‘আমি একজন আন্তর্জাতিক নেতা, আরব শাসকদের প্রধান, আফ্রিকার রাজাদের রাজা ও মুসলিমদের ইমাম। ’ ২০০৯ সালে আরব লিগের শীর্ষ সম্মেলনে এ কথা বলেছিলেন লিবিয়ার শাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফি। তাঁর এ ভাষণকে শুধুই বাগাড়ম্বর বলা যায় না, যখন দেখা যায়, দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার মতো ব্যক্তিত্ব তাঁর নাতির নাম রাখেন গাদ্দাফি।
একজন বিপ্লবী হিসেবে গাদ্দাফি দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন বর্ণবাদবিরোধী লড়াইয়ে, অধিকার আদায়ের আন্দোলনে। কিন্তু নিজে টানা ৪২ বছর দেশের ক্ষমতা আঁকড়ে থেকে ভূলুণ্ঠিত করেছেন নিজের দেশের মানুষের অধিকার।
তবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কাজ করেছেন। তেলসম্পদ কাজে লাগিয়ে লিবিয়াকে তিনি গড়ে তুলেছিলেন একটি সচ্ছল দেশ হিসেবে। নিজের সীমান্তের বাইরে অনেক দেশের অধিকারকামী মানুষের আন্দোলনে সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়ে তিনি আফ্রিকায় নিজের জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছেন। আবার সেই একই পথে শত্রুও সৃষ্টি করেছিলেন অনেক।
সেই কর্নেল গাদ্দাফি নিহত হয়েছেন গত বৃহস্পতিবার।
লিবিয়ার বিদ্রোহীরা ফাঁকা গুলি ছুড়ে উল্লাস করছে পথে পথে। রাজধানীসহ দেশের শহরগুলোর পথে পথে সাধারণ মানুষকেও আনন্দ করতে দেখা যাচ্ছে। স্বৈরশাসক গাদ্দাফির মৃত্যুতে তাঁর সমর্থকেরা বেদনাহত হলেও সংগত কারণেই তার বহিঃপ্রকাশ নেই।
১৯৬৯ সালে মাত্র ২৭ বছর বয়সে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশের ক্ষমতা নেন তরুণ সেনা কর্মকর্তা গাদ্দাফি। এরপর তিনি নিজেকে আরব বিশ্বের নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে নজর দেন আফ্রিকার দিকে।
নিজেকে ঘোষণা করেন আফ্রিকার নেতা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো করে আফ্রিকার রাষ্ট্রগুলোর জোট আফ্রিকান ইউনিয়ন (এইউ) গঠিত হয়েছে মূলত তাঁরই প্রচেষ্টায়। গাদ্দাফি স্বপ্ন দেখতেন আফ্রিকার দেশগুলোর জন্য একক মুদ্রা, একক পাসপোর্টের।
আবার এই আফ্রিকা নিয়েই গাদ্দাফির বিভিন্ন উদ্যোগ ছিল স্ববিরোধী। একদিকে তিনি লাইবেরিয়া ও সিয়েরা লিওনের মতো দেশের বিদ্রোহীদের সহযোগিতা করেছেন, অন্যদিকে উগান্ডার ইদি আমিনের মতো কুখ্যাত শাসককে সমর্থন দিয়েছেন।
কিন্তু এত সব মনে রাখেননি আফ্রিকার নেতারা।
গত ফেব্রুয়ারিতে আরব বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো লিবিয়ায়ও যখন গাদ্দাফির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয় উগান্ডার প্রেসিডেন্ট ইয়োরি মুসেভেনি তখন বলেছিলেন, ‘গাদ্দাফির ভুলত্রুটি যা-ই থাক, তিনি একজন প্রকৃত জাতীয়তাবাদী। বিদেশি স্বার্থের ক্রীড়নকদের চেয়ে আমি এমন জাতীয়তাবাদীদের বেশি পছন্দ করি। আমি মনে করি, লিবিয়ার জন্য তাঁর অনেক অবদান রয়েছে। শুধু লিবিয়া নয়, আফ্রিকা ও বিশ্বের জন্যও।
’
গাদ্দাফির মৃত্যুতে আফ্রিকার দেশগুলো বিশেষ করে লিবিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া সম্ভবত ধরা পড়েছে উগান্ডার একটি সংবাদপত্রের শিরোনামে। পত্রিকাটি শীর্ষ শিরোনাম দিয়েছে, ‘গাদ্দাফির পতন, কাম্পালা নীরব’। কাম্পালা উগান্ডার রাজধানী।
গাদ্দাফির মৃত্যুকে আফ্রিকা ও আফ্রিকান ইউনিয়নের জন্য ক্ষতি বলেই মনে করছেন সাউথ আফ্রিকান ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের ক্যাথেরিন স্টুরম্যান। তিনি বলেন, ‘আফ্রিকান ইউনিয়নের একটি যুগের অবসান হলো।
এইউর অন্যতম বড় আর্থিক দাতা ছিল লিবিয়া। এইউর বাজেটের ১৫ শতাংশই দিত দেশটি। ’ এখন লিবিয়ার নতুন নেতৃত্ব এইউকে সেভাবে সমর্থন দেবে বলে মনে করেন না স্টুরম্যান। কেননা লিবিয়ায় গাদ্দাফির বিরুদ্ধে ন্যাটোর অভিযানের বিরোধিতা করেছিল এইউ।
স্টুরম্যান বলেন, আফ্রিকার দেশগুলোকে নিয়ে একটি যুক্তরাষ্ট্র গঠনের দৃঢ়সংকল্প ছিল গাদ্দাফির।
কিন্তু সে তুলনায় এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক সমন্বয় প্রতিষ্ঠায় তাঁর কোনো উদ্যোগ ছিল না।
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমাও গত সপ্তাহে একই ধরনের কথা বলেছেন। জুমা বলেন, ‘আফ্রিকার জন্য একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার গঠনে গাদ্দাফি অনেক সময় ব্যয় করেছেন, যা আসলে অসম্ভব। কিন্তু এ নিয়ে তাঁর খুব তাড়া ছিল। সম্ভবত তিনি ওই রাষ্ট্রের প্রধান হতে চেয়েছিলেন।
’
গাদ্দাফি নিজেকে আফ্রিকার ‘রাজাদের রাজা’ দাবি করতেন এবং সে কারণেই আফ্রিকার দেশগুলোতে পশ্চিমা হস্তক্ষেপের তীব্র সমালোচনা ও প্রতিবাদ করতেন তিনি। তাঁর প্রতি পশ্চিমা দেশগুলোর নাখোশ হওয়ার এটা অন্যতম কারণ। এখন গাদ্দাফির মৃত্যুতে সেই জায়গাটি শূন্য হয়ে গেল। আফ্রিকায় পশ্চিমাবিরোধী তীব্র কণ্ঠ আর তেমন রইল না।
মাহমুদ মামদানি নামের একজন বিশ্লেষক আল-জাজিরার ওয়েবসাইটে লিখেছেন, বিশ্ব শক্তিগুলো এখন আফ্রিকা নিয়ে অনেক আগ্রহী।
এই মহাদেশে সম্ভবত আরও আগ্রাসন হতে পারে।
মামদানি লিখেছেন, ‘তিউনিসিয়ায় বেন আলী ও মিসরে হোসনি মোবারকের পতনে আমরা অভ্যন্তরীণ সামাজিক শক্তির বিষয়ে সজাগ হয়েছিলাম। কিন্তু গাদ্দাফির মৃত্যু সেই হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়েছে। এখন অভ্যন্তরীণ শক্তির সঙ্গে বহিঃশক্তিকে যোগ করতে হচ্ছে। ’
অভ্যন্তরীণ শক্তির বিজয় হয়েছে ভেবে যারা আজ উল্লাস করছে এবং বহিঃশক্তির কাছে আমাদের হার হয়েছে বলে যারা এখন শোক করছে, উভয়ের কেউ-ই অস্বীকার করতে পারবে না যে এ দুইয়ের মিশ্রণ ছাড়া ত্রিপোলিতে এ পরিবর্তন সম্ভবত অসম্ভব ছিল।
Source: Prothom Alo
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।