আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা, আর কত কাল আমি রব দিশেহারা। ২৮ মে, ১৯৬৭। ইংল্যান্ডের প্লাইমাউথ নৌ-বন্দর। অস্তমিত সূর্যের রশ্মি রাঙিয়ে দিয়ে যাচ্ছে ঢেউগুলোকে। আকাশে উড়ছে ছোট কয়েকটি বিমান।
৩০,০০০ মানুষ জড়ো হয়েছে ‘জিপসি মথ’ নৌকায় পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে আসা নতুন নায়ক ফ্রান্সিস চেসেস্টারকে স্বাগত জানাতে। তরুণ হৃদয়ের অধিকারী ৬৫ বছর বয়সী ফ্রান্সিস এত সুন্দর সূর্যাস্ত সম্ভবত আগে প্রত্যক্ষ করেননি।
রোমাঞ্চপ্রিয় ফ্রান্সিস ১৯১১ সালে স্কুলের পাঠ চুকিয়ে নিউজিল্যান্ড যাত্রা করেন। খনিতে কাজ করে, সংবাদপত্র বিক্রি করে এবং সর্বশেষে জমি সংক্রান্ত কাজ করে ১৯২৯ সালে ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন এবং একটি বিমান পরিসেবা চালু করেন। এরপর মাত্র ৩ মাসের মধ্যে পাইলট লাইসেন্স নিয়ে এক-ইন্জ্ঞিনচালিত একটি বিমানে করে ইংল্যান্ড থেকে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি একাই পাড়ি দেন।
এরকম রোমাঞ্চকর বিমান যাত্রা চলতেই থাকে। এরমধ্যে জাপানে একটি দুর্ঘটনায় অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। ১৯৬০ সালে আটলান্টিক মহাসাগরে একটি নৌকা প্রতিযোগিতায় নিকটতম প্রতিযোগীর চেয়ে এক সপ্তাহ আগে পৌঁছে যান নির্দিষ্ট গন্তব্যে। এরপরই, জীবনের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ভ্রমণ তাঁর ভাবনায় আসে –নৌকা নিয়ে পৃথিবী প্রদক্ষিণ।
শুরু হয় প্রস্তুতি।
১৯৬৬ সালের ২৭ আগস্ট ইংল্যান্ডের প্লাইমাউথ বন্দর থেকে ৫৩ ফিট লম্বা ‘জিপসি মথ’ নৌকা নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু যাত্রা শুরুর কিছুদিন পরেই পেটের অসুখে ভুগতে শুরু করেন। অত:পর দেখা দেয় তীব্র পা-ব্যাথা। ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেশিরভাগ সময়ই পা লম্বা করে রাখতে হয়। এরপর দেখা পান অনুকূল পরিবেশের।
তীব্র বাতাসে ৫৪৮ মাইল পথ পাড়ি দেন মাত্র ৩ দিনে। ১৭ সেপ্টেম্বর শ্যাম্পেনে চুমুক দিয়ে স্ত্রী ও বন্ধুবান্ধবদের স্বাস্থ্য পান করেন এবং পালন করেন নিজের ৬৫ তম জন্মদিন। সেসময় একটি ঝড়ের মধ্যে পরলে জন্মদিন পালন সাময়িকভাবে বন্ধ রাখেন। দক্ষিণ গোলার্ধে প্রবেশের পর নৌকার গতিপথের বিপরীতে ঘণ্টায় ৫০ নট বেগে বাতাস বইতে শুরু করলে গতিপথ নিয়ন্ত্রণের কলকব্জা নষ্ট হয়ে যায়। স্রোতের বিপরীতে শুধুমাত্র দাঁড় বেয়ে নৌকা চালানো তাঁর পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে পরে।
তনুমধ্যে জিপসি মথ আরেকটি ঝড়ের কবলে পরলে ফ্রান্সিসকে নাওয়া-খাওয়া ভুলে নৌকা সেচ করতেই ব্যস্ত থাকতে হয়।
অক্টোবর মাসে দক্ষিণ আফ্রিকার দক্ষিণ প্রান্তে উত্তমাশা অন্তরীপের কাছে দুবার ঝড়ের কবলে পরেন এবং এতে নৌকার পাল সম্পূর্ণভাবে ছিঁড়ে যায়। তনুমধ্যে শক্ত কেক খেতে গিয়ে একটি নকল দাঁত খুলে যায়। পহেলা নভেম্বর সারাদিন ধরে বৃষ্টি হয় এবং ফ্রান্সিস প্রায় ২৭ গ্যালন মিষ্টি পানি জমিয়ে রাখেন। এরপরেই তাঁকে পেয়ে বসে প্রচণ্ড একাকীত্বে।
দক্ষিণ সাগরে প্রকৃতিগত ভাবেই নাবিকরা একাকীত্বে ভোগে বেশি। ফ্রান্সিস কিছুদিন দাঁড় বাওয়া বন্ধই রেখে দেন। একাকীত্ব দূর করার জন্য বিভিন্ন কাজে মনোনিবেশের বৃথা চেষ্টা করেন। রাতে স্বপ্ন দেখতেন তাঁর স্ত্রী মারা গেছেন অথবা কঠিন অসুখে ভুগছেন। ফ্রান্সিসের কাছে একটি উন্নতমানের রেডিও থাকলেও সেটি ব্যবহার করা থেকে বিরত থেকেছিলেন পাছে সভ্য পৃথিবীর খবর তাঁকে আরও একাকীত্বে ফেলে দেয়।
ছেলের দেওয়া শাইকোভস্কি, গারসউইন, বিটোফেনের রেকর্ডগুলো তাঁর একাকীত্ব বরঞ্চ বাড়িয়েই তুলছিল।
অস্ট্রেলিয়ার সিডনি তখনও ৩,০০০ মাইল দূরে। ফ্রান্সিস খেয়াল করলেন স্বয়ংক্রিয় স্টিয়ারিংটি প্রায় বিধ্বস্তই হয়ে গেছে। সেখান থেকে ম্যানুয়াল স্টিয়ারিং চালিয়ে সিডনি পাড়ি দেয়া তাঁর কাছে নিতান্তই হাস্যকর ঠেকল। সাগরে তিনি প্রায় একটানা ৮০ দিন চলছেন।
তবু চেষ্টা করলেন ম্যানুয়াল স্টিয়ারিং দিয়েই চেষ্টা চালাতে এবং অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রমের পর ১০৭ দিনের মাথায় পৌঁছালেন গন্তব্যে। ততদিনে শরীর থেকে ঝরে গেছে ৫০ পাউন্ড ওজন। তিনি সিডনিতে অবস্থান করলেন ৪৭ দিন। জিপসি মথ সম্পূর্ণভাবে মেরামত করে, প্রচুর খাদ্যসামগ্রী নিয়ে আবার শুরু হল যাত্রা। কিন্তু কিছুদূর যেতেই আরেকটি ঝড়ের কবলে পরে জিপসি মথের প্রপেলার ও ককপিট ক্ষতিগ্রস্ত হল।
সমগ্র ফেব্রুয়ারি জুড়েই ফ্রান্সিস লড়লেন ঝড়ের সাথে। যাত্রা শুরুর আগেই তিনি ঠিক করে রেখেছিলেন উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে অস্ট্রেলিয়ার দিকে যাবেন এবং হর্ন অন্তরীপ হয়ে আটলান্টিক মহাসাগরে প্রবেশ করবেন। হর্ন অন্তরীপের কাছে পৌঁছামাত্র আরেকটি তীব্র ঝড়ে নৌকার পানি সেচ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তনুমধ্যে বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৬০ নট। ফ্রান্সিস তীব্র ঠাণ্ডা অনুভব করতে লাগলেন।
কিছুদিন পর স্ট্যাটেন দ্বীপের কাছে একটি বড় চাঁইয়ের সাথে সংঘর্ষের হাত থেকে অল্পের জন্য বেঁচে গেলেন। ২৪ এপ্রিল বিষুবরেখা পার হয়ে উত্তর গোলার্ধে প্রবেশ করলে ভ্রমণ পরিসমাপ্তির তীব্র ইচ্ছা তাঁকে পেয়ে বসল। মে মাসে ডান কনুইয়ে তীব্র ব্যাথা অনুভূত হওয়ায় আর্নিকা( হোমিওপ্যাথিক ঔষধ) খাওয়া শুরু করলেন। পরবর্তীতে কনুইতে চিড় ধরেছে বুঝতে পারায় ব্যথানাশক ঔষধ খাওয়া শুরু করলেন। উত্তর আটলান্টিক সাগরে প্রবেশের পর থেকেই বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের রিপোর্টার, ফটোগ্রাফারদের আগমন তাকে ত্যক্ত-বিরক্ত করে তুলল।
তিনি এতটাই বিরক্ত হলেন যে তাদের দেয়া মদ বর্জন করলেন। প্লাইমাউথ নৌ বন্দরে পৌঁছার কয়েক ঘণ্টা পূর্বেই রেডিওর মাধ্যমে জানতে পারেন তাঁকে স্বাগত জানাতে বন্দরে জড়ো হয়েছে প্রায় ৩০,০০০ মানুষ।
যুক্তরাজ্যের রাজতন্ত্র দেরি করেনি। শীঘ্রই ফ্রান্সিস চেসেস্টার ভূষিত হন ‘স্যার’ উপাধিতে। অদম্য ইচ্ছাশক্তির বলে অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলার কারিগর স্যার ফ্রান্সিস চেসেস্টার নি:সন্দেহে তরুণদের কাছে এক উজ্জ্বল অনুপ্রেরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।