ফিলিস্তিনের মানুষজনের "মুসলমানিত্ব" নিয়ে এই বান্দার বিশেষ মাথাব্যথা নেই। সোমালিয়ার শতকরা কত ভাগ মুসলিম সেটাও জানি না। ইরাকের কয়জন লোক দাড়ি রাখে সেটা নিয়েও বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। আরব বিশ্বের দিকে, উপরওয়ালা মাফ করুন, বিশেষ কোন শ্রদ্ধাও বোধ করি না, অন্তত এই আরব নেতৃত্বের দিকে শ্রদ্ধা হবার কোন কারণ নেই। সাম্যবাদী বা কম্যুনিস্ট নই, দুনিয়ার মজদুরদের দিয়েই দুনিয়া স্বর্গ হয়ে যাবে এমন কোন ধারণাতেও বিশ্বাস করি না।
তারপরেও বহুদিন হলো পশ্চিমা উপনিবেশবাদীদের দিকে বেশ একটা বিতৃষ্ণা বোধ করি, আর দিনে দিনে সেটার পরিমাণ বাড়ছে বৈ কমছে না। বিতর্কটা শুরু হয় ঠিক এখান থেকেই। কেন? পশ্চিমা সভ্যতায় ভাল কিছু নেই? অবশ্যই আছে, ওরা সভ্য, ওরা নিয়মতান্ত্রিক, এবং খুব সামান্য অর্থনীতির জ্ঞান নিয়েও বলা যায়, নানারকম মন্দা সত্ত্বেও পুঁজিবাদী ব্যবস্থার একটা জোর আছে, আধুনিক পৃথিবী মোটামুটি পশ্চিমা সভ্যতার উপর নির্ভরশীল, যে ল্যাপটপে বসে ইন্টারনেটে জ্ঞান ফলাচ্ছি সেটাও পশ্চিমাদের অবদান, কাজেই তাদের দিকে বিতৃষ্ণা প্রকাশ করা রীতিমত অকৃতজ্ঞতার শামিল।
তাহলে? প্রশ্নটা আসলে "মুসলিম-অমুসলিম" নিয়ে না, প্রশ্নটা চিরাচরিত "সারভাইভ্যাল অভ দ্য ফিটেস্ট" এর "নৈতিকতা" নিয়ে, বা "ফুড চেইন"-এর উপরে থেকে অন্যকে খেয়ে আরো উপরে ওঠাই যৌক্তিক কিনা সেটা নিয়ে। একটু ব্যাখ্যায় যাওয়া লাগে তাহলে।
জীবজগতের মূলনীতিই হলো, যার শক্তি বেশি, সে টিকে থাকবে, যে দুর্বল সে প্রাকৃতিক নিয়মেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সবল দুর্বলকে খাবে, যদি তার উপরে গিয়ে টিকে থাকার যথেষ্ট সামর্থ্য না থাকে তো আরেকজন তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে। মানুষ যদি সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হয়ে থাকে, এক্ষেত্রে মানবজাতিও সেই নীতিই অনুসরণ করছে অন্য প্রজাতির বেলায়। অহিংস নিরামিষাশীরাও সত্যিকার অর্থে অন্য ১টা প্রাণ ধ্বংস না করে বেঁচে থাকতে পারে না, সম্পর্কটাই খাদ্য আর খাদকের। এই ফুড চেইনে "নৈতিকতা"র প্রশ্নটা তখনই আসে, যখন কাক খাওয়া শুরু করে কাকের মাংস, মানবজাতিরই কোন একটা অংশ অন্য কোন অংশের উপর নিজের শ্রেষ্ঠত্ব দাবী করে বসে আর নিজেকে খাদকের সুবিধাভোগী আসনে বসিয়ে অন্যদের আপেক্ষিক মূল্য মানুষ অপেক্ষা নিচুতর কোন পর্যায়ে নিয়ে যায়।
এই ফুড চেইনের উপরে থাকার মীমাংসা করার পদ্ধতিটা মানবজাতির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত একই, হানাহানি। ঝাঁপিয়ে পড়ো, মেরে-কেটে খেয়ে ফেলো। আদিকালে গোত্র সর্দার হতো সবচেয়ে নিষ্ঠুর যুদ্ধবাজ হিংস্র ব্যক্তিটি, এখনো ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে আসীন ব্যক্তি অন্য মোড়কে একই রকম ক্রুর, কুটিল, প্রচলিত ভাষায় আমরা অনেকে তাদের "রাজনীতিবিদ" বলে থাকি। একটা সময় বর্শা-কুড়াল-তলোয়ার নিয়ে শক্তিশালী গোত্রপতি নিজেই নেতৃত্ব দিতেন, এখন শুধু সুসজ্জিত কক্ষে বসে বোতাম টিপে আদেশ জারি করে থাকেন। প্রযুক্তির উন্নতি হচ্ছে, বিজ্ঞান এগিয়ে যাচ্ছে, মূল উদ্দেশ্যে কোন ব্যাঘাত ঘটছে না, সেই নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার নিরন্তর প্রচেষ্টা।
মূল কথা থেকে আসলে অনেকদূর সরে গেছি, কথা হচ্ছিলো মুসলমান, সোমালিয়া, ৩য় বিশ্ব অথবা পশ্চিমা সভ্যতা নিয়ে। বিশেষ করে পশ্চিমাদের কথাই কেন এল, সেটা একটু বলি। গত ২-৩ হাজার বছরের ইতিহাসে, মাঝের কয়েক শতাব্দীর মুসলিম আগ্রাসন বাদ দিলে, উপনিবেশবাদ বা সাম্রাজ্য বিস্তারের ব্যাপারে পৃথিবীর পশ্চিমাংশের লোকদের অবদানই বেশি ছিল, সেটা রোমান সাম্রাজ্য বলি, ব্রিটিশ বা ইউরোপিয়ান উপনিবেশ বলি, আর হালের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদই বলি। কেন এরাই বারবার আধিপত্য বিস্তার করে সেটা নিয়ে বিশাল গবেষণা হতে পারে, আদতে তারা শ্রেষ্ঠ কিনা সেটাও আরেক বিষয়, কিন্তু এই শ্রেষ্ঠ ভাবার প্রবণতা এবং শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের প্রাণপণ চেষ্টা যে তাদের মাঝে রয়েছে সেটা নিঃসন্দেহ। জ্ঞান-বিজ্ঞানে শ্রেয়তর হবার চেষ্টা করার দোষের কিছু নেই, কিন্তু তার অনিবার্য পরিণতি হিসেবে প্রতিবারই চলে এসেছে অন্য জাতিগোষ্ঠীর উপর সেই শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দেবার উদগ্র বাসনা।
আনবিক শক্তির উদ্ভাবন মানবসভ্যতার গতিপথ ইতিবাচকভাবে পাল্টে দিতে পারতো, কিন্তু তার প্রথম উল্লেখযোগ্য ব্যবহার হলো আনবিক বোমা বানিয়ে হিরোশিমা আর নাগাসাকির নিরীহ মানুষের উপর। প্রথম ধাক্কাতেই "ফ্ল্যাশ বার্ন"- এ হিরোশিমাতে মারা যায় ৯০,০০০ মানুষ, আর নাগাসাকিতে ৬০,০০০ (অনেকেই বলেন হিসেবটা রক্ষণশীল), পরবর্তীতে তেজষ্ক্রিয়তার কারণে হিরোশিমার সংখ্যাটা ১,৫০,০০০ এ দাঁড়ায়, নাগাসাকিতে ১ লাখের কাছাকাছি। হায়, পৃথিবীর ইতিহাসে এত গণহত্যার কথা আমরা বলি, অথচ "সভ্যতম" জাতির দ্বারা স্বল্পতম সময়ে সংঘটিত বৃহত্তম গণহত্যার কথা কত সাবধানে এড়িয়ে যাই!
বিতর্কটা এখানেই যে, নিজেদের "সভ্য" দাবী করা কোন জাতি সেই আদিমতম "খাদ্য-খাদক" নীতির উপর চলতে পারে কিনা, আর যদি চলে, তাহলে তাদেরকে কেন এই পশুবৃত্তির জন্য পশুর পর্যায়ে বিবেচনা না করে "মানুষ", বা আরো সুক্ষ্মভাবে, "সভ্য মানুষ" হিসেবে বিবেচনা করা হবে। হিরোশিমা আর নাগাসাকির ঘটনা প্রকৃতপক্ষে পার্ল হারবারে জাপানী বিমান হামলার (সেটাও জাপানী আগ্রাসনের একটা নমুনা) একধরণের প্রতিশোধ, যে হামলায় প্রায় ৫ হাজার আমেরিকান সৈন্য মারা গিয়েছিল। পার্ল হারবার নিয়ে সাহিত্য-সিনেমার কোন অন্ত নেই, হাহাকার চলছে এই ৭০ বছর পরেও, কিন্তু তার ৫০ গুণ বেশি মানুষ মারা যাবার পরেও হিরোশিমা-নাগাসাকির বোমাবাজিকে "গণহত্যা" বলে কয়জন উল্লেখ করেন? তারমানে কি দাঁড়ায় যে একজন বিজয়ীর জীবন=৫০ জন পরাজিতর জীবন? বা অর্থসম্পদে সামরিক শক্তিতে উন্নত জাতির একজনের জীবনের দাম পিছিয়ে থাকা কোন জাতির শত শত মানুষের চেয়েও বেশি? খুব সাবধানে চিন্তা করলে, এটাই কিন্তু "বর্ণবাদ"-এর মূল কথা।
"আর্য" জাতির শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার জন্য হিটলার যে ইহুদী নিধন কর্মসূচী শুরু করেছিল, তার মূল কথাও ছিল আর্যরা সভ্য, অন্য জাতিগোষ্ঠীকে পথ দেখানোর দায়িত্ব তাদের, বিশ্বের শান্তি-সমৃদ্ধির জন্য পথ দেখাতেও হবে জার্মানদের, বাকিরা তাদের অনুসরণ করবে মাত্র। কথাগুলো কি খুব পরিচিত মনে হচ্ছে? হতেই হবে, বিশ্ব মানবাধিকার রক্ষা এবং পৃথিবীর নানা প্রান্তে "স্বাধীনতা" দেয়ার জন্য যখন মার্কিন বাহিনী নামে, তাদের কাছ থেকে এই মুখস্ত বুলি প্রায়ই শুনে থাকি আমরা। হিটলার মরেও ওপার থেকে অট্টহাসি দিচ্ছে নিশ্চয়ই, তার আদর্শ, তার প্রেতাত্মা তারই ঘোরতর শত্রুর কাঁধে সওয়ার হয়ে দিব্যি এগিয়ে চলেছে।
এতদিন পরে এই পুরানো কাসুন্দি নিয়ে ঘাঁটাঘাটি কেন? কারণ খানিকটা "গোয়েবলসীয়" প্রচারণার দিকে বিরক্তি আর খানিকটা সেটা নিয়ে সবার লাফঝাঁপ দেখে। তেলা মাথায় তেল দিতে সবাই পছন্দ করে, কাজেই ৯/১১ এর দশম বর্ষপূর্তি নিয়ে পশ্চিমা মিডিয়ার হাহাকারের সাথে তাবৎ বিশ্বের বুদ্ধিজীবি মহল যোগ দিয়েছে, বাংলাদেশী মিডিয়াও পিছিয়ে নেই।
৫,০০০ মানুষের মৃত্যু কোন মুখের কথা নয়, ভয়াবহ এবং দুঃখজনক বললেও সেটা কম হয়ে যায়, টুইন টাওয়ারে নিহত মানুষগুলোর জন্য সারা বিশ্ব কাঁদতেই পারে। কিন্তু সেটার প্রতিশোধ নিতে ইরাকে বাঁধিয়ে দেয়া যুদ্ধে শুধুমাত্র সংবাদপত্রের হিসাবেই এখন পর্যন্ত মারা গেছে ১,১১,০০০ ইরাকী, যারা কেউই কোনরকম সন্ত্রাসবাদের সাথে জড়িত নয়। (http://www.iraqbodycount.org/)। এর সাথে যোগ করা যায় একটি দেশ পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাওয়া, এবং যুদ্ধ পরবর্তী দুর্ভিক্ষে ভবিষ্যতে মৃতের সংখ্যা, যেটা আমাদের অনুমানের বাইরে। ৯/১১ এর ধাক্কায় ঐ তাৎক্ষণিক ৫,০০০ মানুষের জীবনের দাম মেটাচ্ছে কোটি কোটি মানুষ, ঘুরেফিরে সেই একই প্রশ্ন, একজন সভ্য মানুষের জীবনের দাম আসলে কতজন "অনুন্নত" বিশ্বের মানুষের সমান? আবারো বলি, টুইন টাওয়ারে হামলা মানবসভ্যতার এক জঘন্য ঘটনা (এখানে ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলো বাদ দিচ্ছি, ধরে নিচ্ছি এই হামলা সন্ত্রাসবাদীদের কাজ), এবং ৫,০০০ কেন, ৫ জন মানুষের জীবনও অমূল্য।
সেক্ষেত্রে, টুইন টাওয়ারের ৫,০০০ মানুষের জীবন আর ইরাকের ৫,০০০ মানুষের জীবনের মূল্যে কোন তফাৎ হওয়া উচিত নয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, হচ্ছে, অনেক বড় ব্যবধান হচ্ছে। টুইন টাওয়ারে মৃত মানুষগুলোকে নিয়ে এত হাহাকার, সেটা কি তারা "মানুষ" বলে, নাকি উন্নত বিশ্বে বসবাসকারী "সভ্য শিক্ষিত" মানুষ বলে? সেক্ষেত্রে, যারা প্রথম বিশ্বে থাকে না, তারা কি "মানুষ" বলে গণ্য হবে না? নাকি তাদেরকে আমরা আদিমযুগের মতই "খাদ্য-খাদক" সম্পর্কে নিচুতলায় বসিয়ে "আধুনিক বর্ণবাদ" চালু করবো?
এবার দৃষ্টি ফেরাই আফগানিস্তানের দিকে। আফগানরা সম্ভবত জংলী (আমাদের উদারমনা "বুদ্ধিজীবি"দের মতে), কিন্তু সেটাও আসলে তাদেরকে পাইকারী বোমা মেরে খুন করার অনুমতি দেয়না। কেউ যদি সেটা ভাবে, তাহলে তা ঐ ব্রিটিশ এবং ইউরোপিয়ান উপনিবেশবাদীদের মতই হয়ে গেল, যারা আমেরিকায় পা দিয়েই রেড ইনডিয়ানদের "জংলী" এবং "হিংস্র" উপাধি দিয়ে পাইকারী হারে খুন করে তাদেরই জমি দখল করে আজকের তথাকথিত "আমেরিকান সভ্যতা" গড়ে তুলেছে।
রেড ইনডিয়ানরা এখনো নিজভূমে পরবাসী, ইনডিয়ান রিজার্ভে আলাদা হয়ে বাস করে, নিজের জমিতে তাদের থাকতে হয় শ্বেতাঙ্গদের দয়ার উপর, যারা কিনা এখন সারা দুনিয়াকে "স্বাধীনতা" আর "মানবাধিকার"-এর সংজ্ঞা শিখিয়ে বেড়ায়। শুধুমাত্র আমেরিকাতেই অষ্টাদশ শতকে রেড ইনডিয়ান ছিল ১ মিলিয়নের বেশি, রোগ আর যুদ্ধে, এবং তাদের নিজস্ব বাসস্থান থেকে অন্যত্র সরিয়ে দেয়াতে এখন কমতে কমতে সেটা দাঁড়িয়েছে ২,৫০,০০০ এর কাছাকাছি। (http://en.wikipedia.org/wiki Population_history_of_indigenous_peoples_of_the_Americas)। আফগানিস্তানে ২০০১ থেকে এখন পর্যন্ত মৃতের আনুমানিক সংখ্যা ২০ হাজারের কাছাকাছি (http://www.unknownnews.net/casualties.html)। এই ওয়েবসাইট টির মতে ইরাকে মৃতের সংখ্যা ৮ লাখের বেশি, পূর্বে উল্লিখিত "ইরাক বডি কাউন্ট" নামের সাইট টি শুধুমাত্র সংবাদপত্রে প্রকাশিত মৃতের সংখ্যা হিসেব করে বলে বাস্তবের চেয়ে সেটা অনেকটাই কম বলে ধরা যায়।
সভ্য দুনিয়ার সবচেয়ে বড় প্রহসন, এবং একই সাথে "মুসলিম ভ্রাতৃত্বের" প্রতি চরমতম উপহাস হয়ে টিকে থাকা ফিলিস্তিনের দিকে দেখা যাক। গত ৫০০ বছরে এই "মুসলিম ভ্রাতৃত্ব" সত্যিকার অর্থে মুসলিমদের কোন উপকারে এসেছে বলে এই বান্দার জানা নেই, সেখানেও এই বর্ণবাদ, "আশরাফ-আতরাফ" সমস্যা। আরবরা নিজেদের ভাবে অভিজাত মুসলিম, আমাদের মত ৩য় বিশ্বের মুসলিমরা "মিসকিন", কাজেই ১৯৭১ সালে সৌদী বাদশাহদের অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল পাকিস্তানের প্রতি, বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যায় ৩০ লাখ মানুষের মৃত্যুতে আরব নেতারা ফিরে দেখার দরকার বোধ করেনি। পাকিস্তানিদের এই বাঙালি নিধনের পেছনেও কাজ করেছে পরোক্ষ বর্ণবাদ। ওদিকে ফিলিস্তিনের ব্যাপারে বিশ্ববিবেক আর মুসলিম বিবেক দু'টোই আশ্চর্যজনকভাবে নীরব, এমনকি ফিলিস্তিনে মৃতের সংখ্যা ঠিক কত এটা নিয়েও বিতর্ক খুব বেশি।
অন্য সব ব্যাপারে মোটামুটি নির্ভরযোগ্য উইকিপিডিয়া ফিলিস্তিন ইস্যুতে পুরোপুরি পক্ষপাতদুষ্ট, গত ৬০ বছরে তাদের হিসেব অনুযায়ী মাত্র ৭ হাজার ফিলিস্তিনি মারা গেছে, অন্যান্য আরব মিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী সংখ্যাটা ২ লাখের কাছাকাছি। ১৯৪৮ সালেই প্রায় ৫০ লাখ ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু হয়, যুদ্ধ আর দুর্ভিক্ষে মৃতের সংখ্যা যে আরো বাড়তে পারে, সন্দেহ নেই। এখানে বিশ্ববিবেক আমেরিকা নির্লজ্জভাবে বারবার ভেটো দিয়ে গেছে জাতিসংঘে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যে কোন নিন্দা প্রস্তাবে, এবং "আমেরিকান ড্রিম"-এ স্বপ্নালু বাংলাদেশীদের মনে করিয়ে দেয়া যেতে পারে, এটা আমেরিকান প্রশাসনের জন্য নতুন কিছু নয়, গণহত্যাকারী পাকবাহিনীকে জেনেশুনেই তারা ১৯৭১ সালে অকুণ্ঠ নৈতিক ও সামরিক সমর্থন দিয়েছিল।
যুদ্ধ আর সরাসরি আগ্রাসন বাদ দিয়ে শুধুমাত্র বিশুদ্ধ বর্ণবাদের দিকে চোখ ফেরানো যাক। একদম গোড়ায় ফেরা যাক বর্ণবাদের, কালো আফ্রিকাতে, দাস ব্যবসায়।
"আটলান্টিক স্লেভ ট্রেডিং" নামে পরিচিত দাস আমদানির বয়বসা ছিল ষোড়ষ থে অষ্টাদশ শতকের সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা, মধ্যযুগে মূলত যার দখল ছিল আরবদের হাতে, এরপর সেটা চলে যায় ইউরোপিয়ান, বিশেষ করে পর্তুগীজ, ওলন্দাজ আর ব্রিটিশদের কাছে। মৃতের সংখ্যা? গোণা সম্ভব নয়, তবে মোটামুটি রক্ষণশীল হিসেবেও সেটা ১০ মিলিয়ন বা ১ কোটির (ভুল দেখছেন না, ১ কোটি-ই) কাছাকাছি। (http://en.wikipedia.org/wiki/Atlantic_slave_trade) এটা শুধু আনা-নেয়াতে মৃতের সংখ্যা, আনার পর কঠিন পরিশ্রম আর খাদ্যাভাবে মৃতের সংখ্যা কত, কেউ জানে না, সংখ্যাটা দ্বিগুণ হলেও অবাক হবার কিছু নেই। এবার বর্তমানে ফেরত আসি, অবস্থা কি খুব বদলেছে? ফরাসী অর্থনীতির বড় একটা অংশে এখনো অবদান রাখে আফ্রিকার হীরা, যার অনেকগুলোরই পরিচিতি "ব্লাড ডায়মন্ড" হিসেবে। সরাসরি অংশগ্রহণ থেকে গৃহযুদ্ধে ইন্ধন দেয়ার অভিযোগ আছে ফরাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে, সাথে জোট বাঁধা আছে ডি বিয়ার্সের মত আন্তর্জাতিক হীরা ব্যবসায়ীদেরও।
একটা ছোট্ট হিসেব অনুযায়ী, শুধুমাত্র সিয়েরা লিওনের হীরার খনিসংক্রান্ত সংঘাতে মৃতের সংখ্যা ৭৫,০০০, বাস্তুহারা হয়েছে আরো ২ মিলিয়নের বেশি (Click This Link)। তা হোক না, ৬০ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসার কাছে লাখখানেক মানুষের জীবনের দাম আর কত? দাস ব্যবসায়ীদের মনোভাবের সাথে কোন পার্থক্য পাচ্ছেন কি?
সোমালিয়ার দিকে তাকাই। দুর্ভিক্ষ আর গৃহযুদ্ধের কারণে অবিশ্বাস্য রকমের বেশি, প্রতি ১০০০ জনে ১৫ জন প্রায়। (Click This Link)। অন্যানয় আফ্রিকান দেশগুলিতেও যে অবস্থা এরচেয়ে খুব ভাল তা নয়।
জাতিসংঘ এবং অন্যান্য পশ্চিমা সংস্থা সাহায্য দিচ্ছে, তবে সেটা খুবই অপ্রতুল। সাহায্যের সাথে সাথে এসব দেশে একনায়ক শাসক বসিয়ে রাখা এবং গৃহযুদ্ধ বজায় রাখার ব্যাপারেও তারা সমান তৎপর, অস্ত্র ব্যবসার বিশাল একটা অংশ যে এই আফ্রিকাতেই। শোনা কথা, তবে শান্তিরক্ষী বাহিনীগুলোতে নাকি আমেরিকান আর ইউরোপিয়ান সৈন্যদের বেতন-ভাতা বাংলাদেশী এবং অন্যান্য সৈন্যদের ৩ গুণ। তা বটে, উন্নত জাত বলে কথা! এই দেখুন না, আমেরিকার হারিকেন ক্যাটরিনাতে মারা গেছে মোটামুটি ১,৮০০, তাতেই মনে হচ্ছে কেয়ামত হয়ে গেছে, অন্তত পশ্চিমা মিডিয়ার মতে। ১৯৯১ তে বাংলাদেশে সাইক্লোনে মারা গিয়েছিল আনুমানিক ১,৩৮,০০০ লোক, এই তুলনায় কতটা কথা হয় সেটা নিয়ে? ঐ একই ব্যাপার, জীবনের আপেক্ষিক দাম, ৩য় বিশ্বে জন্মালে ১ম বিশ্বের তুলনায় ১০০ ভাগের এক ভাগ হতেও পারে, সেজন্যই মনে হয় তথাকথিত সভ্য প্রথম বিশ্বের নাগরিক হয়ে ফুড চেইনের উপরে উঠে যেতে আমাদের এই প্রাণান্ত প্রচেষ্টা।
আর যদি কেউ সেটা হয়ে যায়, সে তখন "মোর আমেরিকান দ্যান বুশ", বাস্কেটবল আর বেসবলের ফ্যান হবার সাথে সাথে ৯/১১ নিয়ে বাণী দেয়া তখন নিয়মিত কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের দেশের পত্রপত্রিকাতেও তখন নিউইয়র্কের বাসিন্দাদের "ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস" আর তাদের শোকদুঃখগাঁথা নিয়ে বড় বড় কলাম বরাদ্দ হয়, কিন্তু ইরাক বা সোমালিয়ার দুর্ভিক্ষ নিয়ে কয় লাইন লেখা হয়, সেটা অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে খুঁজে বের করতে হয়।
৯/১১ এর নিহতদের স্মরণে যারা গ্রাউন্ড জিরোতে মোমবাতি জ্বালান আর বড় বড় প্রবন্ধ ফাঁদেন, তারা একবারও কি যুদ্ধ আর অনাহারে মৃত লাখ লাখ "৩য় শ্রেণীর" এসব মানুষের কথা মনে করেন? যদি না করেন, আপনি কি "আধুনিক বর্ণবাদ"-এর শ্রেষ্ঠত্ব ধারণ করে গর্বিত? ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।