... ছোট বেলায় ইসলামিক ফাইন্ডেশন হতে প্রকাশিত “মক্কা মদীনা ঘুরে এলাম” বইটি পড়েছিলাম। খুব সম্ভবত সেলিনা হোসেন অথবা রাবেয়া খাতুনের লেখা। লাল রঙা ছবি সহ মক্কা, মদীনা ভ্রমণের কাহিনী আর ইতিহাসের কথা। সেই ছোট বেলাতেই মনের ভেতর লুকিয়ে ছিল- যদি একটিবার মক্কা, মদীনা যেতে পারতাম।
গত বছরের এই সময়টিতেই আমি কখনো ভাবতে পারিনি- আমি ওমরাহ্ করবো, এতো অল্প বয়সে হজ্জ্বও করে ফেলবো।
আলহামদুলিল্লাহ আমি এবং আমার স্ত্রী হজ্জ্ব ও বেশ কয়েকবার ওমরাহ্ করে ফেলেছি।
আমাদের আবহা হতে প্রতি বুধবার মক্কার জন্য কাফেলা যায় ও শুক্রবার রাতে ফিরে আসে। ফলে সহজেই আমরা উইকএন্ডে ওমরাহ্ করে ফেলতে পারি। প্রথমবার ওমরাহ্ করতে যাবার স্মৃতি এখনও মনে আছে। সৌদি আসার এক মাসের মধ্যেই ওমরাহ্ করি।
আমার স্ত্রী ওমরাহ্ করার ব্যপারে বেশ অভিজ্ঞ হয়ে গিয়েছিল (সে আমার ১বছর আগে এখানে এসেছে এবং বেশ কয়েকবার ওমরাহ্ করে ফেলেছিল)। সে আমাকে বেশ ভালোভাবেই গাইড করলো- নিয়ম কানুন, দোয়া সব কিছুই শিখে নিলাম।
যখন রওনা হচ্ছিলাম, কেমন যেন অন্যরকম আনুভুতি কাজ করছিল। আমাদের এখান থেকে প্রায় ১১ ঘন্টা’র জার্নি, নামাজের বিরতী, খাবারের বিরতী আর মিকাতে গিয়ে এহরাম পড়া। হারাম শরিফের সীমানার বাহিরে মিকাতে গিয়ে এহরাম বাঁধতে হয়।
মিকাতে এহরাম বেঁধে দু’রাকাত নামাজ আদায় করে ওমরাহ’র নিয়্যাত করে নিলাম ... “ হে আল্লাহ আমি ওমরাহ’র নিয়্যাত করছি, আমার ওমরাহকে সহজ করে দাও, কবুল ও মঞ্জুর করে নাও...”।
এহরাম বাঁধার পর আমরা সবাই পড়ছিলাম ... “লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক .....” সারা বাসের সুরেলা এই ধ্বনিতে আমি বারে বারে উজ্জ্বীবিত হয়ে উঠছিলাম।
রাত ২ টার দিকে মক্কা পৌছে যাই। আমাদের হোটেলটা কাবা শরীফের অনেক কাছে ছিল, মাত্র ৫/৬ মিনিটের পথ। মনের ভেতর উত্তেজনা, কখন কাবা শরীফ দেখতে পাব।
আমারা রুমে ঢুকে আর দেরী করিনি। ১৫ মিনিটের মাঝেই ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে গেলাম। আমাদের এ যাত্রায় আমাদের সাথে দিবা ও তার আব্বা, ইশরাত ও শাহনাজ ছিল। ইশরাতের জন্যও এটা প্রথম ওমরাহ্ ছিল।
মসজিদুল হারেমের চারপাশ জুড়ে উচু উচু হোটেল, বিশাল ঘড়িটা চোখে পড়ল।
চারপাশ দেখে মনে হলো কংক্রিটের শহর। আমার মতো অনেকেই এহরাম বেঁধে মসজিদুল হারেমের দিকে যাচ্ছিল। মনেই হয়না এখন এতো রাত, চারদিক বেশ জমজমাট। যতই এগুচ্ছিলাম- আমি পরিবর্তিত হচ্ছিলাম। সকল জাগতিক চিন্তা, অবসাদ, ক্লান্তি নিমিষেই কোথায় যেন উড়ে গেল।
মসজিদুল হারাম
মসজিদুল হারেমে ঢুকেই দোয়া পড়ে নেই। একটু এগুতেই চোখে পড়ে কালো পর্দায় আচ্ছাদিত কাবা শরীফ। কাবা শরীফ দেখে দোয়া পড়তে পড়তে এগুচ্ছি, চোখ দিয়ে আপনা আপনিই টপ টপ করে পানি পড়তে থাকে। এখন যখন কাবা শরীফের কথা লিখছি, কেমন যেন শিহরিত হয়ে উঠছি। হাজার হাজার মানুষ কাবা শরীফকে ঘিরে তাওয়াফ করছে।
এ তাওয়াফ কখনো থামেনি, মানুষ না থাকলে ফেরেশতারা তাওয়াফ করেছে। পৃথিবী’র শেষ পর্যন্ত এ তাওয়াফ চলবে।
কাবা শরীফ
আমরা মসজিদে প্রবেশের দু’রাকাত নামাজ, বেশ কয়েক রাকাত নফল নামাজ ও তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে নিলাম। তারপর নির্দষ্ট স্থান (হাজরে আসওয়াদ বরাবর)হতে তাওয়াফ শুরু করি। তাওয়াফ করার সমায় যেকোন দোয়া পড়া যায়, অনেকেই বইয়ে লেখা দোয়া দেখে দেখে পড়ে থাকেন- এটা না করাই ভালো, নিজের মন থেকে আসা প্রার্থনার চেয়ে বড় আর কি হতে পারে? কাবা শরীফের চারটি কর্ণারকে চারটি নামে ডাকা হয়- দক্ষিনপুর্বে রুকনে আসওয়াদ (হাজরে আসোয়াদ কর্নার), উত্তরপুর্বে রুকনে ইরাকি, উত্তরপশ্চিমে রুকনে শামি (সিরিয়া মুখি), দক্ষিনপশ্চিমে রুকনে ইয়েমেনি।
তাওয়াফ এর সময় রুকনে ইয়েমেনি’র কাছে এসে বারবার “রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাতাও ... ” দোয়াটি পড়তে হয়।
৭ বার তাওয়াফ শেষ করে হাতীমে (হাতীম কাবা শরীফেরই অংশ) ২ রাকাত নামাজ পড়ে নেই। জমজমের পানি খেলাম- জমজমের পানিতে অসুস্থতা দূর হয়, ক্ষুধা নিবৃত্ত হয়। কিছুদিন আগে BBC London রিপোর্ট করেছে যে, জমজমের পানিতে নাইট্রেট, ব্যক্টেরিয়া ও আর্সেনিক ক্ষতিকর মাত্রায় আছে। কিন্তু তারা খুঁজে বের করেনা মরুভুমি’র মাঝে কোথা হতে এত পানি আসছে।
সৌদি কতৃপক্ষ প্রতিদিন পানি পরীক্ষা করে এবং পানিতে সকল উপাদানই স্বাভাবিক মাত্রায় আছে।
সাফা ও মারওয়া'র মাঝখানের পথ
ফজরের নামাজের আগেই আমদের তাওয়াফ শেষ হয়ে যায়, ফজরের নামাজ পড়ে সাফা মারওয়া ৭ বার সাঈ করি। সাফা ও মারওয়া হচ্ছে ২ টি পাহাড়, যার মাঝে বিবি হাজেরা শিশু ইসমাইল (আঃ) এর জন্য পানি খুঁজতে দৌড়ে বেড়িয়েছিলেন। আমার ধারনা ছিল ওমারাহ’র জন্য হয়তো কাজটি কষ্টের হবে, হয়তো প্রাকৃতিক পরিবেশে পাহাড়ের মাঝে আমাদেরকে দৌড়াতে হবে। কিন্তু কাবা শরীফের পাশেই সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে দৌড়ানোর জায়গা এখন টাইলস করা, এসি’র ব্যবস্থা আছে, জায়গায় জায়গায় জমজমের পানি রাখা আছে।
কষ্ট এখন নেই বললেই চলে। সাফা ও মারওয়া পাহাড়দুটি গ্রিলদিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। পাহাড় দুটিকে আর পাহাড় মনে হয়না, বেশ ছোট হয়ে গেছে। সাঈ শেষে ২ রাকাত নামাজ পড়ে মাথার চুল ছেটে ফেললাম, আর এভাবেই আমার ওমরাহ্ সম্পন্ন হয়ে গেল।
মক্কার ঘড়ি।
চারপাশে কন্সট্রাকশন কাজ চলছে
আগামীদিনের মক্কা
(চলবে) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।