আমি Somerville এর যে এপার্টমেন্টে থাকি, ওটাতে একটা বড় রুম, একটা বারান্দা আর একটা বাথরুম। বড় রুমের এক সাইডে ছোট্ট একটু পার্টিশান দেওয়া কিচেন। কাজ থেকে ফিরে আমি প্রথমেই একটু কফির পানি বসিয়ে দিয়ে শাওয়ার নিতে যাই, তারপর ফিরে এসে কফি হাতে নিয়ে বসে যাই টিভির সামনে। রাত নয়টা থেকে সাড়ে নয়টার মধ্যে খাবার খেয়ে নিই, তারপর বসি ল্যাপটপ নিয়ে। online এ কিছুক্ষণ কাজ করে ঘুমাতে যাই এগারোটার দিকে।
আর সকালে ছয়টার দিকে এলার্মের শব্দে জাগি, তারপর আটটার দিকে কাজে বেরিয়ে যাই। গত চার বছর ধরে এই একই নিয়মে চলে যাচ্ছিল আমার বোরিং লাইফ । এর মাঝে একটা ঠান্ডা হাওয়ার ঝলক নিয়ে আমার লাইফে আসলো নিলয় বসন্তের এক আবির মাখা বিকালে। ওইদিন পার্কে আমি তার কথার উত্তরে শুধু এটুকু বলেছিলাম যে ভাগ্য যদি আমাদেরকে এক পথে দাড়ঁ করিয়েও দেয়, চৌদ্দো বছর আগের সেই আবেগের অনেকটায় হারিয়ে গিয়েছে। কাজেই এই আজকের আমি থেকে কিছু পাওয়ার নাই।
এটা বলার পর আমি চলে আসতেই সেও আমার পিছু পিছু এসে আমার এপার্টমেন্ট পর্যন্ত পৌছে দিয়ে যাবার সময় বলে গেলো, ‘আবার দেখা হবে’। এরপর দুই সপ্তাহ কেটে গেছে। এর মাঝে আমি office এর কাজে কয়েকদিনের জন্য WORCESTER( western part of Massachusetts) এ গিয়েছিলাম। ফিরেছি ফ্রাইডেতে। আর আজকে শনিবার এ ঘুম থেকেই উঠেছি বারোটার দিকে।
বাসায় কিছুই বাজার করা নাই, আমি সাধারণত শনিবার সকালই সপ্তাহের বাজার সারি বাসার কাছেই একটা মার্ট থেকে। এমনিতেই উঠতে দেরি হয়ে গেছে, তাই বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তায় এসে দেখা হয়ে গেল আমার ল্যান্ডলেডির সাথে। উনিও বাজার করে ফিরছেন। গাড়ি থেকে বিশাল দুটো ব্যাগ নামাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন।
আমি এগিয়ে গেলাম তাকে সাহায্য করার জন্য। কুশল বিনিময় করে জিজ্ঞাসা করলাম, এখন শরীরের অবস্থা কেমন? কেননা গত মাসে হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়াতে আমিই উনাকে হসপিটালে নিয়ে যাই । এরপর বেশ কিছুদিন দেখতেও গিয়েছিলাম। বাসায় আসার পর অবশ্য সেইভাবে তেমন খোঁজখবর নেওয়া হয়নি, কিন্তু যতবারই আসতে যেতে দেখা হয়েছে, উনি কৃতজ্ঞ চিত্তে আমাকে উনার বাসায় আপ্যায়নের অনুরোধ করেছেন। আমি অবশ্য ব্যস্ততার অজুহাতে এড়িয়ে গিয়েছি।
আজকেও উনি আমার হাত ধরে মাতৃসুলভ গলায় বললেন, 'দুপুরে আমার সাথে lunch করো'। আমি আর অন্য দিনের মতো অজুহাত দিয়ে এড়াতে পারলাম না। বল্লাম, আগে বাজার সেরে আসি, তারপর খাবো। এরপর আমি মার্টে চলে গেলাম। ফিরে বাজারগুলো গুছিয়ে গেলাম দোতলায় আমার ল্যান্ডলেডির ফ্ল্যাটে।
খেতে খেতে মিসেস Anderson (ল্যান্ডলেডি ) বললো, যদি কিছু না মনে করো তাহলে তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি? আমি সম্মতি দিতেই উনি বললেন, এত বছর ধরে এইখানে আছো, তোমার কাছে কখনও কাউকে আসতেও দেখিনা, তোমার কি কারও সাথে একটুও ঘনিষ্ঠতা হয়নি? আমি বললাম, আমার একা থাকতেই ভাল লাগে। এরপর উনি কি বুঝলেন কে জানে , অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন। উনার দুই ছেলের একজন থাকে ডেনভারে আর একজন নিউইয়র্কে। এই Christmas এ উনি নিউইয়র্কে যাবেন ছোট ছেলের কাছে। নাতি-নাতনীদের সবার ছবি দেখালেন এলবাম খুলে।
আসন্ন get together এর খুশীতে উনার চোখমুখ খুব উজ্বল হয়ে উঠেছিল। বাসায় ফিরে আমি সপ্তাহের রান্না করতে লাগলাম। সারা সপ্তাহে আমি মাত্র একদিন আবার কখনও দুইদিন রান্না করি। রান্না শেষে খুব tired লাগছিল, তাই বিছানায় এসে শোয়ামাত্র কখন যে চোখ লেগে এসেছে বুঝতেই পারিনি। দরজায় হঠাৎ করে কলিং বেলের শব্দে চমকে জেগে উঠলাম।
এখন দিন না রাত মনে করতেই আধা মিনিট সময় লাগলো । আমি বুঝতে পারছিনা যে এখন আবার কে আসলো ? নাকি মিসেস Anderson আবার কিছু বলতে আসলেন? এসব ভাবতে ভাবতে দরজা খুলতেই দেখি হাতে একগাদা ফুল আর চকলেটের box নিয়ে দাড়িঁয়ে আছে নিলয়। হাসি হাসি মুখে আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই পাশ কাটিয়ে রূমে ঢুকে বললো, গত উইকে এসেছিলাম কিন্তু তুমি ছিলেনা। আজকে আসার আগে তোমার ল্যান্ডলেডি কে ফোন করে কনফার্ম করে নিয়েছিলাম তুমি আছো কিনা জানতে। এখন আমি বুঝলাম কেনো মিসেস Anderson আমাকে ওই কথা জিজ্ঞাসা করেছিলো।
আমার হাতে ফুল আর চকলেটের box ধরিয়ে দিয়ে বললো, চলো আমরা বাইরে ডিনার করে আসি। আমি বললাম, এখন কেবল ছয়টা বাজে, বাইরে এখনও বেশ আলো রয়েছে, এখনই কিসের ডিনার? ও বললো, তাহলে নাহয় ঘন্টাখানেক পরেই যাবো। আমি এড়ানোর জন্য বললাম, তাছাড়া আমি বাইরের খাবার খুব একটা খাইনা। ও বললো, ঠিক আছে, আমরা বাসাতেই রান্না করে খাবো, তোমার ফ্রিজে কি কি আছে বলো, আমি একটা আইটেম বানিয়ে দিচ্ছি। আমি দেখলাম, ও একেবারে নাছোড়বান্দা।
এরই মধ্যে এগিয়ে গিয়ে ও ফ্রিজের ডালা খুলে কি কি আছে তা দেখা শুরূ করে দিয়েছে। আমি বললাম, দুপুরে কিছু রান্না করেছি, ওইটাতে হয়ে যাবে। এর মধ্যে আমি একবারও জিজ্ঞাসা করিনি যে ও কোথায় থাকছে। সোফাতে বসে পড়ে সে বলে উঠলো, জানো, বাংলা community তে তোমাক নিয়ে কি কি কথা হয়? তুমি telecom sector এ এখানে এত ভালো position এ আছো, অথচ ছোট্ট একটা বাসায় একলা থাকো, কারও সাথেই মিশোনা, কারও সাথে দেখা হয়ে গেলেও কথা না বলে এড়িয়ে চলো, সবারই তোমাকে নিয়ে দারুণ কৌতুহল । আমি বাধা দিয়ে বললাম, আমি একাই ভাল আছি আর এইভাবেই থাকতে চাই ।
নিলয় তখন কৌতুকের স্বরে বললো, এখন তো আর একা থাকতে পারবেই না, আমি এসে গিয়ছি, তোমার আর একা একা থাকা চলবে না। ওর কথার মাঝে অধিকারের সুর । আমি বুঝতে পারছিলাম না ওকে কি বলবো? ও কি পারবে আমার হারিয়ে যাওয়া আবেগটুকু ফিরিয়ে আনতে, নাকি আবার একটা কষ্ট দিয়ে দূরে সরে চলে যাবে আমাকে আবার একাকী করে দিয়ে? আমার কি আবার নতুন করে কষ্টের মধ্যে পড়তে হবে? ‘ কি হলো, হঠাৎ চুপ হয়ে গেলে যে? এসো, আমরা ডিনার সাজাই’- আমার চমক ভেঙ্গে বলে উঠলো নিলয় । আমি এগিয়ে গেলাম কিচেনের দিকে, কিন্তু আমার ভাবনাগুলো মনের মধ্যে খচখচ করতে থাকলো । আমি এক অদ্ভূত দি্ধা দন্ধে পড়ে গেলাম ।
চলবে….
নায়রা
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।