হৃদয়ে থাকুক বসন্ত
১২ই আগষ্ট, ১৯৭১। শহরের বড় রাস্তার মোড়ে ছেলেটি দাঁড়িয়ে ছিলো। আলুথালু বেশে, মায়াকাড়া চোখে তাকিয়ে ছিলো আকাশের দিকে। মাঝে মাঝে মিলিটারির সাঁজোয়া যান টহল দিয়ে যাচ্ছে। ছেলেটির দিকে কারো ভ্রুক্ষেপ নেই।
এই অল্পবয়সী ছেলেটাকে তারা কোন সন্দেহ করেনি। যদিও, এখন এইরকম ছোট ছোট ছেলেরাই বুকে মাইন বেঁধে মিলিটারী যানের নিছে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তবু ছেলেটাকে তারা পাত্তা দিচ্ছেনা। ছেলেটা চায়, তারা তাকে দেখুক। গুলি করে মেরে ফেলুক।
এখন আর সে ভয় পায়না। ভাবলেশহীনভাবে দাঁড়িয়ে আছে সে। ছেলেটার আর কিছু হারাবার নেই তার। একবুক কষ্ট চেপে সে অপেক্ষা করছে মৃত্যুর। তাদের শহরে মিলিটারী আসার আগে, সব কিছু সুন্দর ছিলো।
স্কুল বন্ধ ছিলো। সারাদিন খেলা আর খেলা। বাবা যুদ্ধে চলে গেলেন।
তারপর শহরে মিলিটারী এলো। সব কিছু শেষ করে দিতে গেলো।
টুকুনরা গ্রামে চলে গেলো। মা তাকে বাসা থেকে বের হতে দিতেননা। সারারাত ধরে শুধু শব্দ আর শব্দ। মা তাকে নিয়ে স্টোররুমে লুকিয়ে থাকতেন। মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে বাড়ী বাড়ী টহল চলছিলো।
সেনারা তাদের বাসাতেও ঢুকে পড়েছিলো। সে আর মা তখন স্টোর রুমে লুকিয়ে। সেনারা বাসার সবকিছু তছনছ করে, কাউকে না পেয়ে চলে যাচ্ছিল। তখন বিল্লাল শেখ অনভ্যস্ত উর্দুতে বলে উঠলো,
- "রুখতা হ্যায়, মেজর সাব। "
- "হোয়াই!" মেজর রাগী গলায় জিজ্ঞেস করলো।
(বিল্লাল শেখ অশিক্ষিত মানুষ। এতোদিন মানুষের বাড়ীতে কামলা খাটতো। যুদ্ধ শুরু হবার পর শান্তি কমিটি গঠন করে রাজাকার হয়ে গেলো। সে কুটিল হাসি হেসে সবাইকে জানাল,
- "শেষ বয়সে আইসা, আল্লাহর পথে নামলাম। কাফেরগো শেষ করে পাকিস্তানকে বেহেশত বানাবো।
)
বিল্লাল শেখ মেজর সাবের ইংরাজী না বুঝলেও, বলে চলে,
-"ইয়ে দরওয়াজা আন্দার মে বন্ধ থাকতা হ্যায়। কোই আদমি আন্দার মে হো সাকতা হুজুর"
মেজর বুঝে নিলেন। ঠিক কথাইতো! দরজা ভেঙ্গে ঢুকতে হয়েছে। তাড়াহুড়োয় অনেক কিছু চোখ এড়িয়ে যায়।
-" সার্চ এগেইন"
আদেশ দিলেন সৈন্যদের।
সৈন্যরা এবার সবার আগে স্টোর ত্রুমে হামলে পড়লো। বেশি খুঁজতে হলোনা। বিল্লাল শেখ তার ছানি পড়া চোখে পুরানো আলমারীটার পেছনে ছেলেটিকে বুকে জড়িয়ে বসে থাকা মোমেনা বেগমকে আবিষ্কার করলো। দেরী না করে আনন্দে চিৎকার করে উঠলো।
- "খুবসুরাত আওরাত মজুদ হ্যায়।
"
সৈন্যরা যখন টেনেহিচড়ে মোমেনা বেগমকে স্টোররুম থেকে বের করে আনলো, তখন তার খুবসুরত চেহারা দেখে মেজর আলীর রাগী চেহারায় হাসি বিস্তৃত হলো। মোমেনা বেগমের চিৎকার উপেক্ষা করে, তাকে নিয়ে পাশের রুমে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো মেজর আলী। বাইরে দাঁড়িয়ে বিল্লাল সেখ আর সৈন্যরা ভেতরের আর্তনাদ আর হুটোপুটি উপভোগ করছিলো। আর অসহায় ছেলেটা কেঁদে কেঁদে দরজায় বারবার আছড়ে পড়ছিলো। কিছুক্ষন পর মেজর যখন তৃপ্তির হাসি নিয়ে বের হয়ে এলেন, তখন তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো।
নখ দিয়ে আছড়ে দিলো মেজরের মুখ। হঠাৎ মাথায় কিসের আঘাতে জ্ঞান হারালো ছেলেটা।
জ্ঞান ফিরতেই উঠে দাঁড়ালো। মাথার ভেতরটা কেমন যেনো ফাঁকা হয়ে গেলো! পা টলে উঠলো। মা কই! পাশের ঘরে উঁকি মারলো।
দেখলো তার মা নগ্ন হয়ে পড়ে আছেন। কাছে গিয়ে চাদর দিয়ে মাকে ঢেকে দিলো। মাকে ওরা মেরে ফেলেছে। ঢুকরে কেঁদে উঠলো সে।
কাল সারাদিন পর, আজ সে বাসা থেকে বের হয়ে এসেছে।
তারও মরে যাওয়া দরকার।
ছেলেটি একাকী দাঁড়িয়ে আছে। জানেনা গন্তব্য কই।
(আমরা বড় বেশী হুজুগে। আমরা ২৬শে মার্চ ও ১৬ই ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণ করি।
বাকি পুরোটা বছর চুপ। যারা স্বজন হারিয়েছে, তাদের জন্য পুরো ৯ মাসটাই ভোলার নয়। প্রতিটি দিন। এই দেশে রাজাকারদের বিচার হবে। হতেই হবে।
কোন রাজনৈতিক দল নয়, আমরা বিচার করবো। আমরা আমাদের স্বজন হারিয়েছি। )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।