‘আমার স্যার বৃষ্টিতে ভিজতে খুব ভালো লাগে। ’
‘স্বাভাবিক। কিশোরী মেয়েদের মধ্যে এটা খুব দেখা যায়, তবে তার চেয়ে একটু বেশি, মানে তোমাদের বয়সেও এটা এমন কিছু অবাক হওয়ার বিষয় নয়। ’
‘কিন্তু তখন আমার কান্না পায় স্যার, বৃষ্টির মতো চোখের পানিতেও যখন চোখ ভিজে যায় আমার...। ’
মোহিত স্যার কী ভেবে এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করে মাথা নেড়ে বললেন, ‘হুম্ম।
’
পাশ থেকে আমাকে কনুই দিয়ে একটা ছোট্ট গুঁতো দিয়ে নীপা অনুচ্চ স্বরে বলেছিল, ‘ন্যাকামি। ’ কথাটা স্যারের কান পর্যন্ত পৌঁছাবে বুঝতে পারেনি। কিন্তু স্যার শুনেছেন। বললেন, ‘না না, ন্যাকামি না, বাংলায় একটা সুন্দর শব্দ আছে, দুঃখবিলাস। ’
ডা. মোহিতুল আলম মানসিক রোগ বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর।
ফর্সা লম্বাটে মুখ, এক মাথা এলোমেলো চুল, নাকের নিচে ভারী একজোড়া গোঁফ। চেহারায় একটা শিশুসুলভ ব্যাপার আছে, শিক্ষক হিসেবে সেটা বেমানান। তবে ভারী ফ্রেমের চশমা দিয়ে শিশুটিকে আড়াল করা গেছে। এমনিতে রাশভারী মানুষ। শুধু আউটডোর বা রাউন্ড শেষ করে তাঁর কক্ষে এসে ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে বসলে ১৫-২০ মিনিট নানা রকমের আলোচনা করেন।
বিষয় মূলত রোগীদের মন, আচরণ, প্রবণতা ইত্যাদি। আজও এসব আলোচনা হচ্ছিল, হঠাৎ আমিই বা কেন নিজের কথা তুললাম, কে জানে।
স্যারের কক্ষ থেকে বেরিয়ে বুঝলাম ছেলেমানুষি হয়ে গেছে। বৃষ্টিতে ভেজা, কান্না পাওয়া এসব কথা তুলে অহেতুক সহপাঠীদের হাতে টিটকারি দেওয়ার রসদ তুলে দেওয়া হলো।
রায়হানের সঙ্গে পারতপক্ষে কথা বলি না আমি।
গায়ে-পড়া স্বভাবের ছেলে। আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, ‘বৃষ্টির দিনে আমার খুব ঘুড়ি ওড়াতে ইচ্ছে করে, কিন্তু বৃষ্টির পানিতে আমার ঘুড়ি ভিজে যায়, হা হা হা...। ’ অন্য ছেলেরাও যোগ দিয়েছে হাসিতে। এমন যে, আমার বন্ধু সমীর, সেও এসে বলল, ‘রাগ করিস না রানু, আমার কিন্তু তোর ঠিক উল্টো, বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে পড়লে আমার কাতুকুতু লাগে, হাসি পায়...। ’ নিজের বোকামির জন্য হাত কামড়াতে ইচ্ছে করে আমার।
দিন দুয়েক পরে স্যারের সঙ্গে দেখা হতেই বললেন, ‘কেমন আছো, রেহনুমা?’
‘ভালো, স্যার। ’
‘ক্লাস নেই?’
‘আছে স্যার, ডিডি স্যারের ক্লাস। ’ পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম, ডেকে বললেন, ‘শোনো, আচ্ছা, সেদিন তুমি যে বলছিলে কান্না পায়, তোমার কি কোনো স্মৃতি আছে? মানে বৃষ্টির অনুষঙ্গে মনে পড়ার মতো...?’
ভালো পাগলের পাল্লায় পড়া গেল। কথার কথা, কী বলেছি, এখনো তা মনে রেখে দিয়েছেন। সাধে কি বলে, পাগলের ডাক্তাররা নিজেরাই একেকটা পাগল।
‘স্মৃতি? ভেবে দেখিনি তো স্যার। ’
‘ভেবে দেখো, মনে হচ্ছে সে রকম কিছু একটা আছে, যা তোমাকে কাঁদায়, ভেবে দেখো...। ’
‘জি, ভাবব স্যার...। ’
এখানে একটা কথা আপনাদের বলে রাখি, আমার সহপাঠীরা কেউ জানে না। এই মোহিত স্যারের সঙ্গে পারিবারিকভাবে আমার বিয়ের কথা চলছে।
স্যারের পরিবার থেকেই প্রস্তাব গেছে। বাবা বলেছেন, মেয়ের মত ছাড়া আমি কিছুই বলতে পারব না। আমিও মত-অমত কোনোটাই জানাইনি। নিজেই বুঝতে পারছি না, জানাব কী?
ব্যাপারটা ওই পর্যন্ত ঝুলে আছে। আমি ভেবে পাই না স্যার নিজে কেন আমাকে কিছু বলেন না।
আমি না-হয় গ্রাম থেকে আসা মেয়ে, অনেক কথা সোজাসাপ্টা বলতে পারি না। কিন্তু তাই বলে মোহিত স্যার? প্রতিদিন সামনে দেখছেন যে মেয়েটাকে, তাকে কিছু না বলে বাড়িতে খবর পাঠানো? এই জমানায় এ রকমও হয়? নাকি স্যারের নিজের তেমন ইচ্ছে নেই, পরিবারের চাপে...।
মোহিত স্যারকে অনেক মেয়েই খুব পছন্দ করেন। আমার ক্লাসেই অন্তত চারটা মেয়ে আছে, যাদের ক্রাশ মোহিত স্যার। মেয়েগুলো ন্যাকা, ‘আল্লাহ্ যা কু...ল!’—বলে আইসক্রিমের মতো গলতে থাকে।
আমার গা জ্বলে যায়। আমাদের বিয়ে পাকা হলে এই ন্যাকাগুলোর ঈর্ষার মুখে পড়তে হবে ভেবে আমি কুঁকড়ে যাই।
স্যার বলেছেন, ভেবে দেখো, কোনো স্মৃতি আছে কি না। আমি ভাবি না। পরীক্ষার পড়া মুখস্থ করি।
কিন্তু না ভেবেও আমার অনেক কথা মনে পড়ে। একটা ছবির মতো গ্রাম। এক উঠোনে আটটা ঘর, উঠোনজুড়ে নানা বয়সী ২৪টা ছেলেমেয়ের দাপাদাপি। প্রবল বৃষ্টির দিনে পুকুর উঠে আসে উঠোনে, তখন এক বেলা-দুই বেলার ভাড়া করা নৌকা নিয়ে দলবেঁধে খালে বেড়াতে যাওয়া...। এ রকম কত কিছু।
সব ছাপিয়ে মনে পড়ে একটা ব্যথিত-অপমানিত কিশোরের মুখ। শেষবার দেখেছিলাম হাসপাতালে।
আমি গ্রামের মেয়ে, আমার আগে এই গ্রাম থেকে কেউ মেডিকেল কলেজে পড়তে আসেনি কোনো দিন। চলায়-বলায় এখানকার তুখোড় স্মার্ট মেয়েগুলোর সঙ্গে আমার গ্রাম্য দুঃখগুলো কী করে ভাগ করি! ক্রাশ, ব্রেকআপ শব্দগুলো ওদের মুখ থেকেই শোনা, দুঃখবিলাস শব্দটিও তো আগে শুনিনি কখনো।
এর মধ্যে বাবা এসেছিলেন হোস্টেলে দেখা করতে, প্রতি মাসেই একবার আসেন, বললেন, ‘কী মা, কিছুই তো জানালি না, বিয়ের প্রস্তাবটা...।
’
‘না করে দাও বাবা, আমি এখন বিয়ে করব না। ’
বাবা হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন আমার দিকে। বিড়বিড় করে বলেন, ‘আমার বয়স হয়েছে, শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। ’ তাঁর দুঃখটা বুঝতে পারি। আগেও দু-একবার বিয়ের কথা উঠেছিল, রাজি হইনি।
এবার এত ভালো একটা প্রস্তাব, এ রকম তো বারবার আসে না। আবার লেখাপড়া জানা মেয়ের ওপর জোরও খাটাতে পারেন না।
মোহিতুল আলম স্যারের কয়েকটা ক্লাস করিনি। ইচ্ছে করেই এড়িয়ে যাচ্ছিলাম। একদিন ডেকে পাঠালেন।
তাঁর কক্ষে কেউ ছিল না। বললেন, ‘ভেবে দেখেছিলে?’
‘কী ব্যাপারে স্যার?’
‘সেই যে বলেছিলে, কান্না পায়...। ’
এই আদেখলেপনা দেখে আমার মেজাজ বিগড়ে যায়, কখন কী একটা কথার কথা বলেছি। নিজের অভ্যাসের বাইরে গিয়ে একটু কঠিন স্বরে বললাম, ‘স্যার, এটা আমার ব্যক্তিগত বিষয়। ’
একটা ধাক্কা খেলেন বোধ হয়, তাঁর বিব্রত চেহারা দেখে সেটা টের পাই।
এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করে কী যেন ভেবে বললেন, ‘হুম্ম...। ’
‘আমি যাই স্যার?’
‘আমার ওপর বেশি বিরক্ত?’
‘কই, না স্যার...। ’
‘আমাকে তুমি বোধ হয় পছন্দ করো না রানু (স্যার সাধারণত আমাকে রেহনুমা নামে ডাকেন), বিয়েটা ভেঙে দিয়েছ শুনলাম...। ’
আমি মাথা নামিয়ে নিই, চোখ রাখি পায়ের নখের দিকে। অস্থির গলায় স্যার বললেন, ‘তুমি কি কাউকে ভালোবাসো?’
‘জানি না স্যার।
’
‘জানি না, মানে?’
‘একজনের কথা ভেবে খুব কষ্ট পাই...। ’
‘শুধু শিক্ষক নয়, যদি সত্যিকার একজন বন্ধু ভাবো, কথাটা আমাকে বলতে পারো। ’
তাঁর বলার ভঙ্গিতে কী যেন একটা ছিল, ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যায় আমার। এখানে কাউকে তো কখনো বলতে পারিনি, মনে হচ্ছে, এই মানুষটাকে বলা যায়। না-বলা কথার কী যে ভার!
‘আমাকে একজন খুব ভালোবাসত স্যার, আমাদের গ্রামের ছেলে, দূরসম্পর্কের আত্মীয়।
আমি ফিরিয়ে দিয়েছিলাম বলে ঘুমের বড়ি খেয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল। ’
‘বেঁচে আছে?’
‘হ্যাঁ স্যার। স্টমাক ওয়াশ করা হয়েছিল আমাদের কলেজ হাসপাতালে। ওর পকেটে একটা চিঠি পাওয়া গিয়েছিল আমাকে লেখা...। ’
‘তুমি ওকে ভালোবাসো?’
‘জানি না স্যার, তবে খুব কষ্ট হয়...।
’
‘না রানু, তুমি ওকে ভালোবাসো না, করুণা আর ভালোবাসা এক জিনিস না, এটা তোমার করুণা। ’
আমি মোহিত স্যারের দিকে তাকিয়ে থাকি। এত দৃঢ়কণ্ঠে বললেন কথাটা, মনে হলো এ কথাটাই সত্য, আমি এ রকম করে আগে ভাবিনি কেন?
সাহস বাড়ল আমার, স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করতে পারলাম, ‘আপনি কাউকে ভালোবাসেন স্যার?’
‘বাসি। বাসি যে সেটা আগে বুঝতে পারিনি, মাত্র কয়েক দিন আগে বুঝলাম। ’
‘কয়েক দিন আগে? কীভাবে, কখন?’
‘যেদিন বাসায় গিয়ে জানতে পারলাম, তুমি আমাদের প্রস্তাবটা ফিরিয়ে দিয়েছ...।
অদ্ভুত ব্যাপার কি জানো, সেদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। কী ভেবে ছাদে গিয়ে ভিজতে শুরু করেছি। ভাব এই বয়সে! হঠাৎ মনে হলো, শুধু বৃষ্টিতে না, চোখের পানিতেও চোখ ভিজে যাচ্ছে আমার...। ’
‘দুঃখবিলাস স্যার?’
‘বিলাস না রানু, বিশ্বাস করো, সত্যিকারের দুঃখ...। ’
স্যারের চোখ ছলছল করছে, মাথা নিচু করেছেন।
আমাদের স্মার্ট মেয়েদের ক্রাশ মোহিত স্যারকে এ রকম চেহারায় কখনো দেখিনি।
আমি কি স্যারের হাতটা একটু ধরব? খুব ইচ্ছে করছে।
█████████████████████████████████████
প্রথম আলো থেকে কপি করা।
লেখক: বিশ্বজিৎ চৌধুরী ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।