আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প: পদ্মা নদী, লালনের গান কিংবা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পরাজয়ের কারণ

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ এ বছর আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে কুয়ালালামপুরে । অডিটোরিয়ামে থাইল্যান্ড থেকে আগত একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং বাংলাদেশি ডেলিগেট মাহমুদা রহমান-এর ওপর চোখ পড়তেই লজ্জ্বায় শিঁটিয়ে গেলেন পাকিস্তানি ডেলিগেট আজিজাহ বিলকিস । এখন এদের সামনে বিশ্বশান্তির কথা বলতে হবে-যখন আজিজাহ বিলকিস-এর খুনি ও বর্বর পূর্বপুরুষের সামরিক উর্দিতে লেগে আছে রক্ত, যখন বিশ্বে পাকিস্তান অবধারিতভাবেই একটি মধ্যযুগীয় সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত।

এখন ওই শান্তিকামী বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং বাংলাদেশি প্রতিনিধির সামনে শান্তির কথা বললে ঠুনকো শোনাবে না? দর্শক সারিতে বসে আজিজাহ বিলকিস-এর দিকে তাকিয়ে আছেন মাহমুদা রহমান । পাকিস্তানি বৃদ্ধার পরনে নীল রঙের সালোয়ার কামিজ। সাদা ওড়না। ভরাট ফরসা মুখ। কাঁধ অবধি মেহেদি মাখানো বাদামী চুল।

চোখে রুপালি ফ্রেমের গোল চশমা। বেশ স্মার্ট বৃদ্ধা। শান্তি সম্মেলনের আয়োজকরা একই হোটেলে পাশাপাশি রুম বুক করেছিল বলে আজিজাহ বিলকিস- এর সঙ্গে গতকাল রাতেই পরিচয় হয়েছে। কাল রাতের ডিনার এবং আজ সকালে নাশতা একসঙ্গে সেরেছেন। মাহমুদা রহমান-এরই সমবয়েসি আজিজাহ বিলকিস ।

বয়স ষাট ছুঁই-ছুঁই। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপনা করছেন আজিজাহ বিলকিস । কথায় কথায় বললেন ষাটের দশকে ইস্ট পাকিস্তানে এসেছিলেন। মাহমুদা রহমান কৌতূহলী হয়ে ওঠেন । পত্রপত্রিকায় নিয়মিত নিয়মিত গল্প লেখেন।

সমাজবিজ্ঞানে পড়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। লোক সংস্কৃতির উপর প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখেন। “মাতৃমুখ’’ নামে একটি মানবাধিকার সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা মাহমুদা রহমান। থাকেন লালমাটিয়ায় । ... আজিজাহ বিলকিস-এর সঙ্গে কথাবার্তায় অনেকখানি এগিয়েছে।

সেমিনারে অংশ গ্রহন ছাড়াও আয়োজকরা সম্মেলনে আগত অতিথিদের জন্য মালয়েশিয়ায় ভ্রমনের ব্যবস্থা করেছে । কিছুদিন একসঙ্গে থাকতে হবে। দুজনে টেলিফোন নাম্বার বিনিময় করেছেন। ... আজিজাহ বিলকিস-এর প্রেশারের সমস্যা আছে বলে জানালেন। পারিবারিক অশান্তির কথাও লুকালেন না।

ছোট মেয়ে সাইয়ারা। থাকে লন্ডনে। পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করছে। ঝোঁকের মাথায় এক ব্রিটিশ ছেলেকে বিয়ে করে ফেলেছিল । এখন ডিভোর্সের কথা ভাবছে ... সাইয়ারা এখন নাকি আবার একটি ইনডিয়ান ছেলের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করছে ।

ছেলেটা মুসলিম। তবে ইন্ডিয়ান ... ইতিহাসের প্রতিশোধ! মাহমুদা রহমান দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলেন। আজিজাহ বিলকিস বললেন, এসব নিয়ে পারিবারিক অশান্তি। গত বছর ওর বাবার হার্টের সমস্যা ধরা পড়ল । এদিকে আমার বাবাও বৃদ্ধ ।

বাবা আগে পোগ্রেসিভ ছিলেন। এখন ... বয়েসে হয়েছে । নাতনির আচরণে ক্ষুব্দ। সাইয়ারা লাহোর ফিরবে না। লাহোর নাকি কনজারভেটিভ! ছোট মেয়ের জন্যই এখন লন্ডন সেটেল করতে হচ্ছে ।

কাগজপত্রও তৈরি। পাকিস্তানেও থাকতে আর ভালো লাগছে না। ও দেশে এত হানাহানি। পাকিস্তানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে বোমা বর্ষন করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র । তাছাড়া করাচিতেও প্রতিদিন লোক মরছে।

মসজিদে জুম্মার দিনে শিয়াদের ব্রাশ ফায়ার করে মেরে ফেলে ... শিয়াদের প্রসঙ্গে মুহূর্তে মেয়েবেলায় ফিরে গিয়েছিলেন মাহমুদা রহমান । চট্টগ্রাম শহরে কাজীর দেউরির কাছে জামাল খান লেনের একটি হলুদ রঙের দোতলা দালানের একতলায় থাকতেন । একটা শিয়া পরিবার থাকত দোতলায় । অথচ দুটি পরিবার মিলে মিশেই থাকত। মাহমুদা রহমান খাস্তগীর স্কুলে পড়তেন।

ওদের বড় মেয়ে আনোয়ারাও পড়ত খাস্তগীর স্কুলে । অবশ্য এক ক্লাস নীচে। দুজনে আশকারদীঘির পাড় দিয়ে একসঙ্গে স্কুলে যেত। আনোয়ারার মা মাজেদা খালাম্মা মাহমুদাকে ভীষণ স্নেহ করতেন। চমৎকার রান্নার হাত ছিল খালাম্মার ।

বিশেষ করে হালুয়া। একবার জ্বরে পড়েছিলেন মাহমুদা। সারারাত মাথার কাছে বসেছিলেন মাজেদা খালাম্মা ... শান্তি সম্মেলনের উপস্থাপক টমাস লি ঘোষনা করলেন, এখন বক্তব্য রাখবেন পাকিস্তানের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের অধ্যাপক আজিজাহ বিলকিস। অডিটোরিয়ামে মৃদু করতালি ছড়িয়ে পড়ে। আজিজাহ বিলকিস পাকিস্তান থেকে এছেছেন।

সবাই তার বক্তব্য শুনতে চায়। পাকিস্তান সন্ত্রাসীদের মদদ দেয় বলে রাষ্ট্রটি এখন সারা বিশ্বের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ... সেই বিতর্কিত রাষ্ট্রের পক্ষে অধ্যাপক আজিজাহ বিলকিস কি সাফাই গায়-সেটা শোনার জন্য সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে ... আজিজাহ বিলকিস ধীরে সুস্থে মঞ্চে উঠে এলেন। নোটস লিখে এনেছিলেন। ভাঁজ করা কাগজটা এখন মোবাইল দিয়ে চাপা দিয়ে রাখলেন। ডাঁটি ধরে চশমাটা ঠিক করে নিলেন।

ফরসা মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। ক্ষীণ উদ্বেগ অনুভব করছেন। ১৯৪৭ এর পর থেকে পাকিস্তানের ইতিহাসের যা হাল ...তাতে কখনও বিদেশে গেলে শিক্ষিত মহলে থেকে নানান প্রশ্নের সম্মূখিন হতে হয়। দর্শক সারির দিকে একবার তাকালেন বৃদ্ধা। তারপর বললেন, উপস্থিত সুধী এবং আয়োজকদের আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়ে আমার বক্তব্য শুরু করছি।

প্রথমেই আমি বলতে চাই যে আমরা, পাকিস্তানিরা, শান্তি চাই। হলরুমে গুঞ্জন উঠল। পাকিস্তানিরা শান্তি চায়। আজ এই কথা বললে কেউই বিশ্বাস করে না। আজিজাহ বিলকিস অস্বস্তি বোধ করেন ।

পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার কুর্কীতির কথা কে না জানে । আইএসআই জঙ্গীদের প্রত্যক্ষ মদদ দেয়। সন্ত্রাসীদের ট্রেনিং দেয়। সাংবাদিক হত্যা করে। এদেরই পূর্বপুরুষ ১৯৭১ সালে ইস্ট পাকিস্তানে বাঙালিদের নির্বিচারে হত্যা করেছিল।

আজিজাহ বিলকিস নিজের সঙ্গে প্রাণপন যুদ্ধ করেন। বলতে থাকেন, বিশ্বে আজ শান্তি প্রতিষ্ঠা জরুরি। অতীব জরুরি। শান্তি রক্ষায় আমাদের প্রত্যেককে বলিষ্ট ভূমিকা রাখতে হবে ... বলতে বলতে বৃদ্ধার কন্ঠস্বর কাঁপে। লেখা ঝাপসা দেখায়।

চিন্তাসূত্র এলোমেলো হয়ে যায়। চিবুক বেয়ে ঘাড় বেয়ে নামে ঘামস্রোত। তার মৃদু শ্বাসকষ্ট হয়। সম্মেলন কক্ষের অসংখ্য চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। ভীষণ বিব্রত বোধ করছেন বৃদ্ধা ।

... ভাবলেন, আমার কথাগুলি কি ঠুনকো শোনাচ্ছে? হ্যাঁ, ঠুনকো শোনানোরই কথা। কেননা তিনি এমন একটি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করছেন সে রাষ্ট্রের রাজনীতির দৈন্যদশার কথা সবাই জেনে গেছে। যে রাষ্ট্রটির রাজনৈতিক দুর্দশা ঘোচাতে এখন মাঠে নেমেছেন একজন প্রাক্তন প্লেবয় ক্রিকেটার। অথচ পাকিস্তান রাষ্ট্রটির সংস্কৃতিক অন্তসারশূন্যতা, তার বৈপরীত্য, একদিকে ধিনচাক ধিনচাক অর্ধনগ্ন মুজরা ড্যান্স, অন্যদিকে , দমাদম মাস্ত ক্যালেনদারের হালকা নেশা, ওয়াজ ম্যাহফিল ; ভক্তের করোটির ভিতর মূর্তিমান মধ্যযুগ, তথাপি বৈজ্ঞানিক উন্নতির আশা, তার পারমানবিক অস্ত্র, সে অস্ত্রের উপর শিথিল নিয়ন্ত্রণ ... তার অগনতান্ত্রিক আচরণ, এমন কী তার ক্রিকেট বোর্ডের বেহাল দশা- এসবই আজ বিশ্ববাসী জানে। একটা মন্দ দেশ থেকে এসে ভালো কথা বললে তো ঠুনকো শোনাবেই! বৃদ্ধা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ।

খুব কাছ থেকে কে যেন বলল: সত্য কথা বল। সবাই তোমার কথা শুনবে। আজিজাহ বিলকিস চমকে উঠলেন। কে বলল কথাটা? সামনের সারিতে বসে থাকা মাহমুদা রহমান মাথা নীচু করে মোবাইল হাতে কি যেন করছেন। তার পাশে বসে আছেন রেভারেন্ড জোসেফ অ্যালান।

এই বৃদ্ধ খ্রিস্টান নেতা এসেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে । তিনি কি বললেন? রেভারেন্ডের পাশে গেরুয়া রঙের আলখাল্লা পরে সেই থাই বৌদ্ধ ভিক্ষু বসে আছেন । তিনি বললেন? নাকি তাঁর পাশে বসে থাকা তুরস্কের বিশিষ্ট আলেম মৌলবি ইসমেত ফাহরি? মোবাইল ফোন গুঞ্জন করে উঠল। তুলে দেখলেন একটা মেসেজ এসেছে। মাহমুদা রহমান পাঠিয়েছেন।

লিখেছেন, আজিজাহ আপনি আজ সত্য কথা বলুন। যে কথা আজও বলা হয়নি। যে কথা বিশ্ববাসী আজও জানে না। তাহলে সবাই আপনার কথা শুনবে। সত্য কথা না বললে আপনার কথা হাস্যকর ঠেকবে।

আজিজাহ বিলকিস শ্বাস টানেন। তার মনে হল -আর মিথ্যে কথা বলে কী লাভ। পৃথিবী সত্য কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি আজ সত্য কথাই বলব। তাতে আমার পরিনতি যাই হোক।

আজ সত্যি কথা না-বলে উপায় নেই। আমি সত্য জানি। তারপর আজিজাহ বিলকিস বলতে লাগলেন, আমার জন্ম পাকিস্তানের লাহোরে । ১৯৫০ সালে। আমার বাবার নাম আযীম আযীয।

আমার বাবা পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে পড়াশোনা করেছেন । পাস করে হাবীব ব্যাঙ্কে চাকরি নিলেন বাবা। অবসর সময়ে লেখালেখি করতেন। পাকিস্তানের বিশিষ্ট মানবতাবাদী কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ- এর বন্ধু ছিলেন । বাবা প্রচুর বই পড়তেন।

আমার মানসিকতাকে আমার বাবাই গড়ে দিয়েছেন। আমাকে ইতিহাসে পড়তে উৎসাহ দিয়েছেন। ১৯৭০ সাল। আমার বয়স তখন কুড়ি। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি।

সে বছরই ফেব্রুয়ারিতে আমার বিয়ে ঠিক হল। আমার স্বামীর নাম আদিব আখতার। সদ্য লাহোরের একটি কলেজে প্রভাষক হিসেবে ঢুকেছেন । আপনারা অনেকেই জানেন যে ১৯৭১ সালের আগে পাকিস্তান পূর্ব ও পশ্চিম-এই দুই অংশে বিভক্ত ছিল। তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তানই বর্তমানে বাংলাদেশ।

১৯৭০ সালের মার্চ মাসে আমার বাবা ট্রান্সফার হয়ে ইস্ট পাকিস্তানে চলে যান। ইস্ট পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা। ঢাকার মগবাজারে বাড়ি ভাড়া নিলেন । জুন মাসে আমি আমার স্বামীর সঙ্গে ঢাকায় গেলাম । আমাদের সঙ্গে আমার শ্বশুর-শাশুড়িও ছিল।

এরা কেউই এর আগে ইস্ট পাকিস্তান যায়নি। ঢাকায় তখন সরকারবিরোধী উত্তাল আন্দোলন। সরকার শক্তি প্রয়োগ করে সে আন্দোলন দমন করার চেষ্টা করছে । চারিদিকে গুঞ্জন। ফিসফাস।

ডিসেম্বরে নির্বাচন। নির্বাচনের ফলাফল কোন্ দিকে যায় কে জানে। যা হোক। বাবা আমাদের ইস্ট পাকিস্তান ঘুরিয়ে দেখালেন। ইস্ট পাকিস্তানে পদ্মা নামে একটা নদী আছে।

আমরা পদ্মা নদীর পাড়ে পৌঁছে স্তব্দ হয়ে যাই। নদীর এত বিশাল বিস্তার হতে পারে ভাবতেই পারিনি। আমার স্বামী নদীর বিশালতা দেখে ভয় পেয়ে গেল। আমার শ্বশুর ভয় পেলেন, আমার শাশুড়ি ভয় পেলেন, আমার মাও ভয় পেলেন (মা মার্চ মাসে বাবার সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানে এলেও এই প্রথম পদ্মার পাড়ে এলেন) ... আমার ভাই ফয়সাল ভয় পেল। আমার ছোট বোন মুবাশশিরাও ভয় পেল।

ভয় আমিও পেলেও আমার বাবা কিন্তু মোটেও ভয় পাননি। আমার বাবা ছিলেন বাঙালিদের আন্দোলনের নীরব সমর্থক। বাবা পরে আমাকে বললেন, বাঙালিরা পদ্মা নদীকে দেখলে মুগ্ধ হয় আর পাকিস্তানিরা ভয় পায়। এই দৃষ্টিভঙ্গিই দু অঞ্চলের ভবিষ্যৎ সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলবে। তাইই হয়েছিল।

১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পরাজিত হওয়ার কারণ । আমি বাবাকে বললাম, বাঙালিরা এত বিশাল নদীকে ম্যানেজ করে শত শত বছর টিকে আছে? এদের বশে তো রাখা সম্ভব না। ব্রিটিশরা বাঙালিদের শাসন করল কী ভাবে? বাবাকে হেসে বললেন, তারও ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। বাঙালীরা নদীপ্রবাহের মর্ম বোঝে । আর বোঝে বলেই এরা জন্মউদাসী।

বাঙালিরা জাত কবি। এদের উদাসীন্যের সুযোগে বহিরাগতরা এদের শাসন করেছে। বাবার এই কথাটা আমার ভিতরে গভীর ভাবে রেখাপাত করেছিল । বাবা বলেন, পদ্মা নদী পাড় ভাঙে। মানুষ সর্বশ্রান্ত হয়।

পথে বসে । কিন্তু বাঙালিরা কখনও পদ্মার দোষ দেয় না। পদ্মাকে ‘সর্বনাশা’ বললেও অভিশাপ দেয় না। পদ্মাকে ভালোবাসে। পদ্মাকে নিয়ে গান লেখে।

এখানেই পৃথিবীর সব জাতি থেকে বাঙালিরা আলাদা। একেবারে পৃথক। নদীর প্রতি এই ব্যাতিক্রমী ভালোবাসার কারণেই পৃথক। আমার মনে আছে আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বাঙালিরা কি ধর্মচ্যূত? পশ্চিম পাকিস্তানে যে রকম দাবি করা হয়। বাবা বললেন, আরে, না, না।

ইস্ট পাকিস্তানের মুসলমানেরা কখনও দ্বীন থেকে বিচ্যূত হয়নি। বাংলায় শরিয়তও আছে মারেফাতও আছে। তবে বাঙালির মরমী ইসলামের প্রতি ঝোঁক বেশি। তার কারণও ওই নদী। নদী আর অবারিত নীল আকাশ।

বৈচিত্রময় ঋতুসমৃদ্ধ আবহাওয়া। এ অঞ্চলের আকাশে বাতাসে কী যেন আছে ... সেটি বলে বোঝানো যাবে না। কাজেই এই জলময় দেশে দ্বীনকে মরমীপন্থায় ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তখন বলেছি ইস্ট পাকিস্তান হল ভাবুক কবির দেশ। আর পীর আউলিয়ার দেশ।

বলে বাবা আমাকে একটা বই দেখালেন। বইটার নাম: ‘সঙস অভ লালন শাহ । ’ লেখক আবু রুশদ। লালন নামে ইস্ট পাকিস্তানের একজন মিস্টিক পোয়েটের গানের ইংরেজি অনুবাদ। বাবা বললেন, মিডিল এজ থেকে ইস্ট পাকিস্তানের লৌকিক কবিরা গানের মাধ্যমে ইসলাম প্রচার করেছেন।

তাদের মধ্যে অন্যতম লালন। পদ্মা নদীর দক্ষিণ তীরে লালনের জন্ম। এই দেখ লালন আল্লাহ সম্বন্ধে কি লিখেছেন .... বলে বাবা পাঠ করতে লাগলেন: I am deeply indebted to Allah / That’s why I spend sleepless nights. পাকিস্তানি বৃদ্ধার মুখে পরিচিত বইয়ের প্রসঙ্গ এবং লালন শাহের কথায় দর্শক সারিতে বসে থাকা মাহমুদা রহমান সচকিত হয়ে উঠলেন। আবু রুশদ-এর ‘সঙস অভ লালন শাহ’ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৩ সালে । আঠারো বছর বয়েসে বাবা বইটি জন্মদিনে উপহার দিয়েছিলেন।

লালনের গানটির সঙ্গে পরিচিত মাহমুদা রহমান । ওই ইংরেজি লাইনের বাংলা হল: খোদার কাছে আছি আমি বড় দেনাদার/ ও তাই আঁখিতে ঘুম নাই আমার। আজিজাহ বিলকিস বললেন, আমার বাবা বললেন: জলময় মনোরম প্রকৃতির কারণেই বাঙালির মন অতি স্পর্শকাতর। এবং এ কারণেই মিডিল এজ থেকেই ইস্ট পাকিস্তানের ইসলামের স্বরূপটি মরমী। একটা জাতি তো আর তার স্বভাবের বাইরে যেতে পারে না।

পারে কি? না পারে না। মনে করে দেখ ইসলাম যখন উত্তর আফ্রিকায় কি মধ্য এশিয়ায় পৌঁছল তখন তার ওপর কি ধরণের স্থানীয় প্রভাব পড়েছিল । সর্বত্রই স্থানীয় লোকজ সংস্কৃতি আর বহিরাগত ধর্মের বিধিবিধানের মধ্যে একটা পারস্পারিক মিথস্ক্রীয়া ঘটে । কাজেই বাঙালিদের ধর্মচ্যূত হওয়ার প্রশ্নই আসে না। বলে ইসলামের নবী সম্বন্ধে লালন শাহর দুটি লাইন পাঠ করে শোনালেন বাবা ... In Medina once arrived a man called Mohammad/ Although a mortal, still peerless. মাহমুদা রহমান লালনের এই গানটির সঙ্গেও পরিচিত।

ইন্দ্রমোহন রাজবংশীর কন্ঠে শুনেছিলেন শিল্পকলা একাডেমীতে। ওই ইংরেজি লাইনের বাংলা হল: মদিনায় রাছুল নামে কে এলো ভাই/কায়াধারী হয়ে কেন তার ছায়া নাই। মাহমুদা রহমান দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ঈষৎ বিষন্ন হয়ে ভাবলেন: ইংরেজি অনুবাদে বাংলার চিরায়ত ছন্দের মাধুর্য প্রকাশ সম্ভব না। যে কারণে লালনের বাণীতে বাঙালির প্রাণ যতটা দুলে ওঠে, অবাঙালিদের মনে ততটা সাড়া ফেলে না।

তাছাড়া ইংরেজি অনুবাদে মরমী ভাবটিও তেমন প্রকাশ পায়নি যতটা প্রকাশ পেয়েছে বাংলায় । সফল অনুবাদ অভাবেই কি লালনকে যর্থাথ ভাবে তুলে ধরা যাচ্ছে না? কনফুসিয়াস বললেই সারা বিশ্বের মানুষ চিনের ওই জ্ঞানবৃদ্ধকে চেনে। আর লালন কে? আজিজাহ বিলকিস বললেন, বাবা ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে চাকরি ছেড়ে লাহোর চলে এলেন। বাবা স্পর্শকাতর মানুষ। বাতাসে আসন্ন গনহত্যার আগাম আঁচ পেয়েছিলেন।

আমরা থাকতাম লাহোরের আল্লামা ইকবাল রোডে। আমার স্বামী অনুরোধ করলেন বাবাকে আমাদের সঙ্গে থাকতে। বাবা রাজি হলেন। লেখালেখি শুরু করলেন। ‘ইনসাফ’ নামে একটি পত্রিকা বের করলেন।

ইনসাফে আমিও ব্রিটিশ শোষন প্রসঙ্গে লিখতাম। ... তারপর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হল। বাবা বললেন, পাকিস্তানি আর্মি বাঙালিদের পরাজিত করতে পারবে না । বাঙালিদের বিজয় সময়ের ব্যাপার মাত্র। তাই হয়েছিল।

১৯৭১ সালে বাঙালিরা অনেক রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন রাষ্ট্র পেল । তার আগে টিক্কা খান ইস্ট পাকিস্তানে রক্তের সিন্ধু বইয়ে দিলেন। বললেন, ইস্ট পাকিস্তানে মানুষ না জমি চাই ! ... এদিকে পশ্চিম পাকিস্তানেও ধড়পাকড় শুরু হল। আমাদের পাশের বাড়ি একটি বাঙালি পরিবার থাকত। আর্মির গোয়েন্দা বিভাগের লোকজন এক রাতে সে বাড়িতে রেইড দেয়।

ভুল করে আমাদের বাড়িতে আসে। বাবার লাইব্রেরিতে লালনের বইটি পেয়ে লাইব্রেরি তছনছ করে । তারপর বাবাকে ওরা ধরে নিয়ে যায়। সেই সঙ্গে আমার স্বামীকেও। লাহোর সেনানিবাসের এক বদ্ধ কক্ষে তাদের বসিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের নামে মানসিক নির্যাতন করে।

আপনার কাছে ইস্ট পাকিস্তানের লালনের বই কেন? বইটির প্রচ্ছদ লালচে ছিল । কাজেই আপনি কমিউনিষ্ট কি না? আপনি সরকারি চাকরি ছাড়লেন কেন? তারপর শারীরিক টর্চার করে। শেষে বিনা বিচারে দু বছরের সশ্রম কারাদন্ড । আজিজাহ বিলকিস থামলেন। শ্বাস নিলেন।

তারপর বলতে লাগলেন, আজকে সবাই মনে করে ভবিষ্যতে পাকিস্তান ভেঙে তিন টুকরো হয়ে যাবে । কিন্ত কাদের জন্য হবে? ওই ক্ষমতালোভী সেনাবাহিনীর জন্য! বলে আজিজাহ বিলকিস চিৎকার করে ওঠেন। তারপর বলেন, যারা ১৯৭১ সালে ইস্ট পাকিস্তানে রক্তের সিন্ধু বইয়ে দিয়েছিল। অডিটোরিয়ামে গুঞ্জন ওঠে। পাকিস্তানের সবচে বড় পাপ কি জানেন? আজিজাহ বিলকিস জিজ্ঞেস করলেন।

অডিটোরিয়ামে পিনপতন স্তব্দতা। পাকিস্তানের সবচে বড় পাপ হল ইস্ট পাকিস্তানে রক্তের নহর বইয়ে দেবার পরও টিক্কা খান কে ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের চিফ অভ আর্মি স্টাফ নিযুক্ত করা। কাজটা ঠিক হয়নি। খুনিটাকে বরখাস্ত করা উচিত ছিল। অথচ কসাইটা served as the first Chief of Army Staff of the Pakistan Army from 3 March 1972 to 1 March 1976! অডিটোরিয়ামে গুঞ্জন ওঠে।

আজিজাহ বিলকিস এবার তীক্ষ্ম কাটা-কাটা কন্ঠে বললেন, আপনাদের সবার জানা উচিত ... As a Commander of Eastern Command, then, Lieutenant-General Tikka Khan was the architect and top planner of Operation Searchlight. The killings which began on March 25, 1971 led to the deaths of at least 26,000 people, as admitted by Pakistan (by the Hamoodur Rahman Commission) and as many as 3,000,000 as claimed by Bangladesh! Lieutenant-General Tikka Khan was internationally called the Butcher of Bengal for his ruthlessness. সম্মেলন কক্ষে পিন পতন নিস্তব্দতা। আজিজাহ বিলকিস বললেন, আমার বাবা আজও বেঁচে আছেন। যদিও বাবার অনেক বয়েস হয়েছে ... বাবা বলেন এত বাঙালি কবির মৃত্যুর জন্য টিক্কা খান দায়ি ...অথচ ... অথচ টিক্কা খানকেই কিনা ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের চিফ অভ আর্মি স্টাফ নিযুক্ত করা হল। এটাই পাকিস্তান রাষ্ট্রটির খুনে মানসিকতার বড় প্রমাণ। এ হল পাপ।

লানৎ! অভিশাপ! এই পাপের জন্যই সমগ্র বিশ্বের রোষ এখন পাকিস্তানের ওপর, পাকিস্তান আজ তিন টুকরা হতে চলেছে ... দেশটির পারমানবিক স্থাপনাসমূহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। অডিটোরিয়ামের দর্শক সারিতে বসে মাহমুদা রহমান নির্বাক স্তব্দ হয়ে শুনছেন বিতর্কিত রাষ্ট্রের এক বিবেকবান নারীর আবেগ মথিত স্বীকারোক্তি ... আজিজাহ বিলকিস আবার অতীতে ফিরে গেছেন। বলছেন: ... পাকিস্তান সেনাবাহিনী লালনের গানকে অবজ্ঞা করেছিল, পদ্মা নদীটিকে জয় করতে পারেনি তারা, তারা ভয় পেয়েছিল ... তারা পরাজিত হয়েছিল ... উৎসর্গ: আকাশ পাগলা ...খুব প্রাণবন্ত এক মানুষ! ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.