আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হর্ণ অব আফ্রিকা; নিরন্ন মানুষের অসহায় আত্মসর্মপণ

ক্ষুধার্ত ও নিরন্ন সহায়হীন মানুষের জন্য বিবৃতির কয়েকটি লাইনই কি যথেষ্ট? লাখ লাখ মানুষ বিপন্ন ও অসহায় অবস্থায় হর্ণ অব আফ্রিকা হিসেবে খ্যাত সোমালিয়ায় জীবন-মৃত্যুর মুখোমুখী দাঁড়িয়ে আছে। আলজাজিরায় বৃদ্ধা সোমালি মায়ের যন্ত্রণাক্লিষ্ট অসহায় মুখ আমাদের মানবতাবোধকে আহত করছে। যুদ্ধের বিভীষিকা ও ক্ষুধা কাতরতা কুচকে যাওয়া চামড়ার অনেক গভীরে যেন তোলপাড় করছে। ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড টেলিগ্রাফে উদ্ধৃত মাওয়ালিম একজন সত্তোরোর্ধ্ব বৃদ্ধা। বিষণ্ন বদনে বসে আছেন।

চোখে রাজ্যের শূন্যতা। আশায় আছেন, এই দুর্দিনে হয়তো কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। জীবনের অন্তিমলগ্নে দাঁড়িয়ে থাকা এই বৃদ্ধা কি শেষবারের মতো একবার পেটপুরে খেতে পারবেন? উন্নত বিশ্বের দেশগুলো যেখানে শুধু বাজারমূল্য ঠিক রাখার জন্য হাজার হাজার টন খাদ্য অতলান্তিকে বিসর্জন দিচ্ছে! জাতিসংঘ সতর্ক করে দিয়েছে, ইথিওপিয়া, কেনিয়া ও সোমালিয়ায় যে দুর্যোগ দেখা দিয়েছে, তা গত ৬০ বছরে দেখা যায়নি। এ অবস্থার পেছনে অনেকগুলো ফ্যাক্ট কাজ করছে। বিশ্বে খাদ্যদ্রব্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়া, দীর্ঘকালীন খরা ও সোমালিয়ার অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে পরিস্থিতি আরো নাজুক হয়ে পড়েছে।

এসব সংঘর্ষ লাখ লাখ মানুষকে উদ্বাস্তুতে পরিণত করেছে। ১৯৯৫ সাল থেকে ২০১০ সালের মধ্যে পূর্ব আফ্রিকায় বৃষ্টিপাত কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। এর ফলে খরা পরিস্থিতি প্রচণ্ড আকার ধারণ করেছে। খরা সমগ্র পূর্ব আফ্রিকাকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। সাধারণভাবে এ অঞ্চলের মানুষ, ফল-ফসল ও পশুপাখিও বৃষ্টির পানির ওপর নির্ভর করে।

খরাকালীন সময়ে জলাশয়গুলো হচ্ছে পানির একমাত্র উৎস। কিন্তু বৃষ্টি না হওয়ায় জলাশয়গুলো শূন্য হয়ে পড়েছে। জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সেখানে খাদ্যের ভীষণ প্রয়োজন। আনুমানিক ১১ মিলিয়ন মানুষ ‘খারাপ মানবিক বিপর্যয়ে’ পর্যদুস্ত। পুরো হর্ণ অব আফ্রিকা জুড়ে চলছে খরা।

এর সাথে বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে আছে যুদ্ধবাজ গোত্রপতিদের হানাহানি। পার্শ্ববর্তী ইথিওপিয় খ্রিস্টান মিলিশিয়া আর মার্কিন মেরিন স্নাইপার। পনেরটি বছর যেসব যুদ্ধবাজ গৃহযুদ্ধ চালিয়ে ১০ লাখ লোককে হত্যার মাধ্যমে সোমালিয়াকে বিশ্বের সবচেয়ে বিশৃঙ্খল রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলো, ইসলামপন্থীরা তাদের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলো। যে দেশটি শাসন করা অসম্ভব বলে মনে হচ্ছিলো, ছয়মাস ধরে কার্যত সে অসম্ভব কাজটি তারা প্রায় সম্ভব করে এনেছিলো। কোনো ধরনের নির্যাতন না করে, পাশবিক শাস্তি না দিয়ে, ব্যক্তিস্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রেখে তা তারা অর্জন করেছিলো।

কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, সেখানে ইসলামপন্থীদের সরিয়ে তাদের ক্ষমতায় বসানো হয়েছে, যে সরকার তৈরি করা হয়েছিলো ইসলামপন্থীদের বিজয়ের অনেক আগে। এ সরকারে আছে সেসব পরাজিত যুদ্ধবাজ, যারা সোমালিয়দের বেঁচে থাকার পথে সবচেয়ে বড় বাধা। দীর্ঘকাল ধরে দুর্ভোগের শিকার সোমালিয়দের শান্তির জন্য ইসলামপন্থীরা নেতৃত্ব নিতেই পারে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সেখানে বড় ধরনের ঝুঁকি নিয়েছে এবং কেউ অবাক হবে না, যদি শিগগিরই সোমালিয়ায় যুদ্ধবাজরা আবার আগ্রাসী হয়ে উঠে কিংবা ইসলামপন্থীরা আবার গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে। ইথিওপিয়ার অগ্রহণযোগ্য সরকারের সোমালিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপকে ওয়াশিংটন এজন্য সমর্থন করেছে, তারা সেখানকার ইসলামপন্থীদের নতুন তালেবান বলে বিবেচনা করে এবং তাদের বিরুদ্ধে আলকায়েদাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দানের অভিযোগ এনেছে।

শান্তি প্রতিষ্ঠার বদলে সংঘাত ছড়িয়ে দেয়া সাম্রাজ্যবাদের পুরনো বাতিক। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র সফল হয়েছে চরমপন্থাকে বরং উসকে দিতে। সোমালিয়ার আল শাবাব যোদ্ধারা আলকায়েদার ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও পশ্চিমাবিশ্বের বিরুদ্ধে সংগ্রামের লক্ষ্যে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। গত প্রায় দুই দশকে তারা দেশের একটা বড় অংশের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছে।

সোমালিয়ার পুতুল সরকার ও আফ্রিকান ইউনিয়ন বাহিনী তাদের পরাস্ত করতে পারছে না। ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত আল শাবাব অর্থ হচ্ছে, ‘তারুণ্য’। প্রথমদিকে তারা শুধু সোমালিয়ায় মোতায়েন করা ইথিওপিয়ার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতো। কিন্তু তারপর এই গোষ্ঠী আরো র‌্যাডিকাল ভাবধারা আঁকড়ে ধরলো। কট্টরপন্থীরা নেতৃত্বের দায়িত্ব নিলো।

আলকায়েদার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাও তাদের গর্বের কারণ হয়ে দাঁড়ালো। আল শাবাবের অন্যতম নেতা শেখ আলি মুহাম্মদ হুসেন কয়েক মাস আগে বলেছিলেন, ‘নারীদেরও জিহাদে তাদের ভূমিকা পালন করতে হবে। যে নারীদের বয়স হয়েছে, যাদের কাছে কিছুই নেই, তাদের উদ্দেশ্যে আমি বলি- নিজেরা জিহাদে অংশ নিতে না পারলে নিজেদের সন্তানদের পাঠাও। সন্তানদের জন্য অস্ত্র-শস্ত্র, গোলা-বারুদ কিনে দাও। কারণ কুরআনেই লেখা আছে, কাউকে জিহাদের জন্য প্রস্তুত করা মানে নিজেই সেই জিহাদে অংশ নেয়া।

’ ‘দাদাব’ কেনিয়ার সবচেয়ে দুরাবস্থা পতিত তিনটি ক্যাম্পের একটি। ক্ষুর্ধাত মানুষ যেখানে হতাশাপূর্ণ মৃত্যুর অপেক্ষায় আছে। গৃহযুদ্ধ, জাতিগত সহিংসতা ও খরার পীড়ন মানুষের বেঁচে থাকার প্রতি প্রকৃতির অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ এইসব জনপদ দীর্ঘ নিপীড়নের শেষসীমায় উপনীত। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি সংস্থা [WFP] জানাচ্ছে, বিগত ৬০ বছরের মধ্যে এটি সবচেয়ে ভয়াবহ খরা।

এর ভৌগলিক বিস্তৃতি আফ্রিকার বিস্তৃণ অঞ্চল জুড়ে। ইথিওপিয়া, সোমালিয়া, জিবুতি, কেনিয়া পর্যন্ত এই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে পর্যদুস্ত। সুদান ও ইরিত্রিয়া এই বিপর্যয় কেন্দ্রের খুব বেশি দূরে নয়। ডব্লিউএফপি বলছে, দুর্দশাগ্রস্ত এসব মানুষের জন্য প্রয়োজন ৫০০ মিলিয়ন ডলার অর্থ সহায়তা। যদিও এর মধ্যে কেবল ৬০ শতাংশ ইতোমধ্যে সংগৃহীত হয়েছে।

আরো বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন। জরুরিভিত্তিতে খাদ্য সংস্থান ও আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন প্রয়োজন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা [WHO] জানিয়েছে, ইথিওপিয়ায় প্রায় ৫ মিলিয়ন মানুষ কলেরার ঝুঁকিতে আছে। ইতোমধ্যে হাজারখানেক মানুষ কলেরায় মারা গেছে। আরো বহু মানুষের অবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ।

কলেরা ও এর উপজাত অন্যান্য উপসর্গ যেমন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে সমানে মানুষ মারা পড়ছে। এই পরিসংখ্যান দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। ডব্লিউএইচও মুখপাত্র তারিক জানাচ্ছেন, ইথিওপিয়ার ৮.৮ মিলিয়ন মানুষ মহামারি সংক্রমণের মুখে নিপতিত। তিনি সংবাদ সংস্থাকে জানিয়েছেন, একই রকম পরিস্থিতি সোমালিয়া ও অন্যান্য অঞ্চলগুলোতেও বিরাজ করছে। বিশেষ করে উদ্বাস্তু শিবিরগুলো এ ধরনের সংক্রমণে বেশি আক্রান্ত এবং এখানে এসব নিয়ন্ত্রণ দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে।

বাস্তুত্যাগী এসব মানুষের জন্য নেই কোনো নিরাপদ আশ্রয় শিবির। দলে দলে মানুষ প্রতিদিন এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে খাদ্য ও আশ্রয়ের আশায় উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরছে আর মৃত্যুর কাছে অসহায় আত্মসমর্পন করছে। কেনিয়ার আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে লাখ লাখ মানুষের ভীড়। একই অবস্থা ইথিওপিয়াতেও। এখানে গড়ে প্রতিদিন ১৭০০ সোমালি নাগরিক আশ্রয়ের আশায় জড়ো হচ্ছে।

কিন্তু ইথিওপিয়ার প্রায় ৮৫ মিলিয়ন মানুষের অবস্থায় যেখানে শোচনীয়, সেখানে এসব নতুন উদ্বাস্তুদের জন্য নিরন্ন মৃত্যু ছাড়া আর কি আশা করা যায়? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, ইথিওপিয়ার ৪.৫ মিলিয়ন মানুষের জরুরি খাদ্য সহায়তা দরকার আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যেমন, ডব্লিউএফপি, ডব্লিউএইচও এবং ইউনিসেফ অনেক আগে থেকেই এ ধরনের ক্রাইসিস নিয়ে সতর্কতা জানিয়ে আসছিলো। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, বিশ্বের প্রধান প্রধান প্রচারমাধ্যমে এ সংবাদ এতোদিন পর্যন্ত উপেক্ষিতই ছিলো বলা চলে। যেটুক সংবাদ প্রচারিত হয়েছে, তা নিয়েও কারো তেমন আগ্রহ ছিলো না। বিশ্বের সম্পদশালী দেশগুলো এ ব্যাপারে সাহায্যের হাত প্রসারিত করতে গড়িমসি করেছে। ব্রিটিশ টেলিগ্রাফের রিপোর্টে উদ্ধৃত হয়েছে, ‘এ পর্যন্ত কোনো আফ্রিকান দেশ হর্ণ অব আফ্রিকার এই বিপর্যয়ে অর্থ সহায়তার ঘোষণা দেয়নি।

’ অক্সফাম রিজিওনাল ক্যাম্পেইনসের ইস্ট এণ্ড সেন্ট্রাল আফ্রিকার পলিসি ম্যানেজার মাইকেল ও’ব্রেইন ১৫ জুলাই প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে হাতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘আফ্রিকার সমস্যার জন্য আফ্রিকান সমাধান’-এর ক্ষেত্রে লিবিয়া ও হর্ণ অব আফ্রিকার দুর্ভিক্ষ নিয়ে আফ্রিকান ইউনিয়ন ব্যর্থ। ’ টেলিগ্রাফ জানিয়েছে, ব্রিটিশ সরকার ইথিওপিয়ার জনগণের জন্য ৩৮ মিলিয়ন পাউণ্ড খাদ্য সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে। এর একদিন পর ব্রিটিশ ডেইলি মিরর পত্রিকা লিবিয়া আক্রমণ নিয়ে একটি সামগ্রিক পর্যালোচনা প্রকাশ করে। প্রকাশিত রিপোর্টে জেমস লিয়ন লিখেছেন, লিবিয়া আক্রমণে ব্রিটিশ সরকার শুধু যুদ্ধ বিমানগুলো পরিচালনা করতে এ পর্যন্ত ২৬০ মিলিয়ন পাউন্ড ব্যয় করেছে। অথচ ডব্লিউএফপি বলছে, মাত্র ৪০ মিলিয়ন পাউন্ড অর্থ সহায়তা পেলে এখানকার ১১ মিলিয়ন অনাহারী মানুষের খাদ্যের সংস্থান সম্ভব হতো।

লিবিয়ায় পশ্চিমা জোট পরিচালিত যুদ্ধে ইতালির এয়ার বেস থেকে লিবিয়ার ওয়ারজোনে উড়ে যেতে একেকটি ব্রিটিশ টর্নেডো বিমানের ঘণ্টা প্রতি খরচ হয় ৩৫ হাজার পাউন্ড। এটি ডেইলি মিরর এর তথ্য। তাদের ভাষ্যে, ‘জনগণকে গণহত্যার হাত থেকে বাঁচাতেই তারা আফ্রিকার এই দেশটিতে অভিযান চালাচ্ছে। ’ ব্রিটেন, আফ্রিকা ও পশ্চিমা দেশগুলো এক ধরনের ছলনার খেলা খেলছে। সোমালিয়ার মতো দেশে, যেখানে গত কুড়ি বছর থেকে গৃহযুদ্ধ চলছে, সেখানে আমেরিকান ড্রোন বিমান যখন খাদ্য, ঔষধ ও অন্যান্য আশ্রয় সরঞ্জামের পরিবর্তে হাজার পাউন্ড ওজনের বোমা ছুড়ে ফেলে, তখন আমরা এসব দেশের অনাহারী মানুষের উদ্বাস্তু হওয়া ছাড়া আর কি আশা করতে পারি? সোমালিয়াতে ২০ বছরে কোনো কেন্দ্রীয় সরকার গড়ে উঠেনি।

ইসলামপন্থী সোমালিয়ান সংগঠন আল শাবাব যখন দেশটির অধিকাংশ এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে সরকার গঠন করছিলো, তখন মার্কিনীরা তাদেরকে সন্ত্রাসী আখ্যায়িত করে সেখানে নতুন করে গৃহযুদ্ধ উস্কে দেয়। যার ফলাফল লাখ লাখ লোকের বাস্তুত্যাগ। বাতুলা মাওয়ালিমদের জন্য প্রয়োজন প্লাস্টিকের আচ্ছাদন, খাদ্য ও ঔষধসামগ্রী। যদিও এর সামান্যটুকু কেবল পৌঁছানো গেছে।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।