আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একিলিস হীল (আমার মেডিকেল কলেজ জীবন-৫)

“আমি নিরালায় একা খুজেঁ ফিরি তারে, ‍স্বপ্নবিলাসী, কল্পনাপ্রবণ আমার আমিরে.........” গ্রীক মিথোলজীতে আছে একিলিসের জন্মের পর একিলিসের মা থেটিস তার ছেলের অমরত্বের জন্য তাকে styx নদীতে ডুবাতে থাকে, শুধুমাত্র পায়ের হীল ছাড়া, যে অংশটুকু ধরে থেটিস তাকে ডুবাচ্ছিল। যে কারণে একিলিসের হীল ছিল তার শরীরের একমাত্র দুর্বল জায়গা। সে থেকে মানুষের দুর্বলতার স্থানকে সেটা মানসিক হোক বা শারীরিক, বলা হতো ‘একিলিস হীল’। আমাদের এক মাস পূর্তি অনুস্ঠানের দিন একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটলো। আমাদের ব্যাচের প্রথম জুটি হয়ে গেলো, তাও আবার আমার রুমমেট ফয়েজ! আমি জানতামই না।

অ্যাফেয়ার হওয়াটাকে আমরা বলতাম উইকেট ভাঙ্গা। ফয়েজের উইকেট কিভাবে ভাঙ্গলো সেটা আমি কখনই জানিনি, তবে জানতাম সে ক্যাম্পাসে আসার প্রথম দিন থেকেই বলে আসছিল লিমাকে পছন্দ করে। লিমার রুমমেট ছিলো ত্বন্নী। ফয়েজকে দেখা যেতো ত্বন্নীর সাথে ঘুরতে, আমরা জানতাম ত্বন্নীকে দিয়ে সে লিমাকে রাজী করাচ্ছে। শেষে জানতে পারলাম লিমা ছিল ডাইভারশন! কিন্তু আমরা ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা সবসময় বলে এসেছি লিমা ছিল ফয়েজের ‘একিলিস হীল’! মৌরিনের প্রতি দুর্বলতাকে খুব একটা প্রশ্রয় দিতে পারছিলাম না, পুরোদমে ক্লাস শুরু হয়ে যাবার জন্য।

প্রায় প্রতিদিনই আমাদের আইটেম থাকতো। লেকচারার স্যারদের মধ্যে আমরা ভয় পেতাম মুশফিক স্যারকে। আমাদের এনাটমি ডিসেকশন নিতেন, আইটেমগুলো তাঁর কাছেই দিতাম। সারারাত পড়ে গিয়ে পরদিন সকালে আইটেম দিতে গেলে কিছুক্ষন পর স্যার বলতেন, ‘পড়া হয়নি, আবার দিবে’। এটার একটা নাম ছিলো ‘Reappear’।

মুশফিক স্যারের কাছে কতবার Reappear দিয়েছিলাম, হিসাব নেই। আমরা কয়েকজন স্যারের একিলিস হীল খুঁজে বেড়াতাম, কখনই পেতাম না। এনাটমীর প্রফেসর ছিলেন হাই ফকির স্যার, চরম জাদরেল স্বভাবের। দূর থেকে তাঁকে দেখতে পেলেই আমরা সটকে পড়তাম। তাঁর সম্পর্কে একটি কাহিনী প্রচলিত ছিল।

তিনি যখন সিলেট মেডিকেল কলেজের প্রফেসর ছিলেন একজন ছাত্র এনাটমী পরীক্ষায় পাস করতে পারছিলো না। একদিন সে ছাত্র পিস্তল নিয়ে স্যারকে হুমকি দিতে গিয়েছিলো, স্যার ছেলেটার কম্পিত হাত থেকে পিস্তলটি কেড়ে নিয়ে পাল্টা হুমকি দিয়েছিলেন। এই ছিলেন হাই ফকির স্যার। কিন্তু উনার একিলিস হীল খুঁজে পেতে আমাদের খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। স্যার মেয়েদেরকে খুব পছন্দ করতেন, বিশেষ করে সুন্দরী মেয়েদের।

তাই স্যারের কাছে আমাদের কোনো প্রয়োজন থাকলে সুন্দরী মেয়েদেরকে আমরা আগে পাঠাতাম, আমাদের কাজ হয়ে যেতো। (এই লেখাতে হাই ফকির স্যারের প্রতি আমার শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি উনার যে মমত্ববোধ ছিলো সেটা আর কোথাও পাই নি। ) আমার তখন কোনো মোবাইল ফোন ছিল না। পুরো এলাকাতে একটি মাত্র ফোনের দোকান ছিল, ‘মা ফোন’, গ্রামীনের পল্লী ফোন।

ফোন বিল ছিলো প্রতি মিনিটে বিশ টাকা। দেশের বাইরেতো আরো বেশী। আম্মু তখন চিকিৎসার জন্য লন্ডনে ছিলেন, আমার ফোন বিল প্রচুর হতো। তাই ঠিক করেছিলাম ফোন না করে চিঠি লিখবো। আমার জীবনে চিঠি লেখার তখনই শুরু।

এরই মধ্যে একদিন হোস্টেলের কমনরুমে দেখানো হলো সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত হিন্দী ছবি ‘তাল’। তাল দেখে নিজেরই বেতাল হবার দশা। ববিকে জিজ্ঞেস করলাম মৌরিনের খবর কতদূর। উত্তর এলো, ‘কাজ হচ্ছে, একটু সময় লাগবে। সবুরে মেওয়া ফলে’।

আমি সবুর করতে লাগলাম। মেরিনার সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে খুব বেশীদিন সময় লাগেনি। সে বুঝতে পেরেছিলো পুরো ব্যাপারটা। আসলে আমাদের সাথে যে তিনজন নেপালী মেয়ে ছিলো তারা প্রত্যেকেই খুব সমঝদার ছিলো, ছিলো প্রচন্ড রকমের মিশুক। পুজা লামা সবসময় দেখা হলে বলতো কাউকে পছন্দ হয়েছে কি না।

অনেকবার ভেবেছি ওদেরকে বলবো। অধিক সন্যাসীতে গাঁজন নষ্ট-চিন্তা করে আর বলা হয়নি। ক্লাসে আমার পরে যার রোল নম্বর ছিলো তার নাম রাসেল। ওর বাবার চাকরিসূত্রে সে কয়েক বছর ইরানে ছিলো। দেশে এসে ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হয়েছিলো।

সেখান থেকে মেডিকেলে। রাসেল ছিলো আমাদের ব্যাচের সবচেয়ে খাটো ছেলে। একদিন শুনি পূজা ওকে ‘ফিস্টু’ বলে ডাকছে। পরে জানতে পারলাম, নেপালের সবচেয়ে ছোট পাখির নাম ফিস্টু। এরপর থেকে রাসেলের নাম ফিস্টু হয়ে গেলো, এমনকি আমাদের অভিভাবকরাও ওকে রাসেল নামে চিনতো না, চিনতো ফিস্টু নামে।

সেই ফিস্টু ক্লাসের সবচেয়ে লম্বা মেয়েটাকে বুকিং দিলো, নাম স্নিগ্ধা। স্নিগ্ধা ছিলো প্রচন্ড জেদী মেয়ে, একটু পাগলাটে ধরনের। প্রেম কাকে বলে জানে না। একদিন আমি, ফিস্টু আর মাসুদ ভৈরবে গিয়েছিলাম। সেখানে নদীর পাড়ে কতগুলো মাঝারী সাইজের পাথর দেখে কি মনে হলো, নিয়ে আসলাম।

ক্যাম্পাসে এসে পাথরের সাথে গোলাপ ফুল কসটেপ দিয়ে লাগিয়ে রাতের বেলা স্নিগ্ধার রুমে আমি আর ফিস্টু পাঠালাম, আর একটা কাগজে লিখলাম, ‘পাথরে ফোটাবো ফুল...’। ভাগ্যিস, আমরা রাতে পাঠিয়েছিলাম অন্য কাউকে দিয়ে, সরাসরি দিলে পাথরগুলো যে আমাদের মাথার উপর এসে পড়তো সে ব্যাপারে আমাদের কারো কোনো দ্বিমত ছিলো না। টানা দুইদিন ভয়েই আমরা স্নিগ্ধার সামনে যাই নি। অবশেষে এলো সেই দিন। ববি বললো আমার সাথে গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।

‘তোর না কি ঢাকায় একটা অ্যাফেয়ার ছিলো? মেডিকেলে ভর্তি হবার সময় ভেঙ্গে গেছে? মৌরিন এটা শুনেছে, তোর ব্যাপারে ও আর রাজি হবে না। বরঞ্চ আমি এখন দেখতে পারি, কি বলিস?’ ববির শেষ দিকের কথা আমি আর ভালোভাবে শুনতে পারছিলাম না, শুধু বুঝতে পারছিলাম এতদিন সময় নিয়ে ববি আমার ‘একিলিস হীল’ খুঁজে পেয়েছে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।