আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রাজনীতিবিদ: আবদুল হামিদ খান ভাসানী

আমার আমি নাই আবদুল হামিদ খান ভাসানী (ডিসেম্বর ১২, ১৮৮০-নভেম্বর ১৭, ১৯৭৬) বাংলাদেশী রাজনীতিবিদ। যুক্তফ্রন্ট গঠনে প্রধান নেতাদের মধ্যে অন্যতম। দেশের মানুষের কাছে 'মজলুম জননেতা' হিসাবে পরিচিত। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন। তিনি রাজনৈতিক জীবনের বেশীরভাগ সময় বামপন্থী মাওধারার রাজনীতির সাথে জড়িয়ে ছিলেন।

তার অনুসারীদের অনেকে এজন্য তাকে "লাল মাওলানা " নামেও ডাকতেন। তিনি ছিলেন একজন দূরদর্শী নেতা এবং ষাটের দশকের শুরুতেই নিশ্চিত হয়েছিলেন যে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ একটি অচল রাষ্ট্রকাঠামো। ১৮৮০-১৯২৯ মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সিরাজগঞ্জের ধানগড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম হাজী শরাফত আলী খান। মক্তব হতে শিক্ষাগ্রহণ করে কিছুদিন মক্তবেই শিক্ষকতা করেন।

১৮৯৭ সালে পীর সৈয়দ নাসীরুদ্দীনের সাথে আসাম যান। ১৯০৩ সালে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। ইসালামিক শিক্ষার উদ্দেশ্যে ১৯০৭-এ দেওবন্দ যান। দুই বছর সেখানে অধ্যয়ন করে আসামে ফিরে আসেন। ১৯১৭ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ময়মনসিংহ সফরে গেলে তার ভাষণ শুনে ভাসানী অনুপ্রাণিত হন।

১৯১৯ সালে কংগ্রেসে যোগদান করে খেলাফত আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে দশ মাস কারাদণ্ড ভোগ করেন। ১৯২৩ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন স্বরাজ্য পার্টি গঠন করলে ভাসানী সেই দল সংগঠিত করার ব্যাপারে ভূমিকা পালন করেন। ১৯২৬-এ আসামে প্রথম কৃষক-প্রজা আন্দোলনের সুত্রপাত ঘটান। ১৯২৯-এ আসামের ধুবড়ী জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের ভাসান চরে প্রথম কৃষক সম্মেলন আয়োজন করেন। এখান থেকে তার নাম রাখা হয় " ভাসানীর মাওলানা "।

এরপর থেকে তার নামের শেষে ভাসানী শব্দ যুক্ত হয়। ১৯৩০-১৯৫৯ ১৯৩১-এ সন্তোষের কাগমারীতে, ১৯৩২-এ সিরাজগঞ্জের কাওরাখোলায় ও ১৯৩৩-এ গাইবান্ধায় বিশাল কৃষক সম্মেলন করেন। ১৯৩৭-এ মাওলানা ভাসানী কংগ্রেস ত্যাগ করে মুসলীম লীগে যোগদান করেন। সেই সময়ে আসামে 'লাইন প্রথা' চালু হলে এই নিপীড়নমূলক প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দান করেন। এসময় তিনি " আসাম চাষী মজুর সমিতি" গঠন করেন এবং ধুবরী, গোয়ালপাড়া সহ বিভিন্ন জায়গায় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।

১৯৪০ সালে শের-এ-বাংলা এ.কে. ফজলুল হকের সঙ্গে মুসলীম লীগের লাহোর সম্মেলনে যোগদান করেন। ১৯৪৪ সালে মাওলানা ভাসানী আসাম প্রাদেশিক মুসলীম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৪৫-৪৬ সালে আসাম জুড়ে বাঙালিদের বিরুদ্ধে "বাঙ্গাল খেদাও" আন্দোলন শুরু হলে ব্যাপক দাঙ্গা দেখা দেয়। এসময় বাঙালিদের রক্ষার জন্য ভাসানী বারপেটা, গৌহাটি সহ আসামের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বেড়ান। পাকিস্তান আন্দোলনে অংশ নিয়ে ১৯৪৭ সালে আসামে গ্রফতার হন।

১৯৪৮-এ মুক্তি পান। এরপর তিনি টাঙ্গাইলের সন্তোষে ফিরে আসেন। ১৯৪৮ সালের প্রথম দিকে তিনি বঙ্গীয় মুসলিম লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ ব্যবস্থাপক সভার কার্যাবলি বাংলায় পরিচালনা করার জন্য স্পিকারের কাছে দাবি জানান এবং এই দাবি নিয়ে পীড়াপীড়ি করেন। ১৯ মার্চ বাজেট বক্তৃতায় অংশ নিয়ে বলেন, যেসব কর কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ববঙ্গ প্রদেশ থেকে সংগ্রহ করে তার শতকরা ৭৫% প্রদেশকে দিতে হবে।

এখানে উলেস্নখ যে, ব্রিটিশ আমলে বঙ্গপ্রদেশ জুটেক্স ও সেলসট্যাক্স রাজস্ব হিসেবে আদায় করত এবং এই করের ভাগ কেন্দ্রীয় সরকারকে দিতে হতো না। পাকিস্তান সৃষ্টির পর কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ববঙ্গ সরকারের হাত থেকে এই কর ছিনিয়ে নিয়ে নিজেরাই আদায় করতে থাকে যার ফলে পূর্ববঙ্গ সরকার আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো এই সময় পূর্ববঙ্গ সরকারের বার্ষিক বাজেট ছিল মাত্র ৩৬ কোটি টাকা। যাই হোক, মুসলিম লীগ দলের সদস্য হয়েও সরকারের সমালোচনা করায় মুসলিম লীগের ৰমতাসীন সদস্যরা মওলানা ভাসানীর ওপর অখুশী হয় এবং তার নির্বাচনে ত্রুটি ছিল এই অজুহাত দেখিয়ে আদালতে মামলা দায়ের করে এবং মওলানা ভাসানীকে নানাভাবে হয়রানি করতে থাকে। পরিশেষে মওলানা ভাসানী ব্যবস্থাপক সভার সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন।

এতদসত্ত্বেও পূর্ববঙ্গের তৎকালীন গভর্নর এক নির্বাহী আদেশ বলে মওলানা ভাসানীর নির্বাচন বাতিল করেন। বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের জনবিরোধী কার্যকলাপের ফলে মওলানা ভাসানী ১৯৪৯ সালের ২৩-২৪ জুন ঢাকার টিকাটুলিতে রোজ গার্ডেনে মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন আহ্বান করেন। ২৩ জুন ওই কর্মিসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সারাদেশ থেকে প্রায় ৩০০ কর্মিসম্মেলনে যোগদান করেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন আতাউর রহমান খান।

মওলানা ভাসানী ছিলেন প্রধান অতিথি। ২৩ জুন পূর্ববঙ্গের প্রথম বিরোধী রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ গঠিত হয়। মওলানা ভাসানী সর্বসম্মতিক্রমে এই দলের সভাপতি নির্বাচিত হলেন। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন শামসুল হক। ২৪ জুন আরমানীটোলা ময়দানে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।

১৯৪৯ সালের মধ্যভাগে পূর্ববঙ্গে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। ১১ অক্টোবর আরমানীটোলা ময়দানে আওয়ামী মুসলিম লীগের একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় খাদ্য সমস্যা সমাধানে ব্যর্থতার জন্য পূর্ববঙ্গ মন্ত্রিসভার পদত্যাগ দাবি করা হয় এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মওলানা ভাসানী ভুখা মিছিলে নেতৃত্ব দেন। ভূখা মিছিলে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য ১৯৪৯-এর ১৪ অক্টোবর গ্রেফতার হয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কারাবরণ করেন। ১৯৫০ সালে সরকার কর্তৃক রাজশাহী কারাগারের খাপরা ওয়ার্ড এর বন্দীদের উপর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অনশন ধর্মঘট পালন করেন এবং ১৯৫০ সালের ১০ ডিসেম্বর তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান।

বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৫২-র ৩০ জানুয়ারি ঢাকা জেলার বার লাইব্রেরী হলে তার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠিত হয়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সহযোগিতার কারণে গ্রেফতার হয়ে ১৬ মাস কারানির্যাতনের শিকার হন। অবশ্য জনমতের চাপে ১৯৫৩ সালের ২১ এপ্রিল মওলানা ভাসানীকে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়। পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ১৯৫৩ সালের ৩ ডিসেম্বর কৃষক-শ্রমিক পার্টির সভাপতি শের-এ-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দীকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট নামক নির্বাচনী মোর্চা গঠন করেন। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিপুল বিজয় অর্জন করে এবং পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদে ২৩৭ টির মধ্য ২২৮ টি আসন অর্জনের মাধ্যমে নিরঙকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে।

ফজলুল হকের নেতৃত্বে সরকার গঠন করার পর ২৫শে মে ১৯৫৪ মাওলানা ভাসানী বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশ্যে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোল্ম যান এবং সেখানে বক্তব্য প্রদান করেন। ৩০ মে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে গভর্ণরের শাসন জারি করে এবং মাওলানা ভাসানীর দেশে প্রত্যাবর্তনের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করেন। ১১ মাস লন্ডন, বার্লিন, দিল্লী ও কলকাতায় অবস্থান করার পর তার উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হলে ১৯৫৫-র ২৫ এপ্রিল দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। পূর্ব বাংলায় খাদ্যজনিত দুর্ভিক্ষ রোধের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ৫০ কোটি টাকা আদায়ের দাবিতে ১৯৫৬-র ৭ মে ঢাকায় অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। সরকার দাবি মেনে নিলে ২৪ মে অনশন ভঙ্গ করেন।

একই বছর ১২ সেপ্টেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ-রিপাবলিকান পার্টির কোয়ালিশন সরকার গঠিত হলে মাওলানা ভাসানী সরকারের পররাষ্ট্রনীতির বিরোধিতা করে নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করার জন্য সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করেন। ১৯৫৬তে পাকিস্তান গণপরিষদে যে খসড়া শাসনতন্ত্র বিল পেশ করা হয় তাতে পাকিস্তানকে ইসলামিক রিপাবলিক বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল,তখন মাওলানা ভাসানী পল্টনের জনসভায় তার বিরোধিতা করে সুস্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছিলেন৷ কাগমারী সম্মেলনে১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়। ৮ ফেব্রুয়ারি ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানটি আরম্ভ হয়। এই সভায় মওলানা ভাসানীও বক্তৃতা করেন। বক্তৃতায় অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে তিনি বলেন, পূর্ববাংলা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকদের দ্বারা শোষিত হতে থাকলে পূর্ববঙ্গবাসী তাদের সালামু ওআলায়কুম জানাতে বাধ্য হবে।

এছাড়া কাগমারী সম্মেলনে ভাসানী পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিলের দাবি জানান। প্রধানমন্ত্রী সোহ্‌রাওয়ার্দী সেই দাবি প্রত্যাখান করলে ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। একই বছর ২৫ জুলাই তার নেতৃত্বে ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে 'ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি' (ন্যাপ) গঠিত হয়। ন্যাপ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভাসানী প্রকাশ্যে বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন এবং এর পর থেকে সবসময় বাম ধারার রাজনীতিএর সাথেই সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ১৯৫৭-র ৭ অক্টোবর দেশে সামরিক শাসন জারি হলে আইয়ুব খান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে সকল রাজনৈতিক দলের কর্মকান্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

১২ অক্টোবর মাওলানা ভাসানীকে কুমুদিনী হাসপাতাল থেকে গ্রেফতার করা হয়। ঢাকায় ৪ বছর ১০ মাস কারারুদ্ধ থাকেন। ১৯৬০-১৯৬৯ বন্দী অবস্থায় ১৯৬২-র ২৬ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত বন্যাদুর্গতদের সাহায্য ও পাটের ন্যায্যমূল্যসহ বিভিন্ন দাবিতে অনশন ধর্মঘট পালন করেন। ৩ নভেম্বর মুক্তিলাভ করেন এবং ন্যাশনাল ডেমোক্রাটিক ফ্রন্ট-এর রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত হন। ১৯৬৩-র মার্চ মাসে আইয়ুব খানের সাথে সাক্ষাত করেন।

একই বছর ২৪ সেপ্টেম্বর চীনের বিপ্লব দিবস-এর উৎসবে যোগদানের জন্য ঢাকা ত্যাগ করেন এবং চীনে সাত সপ্তাহ অবস্থান করেন। ১৯৬৪-র ২৯ ফেব্রুয়ারি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি পুনরুজ্জীবিত করে দলের সভাপতির দ্বায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং একই বছর ২১ জুলাই 'সম্মিলিত বিরোধী দল' (কপ) গঠনে ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৫-র ১৭ জুলাই আইয়ুব খানের পররাষ্ট্র নীতির প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন। ১৯৬৬-তে শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থাপিত ছয় দফা কর্মসূচীর বিরোধিতা করেন। ১৯৬৭-র ২২ জুন কেন্দ্রীয় সরকার রেডিও ও টেলিভিশন থেকে থেকে রবীন্দ্র সঙ্গীত প্রচার বন্ধ করার নির্দেশ জারি করলে এর প্রতিবাদ করেন।

১৯৬৭-র নভেম্বর-এ ন্যাপ দ্বি-খন্ডিত হলে চীনপন্থি ন্যাপের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে মাওলানা ভাসানী বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামীদের মুক্তি দাবি করেন। ৮ মার্চ (১৯৬৯) পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে সেখানে পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে সাক্ষাত করে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র কায়েমের লক্ষ্যে একমত হন। ২৬ শে ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান কর্তৃক আহুত গোলটেবিল বৈঠক প্রত্যাখান করে শ্রমজীবীদের ঘেরাও কর্মসূচী পালনে উৎসাহ প্রদান করেন।

আইয়ুব খান সরকারের পতনের পর নির্বাচনের পূর্বে ভোটের আগে ভাত চাই, ইসলামিক সমাজতন্ত্র কায়েম ইত্যাদি দাবি উত্থাপন করেন। ১৯৭০-১৯৭৬ ১৯৭০ সালের ৬-৮ আগস্ট বন্যা সমস্যা সমাধানের দাবিতে অনশন পালন করেন। অতঃপর সাধারণ নির্বচনে অংশ গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১২ নভেম্বর (১৯৭০) পূর্ব পাকিস্তানে প্রলয়ঙ্কারী ঘুর্ণিঝড় হলে দুর্গত এলাকায় ত্রান ব্যবস্থায় অংশ নেয়ার জন্য ন্যাপ প্রার্থীরা নির্বাচন থেকে সরে দাড়ান। ১৯৭০ সালের ৪ ডিসেম্বর ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভায় 'স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান' দাবি উত্থাপন করেন।

১৯৭১ এর মার্চ মাসে শেখ মুজিবুর রহমানের অসহযোগ আন্দোলন এর প্রতি সমর্থন প্রদান করেন এবং ১৮ জানুয়ারী ১৯৭১ পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদানের জন্য তার প্রতি আহবান জানিয়েছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারত যান এবং মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হন। ২৫ মার্চ রাতে মওলানা ভাসানী সন্তোষে তার গৃহে অবস্থান করছিলেন। তিনি পাকিস্তান বাহিনীর দৃষ্টি এড়িযে টাঙ্গাইল ছেড়ে তার পিতৃভূমি সিরাজগঞ্জে চলে যান। পাকিস্তান বাহিনী তার সনত্দোষের বাড়িটি পুড়িয়ে দেয়।

মওলানা ভাসানী মোজাফ্ফর ন্যাপ নেতা সাইফুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে নৌকাযোগে ভারত সীমানা অভিমুখে রওনা হন। অবশেষে ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরীর সাহায্যে মওলানা ভাসানী ও সাইফুল ইসলাম ১৫/১৬ এপ্রিল পূর্ববঙ্গ অতিক্রম করে আসামের ফুলবাড়ী নামক স্থানে উপস্থিত হন। পরে তাদের হলদীগঞ্জ বিএসএফ ক্যাম্পে আশ্রয় দেয়া হয়। এরপর মওলানা ভাসানী ও সাইফুল ইসলামকে প্লেনে করে কলকাতায় পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং পার্ক স্ট্রিটের কোহিনুর প্যালেসের ৫তলার একটি ফ্ল্যাট তাদের অবস্থানের জন্য দেয়া হয়। ১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার পৰে মওলানা ভাসানী একটি বিবৃতি প্রদান করেন যা ভারতীয় বাংলা ও ইংরেজি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

এছাড়া মওলানা ভাসানী চীনের নেতা মাও সে তুং, চৌ এন লাই এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কাছে তার বার্তা পাঠিয়ে তাদের অবহিত করেন যেন পূর্ববঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ব্যাপকহারে গণহত্যা চালাচ্ছে। সেজন্য তিনি প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে অনুরোধ করেন এই মর্মে যে, তিনি যেন পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ না করেন। উপরন্তু মওলানা ভাসানী প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার আহ্বান জানান। ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল মওলানা ভাসানী সোভিয়েত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট কাছে পাকিস্তান বাংলাদেশের জনগণের ওপর যে বর্বরোচিত অত্যাচার চালাচ্ছে তার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেন। ৩১ মে মওলানা ভাসানী এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ দখলদার বাহিনীর সঙ্গে জীবনমরণ সংগ্রামে লিপ্ত।

তারা মাতৃভূমি রৰার জন্য বদ্ধপরিকর। তারা এই সংগ্রামে জয়লাভ করবেই। ৭ জুন মওলানা ভাসানী এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের সব অঞ্চল আজ দশ লাখ বাঙালির রক্তে স্নাত এবং এই রক্তস্নানের মধ্য দিয়েই বাংলার স্বাধীনতা আসবে। এর মধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দু'বার কোহিনুর প্যালেসে এসে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন এবং তার পরামর্শ ও সহযোগিতা প্রার্থনা করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সর্বদলীয় চরিত্র দেয়ার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে আট সদস্যবিশিষ্ট উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হয় যার সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী।

ওই উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ছিলেন_ ১) তাজউদ্দীন আহমদ, ২) মণি সিং, ৩) অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, ৪) মনোঞ্জন ধর প্রমুখ। মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে ওই উপদেষ্টা কমিটির সভায় এই মর্মে অভিমত ব্যক্ত করা হয় যে, পূর্ববঙ্গের পূর্ণ স্বাধীনতা ব্যতিরেক অন্য কোন প্রকার রাজনৈতিক সমাধান গ্রহণযোগ্য হবে না। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মওলানা ভাসানী কলকাতা ছাড়াও দেরাদুন, দিল্লী ও অন্যান্য স্থানে অবস্থান করেন। পরবর্তীকালে অনেকে অভিযোগ করেন যে ভারতে থাকাকালীন তিনি নজরবন্দি অবস্থায় ছিলেন। ভারতে অবস্থানকালে মওলানা ভাসানী দুইবার অসুস্থ হয়ে পড়েন।

তখন তাকে দিল্লী অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্সে ভর্তি করা হয়েছিল। বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৭২-এর ২৫ ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক হক-কথা প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীচুক্তির বিরোধিতা করলেও মুজিব সরকারের জাতীয়করণ নীতি এবং ১৯৭২-এর সংবিধানের এর প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেন। ১৯৭৩ সালে খাদ্যের দাবিতে ঢাকায় ১৫-২২ মে অনশন ধর্মঘট পালন করেন।

১৯৭৪-এর ৮ এপ্রিল হুকুমতে রাব্বানিয়া সমিতি গঠন করেন। একই বছর জুন মাসে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করলে টাঙ্গাইলের সন্তোষে গৃহবন্দি হন। ১৯৭৬-এর ১৬ মে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে ঐতিহাসিক লং মার্চে নেতৃত্ব দেন। একই বছর ২ অক্টোবর খোদাই খিদমতগার নামে নতুন আর একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। মৃত্যু ১৯৭৬ খৃস্টাব্দের ১৭ই নভেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এই দেশ বরেণ্য নেতা মৃত্যুবরণ করেন।

তাঁকে টাঙ্গাইলের সন্তোষে দাফন করা হয়। সারা দেশ থেকে আগত হাজার হাজার মানুষ তাঁর জানাযায় অংশগ্রহণ করে। সমাজ সংস্কার রাজনীতির পাশাপাশি তিনি সমাজ সংস্কারমূলক কর্মকান্ডে জড়িত ছিলেন। আসামে ৩০ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি কারিগরী শিক্ষা কলেজ, শিশু কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন সন্তোষে।

এছড়াও তিনি কাগমারিতে মাওলানা মোহাম্মস আলী কলেজ এবং পঞ্চবিবিতে নজরুল ইসলাম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রকাশিত গ্রন্থ * দেশের সমস্যা ও সমাধান (১৯৬২) * মাও সে তুং-এর দেশে (১৯৬৩) মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী আজীবন নিপীড়িত মানুষের মুক্তির সংগ্রাম করে গেছেন। ১৯৭৬ সালের ১৬ই মে তিনি ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চে নেতৃত্ব দেন। এ কর্মসূচিই ছিল তাঁর জীবনের শেষ কর্মসূচি। কেন তিনি এ কর্মসূচি গ্রহণ করতে গেলেন? এ প্রশ্নটি আমার মনে প্রায়ই জাগে।

এ প্রশ্নটির উত্তর খুঁজে পাবার জন্য আমরা কাজ করছি। আমাদের জাতীয় জীবনে ১৯৭৬ সাল এক সংকটপূর্ণ বছর। এ বছরের প্রথম দিকে ভারত উপর্যুপরি সীমান্তহামলা শুরু করে এবং মে মাসের প্রথম দিকে ফারাক্কায় গঙ্গা নদীর পানি এক তরফা প্রত্যাহার করে নেয়। এ সময় দেশবাসীর মনে একদিকে ভারতের আক্রমন ভীতি অপর দিকে ফারাক্কায় গঙ্গা নদীর পানি একতরফা প্রত্যাহার করায় নদীগুলিতে পানি না পাওয়া ভীতি। জাতির এ সংকটময় মূহুর্তে মহান নেতা মওলানা ভাসানী গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন।

তিনি ফারাক্কা লংমার্চের কর্মসূচি ঘোষণা করলেন। এ কর্মসূচীটি আমাদের জাতীয় জীবনের এক মহাসংকটকালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ কর্মসূচীতে আমি ব্যাক্তিগতভাবে সম্পৃক্ত ছিলাম। আজ থেকে চৌত্রিশ বছর আগে অনুষ্ঠিত এ লংমার্চের কিছু কিছু স্মৃতি আজো আমার মনে রয়েছে। এখানে আমার স্মরণে থাকা দু' একটি ঘটনা বর্ননা করব।

এ সময়কার আরও একটি বড় ঘটনা ছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবার পরিজনকে হত্যা করা। এ হত্যাকান্ডের পরপরই জেলখানায় বন্দি অবস্থায় জাতীয় পর্যায়ের চার নেতাঃ মুক্তিযুদ্ধের মহান বীর তাজুদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম. মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে হত্যা করা হয়। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশ একটি স্থিতিশীল সরকার প্রতিষ্ঠার আগেই সে সময়কার সরকার প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানকেসহ এসব রাজনৈতিক হত্যাকান্ড বাংলাদেশকে নেতৃত্ব শুন্য করার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়েছিল। রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকভায় এটা ছিল একটি বড় ধরনের ঘটনা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার আগেও নক্সালের নামে অসংখ্য বামপন্থী নেতা কর্মিদের হত্যা করা হয়েছে।

সেনাবাহিনীতে সাধারণ সৈনিক ও অফিসারের মধ্যকার অসাম্যের কথা তুলে বার বার বিদ্রোহের উস্কানি দেয়া হয়েছে। ফলে মারা গেছে সৈন্য বাহিনীর অনেক অফিসার ও সাধারণ সৈন্য। এতে সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড নষ্ট হয়েছে। একটা সময়ে এটা স্পষ্ট হলো যে, কিছু সংখ্যক দেশীয় চক্রান্তকারী বহিরাগত আগ্রাসনকে আলিঙ্গন করার জন্য এ পরিস্থিতি তৈরী করছে। ঘটনার গভীরতা সাধারণ সৈনিকরা বুঝতে পারলো।

সময় ক্ষেপন না করে ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর রাত ৪টায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের কয়েক হাজার সৈন্য ট্যাঙ্ক ও ট্রাকে করে ঢাকা শহরে আগমন করল। আমি সেদিন রাতে তোপখানা রোডের এক বাসায় ছাত্রদলের (ভাসানী অনুসারী) কিছু কর্মিসহ সংগঠনের অন্যতম নেতা মোবারক হোসেনের বাসায় ঘুমাচ্ছিলাম। রোডের পাশে বাসা থাকায় বাসার সকলেই আমরা জ়েগে উঠলাম। তখন সকাল পাঁচটা। আমি আমার বন্ধুদের বললাম চল আমরা সৈন্যদের সাথে যোগ দেই।

ওদের শ্লোগান আমাদের মত হয় না। কাউকে রাজী করাতে না পেরে আমি একাই একটি ট্যাঙ্কে উঠে গিয়ে শ্লোগান দিলাম। ট্যাঙ্কে ১০/১২ সৈন্য ছিল। আমার শ্লোগানের কন্ঠ শুনে সৈন্যরা যেন বারুদে অগ্নি শলাকা পেল। কামানের গর্জনের চাইতে মানুষের গর্জন কত জোরালো হতে পারে, সেদিন আমি তা বুঝেছি।

ঢাকা শহরের আমি একজন পরিচিত মুখ। সৈন্যবাহী একটি ট্যাঙ্কে উঠে সারা শহরব্যাপী শ্লোগান দিয়ে তোপখানা রোডে এলে সমবেত হাজার হাজার মানুষ ট্যাঙ্ক মিছিলে যোগ দেয়। সিপাহী-জনতা এক কাতারে সামিল হয়। তারা জ়েনারেল জিয়াউর রহমানকে বন্ধি অবস্থা থেকে মুক্ত করে আনে। এ দিনটি দেশবাসী 'সিপাহী-জনতার বিপ্লব দিবস' হিসেবে পালন করে।

সেদিন সিপাহী-জনতা গগনবিদারী স্লোগান দিয়ে বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দেয়; আগ্রাসী যেই হও, বাংলাদেশের দিকে হাত বাড়াইওনা। তারা শ্লোগান দেয়ঃ 'সিপাহী বিপ্লব জিন্দাবাদ', 'সিপাহী-জন তা ভাই ভাই', 'জেনারেল জিয়া জিন্দাবাদ', 'রুশ-ভারতের দালালরা হুঁশিয়ার সাবধান', মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী। পরিকল্পিত হত্যাকান্ডের মাধ্যামে চক্রান্তকারীরা দেশকে নেতৃত্বশূন্য করে ফেলেছে। ৭ই নভেম্বর দুপুর বেলাই সন্তোষে মওলানা ভাসানীর সাথে যোগাযোগ করা হয়। তিনি এক বিবৃতিতে জেনারেল জিয়াকে সমর্থন করেন।

মওলানা ভাসানীর বয়স তখন ৯৬ বছর। বার্ধক্যের নানারোগে তিনি আক্রান্ত। এ সময় সীমান্তে অবিরত হামলা চলছিল। মওলানা ভাসানী সীমান্ত সফর শুরু করলেন। প্রতিদিন তিনি হাজার হাজার মানুষের সামনে দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় এগিয়ে আসার আহবান জানান।

একে অসুস্থ তার উপর সীমান্ত সফরের ধকল, এ অবস্থায় ১৯৭৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারী খুলনার এক সভায় বক্তৃতা প্রদান কালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। স্থানীয় ডাক্তারগণ মওলানা ভাসানীর হৃদরোগে আক্রান্ত হবার কথা বলেন। তাঁকে পিজি হাস্পাতালে নিয়ে আসা হয়। এর পর থেকে হুজুর প্রায়শঃই অসুস্থ হয়ে পড়তেন। পিজি হাসপাতালে তাঁর জন্য একটা রুম বরাদ্ধ ছিল।

দেশের এ সংকটময় মূহুর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাসানী ন্যাপের ছাত্র সংগঠন জাতীয় ছাত্রদলের পক্ষ থেকে আমরা এমন কতগুলো জাতীয়তাবাদী কর্মসুচী গ্রহণ করি-যা বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক ছাত্র-যুব সমাজকে প্রবল ভাবে আকর্ষণ করেছিল। তার একটি হলো 'ফারাক্কা প্রতিরোধ আন্দোলন'। যতটুকু আমার মনে পড়ে তারিখটি ছিল ১৫ কি ১৬ ই এপ্রিল। ভারত কর্তৃক ফারাক্কায় গঙ্গা নদীর পানি এক তরফা প্রত্যাহারের ফলে পদ্মা শুকিয়ে চৌচির হয়ে গেছে। পত্রিকায় এ ছবি দেখে আমি আমাদের ছাত্রদলের কর্মীদের নিয়ে তাত্ক্ষণিকভাবে মধুর ক্যান্টিন থেকে একটি প্রতিবাদ মিছিল বের করি।

এ মিছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্টস ফ্যাকাল্টির করিডোর প্রদক্ষিণ করার পর সাইন্স ফ্যাকাল্টি হয়ে আমরা প্রেস ক্লাব পর্যন্ত গমন করি। সেখান থেকে ১০/১২ জনের একটি গ্রুপ আমরা মওলানা হুজুরের সাথে দেখা করার জন্য পিজি হাসপাতালে গেলাম। আমি বললাম, হুজুর, আমরা ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার প্রতিবাদে মিছিল করে এসেছি। আমরা চাই এ ব্যাপারে বিশ্ব-দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য আপনি একটা কিছু করেন। হুজুর আমাদের উত্সাহ-উদ্দীপনা দেখে খুব খুশী হলেন।

তিনি বললেন তোমরা যুবক, তোমরা যদি চাও অনেক বড় কর্মসূচী গ্রহণ করা যাবে। ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে এখনই কিছু না করলে একদিন বাংলাদেশ মরুভূমিতে পরিনত হবে। জাতি হিসেবে আমরা নিঃশেষ হয়ে যাব। তিনি আমাকে থাকার জন্য বললেন। অন্যরা চলে গেলে হুজুর আমাকে বললেন, প্রথমে সেরাজকে দেখ বাসায় আছে কিনা? তাকে না পেলে জাহিদকে টেলিফোন কর, বাংলাদেশ টাইমস পত্রিকায় পাওয়া যাবে।

শ্রমিক নেতা সিরাজুল হোসেন খানকে টেলিফোন করে পাওয়া গেল। আমি টেলিফোন হুজুরের হাতে দিলাম। হুজুর জিজ্ঞাসা করলেন, সেরাজ আমার এখানে আসতে পারবা। তোমার সাথে একটা জরুরী আলাপ আছে। সিরাজ ভাই বললেন, হুজুর আসছি।

সেদিন বিকালেই হুজুর ফারাক্কায় ভারত কর্তৃক এক তরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতির উপর একটা বিবৃতি প্রদান করলেন। পর দিন বিকাল ৬টার দিকে হুজুরকে দেখতে গেলাম। কিছুক্ষণ পর হুজুর বললেন তোমার সাথে যারা এসেছে তাদেরকেসহ সকলেই এখন চলে যাও। কাল সকালের দিকে এক বার এসো। আমরা যখন কক্ষ থেকে বের হয়ে আসলাম তখন দেখলাম জেনারেল জিয়াউর রহমান সাহেব আরো কয়েকজন আর্মী অফিসারসহ হুজুরের সাথে দেখা করতে এসেছেন।

সে সময় আমরা শুনেছিলাম, জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে মওলানা ভাসানীর পরামর্শকে খুবই গুরুত্ব দিতেন। শুনা কথাগুলি আমাদের কাছে সঠিক হলো। পরদিন ১৮ই এপ্রিল হুজুরের কাছে গেলে বুঝতে আমাদের অসুবিধা হলো না যে, জাতির এ মহাদুর্যোগময় মূহুর্তে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে পরিচালিত চক্রান্ত প্রতিহত করার লক্ষ্যে মওলানা ভাসানী ও জেনারেল জিয়াউর রহমান একমত হয়েছেন। হুজুর বললেন, আমরা ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে লং মার্চ করব। ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের ফলে আমাদের যে ক্ষতি তা ভারতে স্বীকার করতেই হবে।

ভারত যদি বাংলাদেশের ন্যায্য পাওনা পানি না দেয়, তাহলে ১৬ই মে রাজশাহী থেকে লক্ষ জনতার শান্তি মিছিল নিয়ে ফারাক্কা অভিমুখে যাত্রা শুরু করবো। পিজি হাসপাতালে থাকা কালেই মওলানা ভাসানী সকল রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দলের নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠনের ঘোষণা দেন। ২রা মে ৩১ সদস্য বিশিষ্ট ফারাক্কা মিছিল কমিটি গঠন করা হয়। মওলানা ভাসানীকে এ কমিটির আহবায়ক করা হয়। আমাকে এ কমিটিতে রাখার জন্য হুজুর নিজে প্রস্তাব দেন।

আজ থেকে ছত্রিশ বছর আগে গঙ্গা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যার দাবীতে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ফারাক্কা লংমার্চের নেতৃত্ব দেন। রাজশাহী মাদ্রাসা ময়দান থেকে ১৯৭৬ সালের ১৬ই মে আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি প্রায় লক্ষাধিক মানুষের এ মিছিলের যাত্রা ঘোষণা করেন এবং ১৭ই মে রাজশাহীর কানসার্ট সীমান্তে গিয়ে এ মিছিল শেষ হয়। রাজশাহীর মাদ্রাসা ময়দানের সংক্ষিপ্ত ভাষণে বলেন, গঙ্গা নদীর ন্যায্য হিস্যা আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবে। আমরা শান্তি চাই। কিন্তু তারা যুদ্ধ চায়।

বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনতার ভয়ে তারা সীমান্তে সৈন্য মোতায়েন করেছে। আমরা যুদ্ধকে ঘৃণা করি। তিনি আরও বলেন, এ মিছিল বৃহত্শক্তির বিরুদ্ধে মজলুমের সংগ্রামের প্রতীক। গোটা বিশ্বের বুক থেকে জালেমের শোষণ পীড়নের সমাপ্তি না ঘটা পর্যন্ত এ সংগ্রাম চলবে। রাজশাহী থেকে রওয়ানা দেবার সময় হুজুর বলে ছিলেন, আমার সাথে সাথে থেকো।

হুজুর অসুস্থ। ডায়াবেটিকস দ্রুত উঠা নামা করছে। প্রতি আধা ঘন্টা পর পর কাপড় বদলাতে হচ্ছে। ছোট্ট একটা মটর গাড়ি হুজুরকে বহন করছে। সাথে মশিয়ুর রহমান যাদু মিয়া।

মিছিল শুরু হবার কিছুক্ষণ পরেই মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। সারাদেশ থেকে এ মিছিলে অংশ নেবার জন্য কয়েক লক্ষ মানুষ এসেছে। তারা হুজুরের আগে পিছে মিছিলে দৌড়াচ্ছে। কেহই বৃষ্টির কারণে মিছিল থেকে সরে পড়েনি। এ মিছিলে আমিও হুজুরকে বহনকারী গাড়ির পিছনে পিছনে দৌড়াচ্ছি।

আমার সাথে মোজাফফর হোসেন, সামসুজ্জামান মিলন, শওকত হোসেন নিলুসহ আরো অনেকে। এক টানা দৌড়ে কিভাবে আমরা ১১ মাইল পথ অতিক্রম করে প্রেমতলী পৌঁছেছিলাম, তা আজো বলতে পারি না। প্রেমতলী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ১৯ মাইল পথ। এখানে আমরা রাত্রি যাপন করলাম। পরদিন সকালে আবার যাত্রা শুরু।

অতিক্রম করতে হবে কানসার্ট পর্যন্ত আরও ৩৪ মাইল পথ। বিকাল ৪টায় আমরা কানসার্ট গিয়ে পৌঁছলাম। এখানে এ সে তিনি মিছিলের সমাপ্তি ঘোষণা করে বললেন, বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যার দাবী মেনে না নিলে তিনি আগামী মাসের মধ্যে স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী গঠন করে আগামী ১৬ই আগষ্ট থেকে ভারতীয় পন্য বর্জন আন্দোলন শূরু করবেন। তিনি মিছিলে আগতদের শপথ বাক্য পাঠ করানঃ গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা না পাওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, এবং দেশ গড়ার কাজে আত্মোসর্গ করা। ফারাকা লং মার্চের মাধ্যমে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী জাতীয় দুর্দিনে কিভাবে আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে হয়, সে পথ নির্দেশ রেখে গেছেন।

বাংলাদেশের প্রাপ্য গঙ্গা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা না পেলে ভারতীয় পন্য বর্জন আন্দোলন শুরু করার নির্দেশ দিয়ে গেছেন। জেনারেল জিয়া সেদিন মওলানা ভাসানীকে সামনে রেখে আপোসের নয়, একজন দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধার মত লড়াইয়ে সামিল হয়েছিলেন। আর আজ আমরা কি দেখছি, ক্ষমতার লোভে দল বিশেষ, আবার কখনো গোষ্ঠি বিশেষ এ মহান নেতার নির্দেশমত কাজ না করে, আপোসের পথ ধরেছে। দেশের স্বার্থ, দেশের অস্তিত্ব আগ্রাসী শক্তির হাতে তুলে দিচ্ছে। এর জন্য অবশ্যই ইতিহাসের কাঠগড়ায় একদিন দাঁড়াতে হবে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।