আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বইয়ের আলোয়, বইয়ের শব্দে

শুচি সৈয়দ শুচি সৈয়দ চরাচরব্যাপী বিস্তৃত অন্ধকারে আমার কাছে বইকেই মনে হয় আলো। নৈঃশব্দে ডুবে থাকা পৃথিবীতে বই-ই শব্দ এবং সঙ্গীত। যখন খুব ছোট্ট ছিলাম তখন মুখে মুখে ছড়া বলতাম, সেগুলোর কিছু পেয়েছিলাম আমার দাদীর কাছ থেকে আর কিছু আব্বার কাছ থেকে। বর্ণমালাÑ সেও আব্বা শিখিয়েছেন মুখে মুখে। পড়বার বই আর গল্পের বইÑ মিলিয়ে-মিশিয়ে সেও আব্বাই তুলে দিয়েছিলেন হাতে।

গল্পের বই আর পড়বার বইয়ের ভেতর যে একটা বেশ বৈষয়িক পার্থক্য আছে এটা কোনওদিন বুঝতেই পারিনি। আব্বা তো বৈষয়িক ছিলেন না, আমারও সে-বিষয়বুদ্ধি হলো না। আজও ‘পাশের পড়া পড়িনে ছাই, পড়ি ফেলের পড়া’Ñ তাই আখেরে প্রাপ্তিযোগÑ শূন্য। আমার প্রিয় পছন্দের পৌরাণিক চরিত্রের নাম প্রমিথিউস। স্বর্গ থেকে যে-দেবতা মানুষের জন্য আলো চুরি করে এনেছিলেন।

পরিণামে যাঁর কপালে জুটেছে অশেষ নিগ্রহ। আমার আব্বাকে ঠিক এই চরিত্রটির মতো মনে হয়। মনে হয় আব্বাও ছিলেন এক প্রমিথিউসÑ যিনি স্বর্গের আলো এনেছিলেন আমার জন্য আর সে আলো হচ্ছেÑ বই। মনে আছে ছোটবেলা এক পাতা লিখলে আব্বা চার আনা দিতেন আমাকে একইভাবে একটি ছবি আঁকার জন্য পেতাম চার আনা। শৈশবের সেই সিকি পয়সার ঔজ্জ্বল্য আমি আজও কোনও কিছুতেই খুঁজে পাই না।

সেই সিকি পয়সার স্মৃতির-ফিতেয় টান পড়লেই আমার বিষয়বুদ্ধিহীন আব্বার সহজ সরল মুখটি ভেসে ওঠে। আব্বা ছিলেন স্কুল শিক্ষক, রঙের কাজ করতেন, ছিলেন ন্যাপের কর্মী। জেলা শহরের রাজনৈতিক কর্মীকে অনেক কাজ করতে হয়। ব্যানার লেখা, পোস্টার লেখা, মিছিল, মিটিং, শ্লোগান ইত্যাদি। ওয়ালিংও কি করেছেন তিনি ? হয়তোবা! পাবনার ন্যাপ নেতা রণেশ কাকাÑ রণেশ মৈত্রÑ বলতে পারবেন! আমার জানা নেই।

ছোটবেলা বেশ দুরন্তই ছিলাম, একবার মনে আছেÑ আব্বা আমাকে পাশে বসিয়ে তেল রঙে সাইনবোর্ড কিংবা ব্যানার কিছু একটা লিখছিলেন, রঙের গন্ধ তখন আমার খুব প্রিয় ছিল। দিলাম রঙের কৌটো উল্টে, তারপর তাতে জিব্বা লাগিয়ে খাওয়ার কসরৎÑ সারা জিব্বা রঙে রঙিন কিন্তু রঙের স্বাদ মোটেও তার গন্ধের মতো মধুর ছিল না। তারপর সে কি প্রাণান্ত অব¯থা! আর একবার আমাকে দর্জির দোকানে বসিয়ে রেখে দোকানের সাইনবোর্ড লিখছেন আব্বা, আর আমি সেলাই মেশিনের সুঁইয়ের নিচে নিজের কচি আঙ্গুল দিয়ে সেলাই কাজে মগ্ন হয়ে গেছিÑ সেও এক রক্তারক্তি কারবার!! এইসব উদ্ভট দুরন্তপনার অবসান ঘটলো যখন ভেঙে ভেঙে পড়া শিখলাম। শিশুসাহিত্যের রঙ-বেরঙের রাশিয়ান বইগুলো আমার সব মনোযোগ কেড়ে নিল। প্রতিদিন আব্বা আমার জন্য আনতেন দুইটি সওদাÑ একটি হচ্ছে বই, অপরটি সকালে খাবার জন্য বিস্কুট।

সেই শৈশব থেকে বই আমার কাছে আজও নিত্যপ্রয়োজনীয় সওদা। আমার কাছে বই ছাড়া একটি দিনের অর্থÑ আলোহীন একটি দিন, বই ছাড়া একটি দিনের অর্থÑ ঘুমন্ত একটি দিন, স্মৃতিহীন একটি দিন। জানিনা এ অনুভূতি আর কারও হয় কিনা। আব্বা আমাকে বইয়ের পাতায় গুঁজে দিয়ে কেটে পড়েননি, বরং নিয়ত হাত ধরেধরে হাঁটিয়ে নিয়ে গেছেন বইয়ের রাজ্যে, গল্প-কাহিনীতে। যে-বই পড়েছি আর যে-বই পড়িনি দুটোই আমি পেয়েছি তাঁর বুকেÑ তাঁর মুখে।

তাঁর বুকের উপর শুইয়ে তিনি আমাকে ঘুম পাড়াবার জন্য যেমন শুনিয়েছেন আদম এবং ইভের স্বর্গচ্যুতির গল্প ; ঠিক তেমনই চার্লস ডারউইনের মানুষের ক্রমবিকাশের ইতিহাসতত্ত্ব। আমাদের পিতা-পুত্রের মধ্যে যোগাযোগের সবচেয়ে সুন্দর সাঁকোটি ছিল বই। যে-বইটি তিনি আমার হাতে তুলে দিতে পারেননি, শুনিয়েছেন সে-বইটির গল্প। আমি তাঁর মুখে শোনা গল্পের বদৌলতেই বড়দের অনেক আসরে দু’চার কথা বলতে পারতাম আর সে জন্য বিরক্ত বড়রা আমার নাম দিয়েছিলেন ‘ইঁচড়ে পাকা’। এই তিরস্কার আমাকে কখনো কষ্ট দেয়নি কিংবা ক্ষুব্ধ করেনি ; কেবল মনে হয়েছে তাদের অসহিষ্ণুতার কথা।

মনে হয়েছে বই আর বইয়ের গল্প মানুষে মানুষে যে-বন্ধুত্ব তৈরি করে- তারা সেই মহত্তর বন্ধুত্বের বিষয়টি বুঝতে অপারগ। তাদের ওই আচরণে আমি আরও বইমুখী হয়েছি। জীবনকে জানার জন্য, বোঝার জন্য এবং জীবনে বাঁচার জন্য বই-ই আমার একমাত্র অবলম্বন, সবচেয়ে বড় বন্ধু। খুব ছোট্ট থেকে আমি আব্বার কাছে মানুষ। মা ছিলেন না ; মা ছিলেন তাঁর জেদ নিয়ে আর আব্বা তাঁর জেদ এবং যুগপৎ আমাকে নিয়ে।

একদিন আম্মা আমাকে ডাকিয়ে নিয়ে গেলেন তাঁর এক বান্ধবীরÑ খুব স¤ভবত অনিমা মাসীর বাসায়। অনিমা মাসী আমার জন্য পরোটা ভাজলেন সয়াবিন তেলে, আমি চিনি দিয়ে সেই পরোটা খেলাম, আম্মা যে সেদিন কি কি কথা বলেছিলেন আজ তার কিচ্ছু মনে নেই, শুধু মনে আছে তাঁর ব্যক্তিত্ব একটুও টসকায়নি । এবারও তিনি আমাকে বলেননি, খোকা তুই আমার কাছে থাকবি? কিংবা আমাকে আদর করে গায়ে মাথায় একটু স্পর্শও করেননি, তিনি আমাকে বাবার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে চাননি, আমারও মনে হয়নি তাঁর কাছে যাবার কথা। জীবনের এই হিসাব-নিকাশ আমার জানা ছিল না। জীবনের এই যোগ-বিয়োগ গুণ-ভাগে আমি ছিলাম না।

এমনকি আমার শ্রীহীন চেহারা নিয়েও কোনও ভাবান্তর দেখাননি তিনিÑ দেখালেও যে কোনও লাভ হবে না সম্ভবত সেটা তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। আমি আব্বাকে ছেড়ে থাকতে পারতাম না, কেননা বই ছাড়া, বইয়ের গল্প ছাড়া, বন্ধু ছাড়া আমার পক্ষে অন্য কোথাও থাকা ছিল অস¤ভব ব্যাপার। আব্বা বাড়ি এসে আমাকে না-পেলে হুলুস্থূল হবেÑ তাই দ্রুতই ফেরার সময় হল আমার। আম্মা আমার হাতে দিলেন দশ টাকার একটি নোট। তখনও আব্বা আমাকে এক সঙ্গে দশ টাকা দেননি।

দশ টাকা বেশ অনেক টাকা! কি করবো? চকলেট বা বাদাম, ঝাল চানাচুর কিংবা মিষ্টি এরকম কোনও কিছু? না, সে-সবের কোনও কিছু নয়, আমার অজান্তেই আমি হেঁটে চলে গেছি আমাদের মফস্বল শহরের বইয়ের দোকান বিকিকিনি মার্ট-এ। দোকানীর হাতে টাকা দশটি দিয়ে তাকে দিতে বলি ঝিনুক পুস্তিকার শরৎ রচনাবলীর একটি খণ্ড। আমার বেশ কয়েক দিনের পাঠের খোরাক আর আম্মার স্মৃতি! এভাবে আম্মাও আমার বইবন্ধুতে পরিণত হলেন। আম্মা সেটা জানলেনও না। রবি ঠাকুরের একটি গান আছে : “গানের ভিতর দিয়ে যখন দেখি ভুবনখানি, আমি তখন তারে জানি, তখন তারে চিনি।

” বই আমার গান, আমি বইয়ের ভিতর দিয়ে জগতকে জানি, চিনি, বুঝি। বই পড়ে আমি জানিÑ খালি চোখে দেখা যায় না যে অদৃশ্য অণু-পরমাণু আমি তার চেয়ে আকারে বস্তু হিসেবে বড়, বই পড়ে আমি জানিÑ আমার চোখের সীমায় যে সীমানা দেখা যায় না Ñঐ যে সুদূর নীহারিকাÑ তার তুলনায় পরমাণুর চেয়েও ক্ষুদ্র এই আমি। বই আমার অনন্ত আকাশে উড়বার অনিন্দ্য সুন্দর ডানা। বই আমার ছোট্ট খুপড়ি, পরম আশ্রয়, পরম নির্ভরতা। ওমর খৈয়াম তাঁর রুবাইয়াতে লিখেছেন, ‘সাকীর দৃষ্টি ঘোলা হয়ে যাবে, ফুরিয়ে যাবে মদও কিন্তু একটি বই অনন্ত যৌবনা।

’ হ্যাঁ, সব কিছুই আসলে ফুরিয়ে যায় ; মানুষের আয়ু... সে তো খুব সামান্য! আমার পরম বন্ধু ছিলেন আব্বা, একদিন তিনিও চলে গেলেন, আমাকে রেখে গেলেন বইয়ের আশ্রয়ে। বই আমার জন্য বরাভয়। আমার আপন বলে যদি কিছু থাকে আমি তাকে বইয়ের কাছে রেখে যাবো। জীবনে এটুকুই একমাত্র সম্বল যে আমার! অনন্ত যৌবনা বইয়ের কাছে, অনন্ত বরাভয় বইয়ের কাছে। বই মানুষকে বাঁচতে শেখায় আর বাঁচিয়ে রাখে জগতের সব সুন্দর আর সত্যকে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।