আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এলোমেলো স্মৃতিগুলো

১. চার-পাঁচ বছর বয়স তখন। ছোট বোনটার দুই-তিন। রোজ সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর আমাদের দাঁত মেজে মুখ ধোয়ানোর দায়িত্ব ছিল আব্বার উপর। আমি নিজেই দাঁত মাজতাম। ছোট বোনটা তখনও ভালো পারে না।

আব্বা নিজে ওর দাঁত মেজে দিতেন, কুলি করিয়ে দিতেন। নিজের হাতে পানি নিয়ে ওর মুখে দিয়ে দিতেন। একবার এভাবে কুলি করিয়ে দিচ্ছেন, একবার ওর মুখে পানি দিয়ে আবার হাতে পানি নিয়ে ওর মুখের কাছে নিয়ে আসলেন, কিন্তু বোনটা তখনও মুখের পানি ফেলেনি। যেই না আব্বা হাতটা সামনে এনেছেন ওমনি আব্বার হাতের উপর পুচুৎ করে কুলি করা পানি ফেলে দিল। আব্বা "হুর! এইটা কী করলি?" বলে বকা দিলেন।

আমরা হাসতে হাসতে কুটি কুটি। ২. ছোট ভাইটার বয়স তখন দুই-আড়াই হবে। বাসায় জলপাই আনার পর ওকে এক কামড় খাইয়ে দেয়া হল। টকের চোটে ওর মুখ কুঁচকে গেল। বললাম, কী? টক লাগে? ডানে-বায়ে মাথা নেড়ে জানাল, টক লাগে না।

বললাম, মজা লাগে? এবার উপর-নীচে মাথা দুলিয়ে বোঝাল মজা লাগে। বললাম, আরেকটু খাও তাহলে। এবার আবার ডানে-বায়ে মাথা নাড়ানো, আর খাওয়া যাবে না। ৩. ছোট ভাই তখনও হয়নি। মেজপার সাথে আমরা দুই পিচ্চি বোন হাড়ি-পাতিল খেলতাম।

মূলত মেজপাই সব ঠিক করত, আমরা শুধু তার নির্দেশ মেনে যেতাম। মিথ্যামিথ্যি ঘুম দিয়ে এরপর ঘুম থেকে উঠে মিথ্যামিথ্যি রেডি হতাম অফিসে যাওয়ার জন্য। আর মেজপা ভাত বসাত, তরকারী রান্না করত। কাগজের টুকরা আর পুঁতি দিয়ে এসব রান্না হত। পরে ছোট ভাই হবার পর একই ভাবে তাকে নিয়েও খেলতাম।

ঘুম থেকে ডেকে তোলার দায়িত্ব ছিল তার। সে চোখ কচলে কচলে ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে ডাকত, উই, সোকাআআআআআল হোয়েচে। আমি বলতাম, তুমি কাঁদছ কেন? তখন সে হি হি করে হেসে বলত, উঠ, সকাল হয়েছে। তারপর সে যেত অফিসে, আর আমরা চুলায় ভাত-তরকারী বসাতাম। ৪. সন্ধ্যার পর বিদ্যুৎ চলে গেলে আমাদের লুকালুকি খেলা শুরু হত।

ছোট ভাইটাকে চোর বানাতাম শুরুতেই, বেচারার এই চোর হওয়া আর শেষ হত না। সে এক-দুই-তিন করে বিশ পর্যন্ত গুণতে থাকত। আমরা দুই বোন (আমি আর ছোট বোন) এর মধ্যে লুকিয়ে একটা ডাক দিতাম, কুউউউউউক! সে খুঁজতে চলে আসত। আমাকে যদি প্রথমে খুঁজে বের করত, আমি বলতাম, দেখত আরেকজন কই গেল, তুমি ঐদিকে খুঁজ, আমি আরেক দিকে খুঁজি। সে সরল মনে খুঁজতে যেত, এদিকে আমি আবারও লুকিয়ে পড়তাম আরেক জায়গায়।

এরপর ছোট বোনকে খুঁজে বের করার পর সেও একই কথা বলে আবারও লুকিয়ে পড়ত। আমাদের লুকালুকিও শেষ হত না, ছোট ভাইয়ের চোর হওয়াও শেষ হত না। শেষের দিকে এসে সে কাঁদো কাঁদো হয়ে পড়ত। আমাকে দুই হাতে শক্ত করে ধরে রেখে বলত, তুমি অন্য কোথাও যাবা না, আমার কাছেই থাকবা। এই করতে করতে বিদ্যুৎ চলে আসত, আর খেলাও শেষ হয়ে যেত।

৫. লোড শেডিং-এর কথায় মনে পড়ল, আমাদের আরেকটা খেলা ছিল "বি কুইক"। এটাও শুধুমাত্র লোড শেডিং-এর সময় খেলতাম। সবাই মিলে তালে তালে দুইবার তুড়ি আর দুইবার তালি দিতাম, আর বলতে থাকতাম, বি কুইক - ফলের নাম, বি কুইক - আম। পরের জন বলত, বি কুইক - জাম। এইভাবে একেকজন একেকটা ফলের নাম বলতে থাকতাম।

যে বলতে গিয়ে ভুলে গিয়ে একটু তাল ভেঙে ফেলত, সে আউট। এরপর বাকীরা আবার শুরু করে দিতাম, বি কুইক - ফুলের নাম। এইভাবে দেশের নাম, মাছের নাম, পাখির নাম, পশুর নাম আসবাবপত্রের নাম - চলতেই থাকত যতক্ষণ বিদ্যুৎ না আসে। ৬. একবার পাড়ার কিছু ছেলে-পেলে (কলেজ-ভার্সিটির ছাত্রসমাজ) এক জোট হয়ে একটা কোচিং সেন্টার খুলে বসল। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্র-ছাত্রী জোগাড় করছিল।

আমাদের বাসায় এসেও আম্মাকে ভালোই ভুজুং ভাজুং দিয়ে পটিয়ে ফেলল। আম্মা আমাকে পরদিন থেকে কোচিং-এ পাঠালেন। ক্লাস সিক্সে পড়ি মনে হয় তখন। আমার মোটেই পছন্দ হয়নি। একে তো ওদের আগে পড়ানোর অভিজ্ঞতা নেই, তার উপর কোচিং-এ আমি একমাত্র ছাত্রী ছিলাম, বাকীরা সবাই ছাত্র।

আর যেটুকু পড়ানো হত, ঐটুকু আমি নিজেই বাসায় পড়তে পারি। খুব আহামরি কিছুই ছিল না। দুই-তিন মাস পড়ার পর আমার ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটল। আমি ফাঁকি দেয়ার রাস্তা খুঁজতাম। কোচিং-এর সময় হলেই জোর করে ঘুমিয়ে যেতাম।

একবার তো স্টোররুমে ঢুকে লুকিয়ে ছিলাম। কিন্তু কয়েকদিন পর টিচারগুলো ঝামেলা শুরু করে দিল। আমি না গেলে আমাকে খুঁজতে বাসায় চলে আসত, আর আম্মা ঘাড় ধরে আবার পাঠিয়ে দিতেন। শেষ মেশ আমি বিদ্রোহ ঘোষণা করেই বসলাম। আর এই কোচিং-এ পড়ব না।

আম্মাকে রিপোর্ট কার্ড দেখিয়ে বললাম, এই যে দেখেন, কোচিং-এ পড়ার আগে বরং আমি আরও ভালো মার্কস পেয়েছি, এখন মার্কস কমে গেছে। এই কথায় কাজ হল। কোচিং বন্ধ হল। কিন্তু শেষ দেড় মাসের বেতন দেয়া হয়নি। একদিন তারা দল বেঁধে এসে আব্বার কাছে সেটা বলতেই আব্বা টাকাটা দিয়ে দিলেন।

এর কিছুক্ষণ পর আব্বা একটু হাওয়া খেতে বারান্দায় গিয়ে দেখেন ছেলে-পেলেরা হৈ হুল্লোড় করে কোক খাচ্ছে আর বলছে, দেখলি? বলছিলাম না, গেলেই দিয়া দিবে। আব্বা হাসি চেপে ঘরে এসে আমাদেরকে বললেন কাহিনী। কোন কথা থেকে যে কোন কথায় চলে যাচ্ছি ঠিক নেই। জ্বরের ঘোরে মাথা একটু আউলা হয়ে আছে। আজকে শরীর খারাপ নিয়েও মনটা বেশ ভালো।

পিচ্চিকালের এই কথাগুলো হঠাৎ করে মনে পড়ে গেল। তাই লিখেও ফেললাম। বিরক্তিকর হলে ক্ষমা করে দিবেন। (ছবি কৃতজ্ঞতা: রেজোওয়ানা আপু। ) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।