আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সঞ্চয়পত্রের ফসল উচ্চবিত্তের ঘরে

ভালবাসি ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আর্থিক নিরাপত্তা ও স্বচ্ছলতা নিশ্চিত করা সঞ্চয়পত্রের মূল উদ্দেশ্য হলেও এর বিনিয়োগ ও প্রাপ্তসুবিধাদি ভোগ করছে মাত্র ৭ শতাংশ উচ্চবিত্ত বিনিয়োগকারী। ৯৩ শতাংশ প্রান্তিক বিনিয়োগকারী তাদের সীমিত বিনিয়োগের কোনো সুফল পাচ্ছেন না। এতে সঞ্চয়পত্রের মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হচ্ছে। সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগে ক্ষুদ্র বা প্রান্তিক শ্রেণীকে উৎসাহিত করতে সরকার আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন খাতের তুলনায় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে সুদও বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু বর্তমানে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ক্ষুদ্র বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এ খাতে বিনিয়োগে অক্ষম হয়ে পড়েছে।

এখন সে জায়গা দখল করে নিয়েছেন উচ্চবিত্তরা। সঞ্চয়পত্রের তুলনায় বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সুদ হার বেশি হলেও নিরাপদ বিনিয়োগের কারণে উচ্চবিত্ত বিনিয়োগকারীরা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছেন। অন্যদিকে সেক্ষেত্রে একেবারেই পিছিয়ে পড়ছে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক বিনিয়োগকারীরা। জানা গেছে, ক্ষুদ্র বা প্রান্তিক জনগুগোষ্ঠীর আয় অনুপাতে বছরে সর্বোচ্চ সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগের পরিমাণ হতে পারে ৪৭ হাজার ৫২০ টাকা। সে হিসেবে যেসব ব্যক্তি ১৫ লাখ বা তার ওপরে সঞ্চয়পত্রে একক স্কিমে বিনিয়োগ করেছেন তারা উচ্চবিত্ত শ্রেণীর।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের ট্রেজারি ও ঋণ ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগ এবং সরকারি ঋণ ব্যবস্থাপনা শাখার তত্ত্বাবধানে নেশনওয়াইড এনএসডি বেনিফিশারি সার্ভে পরিচালিত এক জরিপে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এ জরিপের ফলাফল ২০ অক্টোবর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে জমা দেয়া হয়। জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগকারীদের ৮০ শতাংশ শহরের বাসিন্দা এবং ৫ লাখ টাকা বা তার অধিক পরিমাণ টাকার বিনিয়োগের প্রায় ৮২ শতাংশ। এরমধ্যে ১৫ লাখ বা তার অধিক পরিমাণ বিনিয়োগ হল মোট বিনিয়োগের ৪৬ শতাংশ। ২০০৫ সালের খানা আয় ও ব্যয় জরিপ (হাউস হোল্ড অ্যান্ড এক্সপেনডিচার সার্ভে ২০০৫) অনুযায়ী বাংলাদেশের ৯৩ শতাংশ হাউস হোল্ডের মাসিক আয় ২০ হাজার টাকার নিচে।

এ ৯৩ শতাংশের মধ্যে অতিদরিদ্র, দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হাউসহোল্ড রয়েছে বলে ধারণা করা যায়। বাংলাদেশে বর্তমানে সঞ্চয়ের হার জিডিপির প্রায় ১৯ দশমিক ৮ শতাংশ। এ হারকে হাউসহোল্ডের গড় সঞ্চয়ের হার হিসেবে ধরলে ৯৩ শতাংশ হাউসহোল্ডের ক্ষেত্রে বছরে সর্বোচ্চ সঞ্চয়ের পরিমাণ হতে পারে ৪৭ হাজার ৫২০ টাকা। এ বিবেচনায়, সেসব ব্যক্তি ১৫ লাখ বা তার ওপরে সঞ্চয়পত্রে একক স্কিমে বিনিয়োগ করতে পারেন, তাদের ক্ষুদ্র বা প্রান্তিক বিনিয়োগকারী হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না। সে কারণেই ধারণা করা হচ্ছে, সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগকারীদের একটা বড় অংশ ক্ষুদ্র বা প্রান্তিক বিনিয়োগকারী নন।

জরিপের তথ্য অনুযায়ী সঞ্চয়পত্রে বিভিন্ন অঙ্কের বিনিয়োগের শতকরা হার হচ্ছে যথাক্রমে- অনূর্ধ্ব ৫ লাখ টাকা। ১৭ দশমিক ৪১ শতাংশ, ৫ লাখ টাকা থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত। ৩৬ দশমিক ৬০ শতাংশ এবং ১৫ লাখ টাকার ওপরে ৪৫ দশমিক ৯৯ শতাংশ। এদিকে সঞ্চয় স্কিমের মধ্যে সর্বাধিক বিক্রীত ৩টি স্কিমের মধ্যে রয়েছে- অনূর্ধ্ব ৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্রের মধ্যে পারিবারিক সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের পরিমাণ ২১ দশমিক ২২ শতাংশ, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ ২০ দশমিক ৭১ শতাংশ এবং ৫ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ ৩১ দশমিক ৯০ শতাংশ। ৫ লাখ টাকা সঞ্চয়পত্রের মধ্যে পারিবারিক সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের পরিমাণ ৪৮ দশমিক ৬২ শতাংশ, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ ৪১ দশমিক ৭৬ শতাংশ এবং ৫ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ ৩৫ দশমিক ০৫ শতাংশ।

আর ৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্রের মধ্যে পারিবারিক সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের পরিমাণ ৩০ দশমিক ১৬ শতাংশ, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ ৩৭ দশমিক ৫৩ শতাংশ এবং ৫ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ ৩৩ দশমিক ০৫ শতাংশ। বিনিয়োগকারীদের অবস্থানের ভিত্তিতে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের পরিমাণ হচ্ছে- বিভাগীয় শহরে ৬৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ, জেলা ও উপজেলা শহরে ১২ দশমিক ৪২ শতাংশ এবং গ্রামাঞ্চলে ১৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। এ হিসেবে বিভাগীয় এবং জেলা-উপজেলা শহরপর্যায়ে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ হচ্ছে ৮০ দশমিক ২৮ শতাংশ। জাতীয় সঞ্চয়পত্রগুলোর সুদের হার সরকারি প্রশাসনিক আদেশের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। ট্রেজারি বিল বা বন্ডের মতো বাজার কর্তৃক নির্ধারিত হয় না।

অধিকাংশ সময়েই বাজারের অন্যান্য সুদের সঙ্গে এ হারের তারতম্য দেখা দেয়। জানা গেছে, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সঞ্চয়ে উৎসাহিত করা এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য। তাই সঞ্চয়পত্রের সুদের হার সরকারের অন্যান্য ঋণ উৎসের হারের চাইতে বেশি। কিন্তু এ খাতে সত্যিকার অর্থে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করছে কি না এবং সরকারের অধিকহারে দেয়া সুদের সুবিধা ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক বিনিয়োগকারীরা পাচ্ছে কী না,। সে সংক্রান্ত কোনো নির্ভরযোগ্য ও সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত সরকারের কাছে নেই।

এ পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় সঞ্চয়পত্রগুলোর বিনিয়গকারীরা প্রকৃতপক্ষে কোনো ধরনের বিনিয়োগকারী তা নির্ধারণ করার জন্য এ সার্ভেটি পরিচালিত হয়েছে। এর পাশাপাশি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীদের লোকেশনও নির্ধারণ করা হয়েছে জরিপের মাধ্যমে। অর্থনীতিবিদদের মতে, বর্তমানে সঞ্চয়পত্রের তুলনায় বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সুদের হার অনেক বেশি। সঞ্চয়পত্রে সুদের হার সর্বোচ্চ ১২ শতাংশ। সেখান থেকে আবারো ৫ শতাংশ কর কেটে রাখা হয়।

এর বিপরীতে বেসরকারি খাতে সর্বোচ্চ সুদের হার হচ্ছে সাড়ে ১৩ শতাংশ পর্যন্ত। তাই সাধারণভাবেই বিনিয়োগকারীরা বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দিকে ঝুঁকছেন। তাছাড়া অতিরিক্ত মূল্যস্ফীতির কারণে প্রান্তিক থেকে মধ্যবিত্তরা তাদের সঞ্চয় ভেঙে ফেলছেন এবং নতুন বিনিয়োগও করছেন না। তবে উচ্চবিত্তদের বিনিয়োগ রয়েছে যথেষ্ট। কারণ সরকারি বিনিয়োগে ঝুঁকি নেই।

এদিকে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত একটি অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বিভিন্ন মেয়াদি সঞ্চয়পত্রের সুদ হার বর্তমানে ১২ শতাংশ পর্যন্ত রয়েছে, যা ঠিক নয়। এতে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হ্রাস পাচ্ছে। তাই সরকার সুদের হার আরো কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেন, বড় বাজেট করার ফলে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের এখনো প্রচুর ঋণ দরকার। তাই এ ধরনের জরিপের কোনো মানেই হয় না।

এখনো ঋণ পেতে হলে উচ্চবিত্ত আর ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বিবেচনায় নেয়া ঠিক হবে না। বাজেট ঘাটতি কমাতে যেভাবেই হউক ঋণ নিতে হবে। অবশ্য এর ফলে বেসরকারি বিনিয়োগে অর্থ জোগান কমে যাবে। তার মতে, সরকার এখন যে হারে সুদ দিচ্ছে তাকে উচ্চ হার বলা চলে না। কারণ এখন বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সাড়ে ১৩ শতাংশ হারে সুদ দিচ্ছে।

তাই সরকার যদি ভাবে সুদের হার কমাতে হবে তাহলে কেউ আর সঞ্চয়পত্র কিনবে না। তবে দুই বছর আগে যদি এ জরিপ করা হতো তাহলে হয়তো যথার্থ হতো। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বর্তমানে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ কমে গেছে। এর কারণ বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তুলনায় এর সুদ কম। তারপরও উচ্চবিত্তরা এখানে বিনিয়োগ করে রেখেছেন।

আর মূল্যস্ফীতির কারণে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এখান থেকে তাদের বিনিয়োগ তুলে নিয়ে দৈনন্দিন খরচ মেটাচ্ছে। ফলে তাদের বিনিয়োগ দিনদিন কমে যাচ্ছে। তাছাড়া নতুন করে বিনিয়োগ করার মতো অবস্থাও তাদের নেই। সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বর্তমানে বৈদেশিক আয়, বিদেশি ঋণ এবং অনুদান কমে গেছে। তাই বাজেট ঘাটতি মেটাতে হলে সরকারকে অবশ্যই সঞ্চয়পত্রের ওপর জোর দিতে হবে।

কারণ ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে বেশি ঋণ নিলে তা অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।