চট্টগ্রাম নগরের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার রিয়াজউদ্দিন বাজারের মূল ফটক দিয়ে কিছুদূর এগোলেই ডান দিকে ‘পাখির গলি’। গলির মুখেই রমজান চাচার দোকান। সেখানে সম্প্রতি একদিন গিয়ে দেখা গেল, চারটি খাঁচায় দুটি কাক, ছয়টি কবুতর ও তিনটি খরগোশ রাখা। নির্ভেজাল পোষা পশুপাখির কারবার। কিন্তু রমজান চাচার কাছে ‘নতুন পশুপাখি কী আছে?’ জিজ্ঞেস করতেই জানা গেল ‘আসল জিনিসের’ খবর।
ক্রেতা ঠাউরে চাচার জবাব, ‘কী লাগবো কন। ভালুকের পিত্ত (গলব্লাডার) দেওয়া যাইবো ১০টা। দাম ৩০ হাজার টাকা কইরা। তাজা অজগর এক লাখ। দুই মাস টাইম দিলে বেঙ্গল বাঘের চামড়াও আইনা দিমু।
’
রমজান চাচা আরও জানান, অজগর ও মেছোবাঘের চামড়াও দিতে পারবেন তিনি। পাঁচ হাজার টাকায় মিলবে জ্যান্ত কেউটে বা শঙ্খিনী সাপ।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এভাবেই অবৈধভাবে বাজারে ঠাঁই পাচ্ছে অনেক বিরল ও বিলুপ্তপ্রায় বন্য প্রাণী। চোরা শিকারিদের হাত ঘুরে তাদের জায়গা হচ্ছে খোদ রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন তথাকথিত ‘পাখির বাজারে’। দেশের গুরুতর ঝুঁকির মুখে থাকা জীববৈচিত্র্য ক্রমেই বিপন্নতর হচ্ছে।
কবুতর-খরগোশ ও বাহারি পাখির আড়ালে বিক্রি হচ্ছে বিপন্ন বাঘ, ভালুুক, উল্লুক, হনুমান এবং ধনেশ ও মদনটাকের মতো বিরল পাখি। অভ্যন্তরীণ চোরাবাজার থাকার পাশাপাশি কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ বন্য প্রাণী পাচারেরও অন্যতম নিরাপদ স্থানে পরিণত হয়েছে। বন্য প্রাণী ব্যবসার ওপর নজরদারি করা আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘ট্রাফিক’-এর ২০১০ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে বছরে ৩০০ কোটি টাকার অবৈধ বন্য প্রাণীর ব্যবসা হয়ে থাকে।
রাজধানীর কাঁটাবনে অবস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপণি কেন্দ্রটির পোষা পশুপাখির দোকানের অনেকগুলোতেই অবৈধভাবে বন্য প্রাণী বিক্রি হয়ে থাকে। সেখানে রংবেরঙের পোষা পাখি, খরগোশ ও কুকুরের পাশাপাশি প্রায়ই ঈগল ও কালিমসহ বিভিন্ন পাখি এবং ছোটখাটো বন্য প্রাণী এক রকম প্রকাশ্যেই বিক্রি হয়।
সম্প্রতি এক দিন গিয়ে চুপিচুপি অজগর ও কুমির আছে কি না জানতে চাইলে বেশ কয়েকজন দোকানি টেলিফোন নম্বর দিয়ে জানালেন, কী লাগবে তা ওই ফোনে জানাতে। মাঝেমধ্যে কর্তৃপক্ষের অভিযানের পরও এ বাজারে বছরের পর বছর ধরে বন্য প্রাণীর ব্যবসা চলছে। রাজধানীর কাপ্তানবাজারের মুরগিপট্টির বিপরীতে নতুন গড়ে ওঠা পাখির দোকানগুলোতে তেমন রাখঢাক ছাড়াই বন্য প্রাণীর ব্যবসা চলে। ‘বিসমিল্লাহ বার্ডস’ নামের দোকানে গিয়ে বন্য প্রাণী কিনতে চাইলে দোকানি ক্যাটালগ বের করে বললেন, ‘কোনটা লাগবো, অরজিনাল জঙ্গল থিক্যা আনা। ’
এখানকার আরেক দোকান ‘বার্ডস হাউস’-এ পাওয়া গেল হাওরের বিরল চারটি কালিম পাখি।
এর পরের খাঁচায়ই দেশে বিলুপ্তপ্রায় পাখি বিশাল ঠোঁটের ধনেশ। দোকানি ইমরান জানালেন, প্রতিটি ধনেশ ৩০ হাজার টাকা। ১২টি দেওয়া যাবে। সুন্দরবন থেকে আনা ছয়টি মদনটাক পাখি গুদামে আছে। এ পাখিটিও অতিবিপন্ন।
টঙ্গী ব্রিজের শেষ মাথায় রোববারে বসে বিশাল কবুতরের হাট। ২০০ থেকে ৩০০ দোকান বসে এই হাটে। সপ্তাহ দুয়েক আগের এক রোববারে সেখানে গিয়ে দেখা যায় নানা প্রজাতির কবুতরের সঙ্গে ঘুঘু, কালিম ও বেজি বিক্রি হচ্ছে। বেশির ভাগ বিক্রেতাই টিয়া, ময়না, বক, কোকিলসহ নানা জাতের বন্য পাখি নিয়ে বসেছেন। বিকেলে নৌপথে এখানে অজগরসহ নানা প্রজাতির সাপ আনা হয় বলে জানালেন কয়েকজন বিক্রেতা।
উত্তর-পূর্বের জেলা নেত্রকোনার ভারত-সীমান্তবর্তী উপজেলা কলমাকান্দায়ও বসে বনবিড়াল, গন্ধগোকুল, লামচিতা, সাপসহ নানা প্রজাতির বন্য প্রাণীর হাট।
কোথা থেকে কোথায় যায়: অনুসন্ধানে জানা গেছে, চোরা শিকারিরা সুন্দরবন ও পার্বত্য চট্টগ্রামের সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে বন্যপ্রাণী ধরে বাজারে চালান দেয়। ভারতীয় সীমান্ত দিয়েও চোরাপথে আসে বেশ কিছু বন্য প্রাণী। চট্টগ্রাম বন্দর, ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও মিয়ানমার সীমান্ত পথে অনেক বন্য প্রাণী বাইরেও পাচার হচ্ছে। থাইল্যান্ড, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও ইউরোপের কয়েকটি দেশ এগুলোর সবচেয়ে বড় ক্রেতা।
ঢাকা ও চট্টগ্রামের একাধিক পোষা পশুপাখির ব্যবসায়ী এবং আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী সংগঠন সূত্রে জানা গেছে, দেশের দুই প্রধান দলের দুজন সাবেক সাংসদ এ ব্যবসার অন্যতম ‘গডফাদার’ হিসেবে পরিচিত। এ ছাড়া চট্টগ্রাম অঞ্চলের একজন প্রভাবশালী বর্তমান সাংসদ তাঁর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বন্য প্রাণী পাচার করে থাকেন বলে তাঁরা উল্লেখ করেন।
বাঘ-হাঙরের চামড়া পাচার: ‘প্রজেক্ট অন টাইগার’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে বছরে দুই থেকে তিনটি বাঘ চোরা শিকারিদের হাতে মারা পড়ে। এ ছাড়া কমপক্ষে দুটি বাঘ মানুষের সঙ্গে সংঘর্ষে মারা যায়। ওয়াইল্ডলাইফ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশের (ডব্লিউটিবি) হিসাবে শিকারিদের হাতে বছরে ১০ হাজার হরিণ মারা পড়ছে।
দেশে মাঝেমধ্যেই বাঘের চামড়া বা দেহাবশেষ আটকের ঘটনা ঘটে। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি সুন্দরবনসংলগ্ন শরণখোলায় বেঙ্গল টাইগারের তিনটি চামড়া, চারটি খুলি ও ৩০ কেজি হাড়সহ একজন ধরা পড়ে। ৬ ফেব্রুয়ারি বান্দরবানের থানচির জঙ্গল থেকে বেঙ্গল টাইগার মেরে এর চামড়া ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি করে দেয় স্থানীয় বম জাতিগোষ্ঠীর কিছু মানুষ।
নদী ও সাগর থেকেও হাঙর, কুমির, ঘড়িয়াল ও কচ্ছপ দেদার ফাঁদ ও বিভিন্ন কায়দায় ধরা হচ্ছে। দেশের ১২টি প্রতিষ্ঠান ‘বৈধ’ অনুমোদন নিয়ে রপ্তানি করছে হাঙর, শাপলাপাতা মাছ (স্টিংরে) ও কচ্ছপের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ।
আর অবৈধ পথে যাচ্ছে সাপ, কুমির ও অতিবিরল ঘড়িয়াল। বিরল পাখিও আছে পাচারের তালিকায়। বাঘ ও ভাল্লুকের চামড়া ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ওষুধ, গহনা ও গৃহসজ্জাসামগ্রী তৈরিতে ব্যবহূত হয়।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বেঙ্গল টাইগারের চামড়ার দাম ১০ থেকে ২০ লাখ টাকা। মেছোবাঘ ও লামচিতার চামড়া মিলবে ২০ থেকে ৬০ হাজার টাকায়।
জ্যান্ত মেছোবাঘ বা লামচিতা এক থেকে দুই লাখ টাকায় পাওয়া যাবে বলে জানান একজন ব্যবসায়ী। তিনি জানান, জ্যান্ত ভালুক, উল্লুক ও হনুমানও মোটা দামে বিক্রি হচ্ছে। বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ রেজা খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বনে বাঘ, সমুদ্রে হাঙর ও নদীতে কুমির প্রাণচক্রের সর্বোচ্চ স্থানে থাকা প্রাণী। এরা অন্য প্রাণীদের খেয়ে বাস্তুসংস্থান ঠিক রাখে। এদের এ হারে মেরে ফেলতে থাকলে একসময় বন-জলাভূমির প্রাণচক্র ভেঙে পড়বে।
বন্য প্রাণী একবার বিলুপ্ত হয়ে গেলে তাদের আর ফিরে পাওয়া যাবে না। ’
দেশের একমাত্র বৈধ কুমিরের খামার রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুশতাক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেছেন, পরিচয় গোপন করে অনেকে তাঁদের কাছে আন্তর্জাতিক বাজারের তিনগুণ বেশি দামে কুমির কেনার প্রস্তাব দিচ্ছে। বিনিময়ে কুমিরের চালানের সঙ্গে অন্য বন্য প্রাণীও পাচারের ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
বায়ো-কেমিক্যাল অ্যান্ড সি ফুড এক্সপোর্ট কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাজহারুল ইসলাম জানান, গত অর্থবছরে তাঁর প্রতিষ্ঠানসহ ১২ জন মিলে মোট প্রায় ৬০ কোটি টাকার হাঙরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, কচ্ছপের খোল ও মাংস এবং শাপলাপাতা মাছ রপ্তানি করেছেন।
চট্টগ্রাম বন্দরের শুল্ক বিভাগের কমিশনার জামাল হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাঙর নিষিদ্ধ হলে তা রপ্তানি হওয়ার কথা না।
তবে বিষয়টি আমার জানা নেই। ’
বিপন্ন বিরল প্রাণী ভালুক: ভালুকের পিত্ত বিক্রির সবচেয়ে বড় বাজার চট্টগ্রাম। এ দিয়ে তৈরি হয় ওষুধ। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ভালুকের পিত্ত সরবরাহ হয়ে থাকে। ওই অঞ্চলের চোরা শিকারিরা ফাঁদ পেতে ভালুক ধরে।
শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের পাশাপাশি জ্যান্ত প্রাণীটিও বিক্রি হয়ে থাকে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে নিয়মিতভাবে জীবিত ভালুক ও এর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাচার হয়ে থাকে। দক্ষিণ কোরিয়া, চীন ও তাইওয়ানের মানুষ এর সবচেয়ে বড় ক্রেতা। ১৯৯১ সালের ১৯ জুন চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরে অপেক্ষমাণ কোরীয় জাহাজ ‘সিইয়াং’-এ অভিযান চালিয়ে বন বিভাগ ছয়টি জীবিত ভালুক ও ২৪টি বানর উদ্ধার করে। উদ্ধার হওয়া প্রাণীগুলো চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় দেওয়া হয়।
ওই জাহাজের মালিকদের জরিমানা করা হয়েছিল।
বিশেষজ্ঞের উদ্বেগ: পরিবেশ ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণবিষয়ক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) তালিকায় অতিবিপন্ন প্রাণী হিসেবে রয়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার (সুন্দরবনের বাঘ), মেছোবাঘ, লামচিতা ও কালো ভালুকের নাম। বিশেষজ্ঞরা বলেন, গত ১০০ বছরে বাংলাদেশ থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে গন্ডার, জলার কুমির, হায়েনা, নেকড়েসহ মোট ১৫ প্রজাতির বন্য প্রাণী।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মনিরুল আলম খান এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাঘ-ভালুকের সংখ্যাও দিন দিন কমে আসছে। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে বাংলাদেশ থেকে বন্য প্রাণী চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
’ অধ্যাপক মনিরুল আলম খান বন্দরগুলোতে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বন্য প্রাণী চিহ্নিত করা ও পাচার রোধে সচেতন করতে প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন বলে মত দেন। তাঁর মতে, একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এ ব্যাপারে সক্রিয় করতে হবে।
প্রধান বন্য প্রাণী সংরক্ষক ইশতিয়াক উদ্দিন আহমদের কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বন্য প্রাণী রক্ষায় আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা না পেলে এই অনৈতিক ও অবৈধ ব্যবসা থামানো যাবে না। ’ কাঁটাবন মার্কেটে অবৈধ বন্য প্রাণীর ব্যবসার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই বাজারে কিছুদিন পরপর অভিযান চালিয়ে বন্য প্রাণী পাওয়া যাচ্ছে।
ফলে এটি বন্ধ করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করা হয়েছে।
লিংক ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।