আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হঠাৎ সাংসদ

থাকেন ঢাকায়। আদি নিবাস ফরিদপুরের সদরপুর। পটুয়াখালী-৩ আসনে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পাওয়ার আগে তিনি ওই এলাকায় দলের কোনো সভা-সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন না। দলের কার্যালয়েও যাননি কখনো। কিন্তু এক-এগারো-পরবর্তী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের পক্ষে সৃষ্ট গণজোয়ারে সহজেই নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে যান।

তিনি সাংসদ গোলাম মাওলা রনি।
পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সন্তোষ কুমার দে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মনোনয়ন পাওয়ার আগে গোলাম মাওলা কখনো উপজেলা আওয়ামী লীগের কোনো অনুষ্ঠানে আসেননি। এমনকি তিনি দলের কোনো স্তরের সদস্যও ছিলেন না। তবে মনোনয়ন পাওয়ার কয়েক মাস আগে গলাচিপার উলানিয়ায় তিনি একটি চক্ষু চিকিৎসা ক্যাম্প করেছিলেন। গলাচিপা ও দশমিনা উপজেলা আওয়ামী লীগ এ মনোনয়নের বিরোধিতা করে।

কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আমল দেয়নি।
হঠাৎ সাংসদ হওয়ার মতো হঠাৎই এই এলাকায় এসেছিল গোলাম মাওলার পরিবার। গলাচিপা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. হারুন অর রশিদ প্রথম আলোকে জানান, ১৯৭৪ সালে ফরিদপুরের সদরপুর এলাকার মো. সামসুদ্দিন মুন্সি জীবিকার সন্ধানে পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার রতনদী-তালতলী ইউনিয়নের উলানিয়া বন্দরে আসেন। রতনদী-তালতলী ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান মো. লাল মিয়া হাওলাদার পরিবার নিয়ে থাকার জন্য সামসুদ্দিন মুন্সিকে উলানিয়া বন্দরে এক টুকরো খাসজমিতে ঘর তোলার অনুমতি দেন। এর পর থেকে তিনি সপরিবারে সেখানেই বসবাস করেন।

সামসুদ্দিন মুন্সির সাত ছেলের মধ্যে সবার বড় সাংসদ গোলাম মাওলা রনি। দশম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় পাশের পূর্ব পাড়ডাকুয়া গ্রামে বিয়ে করেন তিনি।
১৯৮৬ সালে উলানিয়া হাট মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন গোলাম মাওলা। এর পর থেকে তিনি ঢাকায় বসবাস শুরু করেন। তাই গলাচিপা ও দশমিনা উপজেলায় তিনি তেমন পরিচিত ছিলেন না।

তিনি ঢাকায় ব্যবসা করেন এবং সেবোল্ট গ্রুপ নামে একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে তাঁর।
এক-এগারোর পটপরিবর্তনের পর পটুয়াখালী-৩ (গলাচিপার একাংশ ও দশমিনা) থেকে পর পর তিনবার নির্বাচিত সাংসদ সাবেক বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী আ খ ম জাহাঙ্গীর হোসাইন আওয়ামী লীগে সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত হন এবং এই অভিযোগে দলে কোণঠাসা হয়ে পড়েন। সেই প্রেক্ষাপটে গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দল থেকে মনোনয়ন পান গোলাম মাওলা।
সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার নয় মাসের মধ্যেই জেলা ও উপজেলায় সাংবাদিক নির্যাতনের মধ্য দিয়ে সংবাদপত্রের শিরোনাম হন গোলাম মাওলা। গলাচিপা উপজেলার দুটি নদী ভরাটকে কেন্দ্র করে সাংসদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হলে ২০০৯ সালের ৮ সেপ্টেম্বর থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে প্রথম আলোর গলাচিপা প্রতিনিধি ইসরাত হোসেন এবং তাঁর ছোট ভাই আমার দেশ-এর প্রতিনিধি সাইমুন রহমানের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও ধর্ষণের চারটি মামলা করা হয়।

ওই দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলাসহ নদী দখলের তথ্য সংগ্রহ করতে পটুয়াখালী জেলা সদরের কর্মরত ছয় সাংবাদিক গলাচিপায় গেলে তাঁদের ওপরও হামলা চালানো হয়।
সাংসদ নিজে বাদী হয়ে ২০০৯ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকার একটি আদালতে প্রথম আলো, সমকাল, যুগান্তর ও মানবজমিন পত্রিকার সম্পাদক, প্রকাশক, স্থানীয় প্রতিনিধিসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে ১০০ কোটি টাকার মানহানির মামলা করেন। এতে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে পটুয়াখালীসহ সারা দেশে।
দলীয় নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, তাঁদের বাদ দিয়ে গোলাম মাওলা সব কাজে বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীদের প্রাধান্য দেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে এলাকায় সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন তাঁর শ্যালক মকবুল হোসেন খান।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় মকবুলের নেতৃত্বে স্থানীয় আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে হামলা হয় বলেও দাবি করেছেন স্থানীয় নেতারা।
গত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে গলাচিপায় চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী ঘোষণা নিয়ে আওয়ামী লীগের বিরোধ প্রকাশ্য রূপ নেয়। দলের সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে গোলাম মাওলা ঘোষণা দেন দলের উপজেলা সভাপতি মো. হারুন অর রশিদের নাম। আর পৌর মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হাজি আবদুল ওহাব খলিফা প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দেন দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. শামীম মিয়ার নাম। তখন দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে আবদুল ওহাব খলিফা, শামীম মিয়াসহ তাঁদের সমর্থক বেশ কয়েকজনকে বহিষ্কারের ঘোষণা দেন সাংসদ।

এতে পৌর মেয়রের সমর্থকেরা দলে কোণঠাসা হয়ে পড়েন।
কিন্তু উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার মাত্র তিন মাসের মধ্যে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হারুন অর রশিদ সাংসদ গোলাম মাওলার সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। আধিপত্যের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এ বিরোধের সৃষ্টি হয় বলে দলের একাধিক সূত্র দাবি করে। এ অবস্থায় সাংসদকে ঠেকাতে আওয়ামী লীগের দুজন নেতা উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌর মেয়র পুরোনো বিরোধ মিটিয়ে এক হয়ে যান। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির অধিকাংশ নেতা।

২০১০ সালের ১৮ আগস্ট স্থানীয় এক জনসভায় সাংসদ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হারুন অর রশিদকে নিয়ে কটূক্তি করেন। সাংসদের সমর্থকেরা তাঁকে লাঞ্ছিতও করেন। এর পর থেকে দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি সভা-সমাবেশ, বহিষ্কার, অব্যাহতি এবং সাংসদকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করার মতো ঘটনা ঘটে।
দশমিনায়ও সাংসদের দাপটে আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের নেতা-কর্মীরা কোণঠাসা হয়ে পড়েন বলে জানান নেতা-কর্মীরা। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রয়াত হাবিবুর রহমান ঢালী দলের কার্যক্রম থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন আগেই।


টেন্ডার, চাঁদাবাজি, নিয়োগ-বদলি, সাংগঠনিক আধিপত্য ধরে রাখতে গলাচিপা-দশমিনায় গড়ে ওঠে নতুন এক বাহিনী। বাহিনীর সদস্যরা সাংসদকে ‘ভাইয়া’ বলে সম্বোধন করায় বাহিনীর নাম হয় ‘ভাইয়া বাহিনী’। এ বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করেন সাংসদের শ্যালক মকবুল। ২০০৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী পটুয়াখালী-৪ (কলাপাড়া-গলাচিপা উপজেলার একাংশ) আসনের সাংসদ মো. মাহবুবুর রহমান তালুকদারের জনসভার মঞ্চ পুড়িয়ে দেয় এই বাহিনী। এই বাহিনীর হাত থেকে রেহাই পাননি দলীয় নেতা-কর্মী, সাংবাদিক, শিক্ষক ও সংখ্যালঘুরা।


দলীয় সূত্রে জানা গেছে, গলাচিপা-দশমিনা উপজেলার শতাধিক নেতা-কর্মী ‘ভাইয়া বাহিনী’র হামলা ও মামলার শিকার হয়েছেন। সবচেয়ে বেশি হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন গলাচিপা উপজেলার নেতা-কর্মীরা। এঁদের মধ্যে আছেন জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক কাশিনাথ দত্ত, গলাচিপা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান মো. হারুন অর রশিদ, সহসভাপতি ও পৌর মেয়র আবদুল ওহাব খলিফা, সহসভাপতি অধ্যাপক সন্তোষ কুমার দে, সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মজিবুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক ও পানপট্টি ইউপি চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান, সাংগঠনিক সম্পাদক সরদার মো. শাহ আলম, গলাচিপা আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আবুল কালাম মো. ঈসা। দশমিনায় হামলার শিকার হয়েছেন উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান সাখাওয়াত হোসেন শওকত, উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান শামসুন নাহার খান ও মুক্তিযোদ্ধা মো. নিজাম উদ্দিন তালুকদার।
২০০৯ সালের ৯ অক্টোবর পটুয়াখালী প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে গলাচিপা উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতারা প্রশ্ন তোলেন, সাংসদ গোলাম মাওলা আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিত্ব করছেন, নাকি অন্য কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে বিশেষ কোনো দলের লোক হয়ে কাজ করছেন?
পরের বছরের ৮ এপ্রিল পটুয়াখালীর সার্কিট হাউসে জেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় সাংসদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তোলেন গলাচিপা ও দশমিনা উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতারা।

ওই সভায় দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে সংগঠনবিরোধী বক্তব্য, দলীয় নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতন, হামলা-মামলা, অসদাচরণ ও অরাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগে সাংসদ গোলাম মাওলার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। পরে দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের কাছে ওই সুপারিশ পাঠানো হয়।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খান মোশারফ হোসেন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাংসদ গোলাম মাওলার বিরুদ্ধে আমরা বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ করেছি, কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। তবে এখন তাঁর কর্মের ফল তিনি পাচ্ছেন। ’।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।