বিজয়ের তখনও মাস দুয়েক বাকি। চলছে প্রচ- যুদ্ধ। যশোরের মণিরামপুর-কেশবপুর অঞ্চলের হানাদার বাহিনীকে তটস্থ করে রাখছিলেন আসাদ, তোজো, মানিক, শান্তি, ফজলুর নেতৃত্বে প্রচ- মেধাবী মুক্তিসেনাদের এই দলটি। তারা ঘুম নষ্ট করেন রাজাকারদের।
১৯৭১ সালের ২৩ অক্টোবর সেই বীরসেনানীর দলের সদস্যরা ধরা পড়েন রাজাকারদের হাতে।
ঐরাতে মণিরামপুরের চিনেটোলা বাজারের পাশে হরিহর নদীর ব্রিজের ওপরে তাদের নৃশংসভাবে খুন করে রাজাকারদের দল। সেদিনের সেই বিভৎস স্মৃতি আজও তাড়িয়ে ফেরে যে মানুষটির, তার নাম শ্যামাপদ দেবনাথ। যিনি নিজহাতে কবরস্থ করেন সেই মুক্তিসেনাদের। প্রায় এসে সযতনে পরিষ্কার করেন কবরের ওপরের ঝোঁপ-ঝাড়। একাত্তরে তিনি মুটেশ্রমিক ছিলেন, আজ প্রায় ৮৫ বছর বয়সেও একই কাজ করছেন।
বড় এক পরিবার নিয়ে কষ্টে-সৃষ্টে পার করেন সময়। কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন অঝোরে।
শ্যামাপদ দেবনাথ বলেন, সেদিন রাতে আসাদ, তোজো, মানিক, শান্তি, ফজলুসহ ছয়জনকে ধরে আনে রাজাকাররা। রাজাকারদের সাথে একজন খান সেনা ছিল। খান বললো, মেরে কাজ নেই, ওদের আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা নিয়ে ছেড়ে দাও।
কিন্তু রাজাকাররা জানায়, এদের গুলি করে না মারলে আমাদের সুখ শান্তির দেশকে আর ফিরিয়ে আনা যাবে না।
মুক্তিযোদ্ধাদের একজন পানি খেতে চায়। রাজাকাররা পানি দিতে নিষেধ করে বলে, ওদের মুতে (প্রস্্রাব) খাওয়াতে হবে। আমি গোপনে মাস্টারদের বাড়ি থেকে বালতি এনে তাদের যখন খাওয়াইচ্ছি, সেইসময় এক রাজাকার এসে আমার পিঠে রাইফেল দিয়ে বাড়ি দিয়ে বলে, পানি খাওয়ালি ক্যান, মুতে দে...’
এরপর রাজাকাররা একজন করে আনে আর বেয়োনেট দিয়ে খোঁচায়। ওরা চিৎকার করে পড়ে গেলে গুলি করে নদীতে ফেলে দেয়।
এভাবে পাঁচজনকে হত্যা করে নদীর মধ্যে ফেলে দেয়। একজন সেইসময় নদীতে ঝাঁপ দিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
পরদিন সকালে তাদের লাশ নদী থেকে তুলে জমিরমালিক অমূল্য দেবনাথ ওরফে চানমনি কবিরাজের কাছ থেকে ২ আনা দিয়ে জমি কিনে এক গর্তে ৫ জনকে মাটিচাপা দেই।
সেদিন রাতে যে বীরযোদ্ধাকে হত্যা করা হয় তাদের একজন মাশিকুর রহমান তোজো। তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যাকচুয়ারিতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান দখল করেছিলেন।
আসাদুজ্জামান আসাদ ছিলেন যশোর সরকারি এমএম কলেজের ভিপি ও উণসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক। সিরাজুল ইসলাম শান্তি ছিলেন যশোর জেলা কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক, আহসানউদ্দিন খান মানিক জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি আর ফজলুর রহমান ফজলু ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার।
যশোরের মণিরামপুর উপজেলার হরিহর নদীর পারে চিরনিদ্রায় আছেন বীরযোদ্ধারা। এখানেই একটি গর্ত করে একইসাথে তাদের মাটিচাপা দেয়া হয়। এখানকার মানুষ ভালোবেসে তাদের নাম দিয়েছে সূর্যসন্তান।
তবে, রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের স্মরণে আজ পর্যন্ত কোন ব্যবস্থায় নেয়া হয়নি। শহীদদের স্বজনরা নিজেদের উদ্যোগে কোনরকমে কবরস্থানটি পাকা করেছেন। হত্যাবার্ষিকীতে স্বজনরাই যান সেখানে।
স্থানীয় বাসিন্দা পঙ্কজ দেবনাথ বলেন, তখন রমজান মাস। রাত ৮টা সাড়ে ৮টা হবে।
ফায়ারের শব্দ হয়। পাড়ার সবাই দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। সকালে এসে দেখি লাশ সব এখানে। সকালে মজিদ রাজাকার সেখানে ছিল। সে বলে, লাশের গায়ে হাত দিলে গুলি করা হবে।
শহিদদের যেখানে সমাহিত করা হয়েছে সেই জমির মালিকের ছেলে অমল দেবনাথ জানান, আমার বাবা অমূল্য দেবনাথ (চানমনি কবিরাজ) সেসময় মেম্বর ছিলেন। নিহতদের স্বজনরা বাবাকে জানান কবর দিতে হবে। বাবা বলেন, আমার জমি আছে ; এখানে হরিহর নদীর পাশেই কবর দেয়া হোক। টাকা লাগবে না। কিন্তু ওনারা জানান, কবর দিতে হলে জমি কিনে নিতে হয়।
বাবা বললেন, ঠিক আছে ২ আনা পয়সা দিও।
স্থানীয় আশ্রমের তত্ত্বাবধায়ক তপন কুমার দে বলেন, প্রতিরাতেই আমরা গুলির শব্দ শুনি। সেদিন রাতে ২০-২৫ রাউন্ড গুলির শব্দে আমরা ভাবি, আজ বড় ধরনের কোন ঘটনা ঘটেছে। অসংখ্য লোক মারা যাবে, সকালে উঠে শুনলাম ৫টি লাশ ভাসছে নদীতে। তারপর শ্যামা কাকা সেসব লাশ নিজে তুলে সেগুলো কবরস্থ করেন।
শ্যামাপদ দেবনাথ জানান, সে রাতে রাজাকারদের মধ্যে স্থানীয় কমান্ডার ডা. মালেক, মজিদ রাজাকার, আজিজ রাজাকার, ইসাহক রাজাকাররা ছিল। মেহের রাজাকারের ছিল কি না তা তার মনে নেই।
এই পাঁচ সূর্যসন্তানের খুনিদের অনেকে আজও প্রভাব প্রতিপত্তি নিয়ে এলাকায় অবস্থান করছে। বেঁচে আছেন ওই ঘটনার অনেক প্রত্যক্ষদর্শীও। তবুও বিচার হয়নি ওই নরপিশাচদের।
কথা হয় শহিদ আসাদের সেজভাই বিশিষ্ট ক্রীড়াব্যক্তিত্ব শফিকউজ্জামানের সাথে। তিনি বলেন, আসাদ আমার ছোটভাই। সেসহ অপর শহিদ পরিবারের পক্ষ থেকে আমি বলছি, এ হত্যার বিচার হওয়া উচিত। যারা হত্যা করেছে, তাদের কয়েকজন এখনও জীবিত আছে। তারা এলাকায় সদর্পে চলাফেরা করছে।
সরকারের উচিৎ তাদের বিচারের সম্মুখীন করে শাস্তি প্রদান করা। #
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।