রাজা-প্রজা সবাই থাকবে নির্বিশেষে, পাল্টে দেবে দুনিয়ার সব মিথ্যে-কানুন হেসে। শহরের দামী একটা রেস্টুরেন্টে বসে আছি। একটু আগেই ফোনে কথা হয়েছিল জুথির সাথে, কিছুক্ষণের মধ্যেই সে চলে আসবে। অধীর আগ্রহ নিয়ে বারবার চুল ঠিক করছিলাম। ফুলহাতা শার্টের কলার আর বোতামগুলো ঠিক আছে কিনা তাও দেখে নিচ্ছিলাম।
জীবনে কখনো এভাবে কোন মেয়ের সাথে দেখা করতে আসিনি তাই নার্ভাস অনুভব করাটাই স্বাভাবিক। জুথি আসতে আসতে একটা কফি খেয়ে নিলে মন্দ হয় না। ওয়েটারকে অর্ডার দিলাম কফি দেয়ার জন্য।
আজকের দেখা করতে আসার শুরুটা কয়েকদিন আগে হয়েছিল।
প্রতিদিনকার মতো কাঁচের বয়ামটা থেকে একদলা মুড়ি হাতের মুটিতে নিয়ে মুখে পুরে কড়কড় শব্দে চাবাচ্ছিলাম।
আমার মরহুম দাদা প্রায়ই বলতেন, আনমনে হোক আর অবচেতন মনে হোক হঠাৎ করেই মুড়ি খাওয়ার মধ্যে নাকি আলাদা একটা মজার বিষয় লুকিয়ে আছে। সেই বিষয়টি সঠিক কি তা আজ অবধি আমি খুঁজে পাইনি। আজকেও ঠিক একইভাবে মুড়ি খাওয়ার সেই বিষয়টি উপলব্ধি করলাম।
রুমের ঝুলন্ত ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে সেভেন আপের বোতলটা মুখে পুড়ে ঢকঢক করে কয়েকটা ঢোক গিললাম। আবার পিসির সামনে এসে যথারীতি ফেসবুকে বসলাম ।
মুড়ি খাওয়ার ক্ষণিক সময়টুকুর মধ্যেই ১৪টা নোটিফিকেশন চলে এসেছে। স্ট্যাটাস একটা দিয়েছিলাম সেখান থেকেই এই নোটির উৎপত্তি। কয়দিন হলো বন্ধুদের চাপাচাপিতে ফেসবুকে আইডি খুলেছি। ভার্চুয়াল দুনিয়ায় একেবারেই নতুন ভুমিষ্ট শিশুর মতো আমি। প্রথম কয়দিন ফেসবুক ভালো না লাগলেও এখন দিনের প্রায় অর্ধেক সময়ই ফেসবুকে নষ্ট করে ফেলি।
মুখে এক ধরনের অদ্ভুত মার্কা হাসি নিয়ে মন্তব্যগুলোর একটার পর একটা জবাব দিতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। নোটিফিকেশন দেখলে মুখটা একটু ব্যাকা হয়ে একধরনের হাসির সৃষ্টি করে। হাসিটা কিছুটা মুখ বিস্তৃত হলেও মুচকি হাসি, চওড়া হাসি, অট্টহাসি এইগুলোর কোন একটার তালিকায়ও একে ঢোকানো যায় না। এই সমস্যা শুধু যে আমার একার তা কিন্তু নয়; নোটিফিকেশন দেখে এই রকম অদ্ভুত হাসি দিতে আমার কয়েকটা বন্ধুকেও দেখেছি। তাই এই সমস্যা শুধু আমার একার না ।
কিন্তু এই অদ্ভুত হাসিটা যে নোটিফিকেশনের ব্যাপকতা দেখে না সেটা আমি হলপ করে বলতে পারি।
মন্তব্য আদান প্রদানের মধ্যখানে মেসেজ বক্সে কখন যে একটা লাল চিহ্ন ফুটে উঠেছে খেয়ালই করিনি। একটু বিরক্ত আবার অনেক বেশী কৌতুহলী। বিরক্ত কারণ একটা খুব বড় মন্তব্যের জবাব দিচ্ছিলাম আর কৌতুহলী কারণ সেটা যাদের মেসেজ প্রায়ই আসে তারা ভালো করেই বুঝেন।
মেসেজটা নতুন আরেকটা ট্যাবে ওপেন করলাম।
”কি খবর ভালো আছেন ??”
মেয়ে একটার আইডি থেকে এসেছে। নামটা তেমন পরিচিত মনে হলো না। প্রোফাইলে ফিমেইল লেখা ছাড়া বাকি সব কিছুতে প্রাইভেসী দেয়া। আজকাল মেয়েরা একটু বেশীই প্রাইভেসী দিয়ে রাখে। রাখারই কথা কারণ যে হারে মেয়েদের ছবি দিয়ে ফেক আইডি আর বাজে বাজে পেজ-গ্রুপ বানানো হচ্ছে তাতে ফুল প্রাইভেসী ছাড়া উপায় নেই।
প্রফ পিকে তাই নিনজা হাতুরী কার্টুনের উইমিকোর ছবি দেয়া। মিউচুয়াল কোন ফ্রেন্ডও দেখতে পেলাম না।
-জি ভালো আছি। কিন্তু আপনাকে সঠিক চিনতে পারছি। মেসেজ রিপ্লাই করলাম।
-আমি জুথি। মনে নেই রমেশ স্যারের ক্লাসে আমরা একসাথে পড়তাম। মেয়েদের সাথে তোমার কথা বলতে হাত পা কাঁপত আর মুখে তোতলামি চলে আসতো ?
এবার একটু অবাক হলাম। রমেশ স্যারের বাসায় ক্লাস করতাম ঠিক আছে। মেয়েদের সাথে কথা বলতে কাঁপতাম, তোতলাতাম তাও ঠিক আছে কিন্তু জুথি নামে স্যারের ক্লাসে আমার সাথে পড়েছে এমন কারো নাম ঠিক এই মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে না।
অবশ্য না পড়ারই কথা কারণ মেয়েদের সাথে আমার সখ্য এতোটা ছিল না। দুয়েকজন ছাড়া ভালো করে আর কারো নামই জানতাম না।
-আপনি যা বলেছেন সবই ঠিক। কিন্তু আপনাকে আমি সঠিক চিনতে পারছি না। আসলে অনেক বছর হয়ে গেছে তো তাই চিনতে একটু কষ্ট হচ্ছে।
-হুম, আস্তে আস্তে এমনিতেই চিনে যাবে। আচ্ছা বাদ দাও এইসব। সায়েম, পাচু, রজব এদের খবর কি? দেখা হয় তোমার সাথে ?
পাচু, রজবদের কথা জিজ্ঞেস করায় এবার একপ্রকার সিউরই হয়ে গেলাম যে মেয়েটা সত্যি সত্যিই মনে হয় আমাকে চিনে।
-হ্যাঁ দেখা হয় ওদের সাথে। ভালো আছে সবাই।
-ওদেরকে আমার কথা বলার দরকার নেই। তোমার মতো ওদেরকেও হঠাৎ করে সারপ্রাইজ দিবো।
সারপ্রাইজ ? কই আমি তো সারপ্রাইজের কোন লেশমাত্রাও অনুভব করিনি।
-আচ্ছা ঠিক আছে বলবো না। তা কি করেন আপনি ?
-আমি এইতো বিবিএ করতেছি।
তুমি কোথায় আছো ?
-সদ্য অনার্স থার্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা দিলাম।
- তা কোন গার্লফ্রেন্ড আছে ?
- হাহাহাহাহা, না নেই।
- না থাকারই কথা, তুমি যে মানুষ!
-হাহাহাহাহা, এখন কিন্তু আগের মতো নই।
- তাই নাকি ? তাহলে তো দেখতে হয়।
-মানে? কি দেখতে হয় ?
- আরে কিছু না।
একনাগাড়ে চলা মেসেজ আদান প্রদানের শেষের কথাগুলো শুনে আমার মনে আবার সন্দেহের ভাবনা উঁকি দিলো। এ কোন ফেক আইডি না তো ? পাচু তো প্রায়ই এসব করে। কয়েকদিন আগেই বন্ধু হোসেনকে পাচুরা মিলে যা পচানো পচাইলো। মেয়ে ফেক আইডি দিয়ে হোসেনের সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলে। তার কয়েকদিন পর হোসেন দেখা করতে চাইলে একটা রেস্টুরেন্টে দেখা করতে বলে।
বেচারা ভালবাসার টানে ভালোবাসার মানুষটার মুখখানা স্বচক্ষে দেখতে গিয়ে বখরা (মদন) বনে এসেছে। আর এ সবই ছিল পাচুর কাজ। এখন কি তবে পাচু আমাকে পচানোর তালে আছে। এমন যদি হয় তাইলে শালারে জুতা খুলে মোজা দিয়া দাব্রানি দিমু।
-দেখুন প্রথমেই বলেছি জুথি নামে কারো কথা আমার মনে পড়ছে না, শুধুমাত্র কথা বলার খাতিরে কথা চালিয়ে গেছি।
আসলে একটা কথা আপনাকে বলতে ইচ্ছে করছে। ( সন্দেহের ভাবনায় তুমি থেকে ডাইরেক্ট আপনিতে চলে এসেছি )
ইদানীং ফেক আইডির ভিড়ে কোনটা আসল তা বুঝাটাই কষ্টকর হয়ে গেছে। তাছাড়া আমার কিছু পাজি বন্ধু প্রায়শ এসব করে থাকে। তাই আপনার আইডিটা যে ফেক না সেটা বিশ্বাস করতে আমার একটু কষ্ট হচ্ছে।
-ওহ বুঝছি তোমার সমস্যাটা কোন জায়গায়।
দাও তোমার মোবাইল নাম্বারটা দাও। কথা বললেই তো সব কিছু ক্লিয়ার হয়ে যাবে, তাই না ?
এবার একটু অবাক কিন্তু মনের ভিতর এক ধরনের হালকা খুশি বিরাজ করছে। খুশির কারণটা মনে হয় ফেক আইডির রহস্য খুলে যাওয়ার জন্য। যাইহোক নাম্বার যেহেতু চেয়েছে সেহেতু ফেক আইডি হওয়ার প্রশ্নই উঠে না। তাহলে কি তাহলে কি ________ ওফফ আর চিন্তা করতে পারছি না…. এরকম কিছু অঘটন দিয়েই কি ভালবাসার শুরু হয় ?
জমাট বাঁধা পাথরের মতো মেসেজ বক্স আর টেবিলের উপর রাখা মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছি।
দৃষ্টি আজ এখানেই বাসস্থান গড়বে মনে হয়।
দুই সপ্তাহ পর
প্রায় আধ ঘণ্টা হয়ে গেল এখনো জুথির আসার নাম নেই। মোবাইলে ডায়াল করলাম ওর নাম্বারটা। আমাকে আশ্চর্য করে দিয়ে ওপাশ থেকে মোবাইলটা বন্ধ হওয়ার বার্তা এলো। মেজাজটা এখন তপ্ত হলো, সর্বাঙ্গে চিড়বিড়ে রাগের এক স্রোত নামে।
এভাবে কেউ কাউকে অপেক্ষা করায়। ডানবামে আরেকবার চোখ বুলিয়ে উঠে দাঁড়ালাম যাবার জন্য আর ঠিক তখনই একটা টেবিলে পাচুকে দেখতে পেলাম। আমার চোখে চোখ পড়তেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো ও। হাসতে হাসতে আমার কাছে এসে দাঁড়ালো। আমার বিস্ময় যেন আকাশচূড়া স্পর্শ করলো।
চায়না ভয়েস কনভার্ট করা মোবাইলটা যে এতো কাজে আসবে কল্পনা করতে পারিনি; মাফ করে দিস দোস্ত। তাহলে কি জুথি নামে আদ্যে কেউ ছিল না ? আমি যার সাথে কথা বলেছি সে কি তাহলে পাচু ? আমার বিস্ময় তখনো সম্পুর্ণ কাটেনি। বস্তুত আমি যেন চলৎশক্তি হারিয়ে ফেলা একটা মানুষ হয়ে গেছি। এই দুনিয়ায় নিজেকে সবচেয়ে বড়ো বেকুব মনে হচ্ছে। পাচুর সাথে কোন কথা না বলেই বেড়িয়ে এলাম রেস্টুরেন্ট থেকে।
বাইরে বেড়িয়ে অসম্ভব গরম অনুভব করলাম। শার্টের ভিতরে বিন্দু বিন্দু হয়ে ঘাম জমছে। চুলগুলো বাতাসে এলেবেলে হয়ে গেছে। এবার আর হাত দুটি চুল ঠিক করতে যাচ্ছে না। পকেটের ভিতর লজ্জায় মুখ লুকিয়ে আছে।
*******************************************************
এই পোষ্টখানা আমার বড় ভাই নীরবদা কে উৎসর্গ করিলাম।
বিশেষ কথাঃ গল্পের সাথে এই উৎসর্গের কোন মিল নাই
******************************************************* ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।