু বাঁচার জন্য রাজাকার আবদুল্লাহ ও লতিফের কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে তাদের হাত-পা ধরেও মন গলাতে পারেননি। কুন্দুপুকুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ঘিনা সেনাক্যাম্পে এসে দেখা না করায় জিপ গাড়ির পেছনে হাতে দড়ি বেঁধে রাস্তায় ছেঁচড়িয়ে এনে গুলি করে হত্যা করা হয়। রাজাকার আবদুল্লাহ সবচেয়ে লোমহর্ষক ঘটনাটি ঘটান ১০ এপ্রিল ১৯৭১। ওইদিন জেলার জলঢাকা উপজেলার তিন শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশু ভারতে যাওয়ার জন্য কালীগঞ্জ নামক স্থানে জড়ো হচ্ছিল।

ঠিক ওই সময় বিপরীত দিক থেকে একটি জলপাই রঙের গাড়ি যেন যমদূত হয়ে সামনে দাঁড়ায় তাদের। গাড়ির সামনের সিটেই বসা ছিলেন রাজাকার আবদুল্লাহ। তার নির্দেশেই নারী ও পুরুষদের দুই ভাগে বিভক্ত করে ব্রাশফায়ার করে পাখির মতো হত্যা করা হয়। এরপর গাদাগাদি করে গর্তে লাশগুলো মাটি চাপা দেওয়া হয়। এর মধ্য দিয়ে জেলার ইতিহাসের চরম কালো অধ্যায়ের সৃষ্টি করেন রাজাকার আবদুল্লাহ।

বর্তমানে ওই স্থানটিই কালীগঞ্জ বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত এবং এটিই জেলার সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি। রাজাকার ইনফো প্রকাশিত (২০০৭ সাল) একটি ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, আবদুল্লাহ রাজাকার ও তার দোসরদের হাতে নিহত নীলফামারী শহরের মাধার মোড় এলাকার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সালাউদ্দিনের স্ত্রী মোসাম্মাৎ ছালেহা বেগম (৬০) সে দিনের সেই নারকীয় ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বারবার দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। তিনি জানান, একাত্তরের ২২ এপ্রিল রাত ৯টায় রাজাকার আবদুল্লাহ ও কায়ছারের নেতৃত্বে আরও ৬/৭ জন তার স্বামীকে বাড়ি থেকে নিয়ে যায় এবং উপজেলার (বর্তমানে উপজেলা প্রশাসন ভবন) পেছন দিকে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। তিনি ১৯৭৩ সালে শহীদ পরিবার হিসেবে ২ হাজার টাকা সরকারি অনুদান পাওয়ার কথাও জানান। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বার্ধাক্যজনিত কারণে ছালেহা বেগম এখন ঢাকায় অবস্থান করছেন।

আবদুল্লাহর বক্তব্য : একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে আবদুল্লাহ বৃহস্পতিবার সমকালকে বলেন, 'একাত্তরে আমি ছোট ছিলাম। প্রেস ক্লাবে রাজনীতির কারণে হিংসা থেকে এসব অভিযোগ করা হচ্ছে। এর বেশি কিছু আমি বলতে পারব না। ' তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৭০ সালে আবদুল্লাহ বিএ পাস করেন। ২০০৩ সালে মনি খন্দকারের সম্পাদনায় প্রকাশিত নীলফামারীর শত নাগরিক স্মারকগ্রন্থ সূত্রে জানা যায়, আবদুল্লাহ ১৯৪৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন।

তিনি ১৯৬৭-৬৮ সালে নীলফামারী মহকুমা এলএসএফ ছাত্র সংগঠনের সভাপতি ছিলেন। Click This Link  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।