ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাটিয়া চলিল
কিছুদিন গিয়া মর্দ রওনা হইলো
১.
ধোঁয়ার পেছনে যেমন আগুন থাকে, তেমন মধ্যবিত্তের প্রতিটি বিদেশভ্রমণের পেছনে থাকে নানান গল্প। অনেক সময় দেখা যায়, মূল ভ্রমণকাহিনীর চাইতে পেছনের গল্পগুলি বেশি উপাদেয়।
তখন মধুমাস।
ঠিক দুপুর বেলায় চোখের সামনে আমার বাবা স্ট্রোক করলেন। তাকে বারডেম হাসপাতালে নিয়ে ফেলা হলো।
বারডেমের ইমাজেন্সিতে বাবা শুয়ে আছেন। ডাক্তাররা তেমন পাত্তা দিচ্ছেন না। তারা ভীষণ ব্যস্ত। কে যেন একগাদা ফজলি আম নিয়ে এসেছে, ডাক্তাররা খুবই উৎসাহ নিয়ে সেই আম খাচ্ছেন। রোগী দেখার সময় কোথায়?
আমি সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে হালকা প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করলাম।
বুঝলাম, ডাক্তাররা সব সাংবাদিক পোছেন না। যাদের ‘ফেসভ্যালু’ আছে, কেবল তাদেরকেই তারা সময় বিশেষে গুরুত্ব দেন। অবশ্য ‘ফেসভ্যালু’ কি জিনিস আমি আজও বুঝে উঠতে পারলাম না। তবে আমার কিছু বন্ধু যাদের ফেসভ্যালু আছে বলে লোকমুখে শুনেছি। যেমন এভারেস্টজয়ী মুসা ইব্রাহীম, টিভি সাংবাদিক নওরোজ ইমতিয়াজ, প্রথম আলোর ফটো সাংবাদিক , যিনি সবসময় বিশাল বিশাল ক্যামেরা নিয়ে ঘোরেন , সেই জিয়া ইসলাম- ।
আমি দেরী না করে এদেরকে ফোন দিলাম। এরা আমার মতো অভাজনকে বন্ধু জ্ঞান করে হাসপাতালে ছুটে এলেন।
সন্ধ্যার দিকে ডাক্তাররা ঘোষণা করলেন, রোগী আশংকামুক্ত।
আমরা হাফ ছেড়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলাম চা খাবার জন্য। চায়ে চুমুক দিয়ে সিগারেট ধরিয়েছি ।
সেই সময় সিমু নাসের এলেন। বেচারা জার্মানিতে একটি স্কলারশিপ পেয়েছেন। কয়েকদিন পরেই মাস দেড়েকের জন্য জার্মানি চলে যাবে, এখন কাগজপত্র গুছাচ্ছেন, সেটি নিয়ে তিনি দারুন ব্যস্ত। এজন্য হাসপাতালে আসতে তার দেরী হয়েছে।
বাবা হাসপাতালের বিছানায় শূয়ে, তার চিকিৎসা চলছে ধারের টাকায়, অনিশ্চিত একটা সময়, তবু সেই ভর সন্ধেবেলায় আমার মনে হলো, সবাই মিলে জার্মানি বেড়াতে গেলে মন্দ হয়না।
এটাকে গরীবের ঘোড়ারোগ বললে কম বলা হয়, এটি ঘোড়াক্যান্সার। একটা সিগারেটে দীর্ঘ টান মেরে সবাইকে বললাম, শোন, তোদের সবাইকে তো একসাথে পাওয়া যায়না। আজ যখন সবাইকে পাওয়াই গেলো, আমার একটা প্রস্তাব আছে। চল, সবাই মিলে জার্মানি বেড়িয়ে আসি।
এইসব ক্ষেত্রে যা হয়, ব্যাপারটি নিয়ে খানিকণ হাসাহাসি হলো।
তারপর আমরা প্রসঙ্গান্তরে চলে গেলাম।
পরদিন দুপুরবেলায় বন্ধু জুয়েল আমাকে ফোন দিলো। তুমি যে কাল সন্ধ্যায় বললা সবাই মিলে জার্মানি যাবা, আমার জার্মানি যেতে কোনো সমস্যা নেই , কিন্তু যাবো কীভাবে? তোমার প্ল্যানটা কি ? জার্মানির ভিসা পাবে কিভাবে ? জার্মানি ঘুরে আসতে তো অনেক টাকা লাগবে, সেটাই বা কোথা থেকে আসবে। তোমার প্ল্যানটা বলো শুনি।
জুয়েল ব্যাংকার।
কাজেই আমি সাথে সাথে বললাম, আমার প্ল্যান হচ্ছে , তোমার ব্যাংক থেকে লোন নেয়া। সেই লোনের টাকা দিয়ে আমরা ঘুরে আসলাম। তারপর জার্মানি থেকে ফিরে আস্তে আস্তে লোন শোধ করলাম।
জুয়েল ফোন রেখে দিলো।
এর মধ্যে মনে মনে আমি প্ল্যান গোছাতে শুরু করেছি।
গত বছর জার্মানি গিয়েছিলাম, কাছেই নেদারল্যান্ড। সেখানেও গিয়েছি। ওখান থেকে প্যারিসও বেশি দূরে নয়। আচ্ছা একটা কাজ করলে কেমন হয়? কারও কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে একটা টিভি ক্যামেরা ভাড়া করে জার্মানি চলে গেলাম। এর আশেপাশের দেশগুলিতেও ঘুরলাম।
ভিডিও করলাম। তারপর সেই ভিডিও জোড়াতালি দিয়ে একটা ট্রাভেল শো বানিয়ে টিভিতে বেঁচে দিলাম। সেই বিক্রির টাকা দিয়ে ধার শোধ করলাম। যে টাকা বাঁচবে সেটাই নিট লাভ। আর টিভিতে সেই অনুষ্ঠান প্রচার হলে আমি নিশ্চয়ই তারকা হয়ে যাবো।
ফলে এক ঢিলে তিনটি পাখি শিকার করা যাবে- বিদেশভ্রমণ, নগদপ্রাপ্তি এবং তারকাখ্যাতি।
গরমকাল। আইপিএস নষ্ঠ হয়ে গিয়েছে বলে রাতে ফ্যান চলে না। আমি লোডশেডিংয়ের রাতে বিছানায় শুয়ে ঘামতে ঘামতে টাকা, ইউরো ট্রিপ আর তারকা হবার স্বপ্ন দেখি, আর উত্তেজনায় বিছানায় উঠে বসি।
আমার এই পাগলামিকে যথারীতি জুয়েল সমর্থন দিলো।
তার কাছেও মনে হল, এটি শতাব্দীর সেরা ব্যবসায়িক আইডিয়া। আমি, জুয়েল এবং সিমু নাসের মিলে প্রোডিউসার খোঁজা শুরু করলাম।
সাইফুল ভাইয়ের সঙ্গে সেই সময় আমার পরিচয়। তিনি বিনোয়োগ করতে রাজি হলেন। এরই মধ্যে সিমু নাসের তার স্কলারশিপ নিয়ে জার্মানিতে পাড়ি জমিয়েছেন এবং আমাদের সঙ্গে সকল প্রকার যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছেন।
অতএব এক সকালে আমি, জুয়েল এবং সাইফুল ভাই- তিনজনে জার্মান এম্বেসিতে হাজির হলুম। আমি এই ট্রাভেল শোর পরিচালক, জুয়েল ক্যামেরাম্যান এবং সাইফুল ভাই প্রযোজক।
এম্বেসি আমাকে শুধালো, তুমি ট্রাভেল শো করার জন্য জার্মানি যেতে চাও।
আমি লাজুক হেসে বললাম, হ্যাঁ।
- এর আগে কখনো কোনো ট্রাভেল শো বানিয়েছো ?
- না।
- তোমার সাথে বাকী দুইজন কে?
আমি জুয়েলকে দেখিয়ে বললাম, উনি ক্যামেরাম্যান, উনিই ট্রাভেল শোতে ক্যামেরার কাজ করবেন।
জুয়েলকে ডেকে জিজ্ঞাসা করা হলো, তুমি কি করো?
জুয়েলের সপাটে বলল, আমি ব্যাংকার।
- চমৎকার। তাহলে এই টিমে তোমার কাজ কি?
- ক্যামেরা চালানো।
- তুমি কি ব্যাখা করবে, তুমি পেশায় একজন ব্যাংকার অথচ তুমি জার্মানি যেতে চাচ্ছো একজন ক্যামেরাম্যান হিসেবে, একটা প্রফেশনাল কাজে।
তুমি ক্যামেরা চালাতে পারো?
জুয়েলের এবার ঘাবড়ে গিয়ে উত্তর দিল, পারি।
- আগে কখনো ক্যামেরা অপারেট করেছে?
- হ্যাঁ করেছি।
- কোথায়?
- আমার ভাগ্নির গায়ে হলুদে।
যাই হোক, আমাদের এম্বেসির ইন্টারভিউ পর্ব একসময় শেষ হলো। সকলেই অত্যন্ত হতাশ।
সবচেয়ে হতাশ সাইফুল ভাই। তিনি এই প্রোগ্রামের প্রোডিউসার। ইউরোপের ভিসার জন্য অনেক কিছু দাখিল করতে হয়, রিটার্ন টিকেট, হেলথ ইন্সুরেন্স, ভিসা প্রসেসিং ফি - ইত্যাদি। বড় অংকের একটি টাকা তার পকেট থেকে বেরিয়ে গেছে। ফলস্বরূপ পরিষ্কার বোঝা গেছে - ভিসা আমাদের কপালে নেই।
যেদিন ভিসার ইন্টারভিউ এবং পাসপোর্ট জমা দিতে গিয়েছিলাম - সেদিন সাইফুল ভাই আর জুয়েল স্যুট টাই পড়ে গিয়েছিলেন, যাতে বোঝা যায় আমাদের টাকা পয়সা আছে। শুধু তাই নয়, সাইফুল ভাই নিয়ে গিয়েছিলেন তার সদ্য কেনা গাড়ি। জুয়েলও তার কোনো এক ভাগ্নিকে পটিয়ে আরেকটি দামী গাড়ি হাকিয়ে এম্বেসিতে গিয়েছিলো।
কয়েকদিন পর পাসপোর্ট ফেরত আনতে গেলাম। গুলশান এক নম্বরে তিনজন মিট করলাম।
দেখলাম দুইজনেই টি শার্ট আর স্যান্ডেল পড়ে এসেছেন এবং দুজনের কেউই গাড়ি আনেননি। সাইফুল জানালেন, তেল খরচ কইরা কি লাভ । আমি তো দেখছি পুরাই লস প্রজেক্ট।
অতঃপর আমরা তিনজন একটা রিকশায় উঠে বসলাম। যেহেতু আমার জন্যই সবাই ধরা খেয়েছে, সেই শাস্তি স্বরূপ আমাকে রিকশার উপরে বসানো হলো।
গুলশান এক থেকে জার্মান দূতাবাসের দিকে যাচ্ছি। একটু আগে বৃষ্টি হয়েছে বলে পরিষ্কার স্বচ্ছ আকাশ।
আমরা এম্বেসিতে ঢুকলুম। ঢুকেই শুনি ভিসা কাউন্টারের মাইক্রোফোনে আমার নাম ডাকা হচ্ছে। কিম আশ্চর্যম! মহান জার্মান দূতাবাস আমাদের তিনজনকেই এক মাসের মাল্টিপল ভিসা দিয়েছে।
এটি সেনজেন ভিসা। এই ভিসায় গোটা ইউরোপ ঘোরা যাবে।
ভিসা পাওয়া মাত্র জুয়েল একের পর এক ফোন দিতে শুরু করলো। সর্বশেষ হিসাবে দেখা গেছে, ঢাকা শহরে জুয়েলের ভাগ্নির সংখ্যা পৌনে তিন হাজার। সবাইকে ফোন দিতে হবে।
সাইফুল ভাইও কাকে যেন ফোন দিয়ে বলছেন, কয়েকদিন কেমন যেন বোর লাগছে। ভাবছি, এবার ঈদে একটু ইউরোপ ঢুঁ মেরে আসবো। দেখি একটু চেঞ্জে গিয়ে, জীবনের চেঞ্জের দরকার আছে, তাই না?
সবার দেখাদেখি আমিও ফোন দিলাম। ট্রাভেল এজেন্সিতে। আমাদের জার্মানির তিনটি টিকেট দরকার।
( চলছে, চলবে )
গত পর্ব ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।