আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

‘আটচল্লিশ ঘণ্টা’

লেখা এই সময়কালটার ভেতর কেমন যেন একটা সম্মোহনী ক্ষমতা আছে। তাই না? না চাইলেও কেমন যেন একটা উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয়। ‘দেখি কি হয়?’ ধাঁচের একটা প্রত্যাশা নিজে থেকেই গজিয়ে ওঠে। ‘পারবে?’ না ‘পারবে না’ এমন দুটো দল ও তৈরি হয়ে যায়। হয়তো দুটো দলের ভেতর বাজি ধরার ঘটনাও ঘটে।

কথাটা অনেকেই বলেন। এমন আল্টিমেটাম অনেকেই দেন। গনক, রাজনীতিবিদ, কলামিস্ট, চিকিৎসক। গুরুতর রুগী নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন, ডাক্তার সাহেব পরীক্ষা করে দেখলেন। গুরুগম্ভীর মুখ করে বললেন, অবস্থা বেশ সিরিয়াস, ‘আটচল্লিশ ঘণ্টা না পেরোলে কিছু বলা যাবে না।

‘ কিংবা গনক সাহেব হাত দেখে বললেন, ‘এই পাথরের আংটি পড়লে আটচল্লিশ ঘণ্টার ভেতর শনির দশা কেটে যাবে। ‘ সবসময় এমন আল্টিমেটাম দেয়া হয়, এমনটি কিন্তু না। কখনও চব্বিশ ঘণ্টা কখনও বাহাত্তর ঘণ্টা। চব্বিশ ঘণ্টার দুটো মানে। একটা মানে, খুব বেশী সিরিয়াস না।

হয়তো এখনই সেরে যাবে, তারপরও ডাক্তার সাহেব হাতে একটু সময় রাখতে চাইছেন। আবার এমনও হতে পারে যা অঘটন হওয়ার খুব দ্রুতই হবে। আসলে চব্বিশ ঘণ্টার আল্টিমেটামে দোদুল্যমানতা খুব কম থাকে। রুগী বেশী খারাপ থাকলে রুগীর স্বজনরা ধরেই নেন আশা কম। ভালো থাকলে ধরে নেন ফর্মালিটির জন্য বলছেন।

একটু সেফ সাইডে থাকার জন্য। ওদিকে বাহাত্তর ঘণ্টা সময়টা যদিও একটু লম্বা হয়ে যায় তারপরও সবাই ধরে নেন তাঁর আগেই কিছু একটা ফয়সালা হয়ে যাবে। অজ্ঞান রুগীর জ্ঞান না ফিরলেও হয়তো একটু নড়াচড়া করবে কিংবা চিমটি দিলে হাত সরিয়ে নিতে চাইবে। উল্টোটাও হতে পারে। ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যেতে পারে।

এই আল্টিমেটামে ও আশা নিরাশার খেলা আছে তবে কেমন যেন সম্মোহনী ক্ষমতা নেই। অনেকটা ‘দেখি কি হয়। ’ ধাঁচের আশ্বাস বানীর মত। ‘আল্লাহ আল্লাহ করেন। ‘ কিংবা ‘হায়াত মউত আল্লাহ্‌র হাতে’ এই ধরনের কথায় যেমন একজন ডাক্তারের অসামর্থ্য প্রকাশ পায় অনেকটা তেমন ই।

হয়তো ডাক্তারকে আলাদা করে ডেকে জিজ্ঞেস করা হয়, ‘ঠিক করে বলেন, কোন আশা আছে?’ তবে আটচল্লিশ ঘণ্টার একটা আলাদা মোহ আছে। প্রত্যাশা আর হতাশা প্রায় সমান সমান। ‘বেশী খারাপ হলে তো বলেই দিত’ এমন কিছু যুক্তি দাঁড় করিয়ে সবাই আশায় বুক বাঁধেন। ‘এই সময়ের ভেতর ইম্প্রুফ না করলে আশা কম’ এমনটা ভেবে অনেকেই উন্নতির লক্ষণ খোঁজেন। নিঃশ্বাস ঘন ঘন নিচ্ছে কি না, হাত পা নাড়ছে কি না, চোখ মেলে তাকাচ্ছে কি না।

উৎকণ্ঠা আর প্রত্যাশার দারুণ এক কম্বিনেশান। ইদানীং আটচল্লিশ ঘণ্টার আরও একটা ভারসান বেড়িয়েছে। ‘কিছুই হবে না ভারসান’। ‘আটচল্লিশ ঘণ্টার ভেতর অপরাধী ধরা পরবে’ এমনটা প্রথম যেদিন বলা হয়েছিল, সম্মোহনী ব্যাপারটা কাজ করেছিল। মনে হয়েছিল সত্যিই হয়তো কিছু একটা হতে যাচ্ছে।

কিছু করার না থাকলে হয়তো বলতো ‘আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি’ কিংবা ‘খুনি যেই হোক তাঁকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো হবে’। হয়তো বলা হত, ‘আইন তাঁর নিজস্ব গতিতে চলবে’। এমন কিছু না বলে যখন রীতিমত একটা আল্টিমেটাম দিল। এর মানে তারা খুনির হদিস পেয়ে গেছেন। কেবল ফর্মালিটির জন্য কিংবা একটু সাসপেন্স তৈরির জন্য সময় নিচ্ছেন।

দারুণ প্রত্যাশা জাগিয়েছিল সেই আল্টিমেটাম। অবশেষে পার হল সেই সময়। বোঝা গেল এই ‘আটচল্লিশ ঘণ্টা’ নতুন জাতের আটচল্লিশ ঘণ্টা। এটা সময়ক্ষেপণের একটা নতুন ফর্মুলা। আবেগ আর উচ্ছাস থামানোর নতুন আইডিয়া।

বেশ কাজে দিল। ঠিক আটচল্লিশ ঘণ্টা আগের উচ্ছাস আর থাকলো না। খুনিদের ধরার জন্য সরকারের ওপর চাপ দেয়ার যে একতা ছিল তা অনেকটাই কমে আসলো। এর মাঝে আরও অনেক ঘটনা ঘটায় আটচল্লিশ ঘণ্টা আগে দেয়া আল্টিমেটাম নিয়ে খুব বেশী জেরার মুখে পড়তে হল না মন্ত্রীকে। এরপর যথারীতি রুটিন আন্দোলন হয়ে গেল ব্যাপারটা।

মাঝে মাঝে মানব বন্ধন, স্মারক লিপি, প্রেস ব্রিফিং। তবে শুরু হয়ে গেল নতুন এক ধারা—‘আটচল্ললিশ ঘণ্টা’ র নতুন এক ব্যবহার। সম্প্রতি বিরোধীদলীয় নেত্রী হুঙ্কার দিয়েছিলেন। ‘আটচল্লিশ ঘণ্টার আল্টিমেটাম’। প্রথমটায় একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল সবাই।

এতদিন ধরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন করছেন। হরতাল, মানব বন্ধন, জনসংযোগ, লং মার্চ যত জাতের আন্দোলন হয় আর কি। মিছিলের নতুন নাম দেয়া হল, ‘গন মিছিল’, সভা’র নতুন ভারসান আসলো ‘পথসভা’। বিভিন্ন আঙ্গিকে, নতুন নামে পুরনো আন্দোলনের ফরম্যাট গুলো দিয়েই কার্যক্রম টেনে হিঁচড়ে এগোনোর চেষ্টা হল। কোনদিন ভালো রেসপন্স তো আবার কোনদিন ফ্লপ।

ওদিকে সরকারের হার্ড লাইন অ্যাকশান। এমনকি মহাসচিবকেও কথায় কথায় এরেস্ট করতে পিছপা হচ্ছে না। হরতাল ডেকে ককটেল ফাটানো আর গাড়ী পোড়ানো ছাড়া বিরোধীদল তেমন কোন কাজ জানে বলে মনে হল না। প্রেস ব্রিফিং গুলোও দায়সারা গোছের। ভারত ভ্রমণ আর সিঙ্গাপুরের চিকিৎসাও তেমন কোন নতুনত্ব আনল না।

বরং বিরোধী আন্দোলনে নতুন মাত্রা এনে দিল ‘হেফাজতী’ রা। তাঁদের বিশাল সমাবেশে মৃদু আশার আলো দেখতে পেল। ‘নৈতিক সমর্থন’ দিয়ে শুরু করে ‘পাশে দাঁড়ানো’ পর্যন্ত এগুলো। বিশাল এই সমাবেশ অবস্থানে রূপ নিলে এই সরকারকে নড়বড়ে করে দিতে মৃদু একটা টোকা ই যথেষ্ট ভেবে দিয়ে ফেললেন ‘আল্টিমেটাম’। বিরোধীদলের ওপরে না হলেও হেফাজতীদের ওপর অনেকটা আস্থা জন্মে গিয়েছিল দেশবাসীর।

বুঝেই হোক আর না বুঝেই হোক বিশাল এক বাহিনী হুজুরের নির্দেশ এসে হাজির হচ্ছে এই সব সমাবেশে। যুক্তির কোন কথা শুনতে তাঁরা নারাজ। এক গুয়ার্তুমি ‘তের দফা’। এতে কি আছে, তা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলবে কি না, তা না বুঝেই সমর্থন দিয়ে দিল বিরোধীদল। হয়তো মনে আশা, আগে সরকার পতন হউক পরে দেখা যাবে।

আল্টিমেটাম কেও তাই দেশবাসী বেশ গুরুত্ত্বের সঙ্গেই নিয়েছিল। ‘কিছু একটা এবার হবে’ এমন প্রত্যাশা নিয়ে অনেকেই অপেক্ষায় ছিল। এরপর এলো রোববারের রাত। হেফাজতীদের হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাই বুঝে গিয়েছিল সেই আল্টিমেটামের কি পরিণতি হতে যাচ্ছে। আপোষহীন নেত্রীর যে ইমেজ তাঁর ছিল, সেখানে বিশাল এক ক্ষত তৈরি হল।

জলিল সাহবের ট্রাম্প কার্ড মতই এক হাস্যকর পরিণতি হল। সবচেয়ে বড় কথা রাজনীতিবিদ দের দেয়া আটচল্লিশ ঘণ্টার আল্টিমেটাম একটা সুন্দর সেপ পেল। এখন রাজনীতিবিদরা কোন আল্টিমেটাম দিলে, বিশেষকরে ‘আটচল্লিশ ঘণ্টা’ শব্দ দুটো ব্যবহার করলে পরিণতি আঁচ করতে এখন আর কোন সমস্যা হবে না। উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষাও করতে হবে না। সবাই বুঝে নিবে এই আল্টিমেটামের নিশ্চিত পরিণতি ‘কিছুই হবে না।

‘ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।