অর্থনৈতিক উন্নয়ন দারিদ্র বিমোচনের পূর্ব শর্ত। আর্থিক প্রসার আর উন্নয়ন এক জিনিস নয়। তবে আর্থিক প্রসার অর্থনৈতিক উন্নয়নেরই একটা দিক। অর্থনৈতিক উন্নয়নের চরম লক্ষ্য হওয়া উচিত মানুষের সক্ষমতা সৃষ্টি। মানুষের উপর প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশের অনিশ্চয়তা ও পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণের বদলে অনিশ্চয়তা ও পরিস্থিতিকে মানুষের নিয়ন্ত্রণে আনা বা আনতে পারাকে মানুষের সক্ষমতা সৃষ্টি বলা হয়।
মানুষের আর্থ-সামাজিক ক্ষমতা প্রসারের প্রক্রিয়ায়ই অর্থনৈতিক উন্নয়ন। অর্থনৈতিক উন্নয়নের যাচাই জীবনধারনের বিভিন্ন অবস্থার( পুষ্টি, শিক্ষার হার, গড় আয়ু, শিশু মৃত্যুর হার, বয়স্কদের বঞ্চনা ইত্যাদি) উন্নয়ন দিয়ে করা হয়। উক্ত উন্নত অবস্থাগুলো অর্জনকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ধরা হয়। উন্নয়নের কর্মসুচী হওয়া উচিত উক্ত সক্ষমতার জন্য অর্থ ব্যবস্থার প্রয়োজনীয় সংস্কার করা। সংস্কার গুলো ধরা হয় বেকারত্ব দূর, দ্রুত মূলধন গঠন, অব্যবহৃত শ্রমের ব্যবহার, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ ইত্যাদি।
এজন্য অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে যে বিষয় গুলো প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন তা হলোঃ
১। জনগণ যাতে নিজদের শ্রমে নিজদের মংগল সাধনের আর্থ-সামাজিক সকল প্রচেষ্টা নিরাপদে ও স্বাধীনভাবে করতে পারে তার জন্য জনগণের ক্ষমতায়ন বিশিষ্ট ও অংশ গ্রহন মূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থা।
২। সমাজের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে( সঞ্চয়– বিনিয়োগ– উৎপাদন– বন্টন– বিনিময়– ভোগ) স্বাধীনভাবে ও সামর্থ অনুসারে অংশ গ্রহন করতে পারা এবং তার মাধ্যমে ন্যায্য আয় ( মজুরী, বেতন, ভাড়া, লাভ, সুদ) করে জীবনধারণ করতে পারে।
আর্থিক সামর্থ না থাকলে উন্নয়নের ভাগীদার হওয়া যায় না।
সমাজে অর্থনৈতিক উন্নয়নের অংশীদারিত্ব অর্জন করতে হলে সক্ষমতা অর্জন আবশ্যক। শোষণমুক্ত পরিবেশে সমাজে সবার সক্ষমতা অর্জন করতে হলে সকলের জন্য পুঁজি ভিত্তিক আয় ও স্বত্ত্বাধিকারের সাথে শ্রমভিত্তিক আয় ও স্বত্ত্বাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সমাজের প্রত্যেক নরনারীর সক্ষমতা ও স্বত্ত্বাধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানুষের কল্যাণ সাধন করতে হলে সেন্ট্রালাইজড অথরিটি বা কেন্দ্রীভূত কর্তৃপক্ষ (রাষ্ট্র, সরকার, পরিকল্পনা কমিশন) দ্বারা সম্ভব নয়। কারণ সমাজের সকল মানুষের কল্যাণ সাধনের সাথে যে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড জড়িত তার সমাধান কেবল সকল মানুষের সক্রিয় অংশ গ্রহনের মাধ্যমে করা যায়। তাই শোষণমুক্ত ও কল্যাণকর অর্থব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে হলে জনগণের অংশ গ্রহন মূলক অর্থব্যবস্থা প্রবর্তন করা দরকার।
আর্থিক সক্ষমতা অর্জিত হয় আয়ের মাধ্যমে। সমাজে আয়ের উপায় সমূহ নিম্ন প্রকারেরঃ
১। শ্রমবিক্রয়কারীগণ আয় করেন মজুরী, বেতন, বোনাস ইত্যাদি।
২। পুঁজিপতি, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী গণ আয় করেন সুদ, লাভ, কমিশন ইত্যাদি।
৩। সম্পদ, সরঞ্জাম, যন্ত্রপাতি, অবকাঠামো প্রভৃতির মালিকরা আয় করেন খাজনা, ভাড়া, টোল ইত্যাদি।
৪। রাষ্ট্র বা সরকার আয় করে নানা প্রকার কর, শুল্ক, রাজস্ব, টোল,জরিমানা ইত্যাদি।
৫।
রাষ্ট্র বা সরকার থেকে জনগণ আয় সহায়তা পায় ভাতা, ভর্তুকি, কর রেয়াত, ত্রাণ বা দাতব্য সাহায্য ইত্যাদি।
উপরোক্ত আয়ের উপায়ের মধ্যে জনগণের সক্ষমতা অর্জনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো শ্রমের আয়( মজুরী, বেতন, বোনাস ইত্যাদি) এবং সম্পদ, মূলধন ও উৎপাদনের উপায় সমূহের আয় (সুদ, লাভ, কমিশন, খাজনা, ভাড়া ইত্যাদি)। এবং উভয় প্রকারের আয়ের মালিকানা সকল জনগণের থাকতে হবে। নতুবা সমাজে শোষণ হবে এবং তার ফলে ধনী গরিবের সৃষ্টি হবে। কারণ উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব অনুসারে মূলধন শ্রমের অংশ আত্মসাত করে এবং সেটাই শোষণের মৌলিক কারণ।
সুতরাং শোষণ বন্ধ করার উপায় শ্রম বিক্রয়কারীদের মূলধনের মালিকানা অর্জন। যেহেতু মূলধন শ্রমের অংশ শোষণ করে; সেহেতু অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আর্থিক প্রসারের সাথে শ্রমজীবীদের শোষণ বৃদ্ধি পায় এবং দারিদ্র দূর হওয়ার বদলে বেড়ে যায়। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে জিডিপি গ্রোথ বা বৃদ্ধি হলে ও তা শ্রমজীবীদের কাছে যায় না। কারণ সমাজে আয় বন্টন হয় ফ্যাক্টর প্রাইস অনুসারে এবং ফ্যাক্টরের মালিকরা জিডিপির অংশ পায় ফ্যাক্টর প্রাইস অনুপাতে। সেখানে মূলধনের মালিকানা বিহীন শ্রমজীবীরা তাদের শ্রমের মজুরী ছাড়া অন্য কোন অংশ পেতে পারে না।
জিডিপির এই ধনী মুখী বন্টন ফিসকাল পলিসি, মানিটারি পলিসি, বাজেট, সরকারি সহায়তা দ্বারা বন্ধ করা বা কম্পেনসেট করা সম্ভব হয় না। একমাত্র জনগণের মাঝে আয়ের উতস বা ফ্যাক্টর সমূহের মালিকানা বন্টিত হলে আয় বন্টন ও জিডিপির অংশ জনগণের ভাগে পৌছাবে এবং সেটাই হবে জনগণের আর্থিক সক্ষমতা অর্জনের সোপান। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।