আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সাদাকাতুল ফিতর আধা সা গম : হাদীস ও সুন্নায়, আছার ও ইজমায়(সংগৃহীত) - পর্ব ০২

১ম পর্বের পরঃ আধা সা গম দিয়ে সদকায়ে ফিতর আদায়ের মাসআলায়ও তাই ঘটেছে। এ বিষয়ে অনেক হাদীস, আছার এবং সেগুলোর বহু সনদের মধ্যে দু’ একটি হাদীস এবং সনদ যয়ীফও রয়েছে। কারো দৃষ্টিতে কেবল এগুলোই ধরা পড়েছে ফলে তিনি বলতে শুরু করেছেন যে, আধা সা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়!! অন্যথায় যাদের দৃষ্টি বিস্তৃত এবং যাদের এ বিষয় সম্পর্কিত সকল হাদীস এবং রেওয়ায়েত সম্পর্কে নিরীক্ষণের সুযোগ হয়েছে তাদের মধ্য থেকে কোনো হাদীস বিশারদ আধা সা-এর বিশুদ্ধতার বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেননি। বিশিষ্ট মুহাদ্দিসগণের মন্তব্য এখানে আমরা নমুনাস্বরূপ কয়েকজন মুহাদ্দিস এবং ফকীহর বক্তব্য উদ্ধৃত করছি, যারা স্পষ্ট ভাষায় লিখেছেন যে, আধা সা সম্পর্কিত হাদীসসমূহ সহীহ সূত্রে প্রমাণিত এবং গ্রহণযোগ্য। শেষের দিকে কয়েকজন সমকালীন আলেমের বক্তব্যও তুলে ধরা হয়েছে।

কেননা, আমাদের দেশে যারা উক্ত বিষয়টিকে নতুন করে আলোচ্য বিষয় বানিয়েছেন তাদেরকে এদের ভক্ত লক্ষ্য করা যায়। আশা করি, এদের বক্তব্য দ্বারা তাদেরও আধা সা বিষয়ক হাদীসসমূহের বিশুদ্ধতার ব্যাপারে ইতমিনান এবং প্রশান্তি হাসিল হবে। ১. ইমাম ত্বহাবী রাহ. আধা সা গম সম্পর্কে অনেকগুলো হাদীস ও আছার রেওয়ায়েত করার পর বলেন, এ পরিচ্ছেদে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে, তারপর তাঁর সাহাবীগণ থেকে এবং তাঁদের পর তাবেয়ীদের থেকে যেসব রেওয়ায়েত উল্লেখ করেছি, তা প্রমাণ করে যে, সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ হল গম থেকে আধা সা আর গম ছাড়া অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী থেকে এক সা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কোনো সাহাবী ও কোনো তাবেয়ী থেকে এর বিপরীত কিছু বর্ণিত আছে বলে আমাদের জানা নেই। সুতরাং এর বিরোধিতা করার অবকাশ কারো নেই।

কারণ তা ছিল ইজমায়ী ও সর্বসম্মত বিষয়, হযরত আবু বকর সিদ্দীক, উমর ফারূক, উসমান ও আলী রা.-এর যমানা থেকে উপরোক্ত তাবেয়ীদের যামানা পর্যন্ত। هذا كل هذا كل ما روينا في هذا الباب عن رسول الله صلى الله عليه وسلم وعن أصحابه من بعده وعن تابعيهم من بعدهم كلها على أن صدقة الفطر من الحنطة نصف صاع ومما سوى الحنطة صاع، وما علمنا أن أحدا من أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم ولا من التابعين روي عنه خلاف ذلك، فلا ينبغي لأحد أن يخالف ذلك، إذ كان قد صار إجماعا في زمن أبي بكر وعمر وعثمان و علي إلى زمن من ذكرنا من التابعين. ২. ইমাম আবু উবাইদ কাসেম ইবনে সাল্লাম রাহ. (মৃত্যু : ২২৪ হি.) বলেন, গম, যব, খেজুর ও কিসমিস এগুলোর যে কোনোটি দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায় করা যায়। খেজুর, কিসমিস বা যব দ্বারা আদায় করলে এক সা প্রদান করবে। আর গম দ্বারা আদায় করলে আমার মতে উত্তম হল, এক সা থেকে কম না দেওয়া। তবে আধা সা দিলেও ফিতরা আদায় হয়ে যাবে।

কারণ এক জামাত আলিম এই ফতোয়া দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্যের আরবী পাঠ নিম্নরূপ- وأما زكاة الفطر فإن صاحبها فيها بالخيار، إن شاء جعلها برا، وإن شاء جعلها تمرا، أو شعيرا أو زبيبا، فإن اختار التمر، أو الشعير، أو الزبيب فإن هذا المكوك يجزئ عن نفسين ونصف، لأنه صاعان ونصف، وإن اختار البر، فإن أحب الأمرين إلي له أن لا ينتقص من مكيلة الصاع شيئا، لأن أكثر الآثار عليه، وهو أفضل عندي من التمروالشعير، وإن جعله نصف صاع بر كان مجزيا عنه، لأنه قد أفتى به عدة من أهل العلم، وصاع تمر أو صاع شعير أحب إلي من نصف صاع بر، وإن كان مجزيا، لأنه هو أشد موافقة للاتباع. ৩. ইমাম আবু বকর জাসসাস রাহ. (মৃত্যু : ৩৭০ হি.) বলেন, আধা সা গম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এবং হযরত আবু বকর, উমর, উসমান ও আলী, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, জাবির, আয়েশা, ইবনুয যুবাইর, আবু হুরায়রা, আসমা বিনতে আবু বকর, কাইস ইবনে সাআদ রা. প্রমুখ সাহাবী ও অধিকাংশ তাবেয়ী থেকে বর্ণিত হয়েছে। কোনো সাহাবী থেকে এ কথা বর্ণিত হয়নি যে, আধা সা গম প্রদান করলে ফিতরা আদায় হবে না। روي روي نصف صاع من بر عن النبي صلى الله عليه وسلم وأبي بكر وعمر وعثمان وعلي وابن مسعود وجابر وعائشة وابن الزبير وأبي هريرة وأسماء بنت أبي بكر وقيس بن سعد رضي الله عنهم أجمعين، وعامة التابعين، ولم يرو عن أحد من الصاحابة بأنه لا بجزئ نصف صاع من بر. (শরহু মুখতাসারিত তহাবী ২/২৩৪৫) ৪. ইমাম ইবনুল মুনযির রাহ. সম্ভবত আধা সা গম দিয়ে ফিতরা আদায় সংক্রান্ত মারফূ হাদীসমূহ তার নিকট পৌঁছেনি বা পৌঁছলেও সেগুলোর সনদের বিশুদ্ধতার দিকটি তাঁর নিকট স্পষ্ট হয়নি, ফলে তিনি সেগুলো প্রমাণিত নয় বলে মন্তব্য করেছেন। তা সত্ত্বেও তিনি সাহাবায়ে কেরাম রা.-এর অভিমত ও সিদ্ধান্তের কারণে আধা সা-এর মতটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন এবং নিজে তা গ্রহণ করেছেন।

ফাতহুল বারীতে তাঁর বক্তব্য এভাবে উল্লেখিত হয়েছে- لا نعلم في القمح خبرا ثابتا عن النبي صلى الله عليه وسلم يعتمد عليه، ولم يكن البر بالمدينة ذلك الوقت إلا الشيء اليسير منه، فلما كثر في زمن الصحابة رأوا أن نصف صاع منه يقوم مقام صاع من شعير، وهم الأئمة، فغير جائز أن يعدل عن قولهم إلا إلى قول مثلهم، ثم أسند عن عثمان وعلي وأبي هريرة وجابر وابن عباس وابن الزبير وأمه أسماء بنت أبي بكر بأسانيد صحيحة أنهم رأوا أن في زكاة الفطر نصف صاع من قمح. انتهى، وهذا مصير منه إلى اختيار ما ذهب إليه الحنفية. অর্থাৎ গমের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে নির্ভরযোগ্য কোনো হাদীস আমাদের জানা নেই এবং তাঁর সময়ে মদীনায় গমের ফলন খুব সামান্য ছিল। পরবর্তীতে সাহাবায়ে কেরামের যামানায় যখন গমের ফলন বৃদ্ধি পায় তখন তাঁরা আধা সা গমকে এক সা যবের স্থলাভিষিক্ত বলে মত দিলেন। আর তাঁরা হলেন উম্মতের অনুসরণীয় ব্যক্তি। সুতরাং তাঁদের বক্তব্য উপেক্ষা করে তাঁদের সমতুল্য ব্যক্তিবর্গ ছাড়া অন্য কারো মত গ্রহণ করা জায়েয নয়। এরপর ইবনুল মুনযির রাহ. বিশুদ্ধ সূত্রে হযরত উসমান, আলী, আবু হুরায়রা, জাবির, ইবনে আববাস, আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর এবং তাঁর মাতা আসমা বিনতে আবু বকর রা. থেকে রেওয়ায়েত করেছেন যে, তাঁরা সকলেই সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ আধা সা গম মনে করেন।

ইবনুল মুনযির রাহ.-এর বক্তব্য উল্লেখ করার পর ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. বলেন, এটা প্রমাণ করে, এ বিষয়ে তিনি হানাফীদের মত গ্রহণ করেছেন। (ফতাহুল বারী ৩/৪৩৭) ৫. আল্লামা ইবনে আবদুল হাদী আল হাম্বলী রাহ. (মৃত্যু : ৭৪৪ হি.) বলেন, ওয়াজিব ফিতরার ক্ষেত্রে আধা সা গমের সিদ্ধান্তটি একটি শক্তিশালী সিদ্ধান্ত এবং তা অনেক দলিল দ্বারা প্রমাণিত। القول بإيجاب القول بإيجاب نصف صاع من بر قول قوي، وأدلته كثيرة. (তানকীহু তাহকীকি আহাদীসিত তালীক ২/২৪৫) ৬. শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহ.ও মনে করেন, আধা সা গম দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায় হবে। তাঁর বিশিষ্ট শাগরিদ আল্লামা ইবনে মুফলিহ রাহ. কিতাবুল ফুরূতে স্বীয় উস্তাদের অভিমত এভাবে উল্লেখ করেছেন- واختار شيخنا بأنه يجزئ نصف صاع من بر، وقال : وهو قياس المذهب في الكفارة، وإنه يقتضيه ما نقله الأثرم. অর্থাৎ আমাদের শায়খ (ইবনে তাইমিয়া রাহ.) এ মত গ্রহণ করেছেন যে, আধা সা গম দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায় হবে। তিনি বলেন, কাফফারার ক্ষেত্রে হাম্বলীদের যে মাযহাব তা একথাই বলে এবং ইমাম আছরাম রাহ. এর বর্ণনাও তা নির্দেশ করে।

(আলফুরূ ১/৭০৯; যাদুল মাআদ ২/২০; আরো দেখুন : তামামুল মিন্নাহ ৩৮৬) ৭. আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম রাহ. ‘‘যাদুল মাআদ’’ কিতাবে (২/১৮-২০) বলেন, আধা সা গমের বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে একাধিক মুরসাল ও মুসনাদ হাদীস বর্ণিত আছে, যেগুলো সমষ্টিগতভাবে শক্তিশালী। وفيه عن النبي صلى الله عليه وسلم آثار مرسلة ومسندة يقوي بعضها بعضا. এরপর কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করার পর বলেন, আমাদের শায়খ (ইবনে তাইমিয়া রাহ.) এ মতটিকে শক্তিশালী আখ্যা দিতেন এবং বলতেন, কাফফারার ক্ষেত্রে ইমাম আহমদ রাহ.-এর বক্তব্য যা বলে তা এই যে, গম থেকে সদকায়ে ফিতরের ওয়াজিব পরিমাণ অন্যান্য খাদ্যসামগ্রীর অর্ধেক। وكان شيخنا رحمه الله تعالى : يقوي هذا المذهب ويقول : هو قياس قول أحمد في الكفارات، أن الواجب فيها من البر نصف الواجب من غيره. তিনি শুধু আধা সা গমের হাদীসগুলো উল্লেখ করেছেন এবং শাইখের অভিমত উল্লেখ করে ঐ মতটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। ৮. আল্লামা ছালেহ ইবনে মাহদী আলমাকবিলী রাহ. (মৃত্যু : ১১০৮ হি.) বলেন, এমন অনেক রেওয়ায়েত আছে, যা সম্মিলিতভাবে প্রমাণ করে যে, গমের ক্ষেত্রে ওয়াজিব ফিতরা হচ্ছে দুই মুদ বা আধা সা। وردت روايات يعمل بمجموعها أن الواجب من الحنطة مدان. (আল মানার ফিল মুখতার ১/৩৩১) ৯. আল্লামা আহমদ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে সিদ্দীক আলগুমারী রাহ. বলেন, কেউ যদি বলে যে, আধা সা তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত নয়, যেমনটি ইবনুল মুনযির ও বাইহাকী রা.বলেছেন তাহলে এর উত্তরে আমরা বলব যে, বরং তা প্রমাণিত।

কারণ তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, খোলাফায়ে রাশেদীন ও সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেয়ীদের থেকে এত অধিক সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, এরপর আর কোনো সংশয় থাকে না; বরং একে যদি মুতাওয়াতির বলা হয় তবুও অত্যুক্তি হবে না। فإن قيل : إن نصف صاع لم يثبت عن النبي صلى الله عليه وسلم كما قال ابن المنذر والبيهقي؟ قلنا : بل هو ثابت لو روده عن النبي صلى الله عليه وسلم والخلفاء الراشدين وغيرهم من الصحابة والتابعين، من طرق كثيرة لا يبقى معها شك في ثبوته، بل لا يبعد القول بتواتره. فقد ورد من حديث عبد الله بن عمرو بن العاص، وعبد الله بن عباس، وعائشة، وعبد الله بن ثعلبة، وأسماء بنت أبي بكر، وعبد الله بن عمر بن الخطاب، وجابر بن عبد الله، وزيد بن ثابت، وعصمة بن مالك، وعلي بن أبي طالب، وأبي هريرة، وأبي سعيد الخدري موصولا. وعن سعيد بن المسيب وأبي سلمة بن عبد الرحمن، وعبيد الله بن عبد الله بن عتبة بن مسعود، والقاسم بن محمد، وسالم بن عبد الله مرسلا. وعن أبي بكر، وعمر وعثمان وعلي وجابر وابن مسعود وابن الزبير وابن عباس ومعاوية وأبي سعيد الخدري موقوفا. وعن مجاهد وعطاء والشعبي وعمر بن عبد العزيز والحسن البصري وطاؤس وعبد الله بن شداد وإبراهيم النخعي والحكم وحماد مقطوعا. (তাহকীকুল আমাল ফী ইখরাজি যাকাতিল ফিতরি বিল মাল ৬৩) ১০. শায়খ নাসীরুদ্দীন আলবানী রাহ. বলেন, আধা সা সম্পর্কে কয়েকটি মারফূ হাদীস রয়েছে এবং এ বিষয়ে অনেক মুরসাল ও মুসনাদ আছর রয়েছে, যেগুলো সমষ্টিগতভাবে শক্তিশালী। আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম রাহ. ‘‘যাদুল মাআদ’’ কিতাবে এমনটি বলেছেন এবং তিনি ঐসব আছার উল্লেখ করেছেন। এ থেকে প্রমাণ হয় যে, গমের ওয়াজিব ফিতরা হল আধা সা। আর এটি শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহ.-এর অভিমত এবং ইবনুল কাইয়িম রাহ. এ দিকেই ঝুঁকেছেন।

ইনশাআল্লাহ এটিই সঠিক মত। زاد فيه أحاديث مرفوعة إلى النبي صلى الله عليه وسلم وفي الباب آثار مرسلة ومسنده يقوي بعضها بعضا، كما قال ابن القيم في الزاد وقد ساقها فيه، فليراجعها من شاء، وخرجتها أنا في التعليقات الجياد. فثبت من ذلك أن الواجب في صدقة الفطر من القمح نصف صاع، وهو اختيار شيخ الإسلام ابن تيمية كما في الاختيبارات. ص : ٦٠ وإليه مال ابن القيم كما سبق، وهو الحق إن شاء الله تعالى. (তামামুল মিন্নাহ ৩৮৬) ১১. শায়খ নাসীরুদ্দীন আলবানী রাহ.-এর বিশিষ্ট শাগরিদ হুসাইন ইবনে আউদাহ আলআওয়াইশাহ বলেন, গমের ক্ষেত্রে সদকায়ে ফিতরের পরিমাণ হল আধা সা। এটি ইমাম আবু হানীফা ও রাহ.-এর অভিমত এবং শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ রাহ. ও আমাদের শাইখ (নাসিরুদ্দীন আলবানী রাহ.ও) এই মত পোষণ করতেন। তাঁর বক্তব্যের আরবী পাঠ এই - وأما وأما من البر : فنصف صاع، وهو قول أبي حنيفة، وقياس أحمد في بقية الكفارات، وبه يقول شيخ الإسلام وشيخنا رحم الله الجميع. عن عروة بن الزبير : أن أسماء بنت أبي بكر كانت تخرج على عهد رسول الله صلى الله عليه وسلم عن أهلها الحر منهم والمملوك ـ مدين من حنطة، أو صاعا من تمر بالمد، أو بالصاع الذي يقتاتون به، أخرجه الطحاوي واللفظ له، وابن أبي شيبة وأحمد وسنده صحيح على شرط الشيخين، كما في تمام المنة. قال شيخنا فيه (٣٨٧) عقب أثر عروة ابن الزبير : فثبت من ذلك أن الواجب في صدقة الفطر من القمح نصف صاع، وهو اختيار شيخ الإسلام ابن تيمية كما في الاختيارات وإليه مال ابن القيم ... وهو الحق إن شاء الله تعالى. (আলমাউসূআতুল ফিকহিয়্যাহ আলমুয়াসারাহ ৩/১৬৩) ১২. ড. মুহাম্মাদ আবদুল গাফফার আশশরীফ বলেন, হানাফী ইমামগণ আধা সা গম ফিতরা সম্পর্কে অনেক হাদীস ও আছার দ্বারা দলিল পেশ করেছেন। দলীলের প্রাচুর্য্য ও বিশুদ্ধতার কারণে আমার নিকট হানাফী ইমামদের বক্তব্যই অগ্রগণ্য।

আর হানাফী ইমাম ছাড়াও খোলাফায়ে রাশেদীন, ইবনে মাসউদ, জাবির ইবনে আবদুল্লাহ, আবু হুরায়রা, আসমা বিনতে আবু বকর রা. প্রমুখ সাহাবী এবং উমর বিন আবদুল আযীয রাহ.সহ বড় বড় তাবেয়ীগণ এ সিন্ধান্তই দিয়েছেন। এক বর্ণনা অনুযায়ী ইমাম আহমদ এবং ইবনুল মুনযির রাহ.সহ আরো অনেকেরই এই সিদ্ধান্ত ছিল। واستدل الحنفية بأحاديث وآثار كثيرة لوجوب نصف صاع من بر، ... والراجح عندي مذهب الحنفية، لكثرة أدلتهم وصحتها ... وقد قال بهذا القول عدا الحنفية الخلفاء الراشدون، وابن مسعود، وجابر بن عبد الله، وأبو هريرة، وأسماء بنت أبي بكر، وعمر بن عبد العزيز، وكبار التابعين وأحمد في رواية وابن المنذروغيرهم. (বুহুছ ফিকহিয়্যাহ মুআছিরা ১/২৭৬) ১৩. শায়খ মাহমুদ সাঈদ মামদূহ বলেন, আধা সা বিষয়ে একাধিক শক্তিশালী মুসনাদ হাদীস এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ের সহীহ অনেকগুলো মুরসাল হাদীস রয়েছে। ইমাম তাহাবী রাহ. তাঁর দুই কিতাব ‘‘শরহু মাআনিল আছার’’ ও ‘‘শরহু মুশকিলিল আছাওে’’ তা রেওয়ায়েত করেছেন। ইবনে আবদুল হাদী রাহ. ‘‘আততানকীহ’’ গ্রন্থে বলেছেন, আধা সা গম ওয়াজিব হওয়ার বক্তব্যটি শক্তিশালী এবং অনেক দলিল দ্বারা প্রমাণিত।

وفي الباب مسندات قوية، ومراسيل غاية في الصحة أخرجها الإمام الطحاوي في كتابيه شرح معاني الآثار وشرح مشكل الآثار. وقد قال ابن عبد الهادي في التنقيح : ٢/١٤٧ القول بإيجاب نصف صاع من بر قول قوي، وأدلته كثيرة. (আততারীফ বিআউহামি মান কাসসামাস সুনানা ইলা সহীহিন ওয়া যয়ীফিন ৫/৩৮৯) আধা সা-এর পরিমাপটি কি নবী-যুগের পর নির্ধারিত হয়েছে? পূর্বোক্ত মাশহুর ও মুতালাক্কা বিলকবুল তথা প্রসিদ্ধ ও খাইরুল কুরূনের ইমামগণের মাঝে স্বীকৃত হাদীস ও আছারসমূহের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে কেউ কেউ এই বলে সংশয় প্রকাশ করেছেন যে, সহীহ হাদীস থেকে জানা যায়, আধা সা-এর পরিমাপ হযরত মুআবিয়া রা.-এর যুগে অথবা হযরত উমর রা.-এর যুগে নির্ধারিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কয়েকটি বিষয় লক্ষ করুন। 1. যে রেওয়ায়েতে বলা হয়েছে, হযরত ওমর রা. আধা সা গমকে এক সা খেজুরের সমতুল্য সাব্যস্ত করেছেন এবং মানুষ সে অনুযায়ী আমল করতে শুরু করে তা একটি ‘মালূল রেওয়ায়েত’ তথা ভুল বর্ণনা। ইমাম মুসলিম রাহ. কিতাবুত তাময়ীযে সেটিকে বর্ণনাকারীর ওয়াহম ও ভ্রান্তি বলে চিহ্নিত করেছেন। ইমাম ইবনে আবদুল বার রাহ. ইবনুল জাওযী রাহ. শামসুদ্দীন যাহাবী রাহ. এবং হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রাহ.ও উক্ত রেওয়ায়েতকে যয়ীফ বা মালূল বলেছেন।

(দেখুন : আততামহীদ, ইবনে আবদুল বার ১৪/৩১৭-৩১৮; আততাহকীক লিআহাদীসিত তালীক, ইবনুল জাওযী ২/২৪৩; আততানকীহ ১/৪৮০; ফাতহুল বারী ৩/৪৩৫) 2. এ কথা ঠিক যে, কোনো কোনো সহীহ হাদীসে আছে, হযরত মুআবিয়া রা. তাঁর খেলাফত-আমলে হজ্ব বা উমরার এক সফরে মদীনা আগমন করেন। তখন তিনি বলেছিলেন- أرى أن إني أرى أن مدين من سمراء الشام تعدل صاعا من تمر. আমার মতে শামের দুই মুদ (আধা সা) গম এক সা খেজুরের সমতুল্য। (সহীহ মুসলিম ১/৩১৮) এ বর্ণনা থেকে কিছু লোক মনে করেছে, আধা সা গম আদায়ের বিধানটির প্রচলন হযরত মুআবিয়া রা.-এর উক্ত প্রস্তাবনার পর থেকে শুরু হয়েছে। এর আগে এর কোনো অস্তিত্বই ছিল না। কিন্তু তারা ভেবে দেখেননি যে, এ রেওয়ায়েতটি যেমন সহীহ, আধা সায়ের মারফূ হাদীসগুলো তো আরো বেশি সহীহ।

তো এর কারণে ওগুলোকে অস্বীকার করা কিভাবে সঠিক হতে পারে? তাহলে তো কেউ এমনও বলে বসতে পারে যে, সহীহ মারফূ হাদীসে যেহেতু আধা সার কথা আছে তাই ঐ রেওয়ায়েতটি সহীহ নয়, যাতে বলা হয়েছে, আধা সা-এর (পরিমাণ) হযরত মুআবিয়া রা.-এর আগে ছিল না। কেউ কেউ বলে থাকে, আধা সায়ের হাদীস বুখারী-মুসলিমে নেই। পক্ষান্তরে এই পরিমাপ হযরত মুআবিয়া রা. শুরু করেছেন তা বুখারী-মুসলিমে আছে। তাই অগ্রগণ্য বর্ণনা হল, মুআবিয়া রা.ই আধা সা-এর উদ্ভাবক!! এই দাবি নিতান্তই বালখিল্যতা। কারণ যে সকল হাদীসের বিষয়বস্ত্ত সাহাবা-তাবেয়ীনযুগের মনীষী-মহলে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত হয়ে যায় তাকে শুধু এই অজুহাতে গৌণ বা নগণ্য সাব্যস্ত করা যে, হাদীসটি বুখারী-মুসলিমে সংকলিত হয়নি, এর চেয়ে হাস্যকর বিষয় আর কী হতে পারে? তবে কি ফকীহ সাহাবী ও তাবেঈদের স্বীকৃতি এমনই তুচ্ছ বিষয় যে, পরবর্তীযুগে বুখারী-মুসলিমে সংকলিত হওয়া ছাড়া তার কোনো মূল্য নেই; বরং তা যয়ীফ বা গৌণ (অপরটির তুলনায় অগ্রহণযোগ্য) হয়ে যাবে? জেনে রাখা দরকার, এ জাতীয় চিন্তা-ভাবনা হাদীস অস্বীকারকারীদের জন্য রসদ যুগিয়ে থাকে! আর এই দু’ একটি রেওয়ায়েতের কারণে আপনি কতগুলো রেওয়ায়েতকে অস্বীকার করবেন? আধা সায়ের মারফূ হাদীস এবং এ সংক্রান্ত সাহাবা-তাবেয়ীদের আছারের সংখ্যা তো এসব রেওয়ায়েত থেকে অনেক গুণ বেশি।

এই সকল রেওয়ায়েতকে শুধু এ কারণে প্রত্যাখ্যান করে দিবেন যে, কোনো কোনো রেওয়ায়েতে আছে, উক্ত পরিমাপটি হযরত মুআবিয়া রা.-এর যামানায় নির্ধারিত হয়!? হযরত মুআবিয়া রা.-এর আগে যদি এই পরিমাপের কোনো অস্তিত্ব না থেকে থাকে তাহলে খোলাফায়ে রাশেদীন ও বড় বড় সাহাবী তা কোথায় পেলেন, যারা হযরত মুআবিয়া রা.-এর খেলাফত আমলের বহু আগেই ইন্তিকাল করেছিলেন? তাঁরা কীসের ভিত্তিতে এক সা যব ও খেজুরের সাথে আধা সা গমের ফায়সালা ও ফতোয়া দিতেন? আসল কথা এই যে, বুখারী-মুসলিমের ঐ রেওয়ায়েতের সাথে আধা সায়ের হাদীস ও আছারের এমন কোনো সংঘাত নেই যে, একটির কারণে অন্যটিকে অস্বীকার করতে হবে। ওই রেওয়ায়েতে শুধু এটুকু বলা হয়েছে যে, হযরত মুআবিয়া রা. এই প্রস্তাব দিয়েছেন যে, আধা সা গম এক সা খেজুরের সমতুল্য। অন্যরাও তাঁর সাথে একমত হয়েছেন। তাঁর প্রস্তাবের সরল অর্থ হচ্ছে, আধা সা সংক্রান্ত মারফূ হাদীসগুলো তাঁর জানা ছিল না। আর এতে আশ্চর্যের কিছু নেই।

কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতিটি হাদীস প্রত্যেক সাহাবীর জানা থাকবে তা না অপরিহার্য, না বাস্তবে সম্ভব। এ কারণেই উসূলে হাদীসের কিতাবে এটি একটি স্বীকৃত বিষয়। হযরত মুআবিয়া রা.-এর প্রস্তাবের সাথে কেউ এজন্যই দ্বিমত পোষণ করেননি যে, বিশিষ্টদের জানা ছিল, তাঁর প্রস্তাব নতুন কিছু নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীস এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহর দ্বারা তা আগে থেকেই প্রতিষ্ঠিত। এখানে লক্ষণীয় বিষয় এই যে, আধা সা সংক্রান্ত অধিকাংশ হাদীস ও আছার হচ্ছে মৌখিক বর্ণনা।

অর্থাৎ বিধানটি মুখে বর্ণনা করা হত, কিন্তু ঐ সময় মক্কা মদীনায় গমের প্রচলন কম থাকায় তা আমলের সুযোগ হত কম। সাধারণত খেজুর ও যব দ্বারাই ফিতরা আদায় করা হত, যার নির্ধারিত পরিমাণ এক সা। হযরত মুআবিয়া রা.-এর যামানায় গমের প্রচলন বৃদ্ধি পেলে তিনি মিম্বারের দাঁড়িয়ে গম দ্বারা ফিতরা আদায়ের উৎসাহ দিয়েছেন, তখন সাধারণ মানুষও তা জেনেছে এবং ব্যাপকভাবে আমলও করেছে। এর অর্থ এটা নয় যে, ইতিপূর্বে আধা সায়ের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। অস্তিত্বই যদি না থাকবে তাহলে এতগুলো সহীহ হাদীস এবং সাহাবা-তাবেয়ীনের এত আছার ও ফতোয়া এল কোত্থেকে?! (ফাতহুল কাদীর ২/২২৮; ফায়যুল বারী ৩/৫৯; ইলাউস সুনান ৯/১০৭; মাআরিফুস সুনান ৫/৩০৫-৩১০) আধা সা কি আলাদা পরিমাপ নয়? কেউ কেউ বলেন যে, সাহাবায়ে কেরাম আধা সা গম এক সা খেজুরের সমমূল্যের মনে করার কারণে তা দ্বারা ফিতরা আদায়ের ফতোয়া দিয়েছিলেন।

আসলে তা ফিতরা আদায়ের আলাদা কোনো পরিমাপ নয়। বর্তমানে যেহেতু গমের দাম খেজুর ইত্যাদির চেয়ে কম তাই এখন আধা সা গম দ্বারা ফিতরা আদায় হবে না। এই বক্তব্যও ঐ ভুল ধারণা থেকেই উৎসারিত যে, আধা সা গমের পরিমাপ মারফূ হাদীসে নেই। অথচ ইতিপূর্বের আলোচনায় আমরা দেখেছি, সায়ের মতো আধা সাও একটি আলাদা পরিমাপ হিসেবে মারফূ হাদীসে বিদ্যমান আছে। খোলাফায়ে রাশেদীন ও খায়রুল কুরূনের ফকীহগণের ফতোয়াও তা-ই।

দ্বিতীয় কথা এই যে, সাহাবায়ে কেরামের যুগেই যখন গমের দাম কমে গেল তখনও তাঁরা আধা সা গমই আদায় করেছেন। ঐ সময় হযরত আয়েশা রা. এবং হযরত আলী রা. পরামর্শ দিয়েছিলেন, যেহেতু দাম কমে গেছে তাই এখন গমও এক সা-ই আদায় কর। উম্মুল মু’মিনীনের বক্তব্যের আরবী পাঠ এই- أحب إلي أن إذا وسع الله على الناس أن يتموا صاعا من قمح عن كل إنسان. আমার নিকট পছন্দনীয় হল, আল্লাহ তাআলা যখন মানুষকে প্রাচুর্য দিয়েছেন তখন তারা মাথাপিছু এক সা গম সদকায়ে ফিতর আদায় করুক। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ৬/৫০৫; কিতাবুল হুজ্জাহ আলা আহলিল মদীনাহ ১/৩৩৬) হযরত হাসান বসরী রাহ. বলেন, হযরত আলী রা. এসে যখন মূল্য সস্তা দেখলেন তখন বললেন, আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে প্রাচুর্য দান করেছেন। সুতরাং তোমরা যদি সব জিনিসই এক সা করে আদায় করতে (তবে তা উত্তম হত।

) فلما قدم علي ورأى رخص السعر قال : قد أوسع الله عليكم فلو جعلتموه صاعا من كل شيء. (সুনানে আবু দাউদ ১/২২৯) বোঝা গেল যে, তাঁরা পুরা এক সা দেওয়া জরুরি বলতেন না, উৎসাহিত করতেন। আর এতে দোষের কিছু নেই। মানুষ নফল হিসেবে যত বেশি আদায় করতে চায় করতে পারে। আর এখন তো এক সা গমের মূল্যও এক সা খেজুরের চেয়ে কম তাহলে কি এখন এই ফতোয়া দেওয়া হবে যে, এক সা গম দ্বারাও ফিতরা আদায় হবে না? তৃতীয়ত ফিতরার ক্ষেত্রে মূল্যকে মানদন্ড ধরা হয়েছে-এ চিন্তা গোড়াতেই প্রশ্নবিদ্ধ। মূল্যই যদি মূল মাপকাঠি হত তাহলে সায়ের বদলে ছামান বা মুদ্রাই পরিমাপ হিসেবে নির্ধারিত হত।

কিন্তু শরীয়ত তা করেনি। ছামান বা মুদ্রার স্থলে كيل বা মাপের ভান্ডকে মানদন্ড ধরা হয়েছে। আর كيل (পাত্র) এর পরিমাণ নির্দিষ্ট। তাতে কমবেশি হয় না। মূল্যই যদি প্রকৃত বিবেচ্য হত তাহলে নবী-যুগে এক সা খেজুরের স্থলে এক সা খেজুরের দাম দীনার-দিরহামে নির্ধারণ করে তাকে মাপকাঠি সাব্যস্ত করা হত।

সেক্ষেত্রে কখনো কখনো দুই তিন সাও আদায় করতে হত। চতুর্থত ফকীহদের বক্তব্য থেকে জানা যায়, নবী-যুগে এক সা খেজুর, যব, কিসমিস বা পনিরের মূল্য ও আধা সা গমের মূল্য সমান ছিল না। যথেষ্ট তফাত ছিল। সুতরাং সদকায়ে ফিতরের উক্ত পরিমাপের ক্ষেত্রে মূল্যকেই প্রকৃত বিবেচ্য সাব্যস্ত করা খুবই আপত্তিকর। (দেখুন : শরহু মুশকিলিল আছার, ইমাম তহাবী ৯/৩৫; আততাজরীদ, ইমাম কুদূরী ৩/১৪১৫) পঞ্চমত কুরআন-হাদীসের সুস্পষ্ট কোনো বিধানে তত্ত্ব ও তাৎপর্যের ভিত্তিতে রদবদল করার কোনো অবকাশ নেই।

এ কারণে মূল্যের ওঠানামার ভিত্তিতে শরীয়তের একটি মাপকাঠিকে অকার্যকর করে দেওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। মাসলাহাত ও উপযোগের ভিত্তিতে মানসুস আলাইহি তথা কুরআন-হাদীসের সুস্পষ্ট বিধানে রদবদল সম্পূর্ণ অবৈধ শরীয়তের আহকাম ও বিধিবিধানের হিকমত ও মাসলাহাত তথা বিভিন্ন উপকার-উপযোগ সম্পর্কে যে শাস্ত্রে আলোচনা করা হয় তাকে ‘ইলমু আসরারিশ শরীয়া’ বলে। এটি অতি সূক্ষ্ম ও সংবেদনশীল শাস্ত্র। এ প্রসঙ্গে একটি স্বীকৃত কথা এই যে, শরীয়তের অধিকাংশ বিধানের উপযোগ কুরআন-সুন্নাহয় সুস্পষ্টভাবে বলা হয়নি; বরং এ বিষয়ের মনীষী লেখকরা নিজ নিজ প্রজ্ঞা অনুযায়ী ঐসব মাসলাহাত আলোচনা করেছেন। সুতরাং তাদের আলোচনা সম্পূর্ণ ভুলত্রুটিমুক্ত বা শরীয়তের সকল মাসলাহাত তারা আলোচনা করে ফেলেছেন-এমনটা মনে করার কোনো সুযোগ নেই।

প্রকৃত বিষয় এই যে, আল্লাহ প্রদত্ত আহকামের পিছনে হাজারো মাসলাহাত ও উপযোগিতা থাকতে পারে, যা পুরোপুরি মানুষের বুঝে আসাও জরুরি নয়। এরপর কোনো বিধানের হিকমত ও মাসলাহাত যদি সুস্পষ্ট দলিলের মাধ্যমে জানাও যায় তারপরও মূলনীতি এই যে, এসব হিকমত ও মাসলাহাত আহকাম ও বিধানের মানদন্ড নয়। বিধানের মানদন্ড হচ্ছে দলিল। সুতরাং শরীয়তের দলিল থেকেই শরীয়তের বিধান আহরিত হবে, মাসলাহাত বা উপযোগ থেকে নয়। আর এ সকল মাসলাহাতের কারণে কুরআন-হাদীসে বর্ণিত বিধানকে পরিবর্তন করা বা কুরআন-হাদীসে উল্লেখিত শরয়ী পরিমাপের মধ্যে রদবদল করা তো সম্পূর্ণ অবৈধ।

ইলমু আসরারিশ শরীয়াহ বিষয়ে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য কিতাব হল শাহ ওলিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রাহ. (মৃত্যু : ১১৭৬ হি.) কৃত ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’। গ্রন্থকার তার গ্রন্থের বিভিন্ন জায়গায় একথাগুলো পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন। তাঁর আরবী আলোচনার অংশ বিশেষ উদ্ধৃত করছি। نعم كما أوجبت السنة هذه، وانعقد عليها الإجماع، فقد أوجبت أيضا : أن نزول القضاء بالإيجاب والتحريم سبب عظيم في نفسه، مع قطع النظر عن تلك المصالح. لإثابة المطيع وعقاب العاصي، وأنه ليس الأمر على ما ظُنَّ من أن حسن الأعمال وقبحها، بمعنى استحتقاق العامل الثواب والعذاب، عقليان من كل وجه ... كيف ولو كان كذلك لجاز إفطار المقيم الذي يتعانى كتعاني المسافر، لمكان الحرح المبني عليه الرخص. ولميجز إفطار المسافر المترفّ. وكذلك سائر الحدود التى حدها الشرع. সামনে গিয়ে আরো বলেন, আর হাদীস শরীফ একথাও প্রমাণ করেছে যে, শরীয়তের আহকাম পালনের জন্য যখন তা নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত হয় তখন মাসলাহাত জানার অপেক্ষায় থাকা বৈধ নয়। কারণ বহু মানুষ নিজের বিদ্যা-বুদ্ধি দ্বারা শরীয়তের বহু মাসলাহাত বুঝতে অক্ষম আর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নিকট আমাদের বিদ্যা ও বুদ্ধির চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ আশ্রয়।

এ কারণে এ শাস্ত্রের বিষয়ে অযোগ্য লোকের প্রতি কখনো ‘উদারতা’ প্রদর্শন করা হয়নি। এখানেও ঐ সকল শর্ত প্রযোজ্য, যা আল্লাহর কালামের তাফসীরের ক্ষেত্রে রয়েছে। এবং আছার ও সুনানের সহায়তা ছাড়া নিছক যুক্তির আলোকে এ শাস্ত্রে অনুপ্রবেশ সম্পূর্ণ অবৈধ ও হারাম। কিতাবের প্রথমাংশের শেষে باب الفرق بين المصالح والشرائع শিরোনামে একটি আলাদ পরিচ্ছেদে তিনি এ বিষয়টি আরো বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করেছেন। সেখানে পরিষ্কার লিখেছেন যে, সকল ফকীহ এ বিষয়ে একমত যে, মাসলাহাত ও উপযোগের ভিত্তিতে কিয়াস করা সহীহ নয়।

তালিবুল ইলমগণ শাহ সাহেব রাহ.-এর এই ইলমী আলোচনাগুলো হযরত মাওলানা মুফতী সাঈদ আহমদ পালনপুরী ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম-এর ‘রাহমাতুল্লাহিল ওয়াসিআহ’ থেকে (১/১০৮-১১১, ২/৪৫৩-৪৬৭) পাঠ করতে পারেন। যাইহোক, ইতিপূর্বে বলা হয়েছে যে, এই নীতিটি একটি সর্বজনস্বীকৃত মূলনীতি। শাহ ছাহেব রাহ.ও বলেছেন, এই নীতি হাদীস ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত এবং এ বিষয়ে ওলামায়ে কেরাম একমত। সারকথা সদকাতুল ফিতরের পরিমাণের ক্ষেত্রে একটি মুজতাহাদ ফীহ হিকমতের আশ্রয় নিয়ে কিয়াস ও ইজতিহাদের অবকাশ নেই। আর এর পরিমাণ সংক্রান্ত হাদীসের স্পষ্ট কোনো বক্তব্যকে অকার্যকর করে দেওয়া যে সম্পূর্ণ অবৈধ তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না।

উপকার-উপযোগকে আহকাম ও বিধানের বুনিয়াদ বানানো সম্ভবও নয় শরীয়তের দলিল-প্রমাণ হচ্ছে আহকাম ও বিধানের বুনিয়াদ। আর উপকার-উপযোগ জানার সুফল হচ্ছে, এর দ্বারা চিন্তাশীল মানুষের ঈমান মজবুত হয় এবং অন্তরে প্রশান্তি সৃষ্টি হয়। তবে, আগেই বলা হয়েছে যে, শরয়ী বিধানের কার্যকারণকে আহকামের ভিত্তি বানানোর কোনো অবকাশ নেই। আর বাস্তবে তা সম্ভবও নয়। কারণ সেক্ষেত্রে শরীয়ত বা শরীয়তের হুকুম থাকবে না, স্বেচ্ছাচারিতা ও মনগড়া মতামতে পর্যবসিত হবে।

উদাহরণস্বরূপ যে পরিমাণ সদকায়ে ফিতর আদায় করা আবশ্যকীয় করে দেওয়া হয়েছে তার হিকমত ও বাহ্যিক উদ্দেশ্য সম্পর্কেই চিন্তা করা যায়। কিছু দুর্বল বর্ণনার উপর ভিত্তি করে বলা হয়েছে যে, এই বিধানের হিকমত ও উদ্দেশ্য হল, ঈদের দিন গরীব-মিসকীনদের খাবারের ব্যবস্থা করা। উক্ত বর্ণনার শব্দ طعمة للمساكين দ্রষ্টব্য। ২. ঐ দিন তাদেরকে দুয়ারে দুয়ারে হাত পাতা থেকে রক্ষা করা। অন্তত তাদের ঐ দিনের প্রয়োজন পূরণ করা।

একটি রেওয়ায়েতের শব্দ- أغنوهم عن المسألة في هذا اليوم এখন যদি কেউ এই হিকমত ও উদ্দেশ্যকে বুনিয়াদ বানিয়ে বলতে থাকে, আমাদের আসল খাবার যেহেতু চাল তাই খেজুর বা গমের স্থলে চাল দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায় করতে হবে। আর তা হতে হবে এক সা। তাহলে প্রশ্ন হবে যে, খেজুর ও রুটি তো তরকারি ছাড়াও খাওয়া যায়, কিন্তু ভাত তো তরকারি ছাড়া খাওয়া যায় না। কাজেই এক সা চালের সাথে পরিমাণ মতো তরকারিরও ব্যবস্থা করতে হবে। আর তা মাছের তরকারি হলে উত্তম হয়।

এছাড়া অনেক গরীব লোকের পরিবার বড়। পরিবারের সকল সদস্যের দু’ বেলা বা তিন বেলা খাবারের জন্য এক সা চাল যথেষ্ট নয়; বরং দুই, তিন সা প্রয়োজন। অতএব সামর্থ্যবানদের উপর ওয়াজিব, যে সকল গরীব পরিবারের নিকট ঈদের দিনের খাবারের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য পৌঁছেনি তাদের জন্য অতিরিক্ত চালের ব্যবস্থা করা। এক্ষেত্রে প্রত্যেকের পক্ষে যদি এক সা রও বেশি চাল দিতে হয় তা তাদেরকে দিতে হবে। কথা এখানেই শেষ নয়।

ঐ দিন গরীবদেরকে অমুখাপেক্ষী করাই যদি ফিতরার বিধানের মূল নিয়ন্ত্রক হয় তবে তো বর্তমান সমাজের রেওয়াজ অনুযায়ী গরীব-পরিবারের নতুন কাপড়, নতুন জুতা ও বিবিধ প্রকারের মিষ্টান্তের ব্যবস্থাও ফিতরার মাধ্যমে করত হবে। এভাবে আরো নতুন নতুন প্রস্তাব আসতে পারে। তো আসল কথা এই যে, হিকমত ও উপকারিতাকে বিধানের নিয়ন্ত্রক বানানো অসম্ভব। গত রমযানে (১৪৩১ হি.) দৈনিক নয়া দিগন্তে সদকায়ে ফিতরের পরিমাণ সম্পর্কে জনৈক প্রফেসরের একটি প্রবন্ধ নজরে পড়েছিল। তাতে তিনি লিখেছেন-‘সদকাহর ক্ষেত্রে ইসলামের মূল স্পিরিট হল গরীবদের স্বার্থ সংরক্ষণ।

এর পাশাপাশি আদায়কারীর সামর্থ্যকেও বিবেচনায় রাখা বাঞ্ছনীয়। অতএব এই দুই মূলনীতির আলোকে আমরা বলতে পারি, আদায়কারীর সামর্থ্যকে বিবেচনায় রেখে এবং গরীবদের স্বার্থ সংরক্ষণের খাতিরে সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে নিম্নরূপ পলিসি গ্রহণ বাঞ্ছনীয়। ক. ধনীদের জন্য এসব বস্ত্তর মধ্যে যার মূল্য সর্বোচ্চ তার এক সা পরিমাণ। যেমন কিসমিস। খ. উচ্চ মধ্যবিত্তদের ক্ষেত্রে যে বস্ত্তর মূল্য মাঝামাঝি তার এক সা পরিমাণ।

যেমন-খেজুর। গ. নিম্ন মধ্যবিত্তদের ক্ষেত্রে যে বস্ত্তর মূল্য সর্বনিম্ন তার এক সা পরিমাণ। যেমন-গম বা যব হবে সদকাতুল ফিতরের পরিমাণের ভিত্তি। (দৈনিক নয়া দিগন্ত, শুক্রবার ৩ সেপ্টেম্বর ২০১০ ঈ., ২৩ রমযান, ১৪৩১ হি.) এ প্রস্তাব নিছক প্রস্তাবমাত্র। একে শরীয়তের বিধান বানিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই।

অন্যথায় নতুন নতুন ‘শরীয়ত’ অস্তিত্ব লাভ করবে। কারণ ‘যুক্তি’র তো অভাব নেই। প্রত্যেকেই নিজ নিজ যুক্তিতে নতুন নতুন প্রস্তাব পেশ করতে থাকবে। তো কুরআন-হাদীসের বিধানের বদলে এমন এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সূচনা ঘটবে, যার রাশ টেনে ধরার কোনো উপায় থাকবে না। চাল দ্বারা যদি ফিতরা দেওয়া হয় চাল দ্বারা ফিতরা আদায়ের কথা হাদীস শরীফে নেই।

এজন্য চালকে মানদন্ড ধরে ফিতরা আদায় জরুরি বলার অবকাশই নেই। তবে কেউ যদি ফিতরায় চাল দিতে চায় তাহলে তাকে অন্তত এ পরিমাণ চাল দিতে হবে, যার মূল্য আধা সা গম কিংবা এক সা খেজুর, কিসমিস, পনির বা যবের সমপরিমাণ হয়, এরচেয়ে বেশি চাল দিলে তা নফল দান বলে গণ্য হবে। এই কথা ঠিক নয় যে, আমাদের সাধারণ খাবার যেহেতু চাল আর ফিতরের পরিমাণ হল এক সা খাদ্যবস্ত্ত তাই চাল ও এক সা-ই দিতে হবে। কারণ কোনো সহীহ হাদীসে বলা হয়নি সকল অঞ্চলের লোকদের তাদের নিজ নিজ সাধারণ খাবার দ্বারা ফিতরা আদায় করতে হবে। তেমনি একথাও কোনো সহীহ হাদীসে নেই যে, প্রত্যেক খাদ্যবস্ত্ততে সদকায়ে ফিতরের পরিমাণ এক সা।

বরং একাধিক সহীহ হাদীসে আছে, গম দ্বারা ফিতরা আদায় করলে তার পরিমাণ হল আধা সা। এজন্য যে কোনো অঞ্চলের, যেকোনো ব্যক্তি আধা সা গম বা তার মূল্য প্রদান করলে তার ফিতরা আদায় হবে। কেউ যদি শরীয়তের দলিল-প্রমাণ ছাড়া শুধু যুক্তির ভিত্তিতে চালের ক্ষেত্রেও এক সা দেওয়াকে জরুরি বলে সেক্ষেত্রে প্রশ্ন হল, হাদীসের সুস্পষ্ট বক্তব্যকে বাতিল করে আধা সা গম ফিতরা আদায় থেকে বাধা দেওয়ার অধিকার সে কোথায় পেল? আর তার ঐ দলিলহীন যুক্তির-ই বা কী মূল্য? এরপর যদি কোনো সময় এক সা চালের মূল্য আধা সা গমের বরাবর বা এর চেয়ে কম হয।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।