১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং চূড়ান্ত বিজয় বিখ্যাত ঘটনা। স্বাধীকার প্রতিষ্ঠা এবং স্বাধীনতা অর্জনে দীপ্ত প্রত্যয়ের ফলশ্রুতি মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৯ মাসের বীর বাঙালী জনতার সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে আমাদের অনেকের অনেক বিভ্রান্তি আছে । একদল মনে করে যে মুক্তিযুদ্ধ শুধু তাদেরই দলের একক সমপত্তি এবং তাদের যুক্তিতর্ক ও কথার জোরে তারা বুঝাতে চায় যে মুক্তিযুদ্ধে শুধু তাদের দলের নেতাকর্মীরাই অংশগ্রহন করেছিল এবং তারাই স্বাধীনতা এনেছিল যা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট।
তাই মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববর্তী সময় ও যুদ্ধকালীন সময়ের কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা নিচে তুলে ধরলাম সবার অবগতির জন্য যা আমার এই লিখাটির ২য় অংশ বুঝতে আপনাদের সাহায্য করবে । আমি অতি অল্প সময়ে ও সংক্ষেপে সবার কাছে মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধঅপরাধ নিয়ে গোপন রাখা কিছু সত্যি ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র যে ইতিহাসটুকু আওয়ামীলীগ সবসময় গোপন রেখে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ পুরন করতে ব্যবহার করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে । মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল ও পরবর্তী ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনাগুলো সম্পর্কে আমাদের বর্তমান প্রজন্ম বেশ বিভ্রান্ত। আশাকরি আমার এই লিখাটি সব বিভ্রান্তি দূর করতে কিছুটা হলেও সাহায্য করবে। এই লিখাটিকে না বুঝে কেউ যদি আমাকে যুদ্ধঅপরাধী বিচারের বিরোধিতাকারী মনে করে থাকে তাহলে সেটা তাঁর একান্ত নিজের হীনমন্যতার ব্যাপার যা নিয়ে আমার কোন প্রতিক্রিয়া থাকবে না ।
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায় : ১৯৭০ সালে সাধারন নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামীলীগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর নেতৃত্বে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে নির্বাচনে বিজয়ী হয়। নির্বাচনে বিজয়ী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে একটু সংক্ষিপ্ত জেনে নিই -
শেখ মুজিবর রহমানের পরিচয় :
জন্ম : ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ রাত ৮ টায় গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম
পিতার নাম : শেখ লুৎফর রহমান
মাতার নাম : শায়েরা খাতুন
শিক্ষা : ১৯৪৭ সালে কোলকাতা থেকে বি. এ পাশ করে।
স্ত্রীর নাম : ফজিলাতুন্নেসা মুজিব
বঙ্গবন্ধু উপাধি লাভ : ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি মাসে।
রাজনৈতিক জীবন :
- ১৯৩৯ সালে ৮ম শ্রেণীতে পড়াকালে প্রথম ৭ দিনের কারাবাস।
- ১৯৪০ সালে গোপালগঞ্জ মহকুমা মুসলিম লীগের ডিফেন্স কমিটির সেক্রেটারী নির্বাচিত।
- ১৯৪৪ সালে ফরিদপুর ডিস্ট্রিক্ট এসোসিয়েশনের সেক্রেটারী নির্বাচিত।
- ১৯৪৬ সালে কোলকাতা ইসলামিয়া কলেজের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত।
- ১৯৪৮ মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
- ১৯৪৮ মাওলানা ভাসানীর সাথে ভুখা মিছিলে নেৃতত্বদান ও কারাবরন। ৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম।
জেলে থেকেই সহ-সম্পাদক নির্বাচিত।
- ১৯৫২ সালে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত।
- ১৯৫৫ সালে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত।
- ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য নির্বাচিত।
- ১৯৬৬ আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে নির্বাচিত।
- ১৯৬৮ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতার।
- ১৯৭০ জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ।
১৯৭০ সালের সাধারন নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে ১৬৭টি এবং প্রাদেশিক পরিষদে ২৮৮ আসন লাভ করে একক সংখ্যাগরিষ্ট দল হিসাবে আত্বপ্রকাশ করে।
নিয়মানুযায়ী আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাক শাসকগোষ্ঠী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের ভাবী প্রধান মন্ত্রী হিসাবে উল্লেখ করেন এবং ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে বলে ঘোষনা দেন।
কিন্তু তিনি শেখ মুজিবের সাথে কোনরূপ পরামর্শ না করেই তিনি ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। এতে বাঙালী ছাত্র জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ঘোষিত হল আর ছয় দফা নয় এবারে এক দফা আন্দোলন। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে গণ আন্দোলন গড়ে তোলা হয়।
১৯৭১ বা মুক্তিযুদ্ধের মুল পর্যায়: এবার সবাইকে মুক্তিযুদ্ধের মুল পর্যায়টি রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কাঠামোর সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরলাম।
১ মার্চ, ১৯৭১: ইয়াহিয়া ঘোষণা করেন পরবর্তী তারিখ ঘোষণা না করা পর্যন্ত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখা হলো। এ ঘোষণার প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ দেশব্যাপী ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ দেশব্যাপী হরতালের ডাক দেয়। পাশাপাশি ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় চূড়ান্ত কর্মসুচী ঘোষণা করা হবে বলে জানায়।
২ মার্চ ১৯৭১ : ঢাকায় শান্তিপূর্ণ হরতাল পালন। আওয়ামীলীগ পরবর্তী কর্মসূচী ঘোষণা করে।
৩ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ৬ টা থেকে দুপুর ২ টা পর্যন্ত সমগ্র বাংলাদেশে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। কারফিউ জারী হয় সন্ধা ৭ টা থেকে ভোর ৭টা।
৬ মার্চ ১৯৭১ : সর্বাত্বক অসহযোগ আন্দোলন। আন্দোলরত নজগণকে সমর্থন জানাতে সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীরা আন্দোরনে যোগ দেয়।
এছাড়াও এদিন জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে ইয়াহিয়া ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠানের নতুন তারিখ ঘোষণা করেন।
লে. জে. টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের নতুন গভর্নর নিয়োগ দেন।
৭ মার্চ ১৯৭১ : রেসকোর্স ময়দানে এক ঐতিহাসিক জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক নীতি নির্ধারনী ভাষণ দেন। যা স্বাধীনতার ইতিহাসে ৭ মার্চের ভাষন হিসাবে অনুপ্রানিত। রাতে আওয়ামী লীগ ১০ দফার ভিত্তিতে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়। টিক্কা খান ঢাকায় আসেন।
বিভিন্ন স্থানে বাঙালি অবাঙালি সংঘর্ষ ও সামরিক বাহিনীর গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে।
১৯৭১ সারের ৭ মার্চ রেকোর্স ময়দানে এক বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ভাষনের বিষয়বস্তু ছিল নিন্মোক্ত -
ক. তুলমান সামরিক আইন পত্যাহার
খ. সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া
গ. গণহত্যার তদন্ত করা
ঘ. নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা।
৯ মার্চ ১৯৭১ : মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী পল্টন ময়দানে ভাষন দেন। ‘ইয়াহিয়া কে তাই বলি, অনেক হইয়াছে আর নয়।
তিক্ততা বাড়াইয়া আর লাভ নেই।
‘লাকুম দিনুকুম আলিয়াদ্বীন’ এর তোমার ধর্ম তোমার আমার ধর্ম আমার) নিয়মে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার স্বীকার করে নাও। শেখ মুজিবের নিদের্শমত আগামী ২৫ তারিখের মধ্যে কোন কিছু করা না হলে আমি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে মিলিত হইয়া ১৯৫২ সালের ন্যায় তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলে। ভাষানী এদিন ১৪ দফা ঘোষণা করেন।
১৫ মার্চ ১৯৭১ : শেখ মুজিবের সঙ্গে বৈঠকের উদ্দেশ্যে ইয়াহিয়া ঢাকায় আসেন।
২৩ মার্চ ১৯৭১ : পাকিস্তানের জাতীয় দিবস আওয়ামী লীগ প্রতিরোধ দিবস হিসাবে পালন করেন।
ফলাফলবিহীন আলোচনা চলতে থাকে। সর্বত্র বাংলাদেশের নতুন জাতীয পাতাক উত্তোলিত হয়।
২৫ মার্চ ১৯৭১ : আলোচনা ভেঙে যায়। ইয়াহিয়া ও ভূট্টো গোপনে পাকিস্তান চলে যায়। যাবার আগে তারা গণ হত্যার নির্দেশ দিয়ে যান।
ইতোমধ্যে ব্যাপক পাকিস্তানি সৈন্যের সমাগম ঘটে। অপারেশন সার্চ লাইটের নামে নির্বিচারে গণহত্যা শুরু হয়। শেখ মুজিবকে বন্দি করে করাচি নিয়ে যায়।
২৬ মার্চ ১৯৭১ : চট্টগ্রামের কালুঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন মেজর জিয়াউর রহমান। ২৬ মার্চ বেতারে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন যেখানে তিনি বলেন -
“বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
প্রিয় দেশবাসী আমি মেজর জিয়া বলছি, মহান জাতীয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষনা করছি।
আপনারা দুশমনদের প্রতিহত করুন। দলে দলে এসে যোগ দিন স্বাধীনতা যুদ্ধে। গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, সোভিয়েট ইউনিয়ন, চীনসহ বিশ্বের সকল স্বাধীনতা প্রিয় দেশের উদ্দেশ্যে আমাদের আহ্বান আমাদের ন্যায় যুদ্ধে সমর্থন দিন এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিন। ইনশাআল্লাহ বিজয় আমাদের অবধারিত। “
এ ঘোষণা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং জনগন স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
এছাড়াও ৩০ মার্চ ১৯৭১ মেজর জিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে আ্ন্তর্জাতিক সমর্থন, সাহায্য ও স্বীকৃতি লাভের জন্য আরেকবার ইংরেজীতে ঘোষণা দেন যা ছিল - “ This is Shadhin Bangla Betar Kendro. I, Major Ziaur Rahman, on behalf of Bangobondhu Sheikh Mujibur Rahman, hereby declare that the independent People's Republic of Bangladesh has been established. I have taken command as the temporary Head of the Republic. I call upon all Bengalis to rise against the attack by the West Pakistani Army. We shall fight to the last to free our Motherland. By the grace of Allah, victory is ours.” ( সুত্র- মুক্তিযুদ্ধা কল্যাণ মন্ত্রনালয়, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রণীত গ্রন্থসমূহ)
প্রবাসী সরকার গঠন :
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল কুষ্টিয়ার মুজিব নগরে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি কর্তৃক আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র জারি করা হয়। এবং বাংলাদেশকে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করা হয়। ১০ এপ্রিলের ঘোষণা অনুযায়ী বাংাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়, যা ১৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করে।
মুক্তিযুদ্ধের গঠন কাঠামো :
প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম জি ওসমানী। যার তত্ত্বাবধানে ছিল দুটি বাহিনী।
অনিয়মিত বহিনী এফ এফ এবং নিয়মিত বাহিনী সৈনিক বৃন্দ এম এফ।
নিয়মিত বাহিনীর অধীনে ছিল বিমান বাহিনী, নৌবাহিনী, সেক্টর বাহিনী ১১টি এবং বিগ্রেট বাহিনী ৩টি। নিম্নে ১১ টি সেক্টর ও সেক্টর কমান্ডারদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরলাম।
পরিকল্পিত এই যুদ্ধ পরিচালনার জন্য ১০ই এপ্রিল '৭১ বাংলাদেশ সরকার সমগ্র বাংলাদেশকে ৪টি যুদ্ধঅঞ্চলে বিভক্ত করেন। এই ৪টি অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত অধিনায়ক ছিলেনঃ পরিকল্পিত এই যুদ্ধ পরিচালনার জন্য ১০ই এপ্রিল '৭১ বাংলাদেশ সরকার সমগ্র বাংলাদেশকে ৪টি যুদ্ধঅঞ্চলে বিভক্ত করেন।
এই ৪টি অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত অধিনায়ক ছিলেনঃ
ক) চট্টগ্রাম অঞ্চল - মেজর জিয়াউর রহমান
খ) কুমিল্লা অঞ্চল - মেজর খালেদ মোশাররফ
গ) সিলেট অঞ্চল - মেজর কে এম সফিউল্লাহ
ঘ) দক্ষিণ পশ্চিম - অঞ্চল মেজর আবু ওসমান চৌধুরী
-
সেক্টর সমূহ ও কমান্ডারগণ
সেক্টর নং ১ : ফেনী নদী হতে দক্ষিণাঞ্চলে চট্টগ্রাম কক্সবাজার পার্বত্য রাঙামাটি এবং ফেনী পর্যন্ত।
সেক্টর নম্বর ২ : নোয়াখালী কুমিল্লা, ঢাকা ও ফরিদপুর জেলার অংশ বিশেষ।
তিন নম্বর সেক্টর : হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ এবং কুমিল্লা ও ঢাকা জেলার অংশ বিশেষ
চার নম্বর সেক্টর : সিলেট জেলার অংশবিশেষ
পাঁচ নম্বর সেক্টর : সিলেট জেলার অংশ বিশেষ এবং বৃহত্তর ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী অঞ্চল।
ছয় নম্বর সেক্টর : রংপুর ও দিনাজপুরের ঠাকুরগাও মহাকুমা।
সাত নম্বর সেক্টর : কুষ্টিয়া(মুজিবনগর) যশোর এবং ফরিদপুর ও খুলনার অংশবিশেষ।
নয় নম্বর সেক্টর : খুলনা ও ফরিদপুর জেলার অংশ বিশেষ এবং বৃহত্তর ররিশাল ও ও পটুয়াখালী জেলা।
দশ নম্বর সেক্টর : এ সেক্টরের অধীনে ছিল নৌ কমান্ডার, সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল ও আভ্যন্তরীন নৌপরিবহন।
এগার নম্বর সেক্টর : কিশোরগঞ্জ ব্যতীত ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল
সেক্টর কমান্ডারগণ
এক নম্বর সেক্টর : মেজর জিয়াউর রহমান (এপ্রিল-জুন)
দুই নম্বর সেক্টর : মেজর খালেদ মোশাররফ (এপ্রিল- সেপ্টেম্বর)
মেজর হায়দার (সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর)
তিন নম্বর সেক্টর : মেজর শফিউল্লাহ (এপ্রিল- সেপ্টেম্বর)
মেজর নুরুজ্জামান (সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর)
চার নম্বর সেক্টর : মেজর সি আর দত্ত
পাঁচ নম্বর সেক্টর : মেজর মীর শওকত আলী
ছয় নম্বর সেক্টর : ইউং কমান্ডার বাশার
সাত নম্বর সেক্টর : মেজর কাজী নরুজ্জামান
আট নম্বর সেক্টর : মেজর ও সমান চৌধুরী (অক্টোবর পর্যন্ত
মেজর এম এ মনছুর
নয় নম্বর সেক্টর : মেজর আব্দুল জলিল (এপ্রিল- ডিসেম্বর) এ এ মঞ্জুর (অতিরিক্ত দায়িত্ব)
দশ নম্বর সেক্টর : মুক্তি বাহিনীর ট্রেনিং প্রাপ্ত নৌ কমান্ডারগণ যখন যে সেক্টরে কাজ করেছে সেই সেক্টরের কমান্ডারগণের নির্দেশ মোতাবেক করেছে।
এগার নম্বর সেক্টর : মেজর আবু তাহের (এপ্রিল-নভেম্বর), ফ্লাইট লে. এম হামিদুল্লাহ (নভেম্বর- ডিসেম্বর)
মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ। দেশের সর্বস্তরের মানুষ এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।
রাজনৈতিকভাবে এই যুদ্ধকে সার্বজনীন করার লক্ষ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার সর্বসম্মতিক্রমে একটি ''সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ'' গঠন করেন। এই উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেনঃ ক) জনাব আব্দুল হামিদ খান ভাসানী(সভাপতি, ন্যাপ, ভাসানী
খ) শ্রী মনি সিংসভাপতি বাংলাদেশ কমিউনিষ্ট পার্টি
গ) অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ (সভাপতি ন্যাপ মোজাফ্ফর)
ঘ) শ্রী মনোরঞ্জন ধর (সভাপতি বাংলাদেশ জাতীয় কংগ্রেস)
ঙ) জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ (প্রধানমন্ত্রী পদাধিকারবলে)
চ) খন্দকার মোশতাক আহমেদ (পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদাধিকারবলে)
মুক্তিবাহিনী সদর দপ্তরের প্রধান গন ঃ
ক) প্রধান সেনাপতি মুক্তিবাহিনী - কর্নেল এম এ জি ওসমানী
খ) সেনাবাহিনী প্রধান -কর্নেল আবদুর রব
গ) বিমানবাহিনী প্রধান ও উপ-সেনা প্রধান - গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার
ঘ) ডাইরেক্টর জেনারেল মেডিকেল সার্ভিস - মেজর শামছুল আলম
মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ। দেশের সর্বস্তরের মানুষ এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। রাজনৈতিকভাবে এই যুদ্ধকে সার্বজনীন করার লক্ষ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার সর্বসম্মতিক্রমে একটি ''সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ'' গঠন করেন। এই উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেনঃ ক) জনাব আব্দুল হামিদ খান ভাসানী(সভাপতি, ন্যাপ, ভাসানী
খ) শ্রী মনি সিংসভাপতি বাংলাদেশ কমিউনিষ্ট পার্টি
গ) অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ (সভাপতি ন্যাপ মোজাফ্ফর)
ঘ) শ্রী মনোরঞ্জন ধর (সভাপতি বাংলাদেশ জাতীয় কংগ্রেস)
ঙ) জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ (প্রধানমন্ত্রী পদাধিকারবলে)
চ) খন্দকার মোশতাক আহমেদ (পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদাধিকারবলে)
মুক্তিবাহিনী সদর দপ্তরের প্রধান গন ঃ
ক) প্রধান সেনাপতি মুক্তিবাহিনী - কর্নেল এম এ জি ওসমানী
খ) সেনাবাহিনী প্রধান -কর্নেল আবদুর রব
গ) বিমানবাহিনী প্রধান ও উপ-সেনা প্রধান - গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার
ঘ) ডাইরেক্টর জেনারেল মেডিকেল সার্ভিস - মেজর শামছুল আলম
ফ্লাইট লে. এম হামিদুল্লাহ (নভেম্বর- ডিসেম্বর)
এবার আসুন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া বাংলাদেশের সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ সম্পর্কে একটু জেনে নিই -
১. সিপাহী মোস্তফা কামাল ঃ জন্ম : ১৬ ডিসেম্বর ১৯৪৭
জন্মস্থান : ভোলা জেলার দৌলত থানার পশ্চিম হাজিপুর গ্রামে।
পিতার নাম : হাবিবুর রহমান মন্ডল
মৃত্যু : ৮ এপ্রিল, ১৯৭১
যেভাবে শহীদ হন : ১৯৭১ সারের ৮ এপ্রিল আখাউড়ার দক্ষিনে উত্তর দরুইন গ্রামে বর্বর পাকিস্তানী বাহিনীর হামলায় নিহত হন। তিনি সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন।
২. ল্যান্স নায়েক মুন্সী আব্দুর রব
জন্ম : মে মাস ১৯৪৩ সাল।
জন্ম স্থান : ফরিদপুর জেলার বোয়াল খালী থানার সালমেতপুর গ্রামে।
পিতার নাম : মুন্সী মেহেদী হাসান।
মাতার নাম : মোছা. মুকিদুন্নেসা
মৃত্যু ২০ এপ্রিল
যেভাবে শহীদ হন : রাঙামাটি ও মঙলাচড়ি সংযোগ গ্রাম বুড়িমাট এলাকায় চিংড়ি খানের দু পাশে নির্মিত প্রতিরক্ষা বুহ্য অক্ষুণœ রাখতে শহীদান। তিনি বাংলাদেশ রাইফেলস এর সদস্য ছিলেন।
৩. ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান
জন্ম : ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৪
জন্ম স্থান : লক্ষীপুর জেলার রায়পুরা থানার রামনগর গ্রামে।
পিতার নাম : আব্দুস সামাদ
মৃত্যু : ২০ আগস্ট
যেভাবে শহীদ হন : স্বাধীনতার যুদ্ধ চলাকারীন তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত ছিলেন। যুদ্ধ শুরু হবার পর তিনি দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের বিমান সমর্থন দেবার চিন্তা করতে থাকেন।
সুযোগ বুঝে পকিস্থান বিমান বাহিনীর মসরুর মাটি থেকে একটি টি-৩৩ জঙ্গী বিমান ছিনিয়ে নেন এবং বাংলাদেশের পথে রওনা হন। কিন্তু সিন্ধু প্রদেশের মরু অঞ্চলে বিমানটি বিদ্ধস্ত হলে তিনি শহীদ হন।
৪. ল্যান্স নায়েক নুর মোহাম্দ
জন্ম : ২৬ এপ্রিল ১৯৩৬
জন্মস্থান : নড়াইল জেলার মহেশপুর গ্রামে পিতার নাম : মোহাম্মদ আমানত শেখ
মাতার নাম : মোছা জ্নানাত বেগম
মৃত্যু ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
যেভাবে শহীদ হন : ৮ নম্বর সেক্টরে স্থায়ী টহলে নিয়োজিত থাকার সময় ১৯৭১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক ত্রিমুখী আক্রমনের মুখে পড়েন। সঙ্গীদের বাঁচাতে গিয়ে একাকী পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সঙ্গীর পালাতে সহায়তা করেন এবং শহীদ হন। তিনি বাংলাদেশ রাইফেলস এর সদস্য ছিলেন।
৫. সিপাহী হামিদুর রহমান
জন্ম : ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩
জন্মস্থান : ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর থানার ঘোরদা খালিশপুর গ্রামে।
পিতার নাম : আব্বাস আলী
মাতার নাম : কায়সুন নেসা
মৃত্যু : ২৮ অক্টোবর, ১৯৭১
যেভাবে শহীদ হন : ১৯৭১ সালের ৭ অক্টোবর সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। যুদ্ধ শুরু হলে ১ দিনের জন্য তিনি নামের সাথে দেখা করতে আসেন। ফিরে গিয়ে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের ধলাইতে যুদ্ধ করেন এবং পাক হানাদার বাহিনীর সাথে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে শহীদ হন। তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন।
৬. ইঞ্জিন রুম আর্টিফিসার মোহাম্মদ রুহুল আমিন
জন্ম : ১৯৩৪ সাল
জন্মস্থান : নোয়াখলী জেলার বাগপাঁচড়া গ্রামে।
পিতার নাম : মোহাম্মদ আজহার মিয়া
মাতার নাম : জুলেখা খাতুন
মৃত্যু : ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১
যেভাবে শহীদ হন : বি এস প্রান্তরে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে যুদ্ধকালীন সময়ে ভুলক্রমে ভারতীয় বিমান বাহিনীর মুখে পড়েন। গুলির কারনে জাহাজে আগুন ধরে জাহাজের গোলবারুদ ফুটতে শুরু করলে তিনি নদীতে ঝাপ দেন। উপকুল এলাকায় পড়ে রাজাকারদের হাত বুলেটবিদ্ধ হন এবং ধরা পড়েন পরে শহীদ হন। তিনি নৌবাহিনীর সদস্য ছিলেন।
৭. ক্যাপ্টেন মহিউদ্দন জাহাঙ্গীর
জন্ম : ১৯৪৭ সালে
জন্মস্থান : বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ থানার রহিমগঞ্জ গ্রামে।
মৃত্যু : ১৪ ডিসেম্বর
সদস্য: তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন।
বীরশ্রেষ্ঠদের মধ্যে প্রথম শহীদ হন সিপাহী মোস্তফা কামাল এবং সর্বশেষ শহীদ হন ক্যাপ্নেট মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর।
পাকিস্তানী দখলদার বাহিনী ও তার সহযোগীরাঃ
বাংলাদেশে অবস্থিত পাকিস্তান সেনাবাহিনী একটি দখলদার বাহিনীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। দেশকে শত্রুমুক্ত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার এক সশস্ত্র যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।
সমগ্র জাতিকে একত্রিত করে বিদেশী বন্ধু ও সহযোগী রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় ১৬ ডিসেম্বর '৭১ বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয়।
বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করার এই সশস্ত্র অধ্যায়ে উল্লেখযোগ্য কিছু রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, সামরিক বেসামরিক কর্মকর্তা, ছাত্র ও যুব সংগঠনের নেতৃবৃন্দ পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর সহযোগী হয়ে মুক্তিকামী মানুষের উপর জঘন্য এবং পৈশাচিক অত্যাচার ও হত্যাকান্ড চালায়। এই নির্মম ও নিষ্ঠুর অত্যাচারে শহীদ হয় ৩০ লক্ষ নিরীহ নিরাপরাধ শিশু-কিশোরসহ সর্বস্তরের মানুষ। শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয় ২ লক্ষ ৫০ হাজারের অধিক বাংলার নারী। দেশ ছাড়তে বাধ্য হয় প্রায় এক কোটি মানুষ।
সকলের একটি মাত্র অপরাধ ''তারা ছিল বাঙালি''। পাকিস্তানের সামরিক শাসকের দাম্ভিক উক্তি '' আমি মানুষ চাইনা- পূর্ব বাংলার মাটি চাই''। এই পোড়া মাটির নীতিকে সমর্থন দিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি বা সংগঠন এগিয়ে আসে।
শান্তি কমিটিঃ ৪ঠা এপ্রিল '৭১ জনাব নুরুল আমিনের নেতৃত্বে অধ্যাপক গোলাম আযম ও খাজা খয়েরউদ্দীন টিক্কা খানের সাথে সাক্ষাৎ করে সর্বপ্রকার রাজনৈতিক সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করেন এবং ''নাগরিক কমিটি'' গঠনের প্রস্তাব পেশ করেন। ৬ই এপ্রিল '৭১ অধ্যাপক গোলাম আযম ও হামিদুল হক চৌধুরী টিক্কা খানের সাথে সাক্ষাৎ করে ''নাগরিক শান্তি কমিটি'' গঠনের প্রস্তাব দেন।
৯ই এপ্রিল '৭১ ঢাকায় ১৪০ সদস্য নিয়ে ''নাগরিক শান্তি কমিটি'' গঠিত হয়। ১৭ই এপ্রিল '৭১ এই কমিটির নাম পরিবর্তন করে ''শান্তি কমিটি'' রাখা হয় এবং জেলা ও মহকুমা পর্যায়ে এই কমিটি গঠিত হয়। রাজাকার নির্বাচন, নিয়োগ ও নিয়ন্ত্রণ এই কমিটির অন্যতম দায়িত্ব ছিল।
রাজাকার বাহিনীঃ মে '৭১ মওলানা এ কে এম ইউসুফের নেতৃত্বে ৯৬ জন জামায়াত কর্মী নিয়ে খুলনার আনসার ক্যাম্পে এই বাহিনী গঠিত হয়। তিনি এই বাহিনীর নামকরণ করেন ''রাজাকার বাহিনী''।
এই বাহিনীর মোট সদস্য সংখ্যা ছিল ৫০,০০০ (পঞ্চাশ) হাজার। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান সহযোগী হিসাবে এই বাহিনী দায়িত্ব পালন করে। বিশেষ করে গ্রাম অঞ্চলে এই বাহিনীর অত্যাচারের চিহ্ন আজো বিদ্যমান।
আলবদর বাহিনীঃ ১৯৭১ এর আগস্ট মাসে ময়মনসিংহে এই বাহিনী গঠিত হয়। সম্পূর্ণ ধর্মীয় আদর্শের উপর ভিত্তি করে এই বাহিনীর গঠন ও কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী বিশেষ ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে এই বাহিনীকে ব্যবহার করা হয়। এই বাহিনীর কার্যকলাপের মধ্যে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ড অন্যতম। মিরপুর বধ্যভূমি এই বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের সাক্ষ্য বহন করে। ( আগামী লিখায় মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তি উল্লেখিত বাহিনী সহ পাকবাহিনীর কর্মকাণ্ড নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরবো) । রাজাকার বাহিনী পাকিস্থানী আর্মির সরাসরি তত্বাতধানে নিয়োগপ্রাপ্ত, বেতনধারী একটা বাহিনী হিসেবে কাজ করত।
পাকিস্থানী আর্মি মাইকিং করে, পেপারে দিয়ে রাজাকার বাহিনীতে লোক নিয়োগ করেছিল। হাজার হাজার বাঙ্গালী গরীব মানুষ লাইন দিয়ে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। এ রাজাকার বাহিনী জামায়াতে ইসলামী তৈরী করেনি এবং এ বাহিনীতে জামায়াতের কোন লোকও যোগ দেয়নি। এ রাজাকারদের মধ্যে থেকে স্বাধীনতার পর দালাল আইনে যাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছিল তাঁদের ডাটা নিলেই ব্যাপারটা খোলাসা হয়ে যাবে।
বিজয়ের পরিকল্পনা- সম্মিলিত চুড়ান্ত আক্রমণঃ অক্টোবর '৭১ মাসের মধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে সমস্ত সীমান্ত এলাকা ছেড়ে দিয়ে সেনানিবাস অথবা বড় বড় শহর ভিত্তিক অবস্থান নিতে বাধ্য হয়।
এই সময়ের মধ্যে মুক্তিবাহিনী বাংলাদেশের প্রায় ৮০ ভাগ এলাকা মুক্ত করেছিল। নভেম্বর '৭১ এর প্রথম দিকে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত হয় সম্মিলিত বাহিনী। এই পর্যায়ে বাংলাদেশের সমগ্র যুদ্ধ এলাকাকে ৪ ভাগে বিভক্ত করে এই যৌথ কমান্ডের নেতৃত্বে সমস্ত সৈন্যবাহিনীকে সমন্বিত করে যুদ্ধ পরিকল্পনা গড়ে তোলা হয়। ৩রা ডিসেম্বর '৭১ পাকিস্তান অতর্কিতভাবে ভারত আক্রমণ করলে যুদ্ধের মোড় পরিবর্তিত হয়। ৬ই ডিসেম্বর '৭১ ভারত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে মুক্তিবাহিনীর মনোবল বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়।
এই পর্যায়ে সমন্বিত এক যুদ্ধ পরিকল্পনায় সম্মিলিত বাহিনী প্রচন্ড বেগে অগ্রসর হয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পর্যুদস্ত করে।
এই চূড়ান্ত যুদ্ধে ভারতীয় ইষ্টার্ণ কমান্ড অংশ গ্রহণ করে। তাদের সদর দপ্তর ছিল কলকাতাস্থ ফোর্ট উইলিয়ামে এবং অধিনায়ক ছিলেন লেঃ জেনারেল জগজিত সিং অরোরা। এই যুদ্ধে ভারতীয়দের তিনটি কোর (৭ টি ডিভিশন), একটি কমুইনিকেশন জোন, একটি প্যারা বিগ্রেড, ৩টি বিগ্রেড গ্রুপ, ১২টি মিডিয়াম রেজিমেন্ট আর্টিলারী, ৪৮ টি ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারী, ১টি আরমার্ড রেজিমেন্ট, ২টি ইন্ডিপেন্ডেন্ট আরমার্ড বিগ্রেড, ৩টি ইঞ্জিনিয়ার বিগ্রেড, ২৯ টি বিএসএফ ব্যাটালিয়ান অংশ গ্রহণ করেন। এই যুদ্ধে ভারতীয়দের শহীদদের সংখ্যা ৬৯ জন অফিসার, ৬০ জন জেসিও ৩ জন এনসিও ও ১২৯০ জন সৈনিক।
আহত হন ২১১ জন অফিসার, ১৬০ জন জেসিও, ১১ জন এনসিও এবং ৩৬৭৬ সৈনিক। এছাড়াও যুদ্ধে মিসিং হন ৩ জন জেসিও ও ৫৩ জন সৈনিক।
১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বহু বুদ্ধিজীবিদের পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের দোসররা পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করে। ১৬ই ডিসেম্বর '৭১ বিকাল ৪টা ৩০ মিনিটে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ৯৩ হাজার সৈন্য বিনা শর্তে সম্মিলিত বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এই আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন পূর্বাঞ্চলের সম্মিলিত বাহিনী প্রধান লেঃ জেনারেল জগজিত সিং অরোরা ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় অধিনায়ক লেঃ জেঃ এ কে নিয়াজী।
এই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন মুক্তিবাহিনীর উপ-সেনা প্রধান ও বিমান বাহিনী প্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার। এই অনুষ্ঠানে মুক্তিবাহিনীর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে আরও উপস্থিত ছিলেন এস ফোর্স অধিনায়ক লেঃ কর্নেল কে এম সফিউল্লাহ, ২নং সেক্টরের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মেজর এ টি এম হায়দার এবং টাঙ্গাইল মুক্তি বাহিনীর অধিনায়ক জনাব কাদের সিদ্দিকী। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকায় ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণের দলিলে সই করেন পাকিস্তানের জেনারেল নিয়াজী এবং ভারতের জেনারেল অরোরা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীকে ভারতীয় বাহিনী ঐ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দেয়নি।
এরপর পরাজিত পাকিস্থানি সেনাদের ভারত তাদের দেশে নিয়ে যায়। এ ব্যাপারে ভারত যুক্তি দেখিয়েছিল, পাকিস্থানী বাহিনী বাংলাদেশের কাছে আত্মসমর্পন করেনি, করেছে ভারতের কাছে। তাই ভারত পাকিস্থানী সকল যুদ্ধবন্ধীকে তাদের দেশে নিয়ে যায়। পরে বাংলাদেশ সরকার ব্যাপকভাবে পর্যালোচনা করে ঐ ৯৩হাজার পাকিস্থানী সৈন্যের মধ্যে থেকে সবশেষে ১৯৫জনকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং তাদের বিচারের দাবী জানান।
এই হলো মুক্তিযুদ্ধের সংক্ষিপ্ত মুল ও সর্বজনস্বীকৃত ইতিহাস যেখানে কোন দল/ গোষ্ঠীকে বড় বা ছোট করা হয়নি ।
যার যে অবদান সেটা স্বীকার করার মধ্য কোন লজ্জা , মহত্ত্ব কিছুই নেই বরং ইতিহাসকে সঠিকভাবে রাখাটাই হলো মহত্ত্ব ।
যুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশ ও যুদ্ধঅপরাধ বিচারের ইস্যু ঃ
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরলেন ১০ জানুয়ারী ১৯৭২ সালে। ওইদিন বিকেলে রেসকোর্স ময়দানের সমাবেশে তিনি যুদ্ধবন্দী ও স্বাধীনতা বিরোধীতাকারীদের বিচারের ঘোষণা দেন - “১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন এবং শপথ গ্রহণের পরই তিনি বলেন, ‘লোমহর্ষক হত্যাকান্ডের কাহিনী আমি শুনেছি। তবুও বাংলার মানুষ এত নিচে নামবে না। বরং যা মানবিক তাই করবে।
তবে অপরাধীদের আইনানুগ ব্যবস্থা করবে। “
১৯৭৩ সালের ১৭ এপ্রিলে যুদ্ধাপরাধীদের চিহ্নিত করা ও বিচার সংক্রান্ত সরকারের ঘোষণায় বলা হয়েছিল, “Investigations into the crimes committed by the Pakistan occupation forces and their auxiliaries are almost complete. Upon the evidence, it has been decided to try 195 persons of serious crimes, which include genocide, war crime, crimes against humanity, breaches of Article-3 of the Geneva Conventions, murder, rape and arson.” অর্থাৎ পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ১৯৫ জন সেনা কর্মকর্তা যারা ভারতের কারাগারে আটক অবস্থায় ছিলেন তাদেরকেই ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সংঘটিত অপরাধের মুল অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ।
১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারী দালাল আইন জারী করা হয়। এ আইনের অধীনে প্রায় ১লাখ লোককে আটক করা হয়। এদের মধ্যে থেকে অভিযোগ আনা সম্ভব হয় ৩৭৪৭১ জনের বিরুদ্ধে।
বাকীদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ না থাকায় ছেড়ে দেয়া হয়। অভিযুক্ত ৩৭৪৭১ জনের মধ্যে থেকে দালালীর কোন প্রকার প্রমাণ না পাওয়ায় ৩৪৬২৩ জনের বিরুদ্ধে কোন মামলাই দায়ের করা সম্ভব হয়নি। বাকী যে ২৮৪৮জনের বিচার হয় তাদের মধ্যে বিচারে মাত্র ৭৫২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমানিত হয়। বাকী ২০৯৬জন বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। যে ৭৫২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমানিত হয় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগও গুরুদন্ড দেয়ার মত ছিল না।
শুধুমাত্র চিকন আলী নামের একজনের ফাঁসির আদেশ হয়। ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর শেখ মুজিব কতৃক যখন সাধারণ ভাবে মাফ করার ঘোষণা আসে তখন একমাত্র চিকন আলী ছাড়া সকলেই মুক্ত নাগরিক হিসেবে বেরিয়ে আসে। সেই চিকন আলীও দন্ড বাস্তবায়ন হওয়ার আগেই মারা যান (তথ্য সুত্রঃ ‘একাত্তরের ঘাতক দালালরা কে কোথায়’)।
১৯৭৩ সালের ৮ জুন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এক সাক্ষাৎকারে জানান, ‘ইতিপূর্বে তালিকাভুক্ত পাক যুদ্ধাপরাধীদের সংখ্যা ১২০০ থেকে কমে ১৯৫ জন হয়েছে। এই ১৯৫ জন পাক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই।
’ কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে পাক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অবশেষে হয়নি। কারন ১৯৭২ সালের ২ জুলাই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ঐতিহাসিক চুক্তি হয়, যা ‘সিমলা চুক্তি’ নামে পরিচিত। পাকিস্থান ও ভারতের মধ্যে বিবদমান সমস্যাগুলোর সমাধান করে দু’দেশের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্যই এ চুক্তি সই হয়। বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু এ চুক্তির প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন।
‘ সিমলা চুক্তি’র স্বীকৃতি ও বাস্তবায়ন ঃ ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পরপরই ১৯৭২ সালে ভারত- পাকিস্তানের মধ্যে সিমলা চুক্তি স্বাক্ষর হয় এবং চুক্তিতে দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এবং সম্প্রীতি স্থাপনে সব ধরণের প্রতিশ্রুতির কথা ব্যক্ত করা হয় উভয় দেশের পক্ষ থেকে।
চুক্তি স্বাক্ষর করেন ভারতের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী এবং পাকিস্তানের পক্ষে জুলফিকার আলী ভুট্টো। এতে পরিষ্কার করে বলা হয়: "The agreement also paved the way for diplomatic recognition of Bangladesh by Pakistan. As a gesture of goodwill India decided not to try 93,000 (80,000 military-paramilitary and police forces and 13,000 civilians!) Pakistan prisoners of war crimes and released them." (Simla Agreement between India and Pakistan, Embassy of India, Washington, DC: Wikipedia, the Free Encyclopedia).
১৯৭৩ সালের ১৭ এপ্রিল পাকিস্থানের সাথে বাংলাদেশ ও ভারতের সিমলা চুক্তির আলোকে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ-ভারত এবং ভারত-পাকিস্তানের কয়েক দফা আলোচনার পর বাংলাদেশ বিষয়ে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে ২৮ আগস্ট ১৯৭৩ সালে দিল্লিতে এক চুক্তি হয়। এ চুক্তির মাধ্যমেই বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান ত্রিদেশীয় নাগরিক বিনিময় কার্যক্রম শুরু হয় ১৯ সেপেম্বর ১৯৭৩ থেকে। এতে করে প্রায় ৩ লাখ নাগরিক নিজ নিজ দেশে ফিরে আসে।
‘সিমলা চুক্তি’ তে উপ-মহাদেশে শান্তি ও স্থিতি প্রতিষ্ঠা এবং শক্তির বদলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সকল সমস্যা সমাধানের অঙ্গীকার ব্যক্ত হয় কিন্তু তার কোনটিই বাস্তবায়ন সম্ভব হয়না বাংলাদেশকেন্দ্রিক যুদ্ধউত্তর সমস্যার সমাধান না হওয়ায় । যুদ্ধউত্তর সমস্যার সমাধান এবং তা নিয়ে তিন দেশের মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি নিরসনে ১৯৭২ সাল থেকে দফায় দফায় আলোচনাসহ নানামুখী উদ্যোগ নেয়া হয় এবং সবশেষে তা পূর্ণতা পায় ১৯৭৪ সালের ত্রিদেশীয় চুক্তির মাধ্যমে। চুক্তিটি স্বাক্ষরের পর দিল্লী, ইসলামাবাদ এবং ঢাকা থেকে তা একযোগে প্রকাশ করা হয়। ১৬ দফার সেই চুক্তিটি এখানে তুলে ধরা হল।
(১) ১৯৭২ সালের ২ জুলাই ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের মধ্যে ঐতিহাসিক সিমলা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
উপমহাদেশে শান্তি এবং সমৃদ্ধির লক্ষ্যে দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান দ্বন্দ্ব সংঘাতের অবসান ঘটিয়ে পারষ্পরিক বন্ধুত্ব এবং সম্প্রীতি জোরদার করার লক্ষ্য নিয়ে এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হল। এছাড়া এই চুক্তির মাধ্যমে ভবিষ্যতে দুই দেশের মধ্যে যেকোন বিবদমান বিষয়ে শান্তিপূর্ণ উপায়ে পারষ্পরিক তথা দ্বিপাক্ষিক আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা হবে।
(২) বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সিমলা চুক্তিকে স্বাগত জানানো হয়েছে। উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তির লক্ষ্যে প্রতিবেশী দেশদুটির মধ্যে স।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।