কাজের ব্যস্ততায় মাঝে মাঝে দিন রাত্রি কিভাবে পার হয়ে যাচ্ছে ভেবেই পাচ্ছিনা । গত দুই সপ্তাহ ধরে একটা প্রজেক্টের কাজে আমাকে এত বেশী সময় দিতে হচ্ছে যে অন্য কোনো দিকে তাকনোরও সময় পাইনি । আজকে কাজটা complete করে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত নয়টা বেজে গেল। গাড়িটা পার্ক করছি, এমন সময় দেখি, আমার ল্যান্ডলেডী উপর থেকে আমাকে ডাকছেন। উনি নিউইর্য়ক থেকে ফেরার পর আর আমার সাথে দেখাই হয়নি ।
দোতলায় উঠে দেখি, উনি দুজনের জন্য প্লেট সাজাচ্ছেন। আমাকে বল্লেন, কয়েকদিন ধরে দেখছি,তুমি অনেক দেরী করে বাসায় ফিরো, কাজের খুব ব্যস্ততা যাচ্ছে বুঝি? আমি মাথা নেড়ে সায় জানাতেই উনি বল্লেন, খাওয়া-দাওয়ারও যে খুব অনিয়ম করছো তা তোমার শুকনো মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। বসো, রাতের খাবার খেয়ে যাও। আমি বসে পড়লাম । খেতে খেতে উনি বল্ লেন, তোমার কাজিন এর মাঝে দুইদিন তোমার খোঁজ করে গেছে, ওর সাথে পরে তোমার কথা হয়েছে তো ? আমার কাজিন? আমার কাজিন আবার কোথায় থেকে আসলো? পরক্ষণেই বুঝলাম, উনি নিলয় এর কথা বলছেন।
নিলয় কি তাহলে উনার কাছে আমার কাজিন বলে পরিচয় দিয়েছে? আমি আর ওই বিষয়ে কোন কথা না বলে ওখান থেকে চলে আসলাম ।
February মাসের প্রথম সপ্তাহের এক রৌদ্রজ্বল দিনে আমরা Arlington এর নতুন বাসায় উঠলাম। মিসেস এন্ডারসন আসার সময় বাঙ্গালী মা দের মতো আমাকে জড়িয়ে ধরে এমন আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন, যে আমি রীতিমতো অস্বস্তিবোধ করতে লাগলাম । যেকোনো দেশ হোক না কেন, মাতৃসূলভ আবেগের ধরন আসলে একই রকম। উনি চোখের পানি মুছতে মুছতে বললেন, মাঝে মাঝে এসে দেখা করে যেও ।
Arlington এর বাসাটা ডুপ্লেক্স টাইপের । নিচতলায় ঢুকেই একটা বড় লিভিং রুম । সাথে কিচেন । একদিকে একটা বেডরুম , আরেকদিকে মাঝারি সাইজের গেস্টরুম । লিভিং রুমের মাঝে দিয়ে দোতলা যাওয়ার সিঁড়ি, উপরে বড় একটা বড় বেডরুম , যার সাথে ঝুলন্ত বারান্দা আছে।
বাসার পেছন সাইডে প্রশস্ত লন, একপাশ দিয়ে নুড়ি বিছানো পথ,ওই টা দিয়ে সামান্য এগিয়ে ছোট্ট একটা গেট পার হলে লেকের দিকে যাওয়া যায়। লনটা দেখে আমার প্রথমেই মনে হয়েছিল, এইখানটায় কিছু সুন্দর দেখে ফুলের চারা লাগাতে হবে।
বাসায় জিনিসপত্রগুলো গোছাতে গোছাতে আমি নিলয়কে বললাম, আমি কিন্তু লিভিং রুমের পাশে বামদিকের বেডরুমটাতে থাকবো। নিলয় তখন সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, আর আমি ? আমি বললাম, নিচতলা -দোতলা মিলিয়ে আরও তিনটা বেডরুম আছে, তুমি যেকোন একটায় থাকতে পারো, তাইনা ? ও বেশ নিরাশ ভঙ্গিতে বললো, তাহলে কি আর করা...আমি নিচতলার অন্যদিকের রুমটায় থাকবো। অথচ আমি আলাদা রুমে থাকবো- এই শর্তেই আমি এই বাসা বুকিং দিতে রাজী হয়েছিলাম...!
Arlington এ এসে আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় বেশকিছুটা পরিবর্তন এসেছে।
প্রতিদিন সকালে উঠে দ্রুত নাস্তা করে দুইজনে বের হয়ে যাই আমার গাড়ি নিয়ে। আমি ওকে drop করে চলে যাই আমার office এ। সন্ধায় আবার ওকে নিয়ে একসঙ্গে বাসায় ফিরি। আগে শুধু weekend এই রান্না করতাম, এখন দুজনে মিলে প্রায়দিনই টুকটাক রান্না করি। weekend এ বাসার পেছনের লনে গাছ লাগানো, গাছের যত্ন নেওয়া হয়, কখনও লেকসাইডে ঘুরাঘুরি করা হয়।
রাতে খাওয়া-দাওয়ার পরে টিভি দেখার ফাঁকে ফাঁকে অনেক গল্প করা হয়। আমরা পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণ করি, নিলয় ওর জাপানে থাকাকালীন সময়ের কথা শোনায়। আমি বলি, আমেরিকায় আমার ভ্রাম্যমান জীবনের কথা। আর আমাদের common interest- ফটোগ্রাফী নিয়ে আলোচনা- সমালোচনা তো সমান তালেই চলে। মাঝে মাঝে ভাবি, আমার একাকী জীবন যেন পূর্ণতা পেয়েছে এইখানে থাকতে গিয়ে।
যদিও দুইজনের কেউই এখন পর্যন্ত physical need নিয়ে কোন কথা তুলিনি বা ওই বিষয় নিয়ে আগায়ওনি। বিষয়টা সময়ের উপরেই ছেড়ে দিয়েছি । একসঙ্গে থাকায় দুজনের মনের যে চাহিদা পূরণ হচ্ছে, তা বোধহয় আমাদের উভয়েরই বড় প্রয়োজন ছিল জীবনের এই প্রান্তে এসে দাঁড়িয়ে...।
আজকে আমাকে অফিসের কাজে নিউইর্য়কে যেতে হবে। সন্ধা ছয়টার ফ্লাইট।
তাইতো তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরে লাগেজ প্যাকিং করছি, পুরো এক উইকের tour। যাওয়ার আগে নিলয়ের সাথে দেখা হবেনা , কেননা ওর ফিরতে ফিরতে সাড়ে ছয়টা বেজেই যাবে । আমাকে এত travel করতে হয়, যে লাগেজ প্যাকিং করতে বেশী সময় লাগলো না। ফোন করে Taxi Cab ডাকলাম, দরজা লক করে ক্যাবে উঠছি, মনের মধ্যে একটা ফিলিং হচ্ছে...কেন জানি মনে হচ্ছে কি যেন ফেলে যাচ্ছি। এরকমটা আমার কখনও হয়না ।
আজকে এমনটা হচ্ছে কেন ?
নিউইর্য়কে পৌছে hotel এ চেক ইন করে লাগেজ রুমে রাখলাম। তারপর রাতের খাবার জন্য নিচে নামছি, লবিতে এক পুরোনো কলিগ Sam এর সাথে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল। সে জোর করে আমাকে বাইরে নিয়ে গেল ডিনার খাওয়াতে । ও এখন Texas এ থাকে। আমার মতো সে ও একই কাজে এখানে এসেছে ।
আমরা একসাথে ডিনার করতে করতে পুরোনো দিনের কথা মনে করছিলাম । Sam আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, তুমি কি এখনো একাই আছো ? আমি সরাসরি উত্তর না দিয়ে হাসলাম, ও হয়তো সেটাকে হ্যাঁ বাচক ধরে নিয়ে বললো, আমি বিয়ে করেছি দুইবছর হলো, আমাদের ছয়মাসের একটা মেয়ে আছে । জানো, আমার wife এর একটা বিষয়ে তোমার সাথে দারুণ মিল আছে । ওকে পছন্দ করার এটা একটা কারণ। আমি মুখ নিচু করে ফেললাম ।
একসময় Sam আমার প্রতি বেশ দূর্বল ছিল, আমি কখনও পাত্তা দিতাম না । আজ ওর সুখী জীবনের কথা বলায় মনের মধ্যে কি যেন খচখচ করে উঠল, একেই কি ইর্ষাবোধ বলে ? আমি বললাম, চলো hotel এ ফিরতে হবে, কাল সকাল থেকেই workshop শুরু । আমি সকাল সকাল উঠতে চাই । এরপর আমরা hotel এ ফিরে আসলাম । ঘুমাতে যাবো, এইসময়ে এল নিলয়ের ফোন ।
ওর গলাটা শুনে কি যে শান্তি লাগল...!! দু-চারটা কথা বলে ফোনটা রেখে চলে গেলাম ঘুমাতে ।
নিউইর্য়কে আজকে আমার পঞ্চম দিন । আর দুইদিন পরেই Boston এ ফিরবো । এই কয়েকদিন টানা ব্যস্ত ছিলাম workshop নিয়ে । আজ বিকালে off আছে, ভাবছি একটু ঘুরে আসবো ।
আজকের weather টাও চমৎকার । দেরী না করে বেরিয়ে পড়লাম ক্যামেরা নিয়ে । একটা ক্যাব নিয়ে চলে এলাম Manhattan এর Hudson river greenway তে । এখানে এসে হাডসন নদীর পাশে সরু রাস্তা ধরে হাঁটলাম কিছুক্ষণ, সেইসাথে কিছু ছবিও তোলা হলো । আগে যতবার নিউইর্য়কে এসেছি, এইদিকটাতে কখনও আসা হয়নি ।
দূরে George Washington Bridge চোখে পড়ছে, লোকজন বাইসাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে, কেউ কেউ হাঁটতে বের হয়েছে । বেশ ঠান্ডা অথচ মৃদু বাতাস বইছে , সূর্যটা পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ার সাথে সাথে একটা লালচে হলুদ আভায় চারদিক কেমন জানি স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে । Greenwary Park এর একটা বেঞ্চ এ আমি আরও কিছুক্ষণ বসে রইলাম সন্ধা পর্যন্ত । সন্ধার আলো মিলিয়ে যাবার পরে উঠে পড়লাম ওইখান থেকে । যদিও বসে থাকতেই বেশ ভাল লাগছিল ।
সাতদিনের ট্যুর শেষে মঙ্গলবার বিকালের ফ্লাইটে Boston এ ফিরলাম । Airport থেকে বাসায় আসতে আসতে ট্রাফিক এর কারণে আরও এক ঘন্টা লেগে গেল । বাসার সামনে এসে Driveway তে ঢুকছি, দেখি একটা Chevrolet Impala গাড়ি দাঁড়ানো, সামনে থেকে নিলয় বের হয়ে আসলো, তারপর দেখি ড্রাইভিং সিট থেকে সোনালী চুলের একটা মেয়ে ও বের হলো, মেয়েটা নিলয়কে ঘনিষ্টভাবে জড়িয়ে ধরে গালে একটা চুমু দিল, পরে কিছু কথা বলে গাড়িতে ফিরে গেল । নিলয় হাত নাড়িয়ে বিদায় জানাতেই মেয়েটা ওর গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেল । দৃশ্যটা দেখে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম, আমি আসলে চিন্তা ও করতে পারছি না কারও সাথে ওর এরকম ঘনিষ্টতা থাকতে পারে , আমার বুকের ভেতরটা তীব্রভাবে মোচড় দিয়ে উঠলো…. আমি কি তাহলে নিলয়কে পুরোপুরি পাওয়ার আগেই আবার হারিয়ে ফেললাম ? আমি তো এই আশংকায়ই প্রথম দেখা হওয়ার পরে ওর কাছাকাছি আসতেই চাইনি... !! নতুন করে কষ্ট পাওয়াই আমার অদৃষ্টে লেখা আছে- মনকে এ প্রবোধ দিয়ে লাগেজ নিয়ে আমি ধীর পায়ে বাসার দিকে এগিয়ে গেলাম ।
চলবে...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।