বাংলাদেশের অস্তিত্বেই তাঁর অবিশ্বাস। সেটা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও জারি রেখেছেন তিনি। পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন যুক্তরাজ্য থেকে মধ্যপ্রাচ্য। চালিয়েছেন বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় বাঙালি নিধনে পাকিস্তানি সেনাদের দলগতভাবে সার্বিক সহযোগিতা করেছিলেন।
তিনি গোলাম আযম, বাংলাদেশের ‘মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা ও গণহত্যার প্রতীক’।
মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যায় ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা, উসকানি, সহযোগিতা ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃত্বে থেকে করা অপরাধের দায়ে গত সোমবার ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। এসব অপরাধের দায়ে গোলাম আযমের প্রাপ্য ছিল মৃত্যুদণ্ড। ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, বয়স ও শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে তাঁকে প্রশমিত সাজা দেওয়া হয়েছে। ২৪৩ পৃষ্ঠার ওই পূর্ণাঙ্গ রায়ের পরতে পরতে অখণ্ড পাকিস্তানের প্রতি গোলাম আযমের আত্মনিবেদন ও স্বাধীন বাংলাদেশের চরম বিরোধিতার দালিলিক প্রমাণ উপস্থাপিত হয়।
রায়ে দেখা যায়, ১৯৫৪ সালে জামায়াতে যোগ দেওয়ার পর ১৯৬৯ সালে গোলাম আযম তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমির হন। মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তান রক্ষার নাম দিয়ে শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস প্রভৃতি আধা সামরিক বাহিনীর স্থপতি ছিলেন তিনি। এই ঊর্ধ্বতন নেতার অধীন এসব আধা সামরিক বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস বর্বরোচিতভাবে বাঙালি নিধনে সরাসরি অংশ নিয়েছে। পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতা করেছে। তবে বাংলাদেশের বিজয়ের ক্ষণ যখন ঘনিয়ে আসছিল, তখন একাত্তরের ২২ নভেম্বর তিনি তখনকার পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান।
রক্তঝরা যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করলেও এ দেশকে পূর্ব পাকিস্তানরূপে ফিরে পাওয়ার আশা ছাড়েননি গোলাম আযম। রায়ে বলা হয়েছে, ১৯৭২ সালের প্রথম দিকে গোলাম আযম ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি’ গঠন করেন। ১৯৭৩ সালের মার্চ পর্যন্ত তিনি মধ্যপ্রাচ্য ও ইসলামিক দেশগুলোতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করেন, স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালান।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশ কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত একাত্তরের ঘাতক জামায়াতে ইসলামীর অতীত ও বর্তমান বইয়ে বলা হয়েছে, ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের সব রাজনৈতিক দলের কাছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে মতামত চান। এ উপলক্ষে সে দেশের জামায়াতের মজলিসে শুরার বৈঠক হয়।
মাওলানা আবদুর রহিম ও চৌধুরী রহমতে এলাহী—এই দুজন নেতা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে মত দেন। কিন্তু বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় জন্ম নেওয়া গোলাম আযম স্বীকৃতিদানের বিরোধিতা করেন।
ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলেন, ১৯৭৩ সালের ১৮ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার গোলাম আযমের নাগরিকত্ব বাতিল করে। ওই বছরের মাঝামাঝি তিনি পাকিস্তান থেকে লন্ডনে গিয়ে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটির কার্যালয় স্থাপন করেন। সেখানে সোনার বাংলা নামে একটি পত্রিকাও চালু করেন, যাতে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা চালানো হতো।
১৯৭৫ সালের মার্চে তিনি সৌদি আরব গিয়ে বাদশাহ ফয়সালের সঙ্গে দেখা করেন এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালান।
একাত্তরের ঘাতক জামায়াতে ইসলামীর অতীত ও বর্তমান বইয়ে বলা হয়েছে, ১৯৭৪ সালের প্রথম দিকে পূর্ব লন্ডনের একটি বাড়িতে এক বৈঠকে গোলাম আযম বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতার নীলনকশা পেশ করেন। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, বাংলাদেশে ইসলামী বিপ্লবের ডাক দিয়ে প্রচারপত্র বিলি করতে হবে। এ ছাড়া ‘ডকুমেন্টেশন সেন্টার’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও তিনি বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা চালান। ১৯৭৮ সালের ১১ আগস্ট রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সরকারের আমলে তিন মাসের ভিসায় পাকিস্তানি পাসপোর্টে বাংলাদেশে ঢোকেন গোলাম আযম।
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণে গোলাম আযম দুঃখ প্রকাশ করেছেন এভাবে—‘উপমহাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম হিন্দু ও শিখ বাহিনীর নিকট প্রায় এক লাখ সশস্ত্র বাহিনী আত্মসমর্পণ করল। হাজার বছরের ইতিহাসে এত বড় ঘটনা কখনো ঘটেনি। ’ মাসিক উর্দু ডাইজেস্ট-এর সম্পাদক আলতাফ হোসাইন কুরাইশিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন।
গোলাম আযমের বিরুদ্ধে রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধকালে বাঙালি নিধনযজ্ঞ এতটাই ভয়াবহ ছিল যে খোদ পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তারাই এটা অস্বীকার করতে পারেন না। পাকিস্তানি মেজর জেনারেল তোজাম্মল হোসেন মালিক পাকিস্তান ডিফেন্স জার্নালে এক লেখায় লিখেছেন, বাঙালি নিধনের জন্য জেনারেল টিক্কা খান ও লে. জেনারেল জাহানজেব আরবাব ‘পূর্ব পাকিস্তানের কসাই’ হিসেবে পরিচিতি পান।
অথচ জেনেশুনে সেই টিক্কা খানের সঙ্গে হাত মেলান গোলাম আযম। একাত্তরের ৪ এপ্রিল তিনি সমমনা নেতাদের নিয়ে টিক্কা খানের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন। ট্রাইব্যুনালের পর্যবেক্ষণ, বিশ্বের কোনো বিবেকমান মানুষ হত্যাকারী বাহিনীর প্রশংসা করতে পারে না। কিন্তু গোলাম আযম উদ্দেশ্যমূলকভাবে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযোগীদের প্রশংসা করে সভা-সমাবেশ করে বক্তব্য দিয়েছেন, বিবৃতি দিয়েছেন।
বাংলাদেশে ফিরে সেই গোলাম আযম আবার ঝাঁপিয়ে পড়েন স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতকে সংগঠিত করার কাজে।
একাত্তরের ঘাতক জামায়াতে ইসলামীর অতীত ও বর্তমান বইয়ে বলা হয়, ১৯৮১ সালে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির আব্বাস আলী খান সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘একাত্তরে আমরা ভুল করিনি। ’ আর গোলাম আযম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘একাত্তরে যা ঠিক মনে করেছি তা-ই করেছি, এখনো তা-ই করব। ’
গোলাম আযম স্বাধীনতার ৪২ বছর পর বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাঁকে অনুকম্পা দেখিয়েছেন। মৃত্যুদণ্ডের অপরাধ করে তিনি ৯০ বছরের সাজা পেয়েছেন, পুরো জীবনকাল বেঁচে থাকার সুযোগ পেয়েছেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।