সি রা জু র র হ মা ন
শেখ মুজিবুর রহমানকে আমি স্কুলজীবন থেকেই মুজিব ভাই ডেকেছি আমার বড় ভাইয়ের (প্রয়াত এয়ার কমোডোর এবিএম মাহবুবুর রহমান) সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বের সূত্রে; তিনিও বরাবরই আমাকে (এবং পরবর্তীকালে আমার স্ত্রীকেও) স্নেহ করেছেন। নিজের ভাই বারোয়ারি বন্ধুর চাইতে অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ, সে বিবেচনায় আমি তাঁকে বঙ্গবন্ধু বলিনি বলে কেউ কেউ তাঁকে আমার বিরুদ্ধে উসকে দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন।
সাত বছর আমি ব্রিটিশ ইনফরমেশন সার্ভিসে সম্পাদক ছিলাম। খণ্ডকালীন দৈনিক ইত্তেফাকে সম্পাদকীয় লেখার সময় প্রায়ই তাঁর সঙ্গে দেখা হতো। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা প্রায়ই সন্ধ্যাবেলা ইত্তেফাকের অফিসে আসতেন।
বিবিসির কর্মজীবনে দেশে গেলেই মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করতাম। ১৯৬৯ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের শীর্ষ নেতাদের অনেক সাক্ষাত্কার নিয়েছিলাম। মুজিব ভাই তখন বলেছিলেন, দেশে জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও বিদেশে তিনি অপরিচিতই রয়ে গেছেন। আমি প্রস্তাব দিয়েছিলাম যে লন্ডন বিশ্বের মিডিয়া ক্যাপিটাল, লন্ডনে এলে ব্রিটিশ ও অন্যান্য দেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দিতে পারি।
সে বছরের নভেম্বরে শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডনে আসেন।
ফ্লিট স্ট্রিটের সিনিয়র সাংবাদিকসহ কয়েক ডজন সাংবাদিকের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত্কারের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। দেশে ফিরে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে যে চিঠি তিনি লিখেছিলেন আমার স্ত্রী সেটা যত্ন করে এখনও রেখে দিয়েছেন। বাংলাদেশ যে স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশীদের সর্বপ্রথম সে খবর শুনিয়েছিলাম আমি। পাকিস্তান থেকে মুক্তি পেয়ে বাহাত্তরের ৮ জানুয়ারি শনিবার ভোরে মুজিব ভাই লন্ডনে আসেন। সেদিন অনেক আলাপ হয়েছিল তাঁর সঙ্গে।
আমার একাধিক বইতে সে সম্বন্ধে বিস্তারিত বিবরণ আছে।
ব্রিটেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় ১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। দু’দিন পরে আমি স্বাধীন বাংলাদেশের পথে যাত্রা শুরু করি। লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশন টেলিফোনে জানিয়েছিল যে ঢাকায় এরিনমোর পাইপ টোব্যাকো পাওয়া যাচ্ছে না বলে মুজিব ভাইয়ের অসুবিধা হচ্ছিল। আমি নিজে থেকে দুই পাউন্ড এরিনমোর তামাক এবং একটা ডানহিল পাইপ (সে পাইপ তাঁর মৃতদেহের সঙ্গে সিঁড়িতে পড়েছিল) তাঁর জন্য নিয়ে যাই।
খুবই খুশি হয়েছিলেন তিনি। পুরনো গণভবনে তাঁর আপিসে অন্তত ডজনখানেক লোক ছিলেন। পাইপটা তিনি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখলেন, সবাইকে বললেন, ‘আমি ঘুষ খাই না, কিন্তু সিরাজ আমার ভাই, সে পাইপ আর তামাক এনেছে, সেটা আমি খাব। ’
সে যাত্রায় কয়েকবারই তাঁর সঙ্গে দেখা করেছি। একদিন তিনি বললেন, মুক্তিযুদ্ধে তুই যা যা করেছিস আবু সাঈদ চৌধুরী (রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী) সবই আমাকে বলেছেন।
বিদেশে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য তুই তাঁকে যেসব প্রস্তাব দিয়েছিলি সেগুলো লিখে প্রেসিডেন্টকে দিয়ে যাস। আর, তোকে পুরস্কার দেয়া দরকার। কী চাস তুই? কয়েক সেকেন্ড ভেবে বললাম, আপনার যে পোর্ট্রেট ফটো আপনার সবচাইতে বেশি প্রিয় আমি সেটা চাই। কামাল লোহানী তখন অস্থায়ী জনসংযোগ অধিকর্তা ছিলেন। মুজিব ভাই তাঁকে বললেন তাঁর সব পোর্ট্রেট তাঁর আপিসে পাঠাতে।
আমি আবার গেলাম ২২ ফেব্রুয়ারি (১৯৭২)। লক্ষ্য করলাম সাদা পাঞ্জাবি-কোর্তা পরা একটা ছবি তিনি বার বার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখছেন। ছবিটা আমি তাঁর হাত থেকে নিলাম। পকেট থেকে কলম বের করে বললাম লিখে দিন যে ছবিটা আমাকে দিলেন, আর সবাইকে নির্দেশ দিন, এ ছবি অন্য কোথাও ব্যবহার করা যাবে না। তিনি লিখলেন, ‘স্নেহের সিরাজকে, তোমার মুজিব ভাই, ২২.২.৭২)।
সে ছবি সযত্নে লন্ডনে আমার বাড়িতে আছে। এরই মধ্যে রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বঙ্গভবনে আমাকে আমন্ত্রণ করেছিলেন। বিদেশে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা সম্বন্ধে আমার চিন্তা-ভাবনার কথা ১২ পাতার টাইপ করা এক দলিলে তাঁর হাতে দিয়ে এসেছিলাম।
মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে আবার দেখা সে বছরেই। চিকিত্সার জন্য তিনি লন্ডনে এসেছিলেন।
হাইকমিশনার সৈয়দ আবদুস সুলতান টেলিফোন করে তাঁর আগমনবার্তা দিয়ে বললেন, আমাকে এবং আমার স্ত্রীকে অবশ্যই বিমানবন্দরে যেতে হবে। ওরা স্ট্রেচারে করে তাঁকে অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে যাচ্ছিল। মুজিব ভাই আমার হাত ছাড়ছিলেন না। বললেন, তোর সঙ্গে অনেক কথা আছে, হাসপাতালে আসিস। সুলতান সাহেবকে বললাম উনি একটু সুস্থ হলেই আমার জন্য একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দিতে।
সেদিন ছিল বুধবার। শনিবার ভোরে তাঁর ব্যক্তিগত চিকিত্সক অধ্যাপক নূরুল ইসলাম টেলিফোন করলেন। বললেন, আপনি দেখা করতে এলেন না, প্রধানমন্ত্রী একটু বিরক্ত হয়েছেন, শিগগির চলে আসুন আপনি।
ব্রিটিশের গোলামি বনাম বাংলাদেশের সেবা
লন্ডন ক্লিনিকে তাঁর স্যুইটে ঢুকতেই মুজিব ভাই আমাকে বিছানার ওপর তাঁর পাশে বসতে বললেন। আমার স্ত্রী গিয়ে বসলেন ভাবীর পাশে চেয়ারে।
প্রধানমন্ত্রী ভাবীকে বললেন আমাদের চা দিতে। আমি ইতস্তত করছিলাম। আমার হাতে মৃদু চাপ দিয়ে তিনি বললেন, খা এক পেয়ালা চা, তাহলে আমাকেও দেবে এক পেয়ালা। স্যুইটে আরও ছিলেন হাইকমিশনের কাউন্সেলার নূরুল মোমেন খান মিহির, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব আবুল হাশিম, এমআর আখতার মুকুল আর খুব সম্ভবত এবিএম মূসা। চা খেতে খেতে মুজিব ভাই বললেন, সারাজীবন কি ব্রিটিশের গোলামি করবি? বাংলাদেশের কাজ করবি না? আমি বললাম, বাংলাদেশের কাজ আমি কবে করিনি, মুজিব ভাই? তিনি বললেন, জানি রে, আবু সাঈদ চৌধুরী আমাকে সবই বলেছেন।
তুই তাঁকে যে থিসিসটা দিয়েছিলি সেটা তিনি আমাকে দিয়েছেন। সেজন্যই তোকে ডেকেছি। সে কাজগুলো করবি তুই? আমি বললাম, আপনি বললেই করব। আরও কয়েক মিনিট সাধারণ গল্প-গুজারী করে আমরা তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিলাম।
লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, হঠাত্ মিহির এলেন ছুটতে ছুটতে।
বললেন, আপনাকে আবার ডেকেছেন, আসুন। ফিরে যেতেই মুজিব ভাই বললেন, হাশিম বলছে তুই বাংলাদেশের চাকরি করবি না, বিবিসি তোকে অনেক মাইনে দেয়, অত টাকা তো আমি তোকে দিতে পারব না। আমি বললাম, সেটা হাশিমের কথা, আপনি কত মাইনে দেবেন সেটা তো আমি জিজ্ঞেস করিনি। আমরা চলে এলাম। বিবিসির চাকরি ছেড়ে দিতে হবে ভেবে মন খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু মুজিব ভাইকে কথা দিয়েছি!
এরপরও অনেকবার দেখা হয়েছে মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে, বেশ কয়েকটা সাক্ষাত্কারও নিয়েছি তাঁর। ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে সাধারণ নির্বাচনের খবর দিতে গিয়েছিলাম। আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরির ময়দানে আর ধামরাইয়ের জনসভায় যাওয়ার সময় মুজিব ভাই আমাকে আর লন্ডন টাইমসের রিচার্ড হ্যারিসকে হেলিকপ্টারে সঙ্গে নিয়েছিলেন। শুনেছিলাম তাঁর নির্দেশেই বিটিভি তাদের নির্বাচনী ফলাফলের অনুষ্ঠানে আমাকে ডেকেছিল। সে অনুষ্ঠানের শেষে প্রধানমন্ত্রী টেলিফোন করেন।
অনেক গল্প হয়েছিল। শেষে তিনি বললেন পরদিন ভোরে তাঁর আপিসে যেতে। মার্ক টালি আর আমি গিয়েছিলাম। এসবের বিস্তারিত বিবরণ আছে আমার ‘এক জীবন এক ইতিহাস‘ বইতে। সে নির্বাচনের কোনো সঙ্গত কারণ অনেকেই খুঁজে পাননি।
কিন্তু তাতে রাজনৈতিক তর্কবিতর্ক নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ফলাফল ঘোষণার পরের দিন আমি তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলাম বেতার-টেলিভিশনে জাতীয় ঐক্য ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানাতে। কিন্তু গাজী গোলাম মোস্তাফা বিরোধিতা করেন, ‘ওরা’ (জাসদ) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নাকি ‘বেয়াদপী’ করেছে, সুতরাং মুজিবকে ‘ভিক্টোরি’ মার্চে যেতে হবে। মুজিব ভাই সেদিন গাজী গোলাম মোস্তাফার কথাই শুনেছিলেন।
আজীবন সৌহার্দ্য
ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সঙ্গে আমার প্রীতি ও সৌহার্দ্যের সম্পর্ক বরাবরই বজায় ছিল।
চাকরির প্রসঙ্গ তিনি আর তোলেননি, আমিও অনেক বিব্রত হওয়ার হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিলাম। আমাদের মধুর সম্পর্কে প্রথম ও শেষবার কিছুটা তিক্ততা ঘটে ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে। প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান জ্যামাইকায় কমনওয়েলথ সরকারপ্রধান সম্মেলনে যোগ দিয়ে দেশে ফেরার পথে হিথরো বিমানবন্দরে কয়েক ঘণ্টা থেমেছিলেন। সে বছরের জানুয়ারিতে তিনি সংবিধান পরিবর্তন করে সব রাজনৈতিক দল (আওয়ামী লীগসহ) নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং নতুন বাকশাল দলের প্রধান হিসেবে প্রাথমিকভাবে সাত বছরের জন্য নির্বাহী প্রেসিডেন্ট হন। সরকারি মালিকানাধীন চারখানি ব্যতীত (দৈনিক বাংলা, ইত্তেফাক, বাংলাদেশ টাইমস ও বাংলাদেশ অবজারভার) অন্য সব পত্রপত্রিকাও বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল।
স্বভাবতই ব্রিটিশ মিডিয়া মুজিবের মুখেই এসব পরিবর্তনের ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছিল। বিমানবন্দরের একটা ভিআইপি রুমে ফ্লিট স্ট্রিটের সব পত্রিকা আর রেডিও-টেলিভিশন চ্যানেলের প্রতিনিধিরা ভিড় করেছিলেন। আমি ঢুকতেই প্রেসিডেন্ট ইংরেজিতে বললেন, তুমি কেন এসেছ সিরাজ? আমি তো তোমাকে ইন্টারভিউ দেব না। আমি বাংলাতেই বললাম, সাক্ষাত্কার কেন দেবেন না, মুজিব ভাই? আপনি আমাকে সবসময় সাক্ষাত্কার দিয়েছেন, আজও দেবেন। তিনি আবারও ইংরেজিতে বললেন, সারা পৃথিবী আমাকে সমর্থন করে, তুমি শুধু একলা আমার বিরোধিতা কর।
বুঝলাম, বাকশাল গঠন আর পত্রপত্রিকার ওপর নিষেধাজ্ঞার যেসব সমালোচনা বিবিসিতে প্রচারিত হয়েছে, সেগুলোর অতিরঞ্জিত বিবরণ তাঁকে দেয়া হয়েছে। এবার আমি ইংরেজিতে বললাম, ইংরেজি আমিও একটু-আধটু বলতে পারি, মুজিব ভাই; আপনি কি চান যে আমাদের ভেতরের কথা মিডিয়ার ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলাদের শোনাই? ততক্ষণে মুজিব ভাই হয়তো লক্ষ্য করেছিলেন যে উপস্থিত এতজন সাংবাদিক সবিস্ময়ে আমাদের বিতর্ক শুনছেন। তিনি একটু হেসে বললেন, ‘জেন্টেলমেন, সিরাজ আমার ভাই, আমি ওর সঙ্গে রসিকতা করছিলাম। ’ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেল। সংবাদ সম্মেলন শেষে বিস্তারিত সাক্ষাত্কার দিয়েছিলেন তিনি আমাকে।
(এক জীবন এক ইতিহাস দ্রষ্টব্য)
মর্মান্তিক হত্যা, অনুপস্থিত শোক
এর এক মাসের মাথায় শেখ মুজিবুর রহমান পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্যসহ মর্মান্তিকভাবে নিহত হন। প্রবাসী বাংলাদেশীরা মুক্তিযুদ্ধে অজস্র ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট তাঁদের কয়েকজন লন্ডনের বাংলাদেশ হাইকমিশনে ঢুকে কূটনীতিকদের অপমান করেছেন, দেয়াল থেকে জাতির পিতার ছবি নামিয়ে তার ওপর নাচানাচি করেছেন। সেদিন সন্ধ্যায় আইটিএনের খবরে সেসব ছবি দেখছিলাম। শুনেছিলাম বাংলাদেশে সেদিন মিষ্টান্ন বিতরণ করা হয়েছিল।
বছরের শেষের দিকে আমি ঢাকা ছাড়াও খুলনা, যশোর, চাটগাঁ, সিলেট ও রাজশাহীতে গিয়েছিলাম। সর্বত্রই আমি জানতে চেয়েছিলাম জাতির পিতার হত্যায় কেউ কেঁদেছিলেন কিনা, কাউকে কাঁদতে দেখেছিলেন কিনা। কেউ হ্যাঁ বলেননি, অধিকাংশই চুপ করে থেকেছেন।
আমি অজস্রবার ভেবেছি, এখনও ভাবি। বাহাত্তর আর পঁচাত্তরের মাঝে এমন কী হয়েছিল যাতে স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা এবং সর্বজন বরেণ্য জাতির পিতা সম্বন্ধে মনোভাব অমন আকাশ-পাতাল বদলে গিয়েছিল।
অবশ্যি মনে মনে আমি কার্যকারণগুলো ঠাউরে নিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় তিনি অনুপস্থিত ছিলেন। তখন দেশে সঠিক কী ঘটেছিল, কার কী ভূমিকা ছিল তিনি মোটেই জানতে পারেননি। দেশে ফেরার পর যারা সর্বাগ্রে তাঁর কাছে এসেছিলেন তাদেরই তিনি দায়িত্বপূর্ণ পদগুলোতে বসিয়ে দেন। যেমন, পাকিস্তান সরকারের বার্তা সংস্থা এপিপির পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান আবুল হাশিম কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে তাঁর সঙ্গে পড়তেন।
১০ জানুয়ারি (১৯৭২) ঢাকা বিমানবন্দরে তিনি প্রথমেই এসে শেখ মুজিবের পা ছুঁয়ে সালাম করেন। ওখানেই মুজিব তাত্ক্ষণিকভাবে হাশিমকে তাঁর প্রেস সচিব নিযুক্তি দেন। অথচ হাশিম মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সমর্থনে বেশকিছু প্রবন্ধ-প্রতিবেদন লিখেছিলেন। একাত্তরের সেপ্টেম্বর মাসে তাঁর স্বাক্ষরিত একটা প্রতিবেদন লন্ডন টাইমস পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়, টাইমস প্রতিবেদনের শিরোনাম দিয়েছিল, ‘আওয়ামী লীগের অধিকাংশ সাংসদ জে. ইয়াহিয়া খানকে সমর্থন করে’।
যতবারই ঢাকায় মুজিব ভাইর সঙ্গে দেখা করতে গেছি দেখেছি কিছু চেনা লোক তাঁকে ঘিরে আছে।
সর্বক্ষণ কিছু লোক তাঁকে মানপত্র দিচ্ছে, কবিতা কিংবা স্তবস্তুতি শোনাচ্ছে, ফুলের মালা দিচ্ছে তাঁকে। আর সবসময়ই দেখতাম তোফায়েল আহমেদ কিংবা আবদুর রাজ্জাক উপস্থিত আছেন তাঁর আপিসে। তিয়াত্তরে একদিন প্রধানমন্ত্রীর জামাতা (শেখ হাসিনার স্বামী) ড. ওয়াজেদ মিয়া ইন্টারকন্টিনেন্টাল (পরে শেরাটন) হোটেলে আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। বললেন, উনি (প্রধানমন্ত্রী) সর্বক্ষণ ফুলের মালা নিচ্ছেন, এদিকে অর্থনৈতিক সঙ্কট, দুর্নীতি ইত্যাদির দরুন দেশের সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে। শুনেছি আপনার সঙ্গে ওনার সম্পর্ক ভালো, আপনার কথা উনি শোনেন।
আপনি আসুন না আমার সঙ্গে ওনার আপিসে? আমি গিয়েছিলাম ড. ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে। মুজিব ভাই বরাবরের মতোই আমাকে পাশে বসালেন, আমার কাঁধে হাত রাখলেন, আর আমাকে চা ও রসগোল্লা খাওয়ালেন। কিন্তু তাঁর মনোযোগ ছিল স্তবস্তুতি আর ফুলের মালার দিকে। প্রায় আড়াই ঘণ্টা বসে থাকার পর ওয়াজেদ মিয়া ইশারা দিলেন, আবার আসব বলে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিলাম।
ওয়াজেদ মিয়া আমাকে ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে তাঁর শাশুড়ির কাছে নিয়ে গেলেন।
বললেন, আপনার যা বলার আমার শাশুড়িকে বলে যান, হয়তো ওনার কথা শুনবেন প্রধানমন্ত্রী। ভাবী আমাকে খেয়ে যেতে বললেন। আমি বললাম, মুজিব ভাই এলে একসঙ্গে খাব। তিনি বললেন, আপনার ভাই কখন আসবেন কেউ জানে না, কোনোদিন রাত দু‘টো-তিনটাও হয়ে যায়। একটু হেসে বললেন, আপনি কথা বলবেন কি, আমিও তো কথা বলার সুযোগ পাই না।
ওয়াজেদ মিয়া আর আমাকে তিনি খেতে দিয়েছিলেন এগারোটার দিকে। আমরা যখন বেরিয়ে আসি মুজিব ভাই তখনও ফেরেননি।
রক্ষীবাহিনী, সেনাবাহিনী
বলতে চেয়েছিলাম এই যে, তাঁকে ঘিরে থাকা লোকগুলো স্তবস্তুতি আর ফুলের মালা দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে সর্বক্ষণ নেশাগ্রস্ত করে রেখেছিল। তাঁর নামে তারা কী করছে সেটা তিনি জানতেন না বলেই আমার বিশ্বাস। এবং বহু গর্হিত কাজ হয়েছে তাঁর নামে।
একমাত্র জাসদ (জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল) ছাড়া আওয়ামী লীগের তখন কোনো বিরোধী ছিল না বললেই চলে। রক্ষীবাহিনীকে দিয়ে সে বিরোধিতা নির্মূল করা হয়। তখনকার অনুমানে ৪০ হাজার লোক খুন করেছিল রক্ষীবাহিনী। জাতীয় সেনাবাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধাই বেশি ছিল। তাদের অধিকাংশেরই ইউনিফর্ম ছিল না।
কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে আমি সৈনিকদের দেখেছি রবারের স্যান্ডেল পরে কুচকাওয়াজ করতে। কিন্তু ঢাকায় রক্ষীবাহিনী ভারতীয় সেনাবাহিনীর মতো নতুন ইউনিফর্ম পরে নতুন জিপে চলাফেরা করছিল। রক্ষীবাহিনীর এই ইউনিফর্মের কারণে চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে দেরি করছিল। চীন জাতিসংঘে রক্ষীবাহিনীর ফটো পেশ করে বলেছিল যে বাংলাদেশ তখনও ভারতের দখলে আছে।
রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে জাতীয় সেনাবাহিনীর স্বভাবতই ঈর্ষার সম্পর্ক ছিল।
তাছাড়া মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধা নিয়ে সেনাবাহিনীতেও কিছু রেষারেষি ছিল। এরপর পাকিস্তান থেকে রিপ্যাট্রিয়ট অফিসাররা দেশে ফিরে এসে দেখেন তাঁদের অনেক জুনিয়র ডবল প্রমোশন পেয়ে সিনিয়র হয়ে গেছেন। অর্থাত্ ত্রিমুখী একটা রেষারেষি গড়ে ওঠে। এর ওপরও আবার কর্নেল তাহের ও সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বে জাসদ তখনকার গণচীনের অনুকরণে স্বেচ্ছাসেবক অনিয়মিত সমাজতান্ত্রিক সেনাবাহিনী গঠনের আন্দোলন শুরু করলে সেনাবাহিনীর মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী বিবাদ-বিসম্বাদ অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়।
ওদিকে উপেক্ষা আর অব্যবস্থাপনায় অর্থনীতির অবস্থা শোচনীয় হয়ে ওঠে।
কলাপাতা জড়িয়ে লাশ দাফন করার খবর আমি নিজে পরিবেশন করেছি। আমার বন্ধু একজন প্রথম শ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তার দুরবস্থা দেখে আমি আমার নিজের একজোড়া ট্রাউজার ও একটা শার্ট বাদামি রঙের খামে করে তাঁর টেবিলে রেখে এসেছিলাম। এবং দুর্নীতিও চরমে উঠেছিল তখন। দুর্নীতির বহু কাহিনী প্রধানমন্ত্রীর পরিবারকেও স্পর্শ করে যাচ্ছিল। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন যেমন বলেছেন, বাংলাদেশে তখন যথেষ্ট খাদ্য ছিল কিন্তু অব্যবস্থাপনার কারণে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়।
সে দুর্ভিক্ষে ৭০ হাজার লোক মারা গিয়েছিল বলে মিডিয়ায় তখন ব্যাপকভাবে বলাবলি হচ্ছিল। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আইভোরি টাওয়ারে নির্বাসিত প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান এসব বিষয় জানতে কিংবা বুঝতে পারেননি।
দেশজোড়া অসন্তোষ যখন চরমে ওঠে ঘনিষ্ঠ আমলাদের পরামর্শে শেখ মুজিবুর রহমান সংবিধান সংশোধন করে বিশেষ ক্ষমতা আইন জারি করেন। সে আইনে বহু হাজার লোককে বিনাবিচারে আটক করা হয়েছিল। এসবও হয়তো জাতির গা সওয়া হয়ে যেত, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তাঁর দুষ্ট উপদেষ্টাদের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারেননি।
তাঁদের পরামর্শে তিনি আফ্রিকার কোনো কোনো দেশের তত্কালীন দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে যখন বাকশালী পদ্ধতি চালু করলেন দেশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত মানুষ ক্রোধে টগবগ করে ফুঁসছিল। সেনাবাহিনীর মাঝারি কাতারের কিছু অসন্তুষ্ট অফিসার তখন স্থির করলেন সে অবস্থায় তাঁরা যদি ক্ষমতা পরিবর্তনের লক্ষ্যে আঘাত হানেন তাহলে জনসাধারণ রুখে দাঁড়াবে না। বাস্তবেও হয়েছিল তা-ই।
স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় কৃত্রিম প্রতিবন্ধক
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনাবলীর পেছনে খুব সম্ভবত বিদেশি ষড়যন্ত্রও কিছু ছিল। শেখ মুজিবের সমাজতন্ত্রের নীতি ওয়াশিংটনে ভালো চোখে দেখা হয়নি।
একই কারণে কঙ্গোর প্যাট্রিস লুমুম্বা আর চিলির সালভাতোর আইয়েন্দে নিহত হয়েছিলেন। শেখ মুজিবের হত্যার প্রাথমিক খবরাদি বিবিসির নিউজরুমে আসছিল ওয়াশিংটন থেকে। সে যা হোক, মুজিব হত্যার পরেও সেনাবাহিনীর টালমাটাল অবস্থা আরও কিছুকাল চলে। অবশেষে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান দৃঢ় হাতে সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার প্রয়াস পান। একইসঙ্গে গণতান্ত্রিক রাজনীতির পুনর্বাসন এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে এনে তিনি পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক করে এনেছিলেন।
জিয়া আওয়ামী লীগের দুজন শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন ও আবদুর রাজ্জাককে দিল্লি পাঠিয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে দেশে ফিরিয়ে আনেন। দুর্ভাগ্যবশত তার ১৩ দিনের মাথায় আরও এক সামরিক ষড়যন্ত্রে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হন। সে ষড়যন্ত্র সম্বন্ধে কোনো তদন্ত হয়েছে বলে আমার জানা নেই।
সময়ের গতির সঙ্গে সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান সম্বন্ধে সাধারণ মানুষের স্মৃতি অনেকটা সুস্থ এবং স্বাভাবিক হয়ে এসেছিল। এ উপলব্ধি আসছিল যে মুজিবের আমলে যেসব অন্যায় ঘটেছিল তার সবগুলোর জন্যই তিনি ব্যক্তিগতভাবে দায়ী ছিলেন না।
স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা এবং জাতির পিতা হিসেবে তাঁর আসন ধীরে ধীরে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল। প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিশেষ ছিল না। জাতির পিতা এবং দলীয় প্রধানমন্ত্রীর সাংঘর্ষিক অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন বলেই মহাত্মা গান্ধী কিংবা নেলসন ম্যান্ডেলার মতো অবিসংবাদিত ভক্তি-শ্রদ্ধা তিনি বজায় রাখতে পারেননি।
দুর্ভাগ্যবশত মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনা ইতিহাসের সে অধ্যায়টি থেকে উপযুক্ত শিক্ষা নিতে ব্যর্থ হয়েছেন। মুজিবের ভুলভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নেয়ার পরিবর্তে সেসব ভুলকে মূলধন করেই তিনি রাজনীতি করছেন।
১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি মুজিব পাকিস্তান থেকে লন্ডনে আসেন। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশে কী হয়েছিল তিনি জানতেন না। যুদ্ধে আনুমানিক তিন লাখ লোক মারা গিয়েছিল বলে আমরাই তাঁকে বলেছিলাম। আমার বিশ্বাস, তিনি অসতর্কতাবশত ডেভিড ফ্রস্টকে তিন মিলিয়ন সংখ্যাটা বলে ফেলেছিলেন। শেখ হাসিনা এবং তাঁর সরকার সে ভুলটাকেই দেববাক্যের মতো অকাট্য প্রমাণ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন বলেই মনে হয়।
এর কোনো যুক্তিযুক্ততা সাধারণ মানুষের বোধগম্য হবে বলে মনে হয় না।
শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা এবং জাতির পিতা ছিলেন। কিন্তু তিনি যখন আওয়ামী লীগদলীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী হলেন তখন থেকে তিনি আর বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিলেন না। এখন আবার তাঁকে ব্যাপকভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতির পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। শেখ হাসিনা আইন করে এবং সংবিধানের বিতর্কিত পরিবর্তন করে জবরদস্তি তাঁর পিতার জন্য শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আদায় করার অসম্ভব চেষ্টা করছেন।
অর্থাত্ আরও একবার শেখ মুজিবুর রহমানকে রাজনৈতিক বিতর্কে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে। বিতর্কের ঊর্ধ্বে তাঁর যে একটা আসন ধীরে ধীরে আবার গড়ে উঠছিল সে প্রক্রিয়ায় আবার ছেদ পড়েছে। আমার মনে হয় তাতে শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিকেও এখন হত্যা করা হচ্ছে। জাতির জন্য সেটা একটা দুর্ভাগ্য।
ত্রুটি স্বীকার : গত সপ্তাহের কলামে অনবধানতাবশত মুফতি ফজলুল হক আমিনীর পরিবর্তে আমি মতিয়ুর রহমান নিজামী লিখে ফেলেছিলাম।
এ অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্য আমি দুঃখিত ও লজ্জিত। সি.র.
(লন্ডন, ১৫.০৮.১১)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।