আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিভাষায় ‘নিউকন’ ধারণাটির প্রবর্তন ঘটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সত্তর দশকের শুরুর দিকে, মাইকেল হ্যারিংটনের হাত ধরে। মাইকেল নিজেকে ‘সমাজতন্ত্রী’ বলে দাবি করলেও তাঁর রাজনীতি উদারনৈতিক মার্কিন গণতান্ত্রিক পরিমণ্ডল বা লিবারেলিজম থেকে আলাদা কিছু নয়। তিনি চান শান্তিপূর্ণ ভাবে ভোটাভুটির নিয়ম মেনে সমাজতন্ত্র কায়েম বা একধরণের সহনীয় পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই ধরণের লিবারেলদের সংখ্যা কম নয়। এই উদারনীতিবাদীরা ধর্মনিরপেক্ষও বটে।
কিন্তু সত্তর দশকের দিকে ভিয়েতনাম যুদ্ধকে কেন্দ্র করে দেখা গেল, এই উদারবাদী বা লিবারেলদের বিশাল একটি অংশ হঠাৎ ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে নির্মম মার্কিন যুদ্ধনীতি সমর্থন করা শুরু করেছে। শুধু তা-ই নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ জনগণের মধ্যে যে যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠছিল, তার বিরুদ্ধেও দাঁড়াল তারা। মাইকেলের চিন্তাচেতনা থেকে এরা খুব আলাদা ছিল না, কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ লিবারেলদের যুদ্ধবাজে রূপান্তরিত হওয়ার কারণে মাইকেল তার উদারনীতিকে এদের কাছ থেকে আলাদা করা দরকার বোধ করলেন। এদের নাম দিলেন ‘নিউ কনজারভেটিব’ বা নব্য সংরক্ষণশীল। যারা এত দিন প্রগতি, গণতন্ত্র, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সহনশীলতা, ধর্মনিরপেক্ষতা ইত্যাদির পক্ষে বড় বড় বুলি আওড়াচ্ছিল, তারা চিন্তাচেতনায় শুধু সংরক্ষণশীল হয়ে উঠল না এমনকি সংরক্ষণশীলদের চেয়েও আরো উগ্রবাদী বা অতি সংরক্ষণবাদী হয়ে গেল।
মার্কিন নাগরিকেরা যখন ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ফেটে পড়ছে, এরা বরং সেই যুদ্ধের পক্ষে দাঁড়াল। এদেরকেই সংক্ষেপে বলা হয় ‘নিউকন’ বা ‘নিউকনি’। এর পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে এদের প্রভাব ক্রমে ক্রমে বাড়তে শুরু করল। জর্জ বুশের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্তযুদ্ধের নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে উগ্র খ্রিষ্টানবাদী গোষ্ঠির সঙ্গে নিউকনিরা যুক্ত হোল।
নিউকনিদের রাজনৈতিক মতাদর্শ কী? তাদের বক্তব্য হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদকে আমরা যেভাবে মন্দ বলে এত দিন বিচার করে এসেছি সেটা ভুল।
একে ‘ব্যতিক্রম’ বলে গণ্য করতে হবে। কারণ, পাশ্চাত্যসভ্যতাই একমাত্র সভ্যতা। যুদ্ধ করেই এই সভ্যতাকে রক্ষা করতে হবে। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বিরোধিতা এত দিন করা হয়েছে একটা উদারনৈতিক পাপবোধ থেকে, অর্থাৎ মনে করা হয়েছে যুদ্ধবিগ্রহ হানাহানির কাজটা বোধ হয় ঠিক হচ্ছে না। এখন এই সব পাপবোধ ঝেড়ে ফেলতে হবে।
পাশ্চাত্যসভ্যতাকে রক্ষা করাই এখন প্রধান ও একমাত্র কাজ। এই সভ্যতা খ্রিষ্টীয় প্রটেস্টান্ট স্পিরিটের ওপর দাঁড়িয়ে বাজারব্যবস্থা রক্ষা করে। মুনাফাগিরিকে মানুষের স্বাভাবিক ধর্মজ্ঞান করে। এরা মনে করে, সমাজের চেয়েও ব্যক্তি বড়, অতএব ভোগী জীবনকে মহিমান্বিত ও ব্যক্তিতান্ত্রিক জীবনযাপনই এদের কাছে আদর্শ। সমাজকে পাবলিক ও প্রাইভেটে ভাগ করে ধর্মকে একান্তই প্রাইভেট বা ব্যক্তিগত ব্যাপারে পর্যবসিত করা হয়।
এর সুবিধা হচ্ছে পুঁজিতান্ত্রিক সমাজকে ধর্মের হাত থেকে রক্ষা করা। ধর্মের মধ্যে নীতিনৈতিকতার বিধিবিধান, অপরের প্রতি ভালোবাসা ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার কথা যদি থাকে, তাহলে ধর্ম সেটা সামাজিক-রাজনৈতিক ভাবে তুলবার চেষ্টা করে। সব ধর্মই কমবেশি সেটা করে। বাংলাদেশে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সেটা করেছেন। ল্যাটিন আমেরিকায় মার্কস ও বিপ্লবী চিন্তাবিদদের অনুপ্রেরণায় লিবারেশান থিওলজির আবির্ভাব ঘটেছে।
তাঁরা হজরত ঈসা ও তাঁর শিক্ষাকে খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের কাছে ইহলোক ও পরলোকে মজলুমের মুক্তির পথ হিশাবে প্রচার করেছে। এতে ল্যাটিন আমেরিকার জনগণ দ্রুত সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়তে অনুপ্রাণিত হয়েছে। ধর্মকে প্রাইভেট বা ব্যক্তিগত ব্যাপারে পর্যবসিত করা হয় কেন? কারণ তখন পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ধর্মের ইতিবাচক কোন ভূমিকা সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পালন করা থেকে ধর্মপ্রাণ জনগণকে সহজে বিরত রাখা। বলা হয়, সামাজিক নীতিনির্ধারণে এবং রাজনৈতিক আদর্শ নির্মাণে ধর্ম টেনে আনা যাবে না। সমাজে কাউকে সাহায্য-সহযোগিতা করতে চাইলে সেটা ব্যক্তিগত ভাবে করতে হবে।
সাংগঠনিক ভাবে করতে চাইলে সেই উদ্যোগকে ঘোষণা দিতে হবে সেটা অরাজনৈতিক সংস্থা; ইত্যাদি।
নিউকনিদের মূল কথা হচ্ছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার যুদ্ধনীতি বিশ্বের জন্য মঙ্গলজনক। যারা পাশ্চাত্যসভ্যতা চায় না, এর বিরোধিতা করে কিম্বা একে প্রতিরোধ করতে চায় এরা অশুভ শক্তি। এরা সভ্যতাকে পেছন দিকে টেনে ধরতে চায়। অতএব যুদ্ধ করেই দুনিয়ার এই অশুভ শক্তিকে দমন করতে হবে।
সভ্যতা রায় মার্কিন যুদ্ধের ভূমিকা প্রগতিশীল। চাঁদে যেভাবে মার্কিন পতাকা পুঁতে দেওয়া হয়েছে, দেশে দেশে তেমনি মার্কিন ‘মুক্তি’ বা ‘স্বাধীনতা’র পতাকা সেঁটে দিতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধ করেই অসভ্য ও বর্বরদের পরাস্ত করতে হবে, নইলে এই ভোগের জীবন ও মধুর সভ্যতা রক্ষা করা যাবে না।
একসময় মার্কিন নীতিনির্ধারকেরা বলতেন, কমিউনিস্টরা বর্বর ও অসভ্য। তারা পুঁজিবাদের মহিমা বুঝতে পারে না।
এদের বিরুদ্ধে ধর্মপ্রাণ মানুষদের খেপিয়ে তুলেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বলেছিল, কমিউনিস্ট মাত্রই নাস্তিক। কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে ঘৃণাচর্চার রক্তাক্ত ইতিহাস তো বেশি দিনের কথা নয়। এখন কমিউনিজম ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ায় তার জায়গায় স্থান পেয়েছে ইসলাম। আর, বর্বর, অসভ্য, গণতন্ত্র ও সভ্যতাবিরোধী কমিউনিস্টদের স্থান দখল করেছে মুসলমান নামক আজব জীব।
লাল পট্টি বাঁধা কমিউনিস্টদের হাত থেকে সভ্য দুনিয়া রক্ষা করার জন্য যুদ্ধ যেমন ঠিক কাজ, ঠিক তেমনি এখন টুপি, পাগড়ি, কোর্তা পরা দাড়িওয়ালা লোকগুলোর হাত থেকে সভ্যতা রক্ষার জন্য মার্কিন নেতৃত্বে নৃশংস যুদ্ধ ও নির্বিচার হত্যা চালাতে হবে। নইলে সভ্যতা রক্ষা করা যাবে না। প্রয়োজনে এই যুদ্ধকে বৈধতা দিতে জাতিসংঘে নতুন আইন ও বিধিবিধান বানাতে হবে। হয়েছেও তা-ই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই সভ্যদুনিয়ার পে সভ্যতা রক্ষাএই কঠিন দায়িত্ব পালন করছে।
যুদ্ধ হচ্ছে সভ্যতার সঙ্গে সভ্যতার, তাদের ভাষায় ক্যাশ অব সিভিলাইজেশান। এতে প্যালেস্টাইন, ইরাক ও আফগানিস্তান ধ্বংসস্তূপে পরিণত হোক তাতে কিছু আসে-যায় না। এমনকি ধ্বংস ও ছারখার হয়ে যাক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র পাকিস্তানও। কিছুই আসে-যায় না। যুদ্ধ চলবে।
দুনিয়ায় মার্কিন ফ্রিডমের বিজয়কেতন উড়ুক। নিউকনিদের আদর্শ বুঝতে হলে এই দিক থেকেই আমাদের বুঝতে হবে।
অতি উৎসাহী ইসলামপন্থীরা কথায় কথায় বিরোধী পক্ষকে নাস্তিক মুরতাদ গালি দেয়। তারা অবশ্য বুঝতে পারে না এই গালি দেবার গোড়ায় রয়েছে নিউকনি আদর্শ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্নায়ুযুদ্ধের সময়কার প্রচারণা। তা ছাড়া নাস্তিক্যবাদ আর কমিউনিজম কখনোই সমার্থক নয়।
কখনোই সমার্থক ছিল না। বাংলাদেশের শ্রদ্ধাভাজন মওলানা-মাশায়েখরা বারবার যখন-তখন যাকে-তাকে নাস্তিক-মুরতাদ বলা ইসলামসম্মত নয় বলে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন।
বিপরীতে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ বামপন্থীরাও প্রগতি এবং সভ্যতা রক্ষার নামে যখন-তখন ইসলামপন্থীদের অসভ্য ও বর্বর জ্ঞান করে তাদের মৌলবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল আখ্যা দিয়ে থাকেন। এরা তাদের চোখে নাগরিক হিশাবে পরিগণিত হবার পর্যায়ভুক্ত নয়, এমন বৈষম্যমূলক মনোভাব প্রকাশ করে ফেলেন। তারা ইসলামপন্থীদের মৌলিক মানবিক অধিকারকে অগ্রাহ্য করতে চান।
এই পরিপ্রেক্ষিতে সত্যিকারের কমিউনিস্টদের দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে হবে এই নিউকনি মতাদর্শের সঙ্গে কমিউনিজমের কোন সম্পর্ক নাই।
নিউকনিদের না বুঝলে দুই হাজার এক সালে সেপ্টেম্বর ১১ তারিখে টুইন টাওয়ার ও পেন্টাগন হামলার পর জুনিয়র বুশের নেতৃত্বে আমেরিকা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যে অনন্তযুদ্ধ শুরু করেছে তার মর্ম আমরা ধরতে পারব না। এটা ঠিক যে এর পেছনে অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে। জ্বালানি পদার্থ, বিশেষত তেলের ওপর একাধিপত্য কায়েমের অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা প্রবল ভাবেই হাজির আছে। যুদ্ধ তো তেলের জন্যই।
কিন্তু একই সঙ্গে কাজ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সহযোগী দেশগুলোর অর্থনৈতিক স্থবিরতা। এই স্থবিরতা কাটিয়ে তোলার জন্য যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্থনীতি চাঙা করে তোলার তাগিদ তৈরি হয়েছে। আরো রয়েছে ডলারকেই একমাত্র বিশ্বমুদ্রা হিশাবে প্রতিষ্ঠিত রাখবার প্রয়োজনীয়তা। ইত্যাদি নানা অর্থনৈতিক কারণ।
কিন্তু শুধু অর্থনীতি দিয়ে সাম্রাজ্যবাদকে ব্যাখ্যা করার এই সেকুলার ধারা সাম্রাজ্যবাদকে মতাদর্শিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে সমালোচনা করতে অক্ষম।
যে কারণে নিউকনিদের মতো এক শ্রেণির প্রগতিবাদী সাম্রাজ্যবাদবিরোধীরাও মনে করে পাশ্চাত্য যেভাবে ‘আধুনিকতা’, ‘প্রগতি’, ‘সভ্যতা’, ‘গণতন্ত্র’, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’, ‘সাম্য’, ‘অধিকার’ ইত্যাদিকে সার্বজনীন ধারণা হিশাবে আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে চায় তার আর কোন পর্যালোচনার দরকার নাই। পাশ্চাত্যের বিশেষ ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার আলোকে ও তার পরিণত ফল হিশাবে এই সব ধারণা গড়ে উঠেছে এবং নিউকনিরা তাকে যুদ্ধ করে রক্ষা করতে চাইছে। অথচ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জনগোষ্ঠির ইতিহাস ও অভিজ্ঞতা ভিন্ন হতেও পারে।
সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জনগোষ্ঠি পাশ্চাত্যসভ্যতাকে সার্বজনীন বলে মেনে নেবে কেন? পাশ্চাত্যসভ্যতার সাংস্কৃতিক মালসামান পরখ না করে এসব আমদানি করতে দেওয়া ঠিক না। এমন মালেরও একটা কাস্টম চেক হবার দরকার আছে।
পাশ্চাত্যই সভ্যতার একমাত্র মানদণ্ড ও চূড়ান্ত আদর্শ এবং পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থাই ইতিহাসের শেষ গন্তব্য এই সব দাবি নানান দিক থেকে আজ সমালোচনা ও পর্যালোচনার মধ্যে পড়েছে। প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেছে। শুধু আমাদের দেশে নয়। খোদ পাশ্চাত্য দেশগুলোতেও। পাশ্চাত্য চিন্তা, মতাদর্শ ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রাম করতে গিয়ে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জনগোষ্ঠী তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, ঐতিহ্য ও জীবনযাপনের অভিজ্ঞতাকে নতুন ভাবে অনুসন্ধান ও পর্যালোচনা করতে শিখছে।
নিউকনিদের বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রামের ক্ষেত্রে যার গুরুত্ব অপরিসীম।
নয় এগারোর পর জুনিয়র বুশ আলকায়েদার রাজনীতি মোকাবেলার পথ যেভাবে গ্রহণ করেছিলেন নিউকনিদের তত্ত্ব মনে রেখে আমাদের সেটা বুঝতে হবে। সেই রণনীতির বৈশিষ্ট্যগুলো আমরা তাহলে বোঝার চেষ্টা করি।
প্রথমেই আসে, খ্রিষ্টান ইভানজেলিক ধারায় এই যুদ্ধকে ইসলামের বিরুদ্ধে খ্রিষ্টীয় ‘ক্রুসেড’ হিশাবে হাজির করা এবং সেইভাবেই লড়া। বুশ শুরুতে একে ‘ক্রুসেড’ হিশাবেই উল্লেখ করেছেন।
স্যামুয়েল হান্টিংটন একেই বলছিলেন ‘সভ্যতার সংঘর্ষ’। বুশের কাছে সেটা হয়ে উঠেছে তার ‘ক্রুসেড’ আর শত্রুদের ‘জিহাদ’। রাতারাতি ‘জিহাদ’ আন্তর্জাতিক রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ক্যাটাগরি হয়ে উঠল। বুশ যখন তার যুদ্ধকে ‘ক্রুসেড’ বলায় নিন্দিত হলেন, তখন সেই ক্রুসেডের রণকৌশলগত ধ্বনি হয়ে উঠল ‘স্বাধীনতা’, ‘গণতন্ত্র’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ রক্ষার যুদ্ধ। বলা হোল এগুলোই পাশ্চাত্য মূল্যবোধের সারকথা।
গ্রিক-খ্রিষ্টীয় সংস্কৃতির ফসল এই মূল্যবোধ। একে রার ক্রুসেড হিশাবে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে সাজানো হোল।
দ্বিতীয় দিক হচ্ছে ‘ওয়ার অন টেরর’ বা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্তযুদ্ধের ডাক দেয়া। এই আহ্বানের অধীনে বিভিন্ন রাষ্ট্র ও তাদের জনগণকে যুক্ত করে নেওয়া। সবাইকে হুঁশিয়ার করে দেওয়া যে এটা পাশ্চাত্যসভ্যতা ও গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের বিরুদ্ধে আক্রমণ হয়েছে।
নিরপেক্ষ থাকার কোন সুযোগ নাই। হয় তুমি আমার পক্ষে নয় তুমি শত্রুদের দলে; অর্থাৎ পাশ্চাত্যের দুশমন। তোমাকে বোমা মেরে প্রস্তরযুগে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। এই যুদ্ধ কোন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়। দুনিয়াব্যাপী ছড়ানো-ছিটানো এক অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধে, ফলে কখন এই যুদ্ধ শেষ হবে তা কোনো দিনই জানা যাবে না।
কী করে এই ধরণের যুদ্ধের পরিসমাপ্তি টানতে হয় কোন অভিজ্ঞতা কারো নাই। কিন্তু ভয়াবহ প্রাণঘাতী যুদ্ধ শুরু করে দেওয়া হোল।
তৃতীয় দিক হচ্ছে ইসরায়েলের স্বার্থ রক্ষা করা। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে ২০০২ সালের ৩০ ডিসেম্বরের মাক্স বুট একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন, শিরোনাম ছিল ‘নিউকন ব্যাপারটা আসলে কী?’ তার সিদ্ধান্ত হচ্ছে নিউকনদের প্রধান একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ইসরায়েলের সমর্থন। নিউকনিদের প্রথম জেনারেশানের মধ্যে অনেকেই ছিল ইহুদি ও বামপন্থী।
কিন্তু প্যালেস্টাইনের জনগণের ইন্তিফাদা ও তাদের পক্ষে মার্কিন দেশে বামপন্থীদের সমর্থন ক্রমশ বাড়তে থাকায় এরা নীরবে তাদের প্রগতির ছাতা মুড়িয়ে আলাদা হয়ে যায়। কিন্তু সরাসরি উগ্র জায়নবাদী বা জাতীয়তাবাদী ইহুদিদের মতো ইসরাইলের পক্ষে তারা দাঁড়াতে পারছিল না। তাদের উদারনীতিই এ ক্ষেত্রে অস্বস্তির কারণ। ইসরাইলের পক্ষে দাঁড়িয়ে ইহুদিবাদী যুক্তি দেওয়া কঠিন হয়ে উঠল। তখন তারা তাদের ধর্মীয় বা ইহুদি পরিচয়কে আড়াল করে রেখে রাজনীতি- বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র ও সামরিক নীতির ওপর বিশেষ ভাবে জোর দিতে শুরু করল।
ইসরায়েলের পক্ষে তাদের নতুন বয়ানের মূল সুর হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি পাশ্চাত্যসভ্যতা রক্ষা করতে চায় তাহলে তাকে ইসরায়েলের স্বার্থ রক্ষা করতেই হবে। কারণ এরাই মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন স্বার্থের রক্ষক ও মার্কিন সামরিক শক্তির প্রধান খুঁটি। ইসরাইলকে অকুণ্ঠ সমর্থন না দিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সভ্যতার ক্রুসেড চালিয়ে যেতে পারবে না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই ক্রুসেড মার খেয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এই ব্যর্থতা জানেন।
তিনি বুশের মতো ওয়ার অন টেরর জাতীয় কথাবার্তা বাইরে বলছেন না। মধ্যপ্রাচ্য থেকে মার্কিন সৈনিকদের সরিয়ে আনাও তার মধ্যপ্রাচ্য নীতির গুরুত্বপূর্ণ দিক। মার্কিন পররাষ্ট্র নীতিতে নিউকনিরা দুর্বল বলা যাবে না, তবে তাদের প্রতিপক্ষ হিশাবে অন্য অনেককে দেখা যাচ্ছে যারা বাস্তববাদী হতে চায়। বর্বর ও অসভ্যদের হাত থেকে সভ্যতা রার সাম্রাজ্যবাদী প্রকল্প পুরা মাত্রায় বহাল আছে, কিন্তু তারা চাইছে সেটা বাস্তবায়ন করতে হবে শক্তির ভারসাম্যের প্রতি সজাগ থেকে। এদের আজকাল বলা হয় ভারসাম্যবাদী বা ইংরেজিতে ‘ব্যালান্স অব ফোর্স রিয়েলিস্ট’।
নিউকনি হিশাবে ওপরে যাদের কথা আমরা বলেছি, সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে বাংলাদেশে অনেকেই তা ধারণ করেন। পশ্চিমা আধুনিক সভ্যতার পচন বহু আগেই শুরু হয়েছে, কিন্তু তাকে মতাদর্শিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে পর্যালোচনা ও মোকাবেলার কাজকে আমরা গুরুত্ব দিতে না পারায় নিউকনি অসুখে বাংলাদেশও আক্রান্ত হয়ে আছে। এই অসুখে শাহবাগী বামপন্থী ও ঘাতক দালাল নির্মূলবাদীরাই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত। এরা বাংলাদেশে নিউকনিদের খুবই যোগ্য প্রতিনিধি। ইসলামের বিরুদ্ধে ক্রুসেড পরিচালনাকে এরাও নিউকনিদের মতো প্রগতি ও গণতন্ত্রের সমার্থক মনে করে।
এদের কাজ হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের কাছে নিরন্তর প্রমাণ করবার চেষ্টা যে বাংলাদেশ জিহাদিদের দখলে চলে যাচ্ছে। এটা প্রমাণ করবার জন্য নির্মূলের রাজনীতির প্রধান শাহরিয়ার কবীর চলচ্চিত্র নির্মাণ করে চলেছেন। তিনি তাঁর ‘দ্য পোর্ট্রেইট অফ জিহাদ’ বাংলাদেশের ভেতরে উগ্র ইসলামপন্থীদের কার্যকলাপ দেখিয়েছেন। ‘জিহাদ উইদাউট বর্ডার’ চলচ্চিত্রে পাকিস্তানে ধর্মীয় মৌলবাদীদের জঙ্গি রূপের ওপর আলোকপাত করেছেন। সম্প্রতি এই ছবিগুলো দেখাতে গিয়ে ওয়াশিংটনে ভয়েস অব আমেরিকার কাছে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলছেন সৌদি আরব ও পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই বাংলাদেশে জিহাদ রফতানি করছে, বাংলাদেশের পক্ষে একা সেটা মোকাবেলা করা কঠিন।
এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এই যুদ্ধে সরাসরি শামিল হতে হবে। তিনি তাই জামায়াত-শিবিরকে জঙ্গি দাবি করছেন এবং মনে করেন এদের দমনের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ‘মুখ্য ভূমিকা’ রাখতে পারে। তার দাবি, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আমেরিকার সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পুনর্মূল্যায়নের সময় এসেছে। নইলে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা, আর্থসামাজিক অগ্রগতি এবং সভ্যতার নিদর্শন সব কিছুই বড় হুমকির মুখে পড়বে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার আহ্বানে বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে সৈন্য না পাঠাক, ড্রোন হামলা শুরু করে দেবে তা মনে হয় না।
তবে এর ফলে বাংলাদেশে নিউকনিদের সঙ্গে আমাদের মোলাকাত হয়ে যাচ্ছে, এটাই নগদ লাভ। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।