ভুল করেও যদি মনে পড়ে...ভুলে যাওয়া কোন স্মৃতি.. ঘুমহারা রাতে..নীরবে তুমি কেঁদে নিও কিছুক্ষণ...একদিন মুছে যাবে সব আয়োজন... সাড়ে আটটায় ক্লাস। যথারীতি আধঘন্টা দেরী করে ছুটতে ছুটতে ওয়ার্ডে ঢুকলাম।
মেডিসিন ওয়ার্ড।
প্রতিদিনকার মতো একই দৃশ্য।
একটা রোগীর বেডের পাশে অর্ধ গোলক সৃষ্টি করে দুই লাইনে দাঁড়িয়ে আছে সবাই।
আরেক পাশে চেয়ারে স্যার বসে পড়াচ্ছেন। ওমা- আরিফ স্যার। কপালে খারাবি আছে। ডাক্তারদের টেবিলে সবার ব্যাগ জড়ো করে রাখা। পা টিপে টিপে আমার ব্যাগটা ওখানে রেখে লাইনের পিছনে চুপটি করে সেধিয়ে গেলাম জয় আর আসিফের মাঝে।
কিছুটা লুকিয়ে থাকা অবস্থানে। উদ্দেশ্য- স্যার যেন দেখতে না পান; পরে দেখতে পেলে বলতে পারবো- ‘অনেকক্ষণ আগে এসেছি স্যার। ’
লাভ হলো না। স্যার দেখতে পেলেন- ‘এই ছেলে, এদিকে আসো। ’
সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
চেহারায় নিরীহ গোবেচারা টাইপের একটা ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু খুব একটা কাজ হলো না। চেহারা আর গলা দুটোতেই কাঠিন্য ফুটিয়ে স্যার জিজ্ঞেস করলেন- ‘কয়টা বাজে?’
‘স্যার ?’ বিনয়ে বিগলিত আমি; তবে প্রশ্নটার উত্তর দিতে তেমন একটা আগ্রহী নয়।
‘দেরী কেন ?’
‘স্যার, অ্যালার্ম ঠিকই দিয়েছিলাম, স্যার। কিন্তু স্যার, শুনতে পাই নাই।
আমার এরকম মাঝে মাঝেই হয় স্যার। কেন যে শুনতে পাই না!’
‘অ্যাপ্রোন কই?’
‘স্যার, পরেই বের হয়েছিলাম। হোস্টেলের গেটে স্যার... কাক... স্যার..। পরে রুমে রেখে এসেছি। ’ ঘটনা সত্য না।
শীতকাল ছিল। নতুন সোয়েটার পড়েছি। তার উপর দিয়ে অ্যাপ্রোন পড়ার কোন ইচ্ছাই আমার ছিল না।
এর পরে স্যার ঠিক কি নিয়ে চার্জ করবেন তা বোধহয় ভেবে পেলেন না। -‘আচ্ছা।
রোগীর সামনে আসো। দেখে বলো, এর কি ধরণের মার্মার আছে। ’ দেখে বলো মানে স্টেথো দিয়ে শুনে বলো। ‘মার্মার’ (সঁৎসঁৎ) হচ্ছে- অ্যাবনরমাল বা অস্বাভাবিক হার্ট সাউন্ড। হৃৎপিন্ড রক্ত পাম্প করার সময় স্বাভাবিক যে শব্দ করে, তার ব্যতিক্রম কোন শব্দ।
থার্ড ইয়ারের শেষ দিক তখন। নরমাল হার্ট সাউন্ডেরই ভাগ ঠিকমতো বুঝি না, ফার্ষ্ট না সেকেন্ড বলতে পারি না। - তায় অ্যাবনরমাল, তার উপর কোন ধরণের। স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম- ‘পারবো না’ বলে পার পাওয়া যাবে না, চূড়ান্ত অপমান কাে ছাড়বেন। আল্লাহর নাম নিয়ে এগোলাম।
রোগীর বুকের বাম দিকে যেসব জায়গায় স্টেথো রেখে সাউন্ড শুনতে হয়, সেভাবে শোনার চেষ্টা করলাম। যথারীতি বুঝতে পারলাম না কিছুই। কয়েক মিনিট মনোযোগের (!) সাথে চেষ্টা করে কান থেকে স্টেথো খুলে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। পাশে লাভলী দাঁড়ানো। ও তো একটু আওয়াজ দিলেও পারে।
তা না- দাঁত কেলায়া দাঁড়ায়ে আছে।
‘হ্যাঁ বলো, কি মার্মার পেলে?’ স্যারের প্রশ্ন। চশমার উপর দিয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে।
কি করবো? কিছুই তো বুঝি নাই। যা থাকে কপালে।
আস্তে করে ডেলিভারি করার সময় স্যারের মুখভঙ্গির পরিবর্তন লক্ষ্য করার চেষ্টা করলাম- ‘ আর্লি ডায়াস্টলিক মার্মার স্যার। ’
ফিক করে হাসির আওয়াজ হলো। তবে কি আমি ভুল বলেছি? স্যারের মুখে কোন ভাবান্তর দেখছি না। দেবব্রতর বিকট হাসির লো-ভয়েস সংস্করণও শোনা গেল।
‘তুমি শিওর?’- স্যার জিজ্ঞেস করলেন।
নিশ্চয়ই ভুল বলেছি। ওরা যখন হাসছে। কিন্তু তখন আমার আর মাত্র এক ধরণের মার্মারের নাম মনে পড়ছে। আল্লাহ ভরসা- সেটাই ট্রাই করলাম-‘প্যান সিস্টোলিকও হতে পারে স্যার। ’
এবার সবারই কম বেশী দাঁত দেখা গেল।
সিরিয়াস ফার্স্ট বয় রাকিবও হাসছে নি:শব্দে! আরি, ভুল তো হতেই পারে- এতো হাসির কি আছে?
স্যার এবার রোগীর একটা এক্স-রে প্লেট নিয়ে ভিউ-বক্সে লাগিয়ে পিছনের আলোটা জ্বালিয়ে দিলেন। এবার সবার হাসিই সশব্দ হয়ে উঠলো।
স্যার-ও আর গম্ভীর হয়ে থাকতে পারলেন না। টের পেলাম, আমার দুই কান দিয়ে গরম হাওয়া বের হচ্ছে। না দেখেও বুঝতে পারছি, গালও লাল হয়ে উঠছে।
-এ রোগীর বুকের বাম পাশে মার্মার তো দূরের কথা, কেউ নরমাল সাউন্ডও খুঁজে পাবে না। কারণ, রোগীর বুকের এক্স-রে ফিল্ম স্পষ্টই জানিয়ে দিচ্ছে, এর হার্ট ডান দিকে। রোগীর ‘ডেক্সট্রোকার্ডিয়া’!
(পাঠক বিভ্রান্ত হবেন না। পৃথিবীর সব মানুষের হৃৎপিন্ড বাম দিকে থাকে না। অনেকে জন্ম নেয় ডান দিকে হৃৎপিন্ড নিয়ে।
এবং এ নিয়েই বেঁচে থাকতে পারে বহু বছর। চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলা হয় ‘ডেক্সট্রোকার্ডিয়া’। )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।