আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

‘বিদেশি গুপ্তচর আনু মুহাম্মদ নাকি তৌফিক-ই-এলাহী?’

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম লেখক গবেষক সমাজকর্মী রেহনুমা আহমেদ প্রশ্ন তুলেছেন, বিদেশি চর কে? জাতীয় তেল, গ্যাস, খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা কমিটির সদস্যসচিব আনু মুহাম্মদ নাকি, প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমকে banglanews24.com দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এ প্রশ্ন উত্থাপন করেন। উল্লেখ্য, গত ১৯শে জুন জাতীয় সংসদে বক্তৃতাকালে বন ও পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ তার বক্তব্যে আনু মুহাম্মদসহ ওই কমিটির সদস্যদের বিদেশি চর বলে উল্লেখ করেন। এ প্রসঙ্গটি ছাড়াও জাতীয় তেল, গ্যাস, খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা কমিটির কাজ ও লক্ষ্য, দেশের তেল গ্যাস উত্তোলন, বিদেশে রপ্তানি, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যোগ্যতা ও দক্ষতা এবং কনোকোফিলিপস-এর সঙ্গে সাম্প্রতিক চুক্তি প্রসঙ্গে বিস্তারিত কথা বলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ। বাংলানিউজের পাঠকের জন্য সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন আউটপুট এডিটর মাহমুদ মেনন।

১. বাংলানিউজ: তেল গ্যাস রপ্তানি কেন সঠিক নয়? রেহনুমা আহমেদ: সময়-স্বল্পতার কারণে আমি একটি যুক্তিই উল্লেখ করব, তার আগে একটি মৌলিক বিষয়ের প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। প্রাকৃতিক জ্বালানি সম্পদ সীমিত। এটা নবায়নযোগ্য নয়। এটা ফুরিয়ে যায়। সে কারণেই বুদ্ধি-সুদ্ধি খরচ করে—আমাদের কতটুকু মজুত আছে, চাহিদা কত, দেশের স্বার্থ কিভাবে রক্ষা করা যায়—ভেবেচিন্তে পদক্ষেপ গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়।

গ্যাসের কথাই যদি ধরেন, বাংলাদেশে মজুত গ্যাসের পরিমাণ ৭.৩ ট্রিলিয়ন ঘন ফুট। দেশীয় চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ ঘাটতি, সর্বশেষ হিসাবমতে, দৈনন্দিন ৪৫০ মিলিয়ন ঘন ফুট। প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা প্রতি বছর ১০% হারে বাড়ছে। সরকারি হিসেবমতে, বর্তমানে গ্যাস যে হারে খরচ হচ্ছে, ২০১৪-১৫ সালের মধ্যে আমাদের গ্যাসের মজুত শেষ হয়ে যাবে। এই হচ্ছে চিত্র।

সরকার বারেবারে বলছে তেল-গ্যাসের খনন বা উত্তোলন দেশের উন্নয়নের জন্য আবশ্যিক, কল-কারখানা-মিল-ফ্যাক্টরির উৎপাদন বাড়ানোর জন্য, স্কুল-কলেজ-হাসপাতালে, বাড়ি-ঘরে, সাধারণভাবে, মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করার জন্য। তারা আরো বলছে, গভীর সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলনের জন্য যে টাকাপয়সার প্রয়োজন তা আমাদের মত গরিব দেশের নাই। শুধু তাই নয়, আমাদের যন্ত্রপাতিও নাই, দক্ষতাও নাই ইত্যাদি, ইত্যাদি। আর তাই বিদেশি কোম্পানিকে লিজ দেয়া ছাড়া আমাদের আর কোনও পথ নাই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যদি রপ্তানি-ই হয়ে যায়, তাহলে আমাদের উন্নতি হবে কেমনে? আমাদের যেই ঘাটতি তা তো থেকেই যাবে, আর মনে রাখতে হবে, রপ্তানি থেকে অর্জিত মুনাফা লিজ-গ্রহণকারী অর্থাৎ, বহুজাতিক কোম্পানি ভোগ করে।

সরকার করে না। আর যদি রপ্তানি না করে আমাদের কাছে ৮০% ভাগ গ্যাস বিক্রিও করে, তা তো তারা করবে আন্তর্জাতিক বাজার দরে। তাই যদি হয়, আমাদের যদি আন্তর্জাতিক বাজার দরেই কিনতে হয় তাইলে এত তড়ি-ঘড়ি না করে, বিদেশি কোম্পানিকে গ্যাস ব্লক লিজ না দিয়ে বরং আমরা যদি সেই দামে মিয়ানমার থেকে কিনি, আর আমাদের দেশীয় সম্পদ আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তুলে রাখি, সেটা আরো বুদ্ধিমানের কাজ হয় না? এই হিসাব যদি সাধারণ মানুষের বুদ্ধিতে কুলায়, সরকারের বুদ্ধিতে, এই ধরেন, প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা, জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের হর্তাকর্তা, পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান, তাদের বুদ্ধিতে আটকায় কেন? ২. বাংলানিউজ: তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ রক্ষার কোনো আন্তর্জাতিক মডেল সামনে রয়েছে কি? রেহনুমা আহমেদ: আলবৎ আছে। চীন আছে, মালয়েশিয়া আছে। তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে, সেই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিজস্ব সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করেছে, তা সুনিশ্চিত করেছে।

আরো মডেল আছে, যেমন ধরেন, ভেনেজুয়েলা, বলিভিয়া। তারা কিন্তু আগে পারে নাই। তাদের অবস্থা অনেকটা আফ্রিকার দেশের মত ছিল। কিন্তু এখন তারা নিজেদের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। বিদেশি কোম্পানিগুলোর হয় নতুন শর্তে রাজি হতে হচ্ছে, অথবা পাততারি গুটিয়ে চলে যেতে হচ্ছে।

আর সেই অর্থে লাতিন আমেরিকার এই দেশগুলোর নজির আমাদের জন্য আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তারা প্রমাণ করছে যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ রক্ষা করা সম্ভব। ৩. বাংলানিউজ : কনোকোফিলিপস-এর চুক্তির কি কোনো একটিও ইতিবাচক দিক নেই? থাকলে সেগুলো কি? রেহনুমা আহমেদ: ক্যামনে জানব? চুক্তিটাতো গোপন। সরকার এখনও পর্যন্ত বিদেশি কোম্পানিদের সাথে যতগুলো চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, তার কোনোটাই জনগণের সামনে তুলে ধরে নাই। কোনো সরকারই না।

না আওয়ামী লীগ সরকার, না বিএনপি-জামায়াত সরকার। এখন পর্যন্ত চুক্তি নিয়ে সংসদে কোনো আলাপ-আলোচনা হয় নাই। এমনকি সংসদের স্ট্যান্ডিং কমিটি পর্যন্ত স্বাক্ষরিত কোনো চুক্তির কপি হাতে পায় নাই। কেন এই গোপনীয়তা? জানতে চাইলে প্রসঙ্গ এড়িয়ে পিএসসি মডেল-২০০৮ দেখিয়ে দেওয়া হয় কিন্তু সেটা তো স্বাক্ষরিত চুক্তি নয়। এটা হচ্ছে বিদেশি কোম্পানিরা যাতে বিড করতে পারে, তার জন্য তৈরি করা একটা ডক্যুমেন্ট।

মঈনউদ্দিন-ফখরুদ্দিন আমলে এই প্রোডাকশান শেয়ারিং কন্ট্র্যাক্ট ইন্টারনেটে আপলোড করা হয়, জনগণকে জানানোর জন্য বা তাদের মন্তব্য-মতামত আহ্বান করার জন্য নয়। চুক্তির কথা বললে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তি বা পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান যখন পিএসসি-২০০৮ দেখিয়ে দেন, সেটা অনেকটা বাঙালকে হাই কোর্ট দেখানোর মত। ৪. বাংলানিউজ : বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদে ও বন্দরের মতো স্থাপনায় বিদেশি শক্তির আগ্রাসন চাই না... কিন্তু আমরা কি কোনো যোগ্যতা বা দক্ষতা অর্জন করেছি যা দিয়ে এ সম্পদ থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা নিশ্চিত করতে পারি? রেহনুমা আহমেদ: আমরা অনুন্নত দেশ, আমাদের যোগ্যতা নাই, দক্ষতা নাই, যা কিনা উন্নত দেশের আছে, এই সরলীকরণ কিন্তু আর ধোপে টেকে না। এর সবচাইতে ভালো উদাহরণ হচ্ছে মাগুরছড়া, টেংরাটিলা। অক্সিডেন্টাল আর নাইকো মিলে ৫০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস নষ্ট করেছে।

মাগুরছড়ায় প্রায় ৯০ একর জমিও নষ্ট হয়েছে। বেলা`র (বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল লইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন) মতে, ক্ষয়-ক্ষতির হিসাব ১০০ মিলিয়ন ডলার। নাইকো ৬২০টি পরিবারকে ৫২৫,০০০ ডলার ক্ষতিপূরণ দিয়েছে, আর গাছ লাগানোর জন্য আরো ১০০,০০০ ডলার। এটা মোট হিসাবের মাত্র ০.৬৫%! অপরপক্ষে, বিদেশি কোম্পানির তুলনায় বাপেক্স-এর রেকর্ড অনেক ভালো, তারা নিরাপদে, কোনো ধরনের আপদ-বিপদ বা দুর্ঘটনা না ঘটিয়ে গ্যাস উত্তোলন করে আসছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও, এই প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করার জন্য, আরো দক্ষ, আরো প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সরকার এখানে উপযুক্ত পরিমাণ টাকা বরাদ্দ করছে না, বরং উল্টোটাই হচ্ছে।

তার মানে, যদি ব্যাপারটাকে সাদামাটাভাবে দেখি তাহলে শক্তিশালী মহল আমাদের যেভাবে বোঝাতে চায় আমরা সেভাবেই বুঝব। ৭. বাংলানিউজ : ১৯ জুন সংসদে বক্তৃতাকালে বন ও পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী তেল, গ্যাস, খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর প্রতিরক্ষা কমিটির সদস্যসচিব আনু মুহাম্মদকে বিদেশি গুপ্তচর বলেছেন। এবিষয়ে আপনার মন্তব্য জানতে চাচ্ছি। রেহনুমা আহমেদ: প্রথমেই বলে নেই, মন্ত্রীসাহেব ‘টোকাই’দের যে অবজ্ঞা ও শ্রেণী বিদ্বেষের দৃষ্টিতে দেখেন, আমি সে দৃষ্টিতে দেখি না। তথাকথিত ‘টোকাই’-রা তাদের রাজনৈতিক সচেতনতার প্রমাণ এদেশের ইতিহাসে একবার না, বহুবার দিয়েছে, তাদের কারণে নগরীর পরিবেশ পরিচ্ছন্ন থাকে, কিন্তু দুঃখের বিষয় গরিব, দুঃস্থ শিশুদের সংখ্যা কমেনি, বরং বেড়েই চলেছে।

মন্ত্রীসাহেব তা নিয়ে চিন্তিত নন, তা তাঁর কথা থেকেই বোঝা যাচ্ছে। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদকে তিনি শুধু বিদেশি গুপ্তচর ডাকেননি, তিনি অশ্লীলভাবে কটাক্ষ করে কথাগুলো বলেছেন। শ্লীলতা-অশ্লীলতা যার যার ওরিয়েন্টেশনের ব্যাপার; আমি বরং বিদেশি গুপ্তচর প্রসঙ্গে আসি। ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের তারবার্তা যা উইকিলিকসের মাধ্যমে ডিসেম্বর ২০১০-এ ফাঁস হয়, সেখানে কী আনু মুহাম্মদের নাম ছিল, না-কি প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীর? মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস মরিয়ার্টি কাকে বলেছিল কনোকো ফিলিপসকে গভীর সমুদ্রের গ্যাস ব্লক দিতে? আনু মুহাম্মদকে না-কি তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীকে? তার নির্দেশমত কাজটি কে সম্পাদন করে, আনু মুহাম্মদ না-কি জ্বালানি উপদেষ্টা? ফুলবাড়ির মানুষ যখন এশিয়া এনার্জিকে তাদের এলাকা থেকে তাড়িয়ে দেয়, যেই আন্দোলনে ৩জনের প্রাণহানি ঘটে, তার কিছু দিন পরই শেখ হাসিনা ফুলবাড়িতে যান (৪ সেপ্টেম্বর ২০০৬), তিনি তখন বিরোধী দলের নেত্রী ছিলেন। সরকারি কলেজ প্রাঙ্গনের জনসভায় তিনি বলেছিলেন, `যদি বিদেশি কোম্পানিকে প্রাকৃতিক সম্পদ হস্তান্তরে রাজি হতাম, তাহলে প্রধানমন্ত্রী হয়ে যেতে পারতাম।

`তার এই কথা নিয়ে তো এখন প্রশ্ন তোলার সময় এসেছে। প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা, জ্বালানি নিরাপত্তা দেশের সার্বভৌমত্বের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। বাংলাদেশ সময় ১২৩৫ ঘণ্টা, জুন ২১, ২০১১ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।