সমাজকর্মী কনক বর্মন ও অদিতি ফাল্গুনী
দৈনিক ‘সমকাল’ পত্রিকায় লিমনকে নিয়ে ‘আমার এখন হাজারটা পা’ শিরোনামের লেখাটি মুদ্রিত হবার পর ওকে জানাতে ওর মামা’র নম্বরে ফোন করেছিলাম গত বুধবার বিকেলে। হাসি-খুশি ও আশাবাদী প্রকৃতির লিমনের গলা সেদিন অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগ বোধে ছিল আচ্ছন্ন।
‘আমাকে আপনারা আর একবার দেখতে আসলে খুব ভাল লাগতো। কালই আসেন। দুপুর দুইটার ভিতরে।
কালই ত’ হাসপাতাল থেকে রিলিজ দিয়া দেবে। ’
‘তুমি কি দেশের বাড়ি ফিরে যাবে?’ আমরা প্রশ্ন করেছিলাম।
‘কিছুই এখনো ঠিক হয় নাই। দেশের বাড়ি যাইতে ইচ্ছা করে। কিনত্ত, এখন গেলে আমার নিরাপত্তার সমস্যা হইতে পারে।
এছাড়াও এখন বর্ষাকাল শুরু হবে। বরিশাল অঞ্চলে বৃষ্টির দিনে এত কাদা-পানি...তার ভেতর নতুন ক্রাচ নিয়া হাঁটা-চলা কি করবো...মাত্র পা’টা কাটা গ্যাছে আমার...মানবাধিকার কমিশনের ড: মিজানুর স্যার ত’ বলছেন যে আমারে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দিলেও য্যানো ঢাকায় আরো কিছুদিন থাকতে পারি সেই ব্যবস্থা করবেন...যাতে আমার কাটা পায়ের উপর অংশে ফিজিওথেরাপি কইরা জোর আনা যায়...সাভারে কৃত্রিম পা লাগানো যায়...তার জন্যও দেড় মাস বিশ্রামে থাকা দরকার...কিনত্ত, কিছুই যে এখনো নিশ্চিত না!’ লিমনের গলায় ঝরে পড়েছিল গুমরানো কান্না।
বুধবার বিকেলে লিমনের সাথে এই কথার পরপরই আমাদের ফেসবুক নির্ভর গ্রুপ ‘লিমনের জন্য, জীবনের জন্য’-এর সঞ্চালক নিশাত জাহান রানা (রানা আপা) ও আমরা (অদিতি ফাল্গুনী ও কনক বর্মন) ঠিক করি যে বৃহষ্পতিবার সকালেই আমরা লিমনকে দেখতে যাব। বৃহষ্পতিবার বেশ সকালেই ঘুম ভেঙ্গে যায় রানা আপার টেক্সট মেসেজের শব্দে: ‘লিমন হাসপাতালে আরো দু’দিন থাকছে। ঢাকাতেই সে আরো কিছুদিন থাকবে।
কাজেই আজ সকালে না গিয়ে পরেও আমরা ওর সাথে দেখা করতে পারি। ’ মনটা ভাল হয়ে গেছিল রানা আপার টেক্সট মেসেজ ও পত্রিকায় প্রকাশিত লিমনের ঢাকায় থাকতে পারার খবরে। না, দেশটা এখনো খুব মন্দ হয়ে যায় নি। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ার পার্সন ড: মিজানুর রহমান খান এবং মানবাধিকার ও আইন সহায়তা সংস্থা ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্র’ ঢাকার কোন বেসরকারী হাসপাতালে লিমনকে আরো দেড় মাস রাখা, চিকিৎসা ও প্রয়োজনীয় সব কিছুর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেবে এমন খবরে স্বস্তি পাই।
গতকাল শনিবার বিকেলে শ্যামলীর পঙ্গু হাসপাতালে আমরা আবার যাই।
‘আমরা’ অর্থাৎ অদিতি ফাল্গুনী ও কনক। ‘যুক্ত’ নামক একটি প্রকাশনা সংস্থার যাবতীয় দায়িত্ব কাঁধে থাকার কারণে রাণা আপা মাঝে মাঝেই আটকে যান। সবসময় চাইলেও আমাদের মতো সব জায়গায় ছোটা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় না। আমাদের দেখে লিমন হাসে, ‘আসেন। ’ আজ লিমনের পাশে ওর মা হেনোয়ারা বেগমও ছিলেন।
ছোট-খাট গড়নের এবং ‘প্রায়-তরুণী’ লিমনের মা কোন শহুরে নারী হলে হয়তো আজো তাঁর বিয়েই হতো না। উচ্চ শিক্ষা, চাকরি, কেরিয়ার নাম্নী বেশ কিছু উচ্চাকাঙ্খার পেছনেই হয়তো ছুটতে থাকতেন, ‘বারো-তেরো বছর বয়সে আমার বিয়া হয়। লিমন আমার ছোট ছেলে। আমার মাইয়া, লিমনের বড় বইনের স্বাস্থ্য আমার চাইতে ভাল। হ্যারে আমার চাইয়া বড় দেখায়,’ লিমনের মা হাসেন।
বানান করে জোরে জোরে উচ্চারণ করে হলেও বাংলা সংবাদপত্র অন্তত: পড়তে পারেন দেখা গেল।
‘ঢাকা থেকে আমার পক্ষের যারা ঝালকাঠি আমাদের দেশের বাড়ি গ্যাছে, তাদের কেউ কেউ ‘র্যাবে’র শেখানো কথা বলছে। এক হোণ্ডা চালক বলছে যে আমি মাদক ব্যবসায়ী আর ২৩ মার্চ সারাদিন আমি নাকি তার হোণ্ডায় চইড়া নানা জায়গায় মাদক বিক্রি করছি। অথচ, ২৩ তারিখ আমার কলেজের খাতায় আমার এ্যাটেণ্ডেন্স আছে। সারা দিনের সবগুলা ক্লাসেই আমার ফুল এ্যাটেণ্ডেস আছে।
আমার পা ত’ গেছেই। ‘র্যাব’ কেন আমারে...আমার মা-বাবা-ভাই-বোণ...সবাইরে সন্ত্রাসী বলতে চাইছে?’ দৈনিক ‘আমাদের সময়’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদ দেখিয়ে অভিমানী গলায় প্রশ্ন করে এই কিশোর।
‘মন খারাপ করো না, লিমন। সারা দেশে আমরা কত মানুষ তোমার পক্ষে!’ আমরা ওকে স্বান্তনা দিই।
এবার ফিক করে হাসে লিমন।
পুনর্বার তার চোখ আত্মবিশ্বাসী দেখায়, ‘তা’ জানি। বাংলাদেশে শুধু একজন আমারে দ্যাখতে পারে না!’
‘কে?’
‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী- সাহারা খাতুন। ’
আমরা এবার হেসে ফেলি। লিমনের বাবা মা-ও হাসতে থাকে। লিমনের বাবা জানান ‘ধানমণ্ডি’র কোন প্রাইভেট হাসপাতালে সোমবার নাগাদ তারা উঠতে পারেন।
সেখানে লিমনের ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা চলবে আগামী আরো এক-দেড় মাস। তারপর সাভারে কৃত্রিম পা সংস্থাপন হতে পারে সিআরপি হাসপাতালে।
কথা হয় নানা বিষয়েই। লিমনের উপর প্রকাশিত তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হবার দু’ঘণ্টার ভেতর সংবাদ মাধ্যম থেকে প্রতিবেদনের খবর সরিয়ে নেওয়া, প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টার দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য ও পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক তাঁর দলের বা সরকারের দায়িত্বশীল কোন পদে থাকা ব্যক্তিদের লিমন সংক্রান্ত বিষয়ে কোন বক্তব্য না দেওয়ার নির্দেশ প্রভৃতি বিষয়ে নানা জিজ্ঞাসা রয়েছে লিমনের পরিজনদের। লিমনের মা ছেলের চিকিৎসার জন্য ডাচ-বাংলা ব্যঙ্কে যে হিসাব নম্বরটি খুলেছেন, সেখানে আদৌ কোন টাকা এসেছে কিনা তা’ পরখ করে দেখার সময়ও তারা পাচ্ছেন না ।
‘আমি ত’ সাভারে একটা ফলের দোকানে কাজ করতাম। কিনত্ত, অসুস' ছেলেডারে ফেইলা সেইখানে ক্যামনে যাই? আবার টাকারও ত’ দরকার আছে!’ লিমনের বাবা বলেন।
‘র্যাব গুলি করার পর আমার ছেলে মা বইলা যে চিৎকারডা দিছে তা’ মরণ পর্যন্ত আমার কাণে বাজবে। গুলি করার আড়াই ঘণ্টা পর লিমনরে যখন র্যাবের গাড়িতে বরিশাল মেডিকেলে নিয়া যায়, আমি ‘র্যাবে’র তিনডা গাড়িতেই লাফ দিয়া ওঠার চেষ্টা করছি...কিনত্ত, তিনবারই তারা আমারে ধাক্কা দিয়া ফেলায় দিছে। আমাগো বাড়ি থেকে কাছেই একটা ঝোপের পাশে ত’ ওরে গুলি করছে।
দুই ঘণ্টা ধইরা এত রক্ত পড়ছিল যে মনে হবে য্যানো দুইডা আস্ত গরু জবাই দিছে। বরিশাল মেডিকেলে চব্বিশ তারিখ বিকালে যখন বোঝা গেল ও জীবনে বাঁইচা গ্যাছে, তখন ওর পায়ের দিকে ডাক্তার-নার্স সবাইর নজর গেল!’ হেনোয়ারা বেগম চোখ মোছেন।
‘জানেন, আমার চক্ষুর সামনে আমার হাঁটু তাক কইরা গুলি করছে ত...নিজের চোখে দেখলাম গুলিটা একপাশ দিয়া ঢুইকা আর এক পাশ দিয়া বাইর হইলো। গুলি খাওয়ার পর ঐ জায়গাটা মনে হয় পুইড়া গেল। ডাক্তারে বলছে যে হাঁটু বরাবর গুলি না কইরা যদি দূর থেকে গুলি করতো, তাহলেও পা’টা বাঁচতে পারতো।
চব্বিশ তারিখ বিকালে নার্সরা আমার পায়ে সুই ফুটায় জিগায়, কোন আলাপ (সাড়া) পাও? না, কোন সাড়া ত’ পাই না। এই বোঝা গেল যে আমার পা’টা নষ্ট হইয়া গেছে! আগে কত মাইল মাইল হাঁটছি! কত কষ্টের কাজ করতে পারছি। ছুটির দিনে ইট ভাঁটায় কাঁচা ইঁট মাথায় বইয়া আয়-রোজগার করছি। এখন কি করব?’ লিমন বললো।
‘ওরে মেট্রিকের পর কলেজে পড়ানোর টাকা আমাগো আছেলো না।
পোলায় আমার ঢাকা যাইয়া সতেরো দিন রং মিস্ত্রির কাজ কইরা ছয় হাজার টাকা আয় করলো। ছয় হাজার টাকার পাঁচ হাজার টাকা দিয়া বই কিনলো আর কলেজে ভর্তি হইলো। বাকি এক হাজার টাকার পাঁচশো টাকা ওর বাপের হাতে দিলো। আর পাঁচশো টাকার আড়াইশো টাকা লাগছিল ওর ঢাকা থেকে বরিশাল আসতে আর আড়াইশো টাকায় বাসার জন্য ফল কিনছিলো!’ হেনোয়ারা বেগম পুনরায় তার শাড়ির আঁচলে চোখ মোছেন।
প্রিয় বন্ধুরা, লিমন একা নয়।
‘মানবাধিকার কমিশন’ ও ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্র’কে দেশের হাজারো সাধারণ নাগরিকের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ একটি জরুরি দায়িত্ব তাঁরা এই অসহায় কিশোরের জন্য পালন করতে এগিয়ে এসেছেন বলে। ধন্যবাদ দেশের বামপন্থী দলগুলোকে যারা লিমনের দেশের বাড়ি ঝালকাঠির রাজাপুর গ্রামে গিয়ে সেখানে সর্বস্তরের মানুষের সাথে কথা বলে লিমনের নির্দোষীতার পক্ষে তথ্য প্রমাণ সংগ্রহের কষ্টকর কাজটি করেছেন। ধন্যবাদ প্রতিদিনই দেশের ভেতরে ছোট ছোট অজস্র নাগরিক উদ্যোগকে যারা লিমনের পক্ষে প্রায়ই মানব বন্ধন করছেন, বিক্ষোভ সমাবেশে অংশ নিচ্ছেন। ধন্যবাদ সকল সাংবাদিক, শিল্পী, কবি ও লেখককে যারা লিমনের পক্ষে কোন না কোন কাজ করেই চলেছেন। আমাদের ভেতরে প্রসত্ততি অব্যাহত থাকুক।
যেন লিমনকে জড়িয়ে আবারো কোন অশুভ তৎপরতা লক্ষ্য করা গেলেই আমরা মুখরিত হতে পারে সৎ ও নির্ভীক প্রতিবাদে। ‘লিমনের জন্য, জীবনের জন্য’ নামের ফেসবুক নির্ভর এই অরাজনৈতিক মঞ্চটি গোটা বিষয়েই সজাগ দৃষ্টি রাখছে। আমাদের তৎপরতা একা লিমনকে নিয়ে নয়। প্রিয় স্বদেশভূমির সকল বিচার বহির্ভূত খুন-জখমের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। যে কোন অপ তৎপরতার প্রতিবাদে আমরা নতুন কর্মসূচী ঘোষণা করবো ।
(শেষ...)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।