রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স যখন সবে দু’বছর তখন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বীরভূম জেলার অন্তর্গত বোলপুরে কিছু জমি কিনে নেন। জায়গাটা বেশ নিরিবিলি- শুধু দু’টি ছাতিম গাছ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। মহর্ষির এই জায়গাটা এতই ভালো লেগে গেলো তিনি যখনই এখানে আসতেন সেই ছাতিম তলায় বসে নীরবে ধ্যানমগ্ন হতেন। তারপর একসময় একতলা, তারপর দোতলা, চারিদিকে শাল, আমলকি, কাঁঠাল, আম, দেবদারু আর ফুলের বাগান তৈরি করা হলো। এখানেই মহর্ষি একটি ‘ব্রহ্মআশ্রম’ তৈরি করলেন।
অনেকটাই প্রাচীন ভারতীয় গুরু-শিষ্যের পাঠশালার মতো। মহর্ষির আশ্রমে ছিলো একটি অতিথি ভবন, প্রার্থনা কক্ষ এবং ধর্মীয় সাহিত্য বিষয়ক গ্রন্থাগার। ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই আশ্রমটিকে ‘শান্তিনিকেতন’ আশ্রমে অভিহিত করেন এবং এখানে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৬৩ তে যাত্রা যে আশ্রমের, ১৯০১ এ স্কুল এবং ১৯২১ এ বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মধ্যেই সেই আশ্রমের পূর্ণাঙ্গ রূপকল্প সৃষ্টি হয়েছে। এগুলো কোনটিই বিচ্ছিন্ন প্রতিষ্ঠান নয়।
গবেষণা ও গবেষণালদ্ধ জ্ঞানের মধ্য দিয়েই শান্তিনিকেতনের কার্যক্রম শুরু হয়েছিলো। গ্রামের যুব স¤প্রদায়কে স্বনির্ভর করার জন্য তিনি এখানে “ব্রতী বালক সংগঠন” নামে একটি স্কাউট সংগঠন গড়ে তোলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর আশ্রম সম্পর্কে বলেছেন যে এ আশ্রমের কোথাও প্রাচীর বা গন্ডী নেই। এ একেবারে বিশ্বের চৌমাথায় দাঁড়িয়ে আছে। এখানে বিশ্বের চারিদিক হতে যাত্রীরা আসছে এবং অবশ্যই তারা এখান থেকে অর্জিত জ্ঞান-সাধনা দ্বারা উন্মুক্ত জীবনের পথে বেরিয়ে পড়বে।
তিনি নিজে যেমন ছিলেন উদার বিশ্বমানবতাবোধে জাগ্রত, তাঁর আশ্রম-সন্তানরাও তেমনি সুদূরপ্রসারী চিন্তা-দর্শনে উদ্দীপ্ত হবে এবং গ্রামীণ শিক্ষার্থীরা স্বনির্ভর হবে- এই ছিলো তাঁর প্রত্যাশা। মহারাষ্ট্র, গুজরাট, নেপাল, আসাম, বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আসত শিক্ষার্থীরা।
ঋষি-কবি তাঁর চিন্তা-চেতনার আলোক-রেখা শুধুই কাব্য-সাহিত্যে সীমায়িত রাখেন নি। তিনি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক মুক্তির কথা ভেবেছেন। রাজনৈতিক, শিক্ষা ও সভ্যতার সংকটের কথা ভেবেছেন।
ব্যক্তিজীবনে বহুবার শোক-যাতনা তাঁকে মুহ্যমান করেও বিচলিত করতে পারেনি। গান্ধীজীর সাথে তাঁর মতাদর্শের কিছুটা ভিন্নতা থাকলেও সেই গান্ধীজীই বলেছেন: যার বাংলা অর্থ এরকম- গুরুদেব একজন ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব। তাঁর মধ্যে যে কবিত্বশক্তি, মহৎ চিন্তা-চেতনা এবং স্বদেশবোধ আছে তা অত্যন্ত বিরল। তিনি যথার্থই সম্মান প্রাপ্তির যোগ্য।
শিক্ষাগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এদেশীয় প্রচলিত শিক্ষার সমালোচনা করে বলেছেন: “আমরা যতই বিএ, এমএ পাস করিতেছি, রাশি রাশি বই গিলিতেছি, বুদ্ধিবৃত্তিটা তেমন বলিষ্ঠ এবং পরিপক্ক হইতেছে না।
....সেই জন্য আমরা অত্যুক্তি আড়ম্বর এবং আস্ফালনের দ্বারা আমাদের মানসিক দৈন্য ঢাকিবার চেষ্টা করি। ” [“শিক্ষার হেরফের”]
শিক্ষার উদ্দেশ্যে শিক্ষার্থীদের হাতে গুটিকতক বই তুলে দিয়ে- সর্বোত্তম ফল লাভের প্রত্যাশা যে নিরর্থক সে সম্পর্কে তিনি তাঁর শিক্ষা সংক্রান্ত প্রবন্ধ সমূহে বলেছেন। এমনিতেই বঙ্গমাতা সন্তানদের মানুষ হতে দেবার বেলায় অনেকটাই আদরের আবরণে তাদের শিশুদের শিশু করেই রাখে। এজন্য কবি আক্ষেপ করে ‘বঙ্গমাতা’ কবিতায় বলেছেন-
পদে পদে ছোটো ছোটো নিষেধের ডোরে
বেঁধে বেঁধে রাখিয়ো না ভালো ছেলে করে।
“বাল্যকাল হইতে আমাদের শিক্ষার সহিত আনন্দ নাই।
কেবল যাহা কিছু নিতান্ত আবশ্যক তাহাই কন্ঠস্থ করিতেছি। তেমন করিয়া কোনোমতে কাজ চলে মাত্র কিন্তু বিকাশ লাভ হয় না। ” [“শিক্ষার হেরফের”]
তাঁর আশ্রম প্রাঙ্গন সবার জন্য উন্মুক্ত। তিনি প্রাচীন ভারতীয় গুরু-শিষ্যের শিক্ষা সম্পর্কে অভিমত ব্যক্ত করতে যেয়ে বলেছেন- গুরুর শিক্ষায় উপদেশ নয়, নীতি নয় বরং শিষ্য পেত শক্তি। শিক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ শক্তি।
তাঁর মতে- উন্মুক্ত প্রকৃতি, অগ্নি, জল, বায়ু সমগ্র বিশ্ব বিশ্বাত্মা দ্বারা পরিপূর্ণরূপে দেখতে শেখাই যথার্থ শেখা। তাঁর মতে “গাছপালা, স্বচ্ছ আকাশ, মুক্ত বায়ু, নির্মল জলাশয়, উদার দৃশ্য- ইহারা বেঞ্চ এবং বোর্ড, পুঁথি এবং পরীক্ষার চেয়ে কম আবশ্যক নয়। ” [“শিক্ষা সমস্যা”]
রবীন্দ্রনাথ কখনোও নিজস্ব ধর্মমত বা ধর্মদর্শন কারো ওপরে চাপিয়ে দেবার পক্ষপাতী ছিলেন না। একবার গান্ধীজী তাঁর আশ্রমে এসে দেখলেন- ব্রাক্ষ্মণ ছাত্ররা পৃথক সারিতে ভোজন করছে। গান্ধীজী বললেন- আশ্রমের সকলে সমান, এখানে আহারে বিহারে অশনে বসনে পার্থক্য থাকা উচিত নয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর উত্তরে বলেছিলেন: “যে জিনিস অন্তর হইতে গৃহীত হয় না তাহা বাহিরের চাপে স্থায়ী ফলপ্রদ হয় না। সেই জন্য তিনি বাহির হইতে নৈতিক চাপের পক্ষপাতী নহেন। ”
প্রতি বছর নববর্ষের সকালে আশ্রমের ছাত্রদের নিয়ে তিনি মন্দিরে প্রার্থনা ও উপাসনা করতেন। এর মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের মানসিক সংকীর্নতা দূরীভূত হবে বলে তিনি মনে করতেন। শান্তিনিকেতনে তিনি শিক্ষার্থীদের নিয়ে গান গাইতেন।
কখনোও সমবেত, কখনোও একলাই গেয়ে চলেন মনের আনন্দে। আচার্যদেব যেনো এক দীপ্ত অগ্নিশিখা। আশ্রমের শিক্ষার্থীদের ভাব-রস, কলা-শৈলী শিক্ষার জন্য তিনি তাদেরকে দিয়ে বেশ কটি পত্রিকা প্রকাশের ব্যবস্থা করেছিলেন। যেমন, শান্তি, বাগান, বীথিকা, প্রভাত প্রভৃতি। আশ্রমের শিক্ষার অঙ্গ ছিলো শিক্ষামূলক ভ্রমণ।
প্রতি বৎসর শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাওয়া হতো বিভিন্ন দর্শনীয় ও শিক্ষণীয় স্থানে। শিক্ষকদের জন্য আবাসন ব্যবস্থা। শিক্ষার্থীদের জন্য ছাত্রাবাস, হাসপাতাল, পাকশালা, বিদ্যুৎব্যবস্থা ইত্যাদি সুবিধাদি রেখেছিলেন। এজন্য তাঁকে অনেকবারই ভীষণ আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হতে হয়েছে। কিন্তু তিনি কখনোই দমে যান নি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অনেকেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। যেমন একজন পার্শি বণিক বোমানজি টেকনিক্যাল বিভাগের জন্য পাঁচ হাজার টাকা দান করেন। হাসপাতাল নির্মাণের জন্য ত্রিপুরার রাজা মহারাজ বীরেন্দ্র কিশোর এককালীন পাঁচ হাজার টাকা দান করেন এবং আরও পাঁচ হাজার টাকা সাহায্যের প্রতিশ্র“তি জ্ঞাপন করেন। চিত্রশিল্পী শ্রীযুক্ত গগণেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় বিদ্যালয়কে একটি বহুমূল্য অনুবীক্ষণযন্ত্র দান করিয়াছেন [রবিজীবনী, প্রশান্ত কুমার পাল, ৭ম খন্ড]। তবে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার পর দানের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছিলো।
তিনি নিজে তাঁর জমিদারী আয়ের একটি বড় অংশ আশ্রমের জন্য ব্যয় করতেন। এমনকি পারিবারিক গহণাও বিক্রয় করতে কুন্ঠিত হন নি। তাঁর রচনা সমূহ প্রকাশের রয়ালিটির অংশও এই শিক্ষার্থীদের জন্য অকৃপণহস্তে ব্যয় করেছেন। তাঁর জীবদ্দশায় বৃটিশ সরকার তাঁকে কোনভাবেই সহযোগিতা করেন নাই। তাঁর নোবেল পুরস্কারের একটি বড় অংশ আশ্রমের জন্য এবং একটি অংশ পতিসরে কৃষকদের জন্য সমবায় ব্যাংকে দান করেন।
যুবা বয়স থেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সমবায় আদর্শে বিশ্বাসী। তিনি সেসময় বিদ্যালয়ে একটি সমবায় ভান্ডার স্থাপন করেন। যা এখন ‘বিশ্বভারতী সমবায় সমিতি’ নামে কার্যকর রয়েছে।
শিক্ষাগুরু রবীন্দ্রনাথ ‘বিচিত্রা’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানেরও উদ্বোধক। এখানে পড়তেন ঠাকুরবাড়ির প্রতিমাদেবী, অলকেন্দ্রের স্ত্রী পারুল, গগণেন্দ্রনাথের ছেলেমেয়েরা, সুধীন্দ্রনাধের কন্যা রমা, নীলরতনবাবুর তিন কন্যা- নলিনী, অরুন্ধতী, আরমীরা।
আরও বেশ ক’জন ছিলো এখানকার শিক্ষার্থী। তবে এই ‘বিচিত্রা’ খুব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি বিভিন্ন কারণে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেও মাঝে মাঝে ক্লাস নিতেন। তিনি সাধারণত ইংরেজির ক্লাস নিতেন। তিনি সর্বদাই প্রার্থনা করতেন এই আশ্রম একদিন বিশ্ব আশ্রমে পরিণত হবে।
তিনি বলেছিলেন একসময়: “বিশ্বভারতী যদি প্রতিষ্ঠিত হয় তবে ভারতীয় সঙ্গীত ও চিত্রকলা শিক্ষা তাহার প্রধান অঙ্গ হইবে এই আমাদের সংকল্প হউক। ”
আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বভারতীর কার্যক্রম শুরু হয়েছিলো ১৯২১-এ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমৃত্যু ছিলেন এই বিদ্যাপীঠের আচার্য। ১৯২২-এ তাঁর বাংলা গ্রন্থাবলীর গ্রন্থস্বত্ব-সমুদয় বিশ্বভারতীতে দান করেন। জমিদারপুত্র রবীন্দ্রনাথ শৈশব থেকে অত্যন্ত সাদামাটা ভাবে বড় হয়েছেন।
মহর্ষির উপনিষদিক চিন্তাও তাঁকে অনেকটা বাহুল্যবর্জিত জীবন যাপনে উজ্জীবিত করেছে। তাঁর কাছে ধনী ও দরিদ্রের ব্যবধান নেই। তাঁর মতে, ধনীর আদুরে সন্তানকে অকর্মণ্য ও দাম্ভিক করে গড়ে তোলেন তাঁর পরিবার। অথচ শিশু কিন্তু প্রাকৃতিকভাবেই বেড়ে উঠতে আগ্রহী থাকে। “সুগমতা, সরলতা, সহজতাই যথার্থ সভ্যতা”- এটি রবীন্দ্রনাথের উক্তি।
অধ্যাপকবৃন্দের সম্পর্কেও তাঁর অভিমত- অধ্যাপকের ধ্যান-জ্ঞান-তপস্যা হবে অধ্যাপনা এবং অধ্যয়ন।
আচার্য রবীন্দ্রনাথ শিক্ষার্থীদের অভিনয়কুশলী করে তোলার জন্য নিজের রচিত নাটকে নিজেই কোন কোনটিতে অভিনয় করে তাদেরকে অনুপ্রাণিত করেছেন। যেমন- ‘অচলায়তন’ নাটকে তিনি ছিলেন আচার্য অদীনপূণ্য। ‘ফাল্গুনী’ নাটকে ‘অন্ধ বাউলের’ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাঙ্গনে কৃষিতত্ত্ব, চিত্রকলা, নৃত্যকলা, স্থাপত্য বিদ্যা, পাণিনির ব্যকরণ ও ভাষাতত্ত্ব, ইংরেজি সাহিত্য, কারিগরি বিদ্যা ইত্যাদি শিক্ষার ব্যবস্থা ছিলো।
সঙ্গীতচর্চাতো ছিলোই।
আচার্য রবীন্দ্রনাথের প্রার্থনা ছিলো এমন- তেজস্বীভাবে আমাদের অধ্যয়ন-অধ্যাপনা হউক। আমরা পরস্পরের প্রতি যেন বিদ্বেষ না করি। হে দেব, আমাদের মনকে মঙ্গলের প্রতি সবেগে প্রেরণ করো।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।