১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর বিশেষ করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যা করার পর বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় নীতির পরিবর্তন ঘটে। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাংলাদেশকে ইসলামের মূল্যবোধের রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত করতে সচেষ্ট হন। তিনি একাজ যতোটা এগিয়ে নিয়ে যান তার চেয়েও এক ধাপ সামনে নিয়ে যান তারপরের প্রেসিডেন্ট এরশাদ। জিয়াউর রহমান একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বলে এবং তার দলে আওয়ামী বিদ্বেষী অনেক মুক্তিযোদ্ধার আশ্রয় হয়েছিল বলে রাজনীতির ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমান জোরেশোরে কখনো ধর্মীয় রাজনীতির শ্লোগান দিয়ে রাজনীতির মাঠ গরম করেননি। পরের বিএনপি অর্থাৎ খালেদা জিয়ার বিএনপিও প্রথম দিকে ধর্মীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে অতোটা খোলামেলা ছিল না।
সকলেই বুঝতো, সকলেই জানতো কিন্ত প্রকাশ্যে তা কখনো এজেন্ডায় আনতো না। এর ফলে ধর্মীয় অনুভূতির রাজনীতির বাইরে অবস্থান করার কিছু রাজনীতিবিদও তাদের দলে ঠাঁই করে নিয়েছিলেন। এমনকি বিএনপির শাসনামলে হিন্দু হয়েও মন্ত্রী হয়েছিলেন শ্রী গয়েশ্বর রায়। তবে ধীরে ধীরে বিএনপি পর্দা সরাতে থাকে। এর চরম বিকাশ ঘটে যখন তারা জামাতের সঙ্গে জোট বেঁধে সরকার গঠন করে।
জামাতসহ অন্যান্য ধর্মীয় অনুভূতির ইসলামিক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির জোট বাঁধার ফলে জনগণের কাছে বিএনপির নীতি স্পষ্টতা লাভ করে। এর মধ্যে আসে বিএনপির দুর্দিনের সময়। ১/১১ এর পটপরিবর্তনের ফলে বিএনপি কঠিন রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। দু’বছরের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে এবং বিশেষ করে শেষের দিকে এসে বিএনপি জামাতকে আরো নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে। ফলে তাদের সমর্থক-কর্মী এবং নেতৃত্বের কাছে তাদের রাজনীতির দর্শন আরো কিছুটা সুস্পষ্ট হতে থাকে।
একসময় তারা প্রকাশ্যে বলা শুরু করে যে তাদের দল ইসলামিক মূল্যবোধের ওপর দণ্ডায়মান। এমন একটি পরিস্থিতিতে তারা গণতন্ত্র এবং ইসলামিক মূল্যবোধ এই দুই ভিন্নধর্মী মতবাদের মিশ্রিত একটি ধারার রাজনীতিতে বিশ্বাসী হওয়ার ভাবমূর্তি ধারণ করেছে।
''সাম্প্রদায়িকতা" হচ্ছে এক ধরনের মনোভাব। কোন ব্যক্তির মনোভাবকে তখনই সাম্প্রদায়িক বলে আখ্যা দেওয়া হয় যখন সে এক বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্তির ভিত্তিতে অন্য এক ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং তার অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধচারণ এবং ক্ষতিসাধন করতে প্রস্তুত থাকে। এ ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তিবিশেষের ক্ষতিসাধন করার মানসিক প্রস্তুতি সেই ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ পরিচয় অথবা বিরুদ্ধতা থেকে সৃষ্ট নয়।
ব্যক্তিবিশেষ এ ক্ষেত্রে গৌণ, মুখ্য হলো সম্পদায়। ধর্মনিষ্ঠার সাথে সম্পর্ক আছে ধর্মীয় তত্ত্ব এবং আচার বিচারের। সাম্প্রদায়িকতার যোগ আছে সম্পদায়ের সাথে। অর্থাৎ ধর্মনিষ্ঠার ক্ষেত্রে ব্যক্তির নিজের আচরণ এবং ধর্মবিশ্বাসের গুরুত্ব বেশি। সাম্প্রদায়িকতার ক্ষেত্রে নিজের ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি বিশেষ এক জাতীয় আনুগত্যের গুরুত্ব বেশি।
এ ছাড়া সত্যকার ধর্মনিষ্ঠা পরকালমুখী। পরকালেই তার সত্যকার পুরস্কারের আশা। সাম্প্রদায়িকতার মুনাফা ইহলোকে। ধর্মনিষ্ঠার জন্য অন্যের বিরুদ্ধাচরণের প্রয়োজন নেই। আর "অসাম্প্রদায়িকতা" এ ধারার সম্পূর্ণ বিপরীদ।
আওয়ামী লীগের জন্মলগ্ন থেকেই অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির চিন্তাধারার কথা তারা বলে আসছে। আওয়ামী লীগে তাই শুধু মুসলিম সমর্থকই নেই বরং হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ সমর্থকরাও আছে। ভুল রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজির কারণে মাঝে মধ্যে আওয়ামী লীগ অসাম্প্রাদায়িকতার বিরুদ্ধে কিছুটা কার্যকরণ হাতে নিলেও বৃহত্তর ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ বরাবরই ধর্মীয় মূল্যবোধের রাজনীতির বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দু’বছরের ক্রান্তিকালে আওয়ামী লীগের এই অসাম্প্রদায়িক মনোভাব আরো সুস্পষ্ট হয়েছে, আরো দৃঢ়তা পেয়েছে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের একটি বিশাল অংশ আওয়ামী লীগের সমর্থক থাকায় তাদের একটি সবল চাপ সবসময়ই আওয়ামী লীগকে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি চর্চায় সাহায্য করেছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।