আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অবিশ্বাসীর দিনলিপি-১: সদা পরিবর্তনশীল জ্ঞান ও ধর্ম।

চলতাছে আরকি

ধর্ম নিয়ে কিছু লিখতে চাইনা ইদানিং। কিন্তু ধর্মীয় প্রোপাগান্ডা মেশিন থেমে নেই, কখনও ছিলনা। একই পুরোনো জিনিস ঘুরেফিরে তারা সামনে নিয়ে আসে। বার বার নাক গলায় বিজ্ঞান, বিবর্তনবাদ, নৈতিকতা এসব বিষয়ে। এসব নিয়ে ঘুরে ফিরে বহুরকমের আলোচনা হতেই থাকে।

ভাবলাম পুরোনো জিনিস হলেও এ ধরনের আলোচনা বন্ধ হয়ে যাওয়াটা ঠিক হবেনা। কারন ধর্মীয় মধ্যযুগ পার করে আমরা যুক্তিবাদের আধুনিক যুগে প্রবেশ করেছি। কাজেই আবার লিখতে হচ্ছে--- জ্ঞান অর্জিত হয় বিভিন্ন ধারণা বা ঘটনার দ্বন্দ্বে। ধরুন কেউ বলল পৃথিবী পানির তৈরি। সাথে সাথে অন্যরা বলবে কিভাবে? আগুন তো পানির সাথে মিলেনা, তাহলে? আবার নতুন করে উত্তর খোঁজা।

এবার হয়ত সিদ্বান্ত হল পৃথিবী আগুন ও পানির তৈরি। কিন্তু আরেকজন বলল যে তাহলে বায়ুর ভুমিকা কী? এভাবেই বিভিন্ন মতবাদকে প্রশ্ন করে, নতুন ভাবে বিশ্লেষণ করে নতুন নতুন জ্ঞান তৈরি হয়, আগের জ্ঞান বাতিল হয়। ধরুন কেউ একজন দেখল যে তাপ দিলে লোহা আয়তনে বাড়ে। আবার তামা, রুপা এগুলোও তাপ দিলে আয়তনে বাড়ে। সেখান থেকে একটা জেনারেলাইজশনে আসা যেতে পারে যে, ধাতু তাপ দিলে আয়তনে বাড়ে।

এভাবে অবজারবেশন, চ্যালেঞ্জ, প্রশ্ন করে করে নতুন জ্ঞনের সুচনা হয় অবরোহ পদ্ধতিতে। আবার কোন জ্ঞান বা ধারণা পুরোনো হয়ে যেতে পারে। যেমন ধরুন একসময় মনে করা হত, পৃথিবী সমতল ও সৌরজগতের কেন্দ্র। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে দেখা গেল এই ধারণাটি ঠিক নয়। তাই বলে আমরা টলেমিকে মুর্খ বলতে পারিনা।

তার সময়ের জ্ঞানের বিস্তার বা গবেষণার মাণ অই পর্যন্তই ছিল। কিন্তু আমরা যদি টলেমির সেই সমতল বিশ্বের ধারণা নিয়ে বসে থাকতাম তাহলে কি হত? মানুষ সেই ধারণা নিয়ে বসে থাকেনি, বরং তাকে প্রশন করেছে, নতুন উত্তর বার করেছে। সেই ধারনা পরিবর্তন করতে প্রায় দেড় হাজার বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। এমনকি গোলাকার পৃথিবী ও সৌরকেন্দ্রিক মডেলের প্রবক্তাদের সহ্য করতে হয়েছে নির্যাতন ও মৃত্যু। জিওদার্নো ব্রুনো, গ্যালিলিও এদের কথা তো আমরা জানি।

আজকের দিনে যা আমরা জানি তাই যে অনন্তকাল চলবে তাও ঠিক না। ভবিষ্যতে এ নিয়ে আরো নতুন নতুন আইডিয়া আসবে। আজকের অনেক কিছুই বাতিল হবে, নতুন কিছু যোগ হবে। এবং এই প্রক্রিয়া নিরন্তর। জ্ঞানান্বেষীরা, বিজ্ঞানীরা সেটা নিরন্তর করে চলেছেন।

নিজের অর্জন বা ধারণাকে তারা নিজেরাই প্রশ্ন করে চলেছেন। বিখ্যাত আস্ট্রো ফিজিসিস্ট লরেন্স ক্রাউস বলেন- Science loves mysteries. It loves not-knowing. That is the key part of science—lawrence krauss. এই বিষয়টা শুধু বিজ্ঞান নয়, সব কিছুর ক্ষেত্রেই সত্যি। দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্য, সমাজ ব্যবস্থা, ধর্ম—সব কিছুর ক্ষেত্রে। আমি চুড়ান্তভাবে কোন সত্য জেনে গেলে সেখানে আর নতুন কিছু কিই বা জানার থাকতে পারে? পৃথিবী গোলাকার- এই সত্য যখন আমরা জেনে যাই তখন সেখানে আর নতুন করে কি জানার আছে? কিন্তু ধর্ম দাবী করে সে জীবনের মৌলিক প্রশ্নগুলোর উত্তর জানে। আমরা কোথা থেকে এলাম, কোথায় যাব, কি আমাদের উদ্দেশ্য- এসব মৌলিক প্রশ্ন গুলোর উত্তর জানে বলে ধর্ম দাবী করে।

ধর্ম জেনে গেছে যে আমরা স্রস্টা কতৃক সৃষ্ট। সেখান থেকেই আমাদের, পৃথিবীর উতপত্তি। আবার মৃত্যুর পরে আমরা স্বর্গে বা নরকে যাব। ধর্ম এই বিষয়গুলো শুধু যে জেনে গেছে দাবি করে তা না বরং সুচারু রুপে জানে কি হবে। যেমন স্বর্গে কয়টা হুর পাওয়া যাবে, কি ধরনের খাবার থাকবে, নরকের কয়টা ভাগ, কবরের ভেতরে কি ঘটবে, কি কি প্রশ্ন করা হবে – এ সমস্ত কিছু এত নিশ্চিত ভাবে জানে বলে দাবী করে যে তা এক কথায় আশ্চর্য।

এই নিশ্চয়তা, এমন মৌলিক জ্ঞান- এসব ধর্মের কাছে নিশ্চিত। কিন্তু তাহলে এখনো কেন আমরা আমাদের অরিজিনের প্রশ্ন খুজে বেড়াচ্ছি? এসব সত্যি হলেত এধরনের খোজাখুজি বাদ দিয়ে, সব কিছু ছেড়ে যে পরম সত্যকে আমরা জানি তার চর্চাই করা উচিত। কিন্তু আবাল বিজ্ঞানীরা এসব বাদ দিয়ে বিগ ব্যং, বা প্রাকৃতিক নির্বাচন এসব নিয়ে পড়ে আছে। কেন? একটা কারন, ধর্ম যা জানে তা প্রমানিত নয়। তা বিশ্বাস।

আর মানুষও এমন ত্যাদোড় যে সে আরো জানতে চায়, নিশ্চিত হতে চায়, প্রমান চায়। এই অন্তহীন কৌতুহলই তাকে আজকের অবস্থানে নিয়ে এসেছে। কাজেই ধর্ম যা বলে তা আসলে বিশ্বাস। বিশ্বাস করলে আছে, না করলে নাই। আবার একেক ধর্মের একেক ধরনের বিশ্বাস।

আব্রাহামিক রিলিজিয়ন একভাবে বিশ্বাস করে, পলিথিস্টিক ধর্ম অন্যভাবে বিশ্বাস করে। বিশ্বাস করাটা সোজা। দেখানো পথে হেটে যাওয়াটা সোজা। কিন্তু চিন্তা করে, প্রশ্ন করে আবিস্কার করা কঠিন। সেকারনেই পালে পালে ডগমা বা মতবাদ অনুসারীর দেখা মেলে, কিন্তু মতবাদ তৈরির লোক খুবই কম।

তারা ক্ষণজন্মা পুরুষ। অনেকে বলে যে এখনও প্রমান হয়নি বটে, তবে একদিন প্রমান হবে। এই যে প্রমান হবার আগেই বলে বসা যে একদিন প্রমান হবে – তাও আবার একরকমের বিশ্বাস। আগেই কিভাবে বলে দেয়া যায় যে প্রমান হবে। বিজ্ঞান সব প্রশ্নের উত্তর আজো দিতে পারেনি।

পারবেওনা। কারন সব কিছু জেনে যাওয়া সম্ভব নয়। আজকে যেটা অজানা কালকে সেটা জানা হবে কিন্তু কালকে আবার নতুন প্রশ্নের উদ্ভব হবে। নতুন নতুন প্রশ্ন সব সময়েই আসবে, তার জবাব ও আসবে। কিন্তু দু হাজার বছর আগের বিজ্ঞানের চএয়ে আজকের বিজ্ঞান অনেক শক্তিশালী।

সে আস্তে আস্তে শক্তিশালী হচ্ছে। বিজ্ঞানের সেই অজানা প্রশ্নগুলোর ফাকে ঈশ্বরকে বসিয়ে দিয়ে ধার্মিকরা শান্তি খোজেন। দর্শনের ভাষায় যাকে বলা হয় গড অব দ্য গ্যাপস। দুহাজার বছর আগের ধর্ম সেখানেই এখনো আছে। তার পরিবর্তন হবার সম্ভাবনা কম।

কারন সে তো তার মত চুড়ান্ত সত্য জেনে বসে আছে। আর নতুন কিছু জানার দরকার কি? বিজ্ঞান সব সময়েই সংশয়বাদী। সে প্রশ্ন করে। চ্যালেঞ্জ করে। তাই সে সমালোচনাকে আওহান জানায়।

ধর্ম সমালোচনা সহ্য করতে পারেনা। কারন তার জন্য যে নতুন সংশয়ের উতপত্তি হবে সেটা মেনে নিতে সে প্রস্তুত নয়। তাই সমালোচনার জবাবে সে হুমকি দেয়। মুরতাদ ঘোষণা করে। খুন করে।

সমালোচনার জবাবে নতুন জ্ঞানের সন্ধান করতে হয়। তাতে ধর্মের অনেক আপত্তি। কারন সে তো চুড়ান্ত জ্ঞান নিয়ে বসে আছে। মডারেট ধার্মিকদেরো একই অবস্থা। আমার এক মডারেট শিক্ষিত ধার্মিক বন্ধু বলেছিল যে, কোরানে যদি লেখা থাকে যে পৃথিবী সমতল তাহলে আমি সেটাই মেনে নিব।

বিজ্ঞান কি বলে তা খুজতে যাব না। আমি তার মতকে শ্রদ্ধা জানাই। সে অন্তত তার চিন্তায় স্থির আছে। সমস্যা হয় তখনই যখন বৈজ্ঞানিক আবিস্কার ধর্মগ্রন্থের পাতায় পাতায় খোজা হয়। ইতিহাসে এমন ঘটনা নেই যে ধর্ম গ্রন্থের কারনে বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত বাতিল হয়েছে।

কিন্তু উল্টা ঘটনা আছে ভুরি ভুরি। পৃথিবীর গোলত্বের প্রমান তার মধ্যে একটি। খুব ভালো হত যদি ধর্মের যায়গায় ধর্ম আর বিজ্ঞানের জায়গায় বিজ্ঞান থাকত। যে যার যার মত করে চলতে পারত। কিন্তু দু পক্ষ থেকেই গোল বাধানোয় বিষয়টা আর ঠিক থাকছেনা।

বিজ্ঞান আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছে প্রাণ ও পৃথিবীর উত্তপত্তির প্রশ্নে আর ধর্ম শুরু করেছে পুরোনো বই গুলোতে বিজ্ঞান খোজা। এখানেই যত বিপত্তি। বিশ্বাস আর প্রমানের বিরোধ। হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, এ যুগে ধর্মকে অস্বীকার করা যায় কিন্তু বিজ্ঞানকে যায়না। সেটা ধর্মবাদীরাও জানেন।

কাজেই ধর্মের লাইনে লাইনে কি পরিমান বিজ্ঞান লুকায়িত সেটা খুজে বের করা জরুরী হয়ে পড়েছে। তার পাশাপাশি সেই পুরোনো কায়দা তো আছেই। হুমকী ধামকী। খৃষ্টীয় চার্চ সেটা প্রাচীন কাল থেকেই করে আসছে। এখনও করছে।

ইসলাম সেই মুতাজিলাদের সময় থেকে ইবনে সিনা, ওমর খৈয়ামদের সাথে করেছে। এখনও করেছে। বেদ গীতা কতটা বৈজ্ঞানিক সেটাও প্রমানের চেষ্টা চলছে। ধর্মের সাথে এই যে বিরোধ, তা কিন্তু শুধু বিজ্ঞানের সাথে নয়। বরং গনতান্ত্রিক চেতনা, বাক স্বাধীনতা, নারী স্বাধীনতা, সমাজবিজ্ঞানের ধারনা এসবের মধ্যেও প্রচন্ড বিরোধ আছে।

এখন কথা হচ্ছে পৃথিবীতে ধার্মিক মানুষ থাকবে আবার অবিশ্বাসীরাও থাকবে। আবার তাদের মধ্যে অন্তহীন বিভেদও থাকবে এবং ছিল। তাহলে এই দুই ধরনের মতামতের সমন্বয় কিভাবে হবে? বা আদৌ সমন্বয়ের দরকার কিনা? যেহেতু অবিশ্বাসিদের সংখ্যা পৃথিবীতে নেহায়েত কম নয়, এবং দিন দিন আগের চেয়ে দ্রুত গতিতে বেড়ে চলছে, তাই তাদের শান্তিপুর্ন সহাবস্থান জরুরী। সেই লক্ষ্যে আমরা কতিপয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারি। এ বিষয়ে পরবর্তী কিছু পর্বে আমরা আলোচনা করব।

বিষয়গুলো এধরনের হতে পারে- ১। ধর্ম নিয়ে ক্যাচাল কেন জরুরী ২। ধর্ম সমালোচনা, জ্ঞনের অগ্রগতি ও ধর্মানুভুতি। ৩। বিজ্ঞান ও বিজ্ঞান মনষ্কতা ৪।

ধর্ম ও ঈশ্বর কি একই বস্তু কিনা ৫। আধুনিক বিশ্বে নাস্তিকতার প্রসার ৬। ধর্মের বিবর্তনের ইতিহাস। ৭। গড অব দ্যা গ্যাপস এবং বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা ৮।

নাস্তিকতা ও যুক্তিবোধ কি? ৯। নৈতিকতা ও ধর্ম। ১০। ধর্মীয় যুক্তিগূলোর প্যাটার্ন। ১১।

নাস্তিকতা কাকে বলে ও তা কত প্রকার ও কী কী? ১২। রাজা ঈদিপাস ও নাস্তিকতার প্রসার। ১৩। ধর্ম ও বিজ্ঞানের ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব। এ ধরনের বিষয় নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা আস্তিক নাস্তিক সবার জন্যই উপযোগী বলে আমার ধারনা।

কারন মানুষ হিসাবে আমরা সবাই সত্যকে জানতে চাই, উপলব্ধি করতে চাই। আমার মতের বিরুদ্ধে গেলেও সত্যকে আবিস্কারের জন্য আলোচনা জরুরী। এই আলোচনা করতে গিয়ে ধর্মকে বিভিন্ন আংগিকে কাটা ছেড়া করা হতে পারে। বিজ্ঞানকে প্রশ্ন করা যেতে পারে। তবে কাউকে হুমকী ধামকী দিয়ে নয়।

বরং যুক্তিপুর্ন আলোচনায়ই তা করতে হবে। অনেকেই বলেন সেই পুরোনো আলোচনা আবার? আস্তিক নাস্তিক নিয়ে এত ক্যাচালের কি আছে? পরবর্তী পর্বে আমরা আলোচনা করব ধর্ম নিয়ে ক্যাচাল করা কেন জরুরী তা নিয়ে। শেষ করি ওমর খৈয়ামের একটা কবিতা দিয়ে— “যদি মানুষ ধার্মিকের ধর্মান্ধতার পরিবর্তে নীতি জ্ঞনের চর্চা করত, যদি উপাসনালয়গুলো সর্ববিদ্যা চর্চাকেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠত, ধর্মতত্ব চর্চার পরিবর্তে যদি গণিত-বীজ গণিতের উন্নতি সাধন করত --------------------- পৃথিবী তাহলে বেহেস্তে রূপ নিত পরপারের বেহেস্ত বিদায় নিত। “

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।