আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছোটগল্প: সদানন্দ আচার্য সমাচার!!!

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

সদানন্দ আচার্য সারা জীবন কেবল আকাশ মুখস্থ করেছে। তবু আকাশের অসীম রহস্যের কোনো কূল কিনারা করতে পারেনি। বুড়িশ্বরী নদীর যেখানটা বিষখালী নদীর সঙ্গে মিশে যুগল ধারা বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিলেছে, সেই মোহনার ঠিক কোল ঘেঁষে ত্রিভূজ আকৃতি'র স্থলভাগের এক শীর্ণ কুটিরে সদানন্দ আচার্যের নিবাস। বুড়িশ্বরী নদী বঙ্গাপসাগরের খুব নিকটে হলেও ভারী শান্ত নদী। নদীর এই শান্ত আচরণের কারণে স্থানীয় মানুষেরা একে পায়রা নামেই ডাকতে অভ্যস্থ।

তবু সেই শান্ত পায়রা বা বুড়িশ্বরী নদী ঝড় জলোচ্ছাসে কখনো কখনো ভারী অশান্ত হয়ে ওঠে। তখন তার রুদ্রমুর্তি নিয়ে সদানন্দ আচার্যেরও ভারী উৎকণ্ঠা কাজ করে। আকাশের বিমুর্ত রূপের সঙ্গে বুড়িশ্বরী নদীর এই রুদ্রমুর্তির একটা যোগসাজস খুব গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করে আবিস্কার করেছে সদানন্দ আচার্য। আকাশের মতিগতি আর উচ্চারিত ভাষার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বুড়িশ্বরী বা বিষখালী নদীও বঙ্গোপসাগরের অশান্ত দানবীয় আচরণের সঙ্গে একই সুরে নাচে। ভারী আশ্চার্য এক রহস্যময় সংকেত বিনিময়ের মাধ্যমে তারা একত্রে রুদ্রনিত্য করে।

তখন সদানন্দ আশ্চার্য জীবনের আশা ছেড়ে দিয়ে বিশ্বশ্রষ্ঠাকে নানান নামে ডাকতে থাকে। দিনের বেলায় আকাশ নীল, রাতের বেলায় কালো, ভোরবেলায় পূবাকাশ আর গোধূলী বেলায় পশ্চিমাকাশের রঙ গাঢ় লাল। জন্মের পর থেকেই সদানন্দ আচার্য আকাশের এই তিনটি রঙের সঙ্গেই পরিচিত। কিন্তু যখন কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসে, বিশেষ করে ঝড়, ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, তাইফুন বা হেরিকেন তখন এই আকাশের রঙ বদলায়। তখন আকাশের রঙ হয়ে যায় ঘোলাজলের মত নিদারুন ঘোলাটে।

তখন আর আকাশের দুর্বোদ্ধ ভাষা বোঝা যায় না। তখণ আকাশের রঙ হয়ে যায় ফ্যাকাশে, কখনো হালকা হলদেটে, কখনো কালচে অফ হোয়াইট, কখনো বা কঠিন গাঢ় নীলচে। দুর্যোগের সময় আকাশের গায়ে যেনো তারই পূর্বাভাস লেখা থাকে। আকাশের এই রঙ বদলের খেলা সদানন্দ আচার্য বুঝতে পারে না। কিন্তু বুড়িশ্বর বা বিষখালী বা বঙ্গোপসাগর ঠিকই বুঝতে পারে আর ওরাও তখন সেরকম অদ্ভূত সব মাতলামি শুরু করে।

দুইয়ের ঘরের নামতা পড়ার সময় সদানন্দ আচার্য খুব অবাক বিস্ময়ে খেয়াল করেছে পৃথিবীতে অসংখ্য দুইয়ের উদাহরণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে একসঙ্গে আছে। চন্দ্র-সূর্য, আলো-অন্ধকার, দিন-রাত, মা-বাবা, জোয়ার-ভাটা, জল-স্থল, যুবক-যুবতী, খোকা-খুকি, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, আকাশ-পাতাল, স্বরবর্ণ-ব্যঞ্জনবর্ণ, কুহক-কুহকি, রাজা-রানী, হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, ময়ূর-ময়ূরী, গরম-শীতল, নরম-শক্ত, যোগ-বিয়োগ, গুন-ভাগ, জন্ম-মৃত্যু, ইত্যাদি ইত্যাদি। দুইয়ের এই রহস্যময় সহ-অবস্থানও সদানন্দ আচার্যের কাছে ভারী বিস্ময়ের! তবু ঘুম থেকে ওঠার পর আকাশে সূর্যের রোজ একই দিকে পূর্বাকাশে উকি মারা আর বিপরীত দিকে পশ্চিমাকাশে সন্ধ্যায় হারিয়ে যাওয়ার রহস্য সদানন্দ আচার্য ঠিক বুঝতে পারে না। এই রহস্যের পেছনে কে কলকাঠি নাড়ছে সেই বিস্ময় সদানন্দ আচার্যকে ভারী চিন্তায় ফেলে দেয়। দিনের বেলায় সূর্য আকাশের একমাত্র রাজা।

রাতের বেলায় চাঁদ ওই আকাশের রানী। এছাড়া অসংখ্য তারা-নক্ষত্র রাতের বেলায় আকাশে মিটমিট করে। তখণ অন্ধকার আকাশের মধ্যেও এক ভারী অপূর্ব সৌন্দর্য খেলা করে। সেই সৌন্দর্য নির্মাণে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে মেঘদল। সাদা মেঘ উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে নানান আকৃতির নানান খেলা দেখায়।

সূর্যের আলো'র সঙ্গে সেই সাদা মেঘের রঙেও আসে নানান জ্যোতি। মেঘের সৌন্দর্য কোনো ভাষায় লিখে ঠিক ফুটিয়ে তোলা যায় না বলেই সদানন্দ আচার্যের ধারণা। সেই অপরূপ সৌন্দর্য কেবল দুই চোখ ভরে উপভোগ করার নিয়ম। সদানন্দ আচার্য আকাশ মুখস্থ করতে গিয়ে সেই মেঘের হরেক কিসিমের রঙ বদলানো দেখে ভারী মুগ্ধ হয়। কখনো পাখির মত উড়ে উড়ে সেই মেঘ ছুঁয়ে দেখতে মন চায় সদানন্দ আচার্যের।

তখন সদানন্দ আচার্য ভাবে পাখিরাই বুঝি পৃথিবীর সবচেয়ে স্বাধীন প্রাণী। আমি কেন পাখি হলাম না! পাখি আকাশে উড়তে পারে মানুষ কেন পারে না সেটাও সদানন্দ আচার্যের কাছে এক অপার বিস্ময়। মানুষ তবু আকাশে নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে ঘুড়ি উড়ায়। বেলুন উড়ায়। উড়োজাহাজ উড়ায়।

জঙ্গিবিমান উড়ায়। মিসাইল উড়ায়। গুলি ফুটায়। ধোয়া উড়ায়। কিন্তু মানুষ কি এই আকাশের অসীম সীমার সীমানা নির্ধারণ করতে পেরেছে? সদানন্দ আচার্যের সেই ঘোর কিছুতেই কাটে না।

আকাশ তার কাছে এক ভারী বিস্ময়। এ কারণেই বুঝি মহামণিষীগণ আকাশকে বলেছেন মহাকাশ। আর সেই মহাকাশ ভারী মহাবিস্ময়। বাবা'র মৃত্যুর পর শ্বশান থেকে ফিরে বুড়িশ্বরীর পারে বসে গোধূলীলগ্নে সদানন্দ আচার্য প্রথম বুঝেছিল অনুভূতি কি জিনিস। তেমনি ছোটবেলায় বুড়িশ্বরীর ওপারে আমতলী'র হরিসভায় মায়ের সঙ্গে কীর্তন শুনতে গিয়ে হারিয়ে যাবার পরদিন যখন মা তাকে খুঁজে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল, সেদিন বুঝেছিল মায়ের স্নেহ কাকে বলে।

তখন কৈশোর অতিক্রমকাল। তখন যৌবনের হাতছানি। গৌরাঙ্গদের ঘাটে সূর্যাস্তের কালে নীলিমাদি'র স্নানরত খোলা বুক লুকিয়ে দেখে সদানন্দ আচার্য টের পেয়েছিল এরই নাম বুঝিবা শিহরণ। শিহরণ বুঝিবা শরীরে উত্তাপ ছড়িয়ে জ্বর নিয়ে আসে। শিহরণ কি শরীরের কোষের ভেতর খুব গোপনে লুকিয়ে থাকে? শিহরণ কেন শিড়দাঁড়া বেয়ে ধাই ধাই করে সারা শরীরে ছড়িয়ে যায়? সেই থেকে রোজ সকালে নীলিমাদি'র ফুল কুড়ানি'র সময়টার জন্য সদানন্দ আচার্য উজবুকের মত অপেক্ষা করে।

খালি পায়ে নগ্ন ঘাসের উপর নীলিমাদি যখন আলতো পা ফেলে ফেলে ফুল কুড়ায়, সেই দৃশ্য সদানন্দ আচার্যের ভারী ভালো লাগে। কিন্তু সেই ভালো লাগার কথা আকাশ আর বুড়িশ্বরী ছাড়া আর কাউকে বলার সাহস পায় না সদানন্দ আচার্য।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।