আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঘর ছেড়ে রাজকান্দি - হাম হাম ঝরনার খোঁজে (শেষ পর্ব)

ফটোগ্রাফি, ভ্রমন, সিনেমা, ওয়ার্ডপ্রেস, এবং সব এলোমেলো ভাবনা ঘর ছেড়ে রাজকান্দি - হাম হাম ঝরনার খোঁজে (১ম পর্ব) ঘর ছেড়ে রাজকান্দি - হাম হাম ঝরনার খোঁজে (২য় পর্ব) ঝরনায় পৌঁছে সবাই নাকি ব্যাগ-কাপড় রেখে পানিতে ঝাপিয়ে পড়ে। আমরা ঝাপিয়ে পড়লাম খাবারের উপর। এত পরিশ্রমে সেই ভোরে খাওয়া নাস্তা হজম হয়ে গেছে কোন আমলে। একপাশে একটু বসার জায়গা জোগাড় করে দুই বেলার খাবার একবারেই শেষ করে দিলাম। সর্বোচ্চ পিক থেকে নেমে আসার পরে লিটন ভাইয়ের ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করতে গিয়ে দেখি বোতল নেই।

নিজের হাতে বোতলটা রেখেছি, সেটা গেলো কোথায়, সে এক বিরাট রহস্য! তৃষ্ণায় ঝিরির পানিই খেয়ে নিতাম, তা যত ঘোলাই হোক, কিন্তু এখানে এসে ভাগ্যগুনে একজনের কাছ থেকে পানি পেয়ে গিয়েছিলাম। চারটা দুই লিটারের বোতল নিয়ে সে ঢুকছিল, দৌড়ে গিয়ে দুটো দখল করলাম। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে খাবারের ফেলে দেয়া প্যাকেট, ব্যাগ সব গুছিয়ে মংরার জিম্মায় রেখে আমরা নেমে পড়লাম পানিতে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পানিতে শরীর জুড়িয়ে রীতিমতো শীত লাগছিল। কিন্তু সরাসরি ঝর্নার পানি মাথায় ঢালার সুযোগ পাচ্ছিলাম না।

দাঁড়ানোর জায়গাই নেই। প্রচণ্ড ভীর আর নোংরা পরিবেশে বসে থাকতে ভালো লাগছিল না। ঝরনার চারপাশে রীতিমতো দোকান গজিয়ে উঠেছে। চা খেয়ে উঠে পড়লাম। আমাদের সেই চার সহযাত্রীও ততক্ষণে সেখানে এসে পড়েছে।

বলল, আসতে আসতে জান বের হয়ে গেছে। আর কোনদিন আসবে না, কানে ধরেছে। আমাদের সাথে এক সাথে ফিরতে চাইলো। কিন্তু যেই পথে এসেছি সেদিক দিয়ে না গিয়ে ঝিরির ট্রেইলটা ধরে ফিরবো শুনে আর আমাদের সাথে আসলো না। ঐ পথে নাকি অনেক কাঁদা আর বাজে রাস্তা।

কিন্তু আমরা কিছুতেই শুনলাম না। আমাদের প্ল্যান দু'টো ট্রেইলই দেখা, তা যত কষ্টকরই হোক। তারা বুঝাতে না পেরে হতাশ হয়ে আমাদের সঙ্গ ত্যাগ করলো। শুরু হলো আমাদের ফিরে চলা। ঝিরি ধরে কিছুক্ষণ হেঁটেই আমরা ডানে বাঁক নিয়ে একটা টিলায় উঠতে শুরু করলাম।

বেশ খাড়া টিলা। কিন্তু কারা যেনো সিঁড়ির মতো করে ধাপ কেটে রেখেছে, এবং ধরার জন্য বাঁশও আছে। বেশ কিছুক্ষণ উঠে শুরু হলো নামার পালা। ঢাল বেয়ে নামছি তো নামছি, শেষ হওয়ার নাম নেই। দুই পাশে বাঁশ ধরেও নামতে জান বের হয়ে যাচ্ছিল।

বুঝলাম এই টিলাটার কথাই বিভিন্ন পোষ্টে বলা হয়েছে দড়ি লাগবে পার হতে। বাঁশ না থাকলে কি হতো আল্লাহ্‌ই জানে। ধাপ কেটে বাঁশ যারা লাগিয়েছে তাদের জন্য সশব্দে দোয়া করলাম, আল্লাহ্ এই কাজ যারা করেছে তাদের তুমি স্বশরীরে স্বর্গে নিয়ো। নেমে এসে বোঝা গেলো জনসেবার এ উদ্যোগ নিঃস্বার্থ নয়, বরং সম্পূর্ণই বানিজ্যিক। এ কাজের জন্য দানবাক্স রাখা আছে।

খুশি হয়ে যা দিবেন তাতেই খুশি। তাদের দোকানও আছে। এখানে ঝিরির পানিতে বসে চা খেয়ে কিছুক্ষণ তাদের সাথে গল্প করে ফের চলা শুরু। ঝিরি ধরে কিছুক্ষন গিয়ে একটি পুকুরের মত জায়গা পড়লো। সেটি পেড়িয়ে বাঁক নিয়ে দেখি প্রচণ্ড কাঁদা।

এত ভালো গ্রিপের স্যাণ্ডেলও কোন কাজ করছিল না। কিছুটা জাগয়াতো একদম পিছলে নামলাম, যদিও আছাড় খেতে হয় নি। আসতে আসতে দু'টো প্রশ্ন ক্রমাগত শুনছিলাম যারা এখন যাচ্ছে তাদের কাছে। ঝরনায় পৌঁছতে আর কতক্ষণ সময় লাগবে, এবং আর কোনদিন আসব কিনা। বোঝাই যাচ্ছিল এরা সব চিড়িয়াখানা টাইপ যায়গায় ঘুরতে যাওয়ার ভ্রমনকারী।

না জেনে এখানে চলে এসেছে। ভাবলাম এরা যত না আসবে ততই মঙ্গল। জায়গাটা আরো কিছুদিন রক্ষা পাবে। এরপর আর কোন খারাপ রাস্তা ছিল না। শুধুই ঝিরি ধরে কিংবা ঝিরির পাশ দিয়ে পথ চলা।

সামনে পড়লো দুটো অদ্ভূত আকৃতির গাছ। এদের একটা পুরুষ একটা মেয়ে?? আমাদের কোন তাড়া ছিল না। দু'পাশের দৃশ্য উপভোগ করতে করতে আস্তে ধীরে হাঁটছিলাম। সামনে কতগুলো গরু চড়তে দেখে বোঝা গেলো লোকালয় আর বেশী দূরে নেই অসম্ভব সুন্দর একটা জায়গা। কিন্তু ক্যামেরার অভাবে ধরে রাখা গেলে না।

প্রচণ্ড আফসোস লাগলো আরেক বার। আর কয়েক মিনিট হেঁটেই পৌঁছে গেলাম বনের শেষ মাথায়। বন থেকে বেরিয়ে কলাপাড়ায় এসে দেখা হলো আমাদের সেই চার বন্ধুর সাথে। সাথে সাথে প্রশ্ন কষ্ট কেমন হলো! বললাম, এনজয় করতে করতে আস্তে আস্তে হেঁটে এসেছি। বিশ্বাসই করলো না।

বলল, এত দেরীতে এসেছেন, এখন তো বলবেনই এনজয় করেছেন! আমরাতো আগে এসেছি!! আফসোস লাগলো এদের জন্য। এরকম ২০-২২ বছর বয়সে কথা বলছে কিরকম ৭০ বছর বয়সের বৃদ্ধদের মত। স্থানীয়রাও জানতে চাইল অনেকে, কেমন লাগলো, আবার আসবো কিনা। বললাম, দারুন ভালো লেগেছে, সময় এবং সুযোগ পেলে আরো অনেক বার আসবো ইনশাল্লাহ্! মংড়াকে এখানে টাকা-পয়সা ও সাথে থাকা অতিরিক্ত খাবার-দাবার-পানি সব দিয়ে বিদায় করলাম। ও আমাদের বেশ কিছু জায়গা এগিয়ে দিয়ে বিদায় নিল।

ওকে খুবই ভালো লেগেছিলো। নিতান্তই হত-দরিদ্র মানুষ। কিন্তু খুব সহজ-সরল। আমাদের নিতে ড্রাইভার সুজনকে আসতে বলেছিলাম চারটায়। কিন্তু আমরা অনেক আগেই বের হয়ে চলে এসেছি।

বসে থাকতে ভালো লাগছিলো না। তাই সামনের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। ওর কাছে কোন ফোন নেই যে কই আছে খবর নিব। হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর আসার পর ওর ফোন পেলাম, প্রায় চলে এসেছে। আরো দুই মিনিট পরে তার দেখা পেলাম।

সোজা হানিফ কাউন্টারে এসেই দুটো টিকেট পেয়ে গেলাম, দশ মিনিট পরেই গাড়ী। কোন কিছু খাওয়ারও সময় পেলাম না। সাড়ে এগারটার মধ্যে গাড়ী আমাদের কাকরাইল নামিয়ে দিল। বারোটার মধ্যেই বাসায়। শেষ হলো আমাদের টানা ২৪ ঘণ্টার অভিযান যার প্রতিটা মুহূর্ত আমরা উপভোগ করেছি।

যাওয়ার সময় লিটন ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন লাগলো। বলল, এক কথায় অসাধারন। এখন থেকে সময় পেলেই বেড়াতে যাব। হাসলাম। আমারো তাই ইচ্ছে।

(সমাপ্ত) ============================================ রাজকান্দি ভ্রমনের কয়েকটি তথ্য ও টিপসঃ # শ্রীমঙ্গলের বাস ভাড়া হানিফ/শ্যামলী পরিবহনে ৩০০ টাকা। চেষ্টা করবেন সর্বশেষ বাসে যেতে। ভোর ৪টা নাগাত পৌঁছে যাবেন শ্রীমঙ্গল। # ৬ টার মধ্য সিএনজি নিয়ে বেরিয়ে পড়বেন। ছুটির দিন না হলে ভোর বেলায় স্ট্যাণ্ডেই সিএনজি পেয়ে যাবেন।

দরদাম করে ভাড়া ঠিক করবেন। এরা ট্যুরিস্টদের কাছে অনেক বেশী ভাড়া চায়। আমরা ঠিক করেছিলাম এক হাজার টাকায়। এটা নিয়ে যাওয়া এবং ফেরত নিয়ে আসার ভাড়া। # আগে থেকে গাইড ঠিক করার কোন প্রয়োজন নেই, এবং এদেরকে কোন কিছু এ্যারেঞ্জ করতে দেয়ারও দরকার নেই।

শুধু শুধু টাকা নষ্ট হবে। শ্রীমঙ্গল এসে নিজেরাই সব ঠিকঠাক করে নিতে পারবেন। # শ্রীমঙ্গল থেকে দুপুরের খাবার-দাবার নিয়ে যাবেন। # কলাপাড়ায় সিএনজি যেখানে নামিয়ে দিবে, সেখান থেকে একটু এগিয়ে বাজারে গিয়ে স্থানীয়দের মধ্য থেকে একজনকে গাইড হিসেবে নিয়ে নিবেন। এরা সাধারনত ৩০০ টাকা করে নেয়।

এটাই স্ট্যাণ্ডার্ড। পথে কুরমায় এসে অনেকে গাইড নেয়ার কথা বলবে। তারা টাকা একটু বেশী নিবে। # পর্যাপ্ত পানি এবং খাবার স্যালাইন নিয়ে নিবেন। পথে প্রচুর ঘাম ঝরবে।

স্যালাইন পানিশূণ্যতা রোধে কাজে দিবে। এগুলো বনে ঢোকার মুখেই পাওয়া যাবে। # ভালো গ্রীপ ও বেল্ট সহ প্লাস্টিকের স্যাণ্ডেল নিয়ে যাবেন। ঝিরিপথ এবং কাঁদায় হাঁটতে অনেক সাহায্য হবে। # কষ্ট করার ইচ্ছা না থাকলে যাবেন না, আর দয়া করে জায়গাটা নোংরা করবেন না।

খাবার-দাবারের প‌্যাকেট, বোতল ইত্যাদি সঙ্গে করে নিয়ে আসবেন, বনে কোথাও ফেলে আসবেন না। আপনাদের ভ্রমন শুভ হোক! শুভ কামনা! ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।