আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মসলিন এবং হারানো ঐতিহ্য

ভারতবর্ষের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পর ইংরেজ শাসনামলে ভারতবর্ষ সবচেয়ে বড় যে ধাক্কার সম্মুখীন হয়, তা হলো এ দেশের সম্পদ লুণ্ঠন, অপব্যবহার, পাচার ও ঐতিহ্যকে গ্রাস করে ফেলা। আর এ সবের ধারাবাহিকতায় পতনের মুখে পড়ে বিশ্বখ্যাত মসলিন সুতিবস্ত্রও। এই মসলিন নামের রয়েছে এক ঐতিহাসিক পটভূমি। মসলিন নামটি এদেশের দেয়া কোন নাম নয় বা আরবী বা ফারসী শব্দও নয়। এদেশের পণ্যের মান উন্নত হওয়ায় বিভিন্ন সময় বণিকরা ভিন্ন ভিন্ন দেশ থেকে এদেশে এসেছে।

তারই সূত্র ধরে মসলিন নামটি পাওয়া। ইউরোপীয় বণিকরাই এই নাম দেয়। তখন ইউরোপীয়রা ইরাকের একটি প্রাচীন বিপণিবিতান মসুল থেকে বস্ত্র আমদানি করত এবং প্রাচ্যের অপরাপর দেশ থেকে মসুল হয়ে যেসব বস্ত্র আনা হতো তারা তার নাম দিয়েছিল মসলিন। ঢাকার সূক্ষ্ম বস্ত্র দেখে তারা সে বস্ত্রেরও নামকরণ করে মসলিন। যে নামটি আজও অমলিন আছে।

মুঘল আমলে বাংলার রাজধানী ঢাকায় স্থানানত্মরিত হওয়ার পর থেকে মসলিনের খ্যাতি আরও বেড়ে যায় এবং তা দূরদূরানত্মের ক্রেতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সৰম হয়। মসলিন বস্ত্র তখন কেবল বিশ্বব্যাপী বিখ্যাতই হয়নি, সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর বিদেশী কাঁচা ও স্বর্ণ মুদ্রাও অর্জন করে। এছাড়া ঢাকাই মসলিন প্রাদেশিক শাসনকর্তা ও পদস্থ কর্মচারীদের ব্যবহারের জন্য সম্রাট ও অভিজাত শ্রেণীর পৃষ্ঠপোষকতায় সংগ্রহ করা হতো। তখনকার সময় এই সূক্ষ্মতম বস্ত্র এতটাই নমনীয় ছিল যে, একটি মসলিন শাড়ি একটি আংটির ভিতর দিয়ে অনায়াসে চলে যেত। ভাবতে অবাক লাগে কত দৰ হলে এ ধরনের শাড়ি তৈরি সম্ভব।

কারিগররা দীর্ঘ ছয় মাসের কঠোর পরিশ্রমের পর এক প্রস্থ সূক্ষ্ম মসলিন তৈরি করতেন (মলমল মসলিন) নামে। ঢাকার মসলিনের ইতিহাস অনেক পুরনো। আজও মসলিনের চাহিদা এতটুকু কমেনি। সেই সূক্ষ্ম মসলিন আজ হয়তো নেই, কারণ তখনকার ইংল্যান্ডের শিল্প বিপস্নব এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের কারণে মসলিন তাঁতিরা দারম্নণ ৰতিগ্রসত্ম হয় এবং অনেক তাঁত বন্ধ হয়ে যায়। ফলে তাঁতিরা এই শিল্পকে চলমান করতে পারেনি।

এছাড়াও মসলিন তৈরির অন্যতম উপাদান, সুতার উৎস 'ফুটি' তুলা বিলুপ্ত হয়ে যায় এদেশ থেকে। ফলে উন্নত মসলিন তৈরি বন্ধ হয়ে যায়। তারপরও সেই তাঁতির প্রজন্মের কেউ কেউ এখনও পৃথিবী বিখ্যাত মসলিন তৈরি করছে। যা আগের মসলিনের মতো না হলেও এটা নিয়ে এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের আগ্রহের শেষ নেই। ধানম-ির সীমানত্ম স্কয়ারের (পুরনো রাইফেলস স্কয়ার) ক্রে ক্রাফটের দোকানে কয়েক তরম্নণী সালোয়ার কামিজ দেখছিলেন কেনার জন্য।

তাদের মধ্যে একজনের সঙ্গে কথা হয়। কি কাপড় কিনছেন জানতে চাইলে এক বাক্যে বলেন, 'মসলিনের' থ্রি পিচ। একটু সময় নিয়ে জিজ্ঞেস করি। জানতে চাই মসলিন কেন ? তখন ঐ তরম্নণী বলেন, 'মসলিন আমাদের অহঙ্কারের নাম, যেটা অতীতে ছিল এবং বর্তমানেও আছে। তাছাড়া মসলিন কাপড় এত নমনীয় যে শরীর জুড়িয়ে যায়।

' তবে তিনি অভিযোগ করেন, অন্যান্য কাপড়ের থেকে মসলিনের দাম একটু বেশি সে জন্য মসলিন কাপড় সব সময় কেনা হয় না। অন্যান্য কাপড়ের ভিড়ে মসলিন সব সময় পাওয়া যায় না_এমন অভিযোগ করেন অনেক ক্রেতারা। মাসুদ রানা ॥ তবে বাজার ঘুরে দেখা যায়, নগরীর প্রায় সব কয়টি বড় শপিংমলে মসলিনের শাড়ি ও সালোয়ার কামিজ পাওয়া যায়। অতীতের মসলিন কাপড় মলমল, ঝুনা, বঙ্গ, শবনম, আলাবালি, আবি-রাওয়ান নামে পাওয়া যেত, কিন্তু বর্তমানে আমাদের ঢাকাতে টিসু্য মসলিন ও সুতি মসলিন এই দুই ধরনের পাওয়া যায়। দোকানিরা জানান, সুতি মসলিনের চেয়ে টিসু্য মসলিনের চাহিদা অনেক বেশি।

দেখতে সুন্দর ও সূক্ষ্ম বুননের জন্য টিসু্য মসলিন কিনতে আগ্রহী ক্রেতারা। মসলিনের দাম বেশি হওয়ায় সমাজের উচ্চবিত্তের মধ্যে মসলিনের ব্যবহার বেশি দেখা যায়। নিম্নবিত্তের সাধ্যের বাইরে এই সব মসলিন পণ্য। সমাজের সব শ্রেণীর ব্যবহারের মতো করেই দাম নির্ধারণ করা হয় বলে দাবি করলেন 'ঘরের বাইরে' ফ্যাশনের স্বত্বাধিকারী জাকিয়া। তিনি বলেন, 'আমাদের বাজারের মসলিনের সালোয়ার কামিজ ২০০০ থেকে ১২০০০ এবং শাড়ি ৩০০০ থেকে ২৫০০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়।

সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য এই দাম নির্ধারণ করা হয়। তিনি আরও বলেন, সুতার দাম বৃদ্ধি ও তাঁতির সংখ্যা কমে যাওয়ায় মসলিনের দাম একটু বেশি। জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাহিদা অনুযায়ী তাঁতের সংখ্যা তুলনামূলক অনেক কম। সরেজমিনে তাঁতিপাড়ার চিত্র সত্যিই অবাক করে দেয়। বেশিরভাগ তাঁতই বন্ধ হয়ে গেছে।

অনেকেই মনে করেন মসলিন কারিগররা তাদের ন্যায্য মূল্য পান না বলেই এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। নারায়ণগঞ্জের বৃদ্ধ মসলিন কারিগর তাঁতশিল্পী শিপু মলিস্নক বলেন, 'প্রয়োজনীয় সুতা ও সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার অভাবেই মসলিন শিল্প ধ্বংসের মুখে পতিত হচ্ছে। ' সরকারী উদ্যোগের মাধ্যমে তাঁতিদের যোগ্য পারিশ্রমিক দিয়ে এই শিল্পকে আরও উন্নত করা সম্ভব। ইতিহাসের অনেক চড়াৎ-উৎরাই পেরিয়ে ঢাকাই মসলিন বাঙালীর মনে যে জায়গা দখল করে আছে তা অবিশ্বাস্য। আমরা আবেগ প্রবণ জাতি।

তাই মাঝে মাঝে নস্টালজিয়ায় ভুগি অতীতের এই মসলিন ঐতিহ্যকে নিয়ে। আমরা স্বপ্ন দেখি আবার হয়তো মসলিন তার পুরনো ঐতিহ্য ফিরে পাবে। বিশ্বজুড়ে এই দেশের নাম উজ্জ্বল করবে। হয়তো সেদিন খুব বেশি দূরে নেই! ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।