তৃতীয় বিশ্বের নেতা হওয়ার জন্যে দুটি জিনিশ দরকার : বন্দুক ও কবর। বিরহ বিদায়' আমার কাছে মনে হয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একটি নান্দনিক দলিল। যুদ্ধের ব্যাপকতা এত সুগভীরভাবে শিল্পিতভাবে এখানে চিত্রিত হয়েছে যা মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের আসল রূপটিই পরিস্ফুট করে তোলে
ফাইজুস সালেহীনের লেখা 'বিরহ বিদায়' যখন পড়ার জন্য হাতে নিয়েছি, প্রচ্ছদের ছবি ছাড়া স্বাভাবিকভাবেই বইটির ভেতরে কোনো ছবিই দেখতে পাইনি, ছবি থাকার কোনো কথাও তো না এ উপন্যাসে, কিন্তু সত্যি বলতে কি, একটার পর একটা পৃষ্ঠা ওল্টাতে ওল্টাতে আমি যেন ছবি দেখাই শুরু করেছি। অনেক ছবি। চলমান ছবি।
কোনো সময় মনে হয়েছে আমি যেন একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য ছায়াছবি দেখছি। আবার কোনো সময় মনে হয়েছে আমি যেন ঘরে বসে টেলিফিল্ম দেখছি। ছাপার অক্ষরের লেখা কী করে চলমান ছবি হয়ে যায়? হ্যাঁ যায়। যদি সে লেখায় দৃশ্যমান, চলমান ছবির আবহ থাকে, গতি থাকে। 'বিরহ বিদায়' উপন্যাসটি পড়ে একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে আমার মনে হয়েছে যে, একটি উপন্যাসের সবগুলো উপাদান ও উপকরণ এর মধ্যে থাকলেও এর অভ্যন্তরে নাটকও আছে, কবিতাও বুঝি আছে মাঝে মধ্যে, প্রেম অবশ্যই আছে।
মানুষে মানুষে প্রেম, দেশ ও মানুষের প্রেম। যে প্রেম প্রেমিকার উত্তপ্ত বুকে বুক রেখে কাঁধে মাথা রেখে ঘ্রাণ নেয় তার ভরা যৌবনের, যে প্রেম লাল, হলুদ আর সবুজের পতাকাকে বুকে জড়িয়ে ঘ্রাণ নেয় যৌবনোন্মুখ স্বাধীনতার ও মহান মুক্তিযুদ্ধের, সে প্রেম কি দুঃসহ স্পর্ধায় আকাশের তারাগুলোকেও ছিনিয়ে আনার স্বপ্ন দেখতে পারে? পারে ফাটল ধরিয়ে দিতে পাকিস্তানি সামন্তবাদের বনিয়াদি প্রাসাদে,পারে কৃষকের লাঙলের সূচিমুখ পরিণত করতে এলএমজি, মেশিনগানে আর শটগানে।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করেই এই উপন্যাসটি তৈরি হয়েছে। আমাদের মধ্যে অনেকেই যেখানে হয়তো বাধ্য হয়েই মুক্তিযুদ্ধকে অবলোকন করেছি শহরে থেকে, তারা কিছুতেই বুঝতে পারব না যে, বাংলাদেশের অগণিত আদমসন্তান কীভাবে কত কষ্ট করে কত রক্তজল ক্ষয় করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, কীভাবে যুদ্ধ করেছিলেন তারা বিদ্যুৎ ইশারার চোখে বাংলাদেশের খালে, বিলে, নদীতে, বিস্তীর্ণ প্রান্তরে, কী আশ্চর্য উদ্দামবেগে তারা ছুটে চলেছিলেন কালো রাত্রির গভীর অন্ধকার থেকে উজ্জ্বল একটি সকাল ছিনিয়ে আনার জন্য, কীভাবে এই উপন্যাসের নূরুল ফয়েজের মতো গ্রামবাংলার মুক্তিযোদ্ধারা গিটগিটে পায়ের পাতায়, আঙ্গুলের ডগায়, মাংসপেশির তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে কালো আঁধারে কাতরাতে কাতরাতে এলএমজি হাতে শত্রু নিধনে এগিয়ে চলেছিলেন। কীভাবে ফয়েজের মায়ের মতো স্নেহময়ী মায়েরা সুবেহ সাদেকের সময় সেজদায় লুটিয়ে পড়েছিলেন আর তাদের চোখের পানিতে জায়নামাজের আঁকা কাবা শরিফ ভিজে গিয়েছিল, মকসুদ খলিফারা কী করে লোকচক্ষুর আড়ালে একের পর এক সেলাই করে চলেছিলেন সবুজ-হলুদ কাপড়ের ওপর স্বাধীনতার লাল সূর্যের পতাকা।
কী করে বাংলার গ্রামের 'সাহসী পোলারা বাইগনবাড়ি ব্রিজ গ্রেনেড মাইরা উড়াইয়া দিছিল', গফরগাঁওয়ের গেরিলারা কীভাবে ফাইট কইরা, শয়তান পাঞ্জাবি সৈন্যগো একটার পর একটা খতম কইরা দিছিল, কীভাবে ওই নরঘাতকগুলো আমাদের সোনার বাংলার সরল-সহজ মা-বোনদের ওপর পাশবিক অত্যাচার করে তাদের রক্তাক্ত দেহ ফেলে দিয়েছিল গাঁও-গ্রামের ট্রেঞ্চে ট্রেঞ্চে, ফাইজুস সাহেলহীন তার বিরহ বিদায় উপন্যাসে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের কাল্পনিক নয়, সত্যিকার একটি বিশ্বস্ত চিত্র অঙ্কন করেছেন। তার সংলাপগুলো সদ্য ফোটা জুঁই, পারুল, শেফালির মতো, ছোট ছোট আমলকী, বেতফল আর আমরুজের মতো; গাঁও-গেরামের সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের মুখের কথার মতো। চরিত্র সৃষ্টিতে তার দক্ষতা অপরিসীম। রেবেকা, শেফালী, মজিবর স্যার, বালক মজনু শাহ, মকসুদ খলিফা, অদেখা সন্তানের কবরের পাশে পৌষের শিশিরভেজা রাতে চুপচাপ বসে থাকা যুদ্ধফেরত শরাফ উদ্দীনদের যেন আমরা না দেখেও অনেক দিন থেকেই চিনি ও জানি। উপন্যাসটিতে আবহ বর্ণনায় কোথাও কিছু আরোপিত মনে হয়নি, ব্যাহত হয়নি স্বচ্ছন্দ, স্বাভাবিক গতি।
জাতি-ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী নির্বিশেষে সব মানুষের একাত্ম হয়ে জাতির জনকের আহ্বানে একই চেতনাপ্রবাহে একই মোহনায় এসে জড়ো হওয়ার প্রাণস্পর্শী চিত্র এই 'বিরহ বিদায়' উপন্যাস। 'নাই বা থাকল চিনপরিচয়, মানুষ তো!' এই অপরিচিত সাধারণ মানুষরাই হচ্ছে ফায়জুস সালেহীনের উপন্যাসের আসল নায়ক, গণনায়ক। টিভি বা ফিল্মে পরিচালকের নির্দেশে কাহিনীর প্রয়োজনমতো, শটের প্রয়োজনমতো নানা জায়গায় আলো প্রক্ষেপণ করা হয়। লেখক-পরিচালক ফায়জুস সালেহীন তার উপন্যাস-নাটকটিতে গাঁও-গেরামের আইনের দুই পাশে শুয়ে থাকা, বসে থাকা, দাঁড়িয়ে থাকা, গড়িয়ে গড়িয়ে চলা, দৌড়ে দৌড়ে চলা সাধারণ মানুষ, অন্ধ-বধির মানুষ যাদের চেনে না কেউ, বোঝে না কেউ_ তাদের ওপরই তার উজ্জ্বল আলোগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে প্রক্ষেপণ করেছেন, তাদের স্পষ্ট করে চেনার জন্য, বোঝানোর জন্য। স্বাধীনতা-সূর্যের উত্তাপে তাদের বড় বড় তীক্ষষ্ট চাহনির চোখগুলো কী দুঃসহ ক্ষোভে, আবেগে ও উত্তেজনায় ফেটে বের হওয়ার উপক্রম হয়েছে তা সুস্পষ্ট করে দেখানোর জন্য।
'বিরহ বিদায়' আমার কাছে মনে হয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একটি নান্দনিক দলিল। যুদ্ধের ব্যাপকতা এত সুগভীরভাবে শিল্পীতভাবে এখানে চিত্রিত হয়েছে, যা মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের আসল রূপটিই পরিস্ফুট করে তোলে। যারা স্বচক্ষে মুক্তিযুদ্ধ দেখতে পারেননি তারা এই বইটি পড়ে মুক্তিযুদ্ধের আসল চিত্রটি দেখতে পাবেন। বইয়ের লাল-সবুজ-কালো রঙের প্রচ্ছদটি যেন মুক্তিযুদ্ধেরই কথা বলে। 'মেলা' প্রকাশনার ৬৩ পৃষ্ঠার এই বইটি একটানা পড়তে পাঠকদের বেশি সময় লাগবে না।
মুক্তিযুদ্ধ তো বাঙালির সব বিরহকে বিজয়ের সরণিতেই টেনে নিয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধ তো শেষ পর্যন্ত আমাদের সব বিরহকে বিদায়ের সমরকাব্যে পরিণত করেছে। স্বপ্নের সবুজ মাঠের ঘাঁটিতে পৃথিবীর এই প্রান্তের মানুষরাই উড্ডীন করেছে স্বাধীনতার লাল পতাকা। বইটির পাতায় পাতায় এই অদৃশ্য পতাকার ছবিই যেন আঁকা রয়ে গেছে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।