আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মায়াবী কথকতা

ভীষণ এক আলস্যে, শীতের মিঠে রোদে ঝিমিয়ে পড়ে আছে দুপুরটা। ক্রিসেন্ট লেকে রোদ মাথায় নিয়ে কাকগুলো আর চড়–ইগুলো কৃষ্ণচুড়ার সবুজ ছুঁয়ে ছুঁয়ে উড়ে যাচ্ছে হঠাৎ হঠাৎ। গাড়ির বনেটে তেছরা রোদের চকিত প্রতিফলন, পিচ রাস্তায় কখনও কখনও ভীষণ ছলকে উঠছে গাড়ির আয়নায় প্রতিফলিত রোদ, দূরে সোজা রাস্তায় গাড়িগুলো এক কাঁপা কাঁপা আলোক তরঙ্গের ভিতরে হুটহাট হারিয়ে যাচ্ছে আচমকা! একি বাস্তব? না যাদু? নাকি যাদু-বাস্তব দুই? এমনি এক ঝিমুনি রোদে, লেকের পাশ দিয়ে যেতে যেতে চোখ আটকে যায় পানিতে, কখনও কখনও উপরে আকাশটার পানেও দৃষ্টি উঠে যায় । কেমন যেন এক অলৌকিক আর সুররিয়াল চিত্রকল্প রচিত হতে থাকে আমার অলক্ষ্যেই। আকাশের আরও উপরে দু’একটা চিল ধীরে উড়ে বেড়ায়।

এমন আদিগন্ত রূপচিত্রে আমি হতভম্ব হয়ে যাই যখন তখন। তখন আর অকারণ ছুটোছুটি বৃথাই মনে হয়। অথচ মাথায় কাজের পোকাটা ঠিকই টিকটিক করে জানান দিয়ে যায়, ভাবনাটা যদিও সংগোপনে ছিলই! গত সংখ্যার মত এবারও অদ্বৈত-র জন্য শিল্পচর্চা বিষয়েই লেখাটা হবে, এরকম ভাবনাটার রূপ দেয়াটাই ছিল মুখ্য, আর এসমস্ত বিচ্ছিন্ন ভাবনা ভাবতে ভাবতেই পথ চলছিলাম । এভাবেই একটা একটা করে দিনগুলো এমনি এমনিই চলে যায়, কোন কিছু ঠিক হয়ে উঠে না। তারপর জোর করেই একদিন টেবিলে বসি।

লেখাটা শুরুও করি সেমতই। কিন্তু কোথায় যেন বারবার আটকে যাচ্ছিলাম, ভিতর থেকে তাগিদটা ঠিক কাজ করছিল না। তখনই মনে হল যদি স্বতঃস্ফুর্তভাবে ভিতর থেকে তাগিদটা না আসে তাহলে যে কোন সৃষ্টিশীল কাজই থমকে যায়। অনুভূতি এবং আবেগ তাই শিল্প সৃষ্টির অন্যতম প্রধান নিয়ামক। শীতের হিমেল আমেজের সাথে সাথে শিল্পচর্চার ক্ষেত্রেও যেন এক মন্দা সময় অতিবাহিত করছি আমরা, দেশের রাজনৈতিক টানাপোড়েন এবং সামগ্রিক পরিস্থিতিও এর জন্য বেশ খানিকটা দায়ী।

শীতটাও কিছুদিন বেশ ভুগিয়েছে সবাইকে, তার উপস্থিতি টের পাইয়ে দিচ্ছে অহরহ। বস্তুত এ সময়টায় কি নিয়ে লেখা যেতে পারে তা নিয়ে খানিকটা দ্বন্দ্বের মাঝেই আরও কতকটা সময় পেরিয়ে যায়। এরকম ভাবতে ভাবতেই দেখি ফেব্র“য়ারী সমাগত । এসময়টায় সারা দেশেই শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির নানাবিধ কর্মকান্ড দেখা যাবে। একবার ভাবি যে, বইমেলা নিয়ে লিখি, আবার ভাবি যে শীতকে নিয়ে লিখি।

এরকম দোটানায় থাকতে থাকতেই লেখাটা হঠাৎ করেই সেদিন শেষ পর্যন্ত দানা বেঁধে উঠে। অনেকে ভাবতে পারেন যে, এত বড় ভূমিকার কি দরকার ছিল! আসলে এখানে এটি উল্লে¬খ করার কারণ আর কিছু নয় এটিই দেখান যে আবেগ ও অনুভূতি যে কোন সৃজনশীল কাজের পিছনে ক্রিয়াশীল। আর ভাবনাটিও মূলত সেদিন বাসে করে ঢাকার বাইরে যেতে যেতে অলস চোখে বিস্তৃত মাঠের ওপাশে গাছের পাতায় পাতায় বাতাসের আন্দোলনকে দেখে আচমকাই উঠে আসে, সেমুহূর্তেই লেখাটি লিখতে শুরু করি বাসে বসেই! প্রকৃতির বিচিত্র ফর্মের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আরও একবার অভিভূত হই। দেখি যে বাতাসে তিরতির করে গাছের পাতাগুলো কেমন সতেজ আন্দোলিত হচ্ছে, আর সমগ্র প্রকৃতিতে কেমন বিন্যস্ত এক সমগ্রের উদ্ভাসন! লেখাটা দানা বাঁধতে থাকে প্রকৃতির এই নানাবিধ ফর্মের বহিঃপ্রকাশকে চারুশিল্প ও অন্যান্য সৃজনশীল মাধ্যমের সাথে এক তুলনার ভিতর দিয়ে। শিল্পের (চিত্রশিল্প, ভাস্কর্য ইত্যাদি) সাথে অন্যান্য সৃজনশীল মাধ্যমের প্রকৃতিগত একটা পার্থক্য রয়েছে।

আর তা হচ্ছে কাঠামোগতভাবে (ঋড়ৎস) চারুকলা প্রকৃতির অনেক বেশী কাছাকাছি। চারুকলার ভাষা বুঝতে হলে তাই ফর্ম সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা নেয়াটা প্রয়োজনীয়। পার্থক্যটা কিরকম সেটা প্রথমে স্পষ্ট করা দরকার। সাধারণতঃ আমরা আমাদের চারপাশে হরহামেশাই মনুষ্যসৃষ্ট যে সমস্ত বস্তু দেখে থাকি (যেমন আসবাবপত্র, দালান, স্থাপনা, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি) সেগুলোর কাঠামো প্রধানতঃ হয় চতুর্ভুজাকার নয় ত্রিভুজাকার নয়ত বৃত্তাকার। অন্যভাবে বলতে গেলে, এগুলো সবই জ্যামিতির উপর ভিত্তি করে নির্মিত।

কদাচ এই কাঠামোগুলোর বাইরে অন্য ধরনের কাঠামো দেখতে পাই আমরা। চারুশিল্পের ক্ষেত্রে (যদিও চারুকলাতেও এ সমস্ত ফর্মগুলোর উপস্থিতি দেখা যায়), চিত্রশিল্প বা ভাস্কর্য যাই বিবেচনায় নেই না কেন, এই প্রকাশ অনেক বেশী গতিশীল। এই যে মানুষের মাঝে চতুর্ভুজ, ত্রিভুজ বা বৃত্তের প্রতি অনুরাগ, এ কিন্তু প্রকৃতির সাথে ঠিক সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এর অবশ্য যৌক্তিক কারণও আছে, যেমন দালান তৈরীর ক্ষেত্রে দালানের কাঠামো চতুর্ভুজাকৃতি করার কারণ তাতে ভারসাম্য এবং স্থিতি বজায় থাকে, আর তাই এসমস্ত তৈরীর ক্ষেত্রে যতœসহকারে জ্যামিতিক ফর্ম নিয়ে কাজ করা হয়। আর তাই ভূমির মত উঁচু নীচু বা গাছের মত ছড়ানো ছিটানো বা পাহাড়ের মত অবিন্যস্ত বিস্তৃতি দেয়া এতে সম্ভব হয়না।

কিন্তু এটি কি সত্যিই অসম্ভব? অর্থাৎ প্রকৃতিতে যে সমস্ত ফর্ম আছে তার কাছাকাছি পৌঁছান? সে বিতর্কের বিষয়, অন্য সময়ের জন্য সেই আলোচনা তোলা রইল। এখানে কেবল এটুকু বলি, ‘যদি নিখুঁত ফর্মের চূড়ান্ত হয় প্রকৃতি, তাহলে মানুষের তৈরী কোনো ফর্মই সে তুলনায় যথেষ্ট নিখুঁত নয়’। আর তাছাড়া অধুনা এসমস্ত ভাবনাগুলোর পরিবর্তন হচ্ছে এবং দালান, স্থাপনা ইত্যাদি নির্মাণের ক্ষেত্রে বিমূর্ত ধ্যান-ধারণা ও উত্তর-আধুনিক বিনির্মাণ তত্ত্ব ইত্যাদি যথেষ্টই প্রভাবিত করছে। গাছের ফর্মকে যদি আমরা দেখি, তাহলে দেখতে পাব যে সেগুলোর আকৃতি বিবিধ এবং বিচিত্র এবং একই সাথে উলম্ব এবং ছড়ানো। একই ব্যাপার প্রাণীকুলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

তাদের ফর্ম যথেষ্ট গতিশীল এবং বিচিত্র, কোন জড়তার বোধ জন্মে না এদের দেখলে। অন্যান্য সৃজনশীল মাধ্যম থেকে চিত্রকর, ভাস্কর, কবি ও শিল্পীর সুবিধা এই যে সে এসমস্ত নানাবিধ ফর্মের প্রকাশ তার চিত্রে, ভাস্কর্যে ও কবিতায় ফুটিয়ে তুলতে পারে। প্রকৌশলীকে কিন্তু নির্ভর করতে হয় জ্যামিতিকতায়, অন্যদিকে শিল্পী, এসমস্ত ফর্মের অন্তর্গত ভাঙ্গচুর নিজের মত করে দেখাতে পারে। যেমন প্রকৃতিতে ঘন বনানীর কাঠামো ইট কাঠ শহরের কাঠামো থেকে ভিন্ন। একটি সতেজ ও সাবলীল, অন্যটি আড়ষ্ট ও জড়।

এখানেই শিল্পী অন্যের থেকে আলাদা, যদিও প্রথাগত কিছু ব্যাকরণ (যেমন পারস্পেক্টিভ, রেখা ও বর্ণের বিজ্ঞান) তার আয়ত্ত্বাধীন তথাপি সেসমস্ত নতুন করে সাজানো চলে। এগুলোর সাথে অনুভূতি ও মননের যোগ হয়ে ভিতরের যে প্রকাশ তাকে দেখান চলে। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, যখনই শিল্পী তথাকথিত অনুশাসন ও নিয়মের ভিতর দিয়ে যায় তখনই সৃষ্টিশীলতা নিরেট জ্যামিতিকতায় পর্যবসিত হয়। এগুলো ভাল বা মন্দের কোন বিষয় নয়, এই ঘটে। অন্যদিকে যখনই সে স্বতঃস্ফুর্ত তখনই কিন্তু ফর্মগুলো সাবলীল ও ছন্দময়।

একারণেই কামরুল হাসানের দুরন্ত গতির পাখী সে অর্থে পাখীর অনুকৃতি না হয়েও তারও অধিক পাখী! কিংবা হাশেম খান বা কাইয়ুম চৌধুরীর নিবিড় প্রকৃতি-ঘনিষ্ঠ তৈলচিত্রগুলো সবুজে, নীলে, লালে, হলুদে, মেটে, কমলায় মিলে মিশে যেন এক বাংলাদেশেরই অন্য রূপ, মায়ায়, রঙে, রেখায় এ এক অদ্ভুত মিতালী। তাহলে কি মায়া তৈরীরই আরেক ভিন্ন নাম এই সৃষ্টিশীলতা। কবিতায়, সঙ্গীতে, চিত্রে? কি আছে এই সৃজনশীল মননের পিছনে? একি নিছকই ব্যাকরণ আর বিচার বিশ্লে¬ষণ করে দেখা প্রতিনিয়ত, ব্যবচ্ছেদ করে অংক কষে দেখানো এই হচ্ছে শিল্প আর সৃজন? আঁকতে আঁকতে চিত্রকর ভুলে যায় ব্যাকরণের হিসাব নিকাশ, ভুলে যায় মাত্রা ও ছন্দের তথাকথিত শক্ত গাঁথুনি। তা’বলে কিন্তু ছন্দহীন হয় না ওসমস্ত, কেননা ছন্দের দোলা তো প্রকৃতপ্রস্তাবে আরোপিত কিছু নয়, এ আছে, থাকে সবারই ভিতরে। শিল্পী কেবল তাকে চিনে যায় সহজে! প্রথম প্রকাশ- শিল্পকন্ঠ, ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০১০ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।