আজকে সকাল থেকেই আকাশটা মেঘলা। এইরকম মেঘলা আকাশ দেখলে আমার মনটা কেন জানি খারাপ হয়ে যায়। ঘুম থেকে উঠে মর্নিং ওয়াকে যেতে ইচ্ছাই করছিলনা। তবুও কোনোমতে উঠে রেডি হয়ে আসলাম পার্কে। চারপাশে নানা বয়সী ছেলে, মেয়েরা জগিং এ ব্যস্ত।
গড়পড়তা আমেরিকানরা এই জগিং জিনিসটা বেশ গুরুত্বের সাথে নেয়। তারা এটাকে দৈনন্দিন জীবনের একটা অংশ বলেই মনে করে। তাইতো কোনোদিনই পার্ক ফাঁকা থাকতে দেখিনা। কয়েকবার দৌড়ে আসার পর একটু বিশ্রাম নিতে পার্কের বেঞ্চে বসেছি। মন খারাপ ভাবটা দূর হচ্ছেই না।
কালকে মিসেস এন্ডারসন উনার ছেলের কাছে নিউ ইয়র্কে ক্রিসমাস পালনের জন্য গেলেন। আমি কাল দুপুরে উপরে গিয়ে উনার লাগেজ গুছিয়ে দিতে সাহায্য করলাম। ছেলে এবং নাতিদের সাথে দেখা হবে এই উত্তেজনায় উনার চোখমুখ ঝলমল করছিল। সন্ধায় উনাকে বাসে তুলে বাসায় ফিরে খুব একা একা লাগছিল। অনেকদিন পরে মনে হচ্ছিল, বাসাটা যেন একদম ফাঁকা হয়ে গেল।
এমন নয় যে উনার সাথে খুব আন্তরিকতা ছিল, তবুও একটা অদৃশ্য মাতৃসুলভ স্পর্শ অনুভব করতাম উনার প্রতি। মন খারাপ ভাবটা হয়তো সেই শূন্যতাকে ঘিরেই।
জগিং শেষে বাসায় ফিরে দেখি দরজার বাইরের সিঁড়িতে বসা নিলয়। আমাকে দেখে উঠে দাড়িয়ে বললো, সেই কখন থেকে বসে আছি, ফিরতে এত দেরী করলে যে? উপরে গিয়ে যে মিসেস এন্ডারসনের ওখানে বসবো,তারও উপায় নেই, উনার দরজাতেও দেখি তালা দেওয়া। আমি দরজা খুলতে খুলতে বললাম, উনি ছেলের কাছে নিউ ইয়র্কে গেছেন।
তখন নিলয় একটা দুষ্টামির হাসি দিয়ে বললো, তাহলে তুমি এই পুরো বাড়িতে এখন একদম একা? আমি বিষয়টা চেঞ্জ করার জন্য তাড়াতড়ি বলে উঠলাম, আর তুমিইবা এত সকাল সকাল কি মনে করে? নিলয় বললো, মনে নেই, তোমাকে একটা বাড়ি বিক্রির অ্যাড দেখিয়েছিলাম, আজকে দুজনে মিলে চলো বাড়িটা দেখে আসি।
আমরা এগারোটা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম Arlington এর উদ্দেশ্যে আমার গাড়ি নিয়ে। যাওয়ার আগে প্রপাইটারের সাথে কথা বলে নিয়েছিলাম যাতে উনি আমাদেরকে বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখান। রবিবারে ট্রাফিক অনেক কম থাকাতে অনেক আগেই পৌছে গেলাম। ছুটির দিন বলে কিনা জানিনা, এলাকাটা অস্বাভাবিক রকমের শান্ত।
ঠিকানা অনুযায়ী যে বাসাটার সামনে নিয়ে এসে গাড়ি পার্ক করলাম, প্রথম দেখাতেই সেটা দেখে আমি চমকে উঠলাম। স্বপ্নে আমি ঠিক এরকম একটা বাড়িই দেখেছি। প্রপাইটার আমাদেরকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলেন। আমি মুগ্ধ চোখে এক রুম থেকে অন্য রুমে ঘুরতে লাগলাম। বাড়ির পেছনে লম্বা একটা লন আর তারপরেই Lake।
এ যেন স্বপ্নের বাড়ি জলজ্যান্ত চোখের সামনে সামনে দাঁড়িয়ে। বাড়ি দেখা শেষে আমরা বাইরে এলাম। উনি বাসার যে দাম বললো তা জায়গার অনুপাতে যথেষ্টই বেশী। আমি নিলয় এর দিকে তাকাতেই ও চোখ ইশারায় আমাকে চুপ থাকতে বললো। তারপর প্রপাইটারের দিকে ফিরে বললো, আমরা খুব তাড়াতাড়িই আমাদের সিদ্ধান্ত আপনাকে জানাবো।
ওখান থেকে ফেরার পথে আমি চুপচাপ আছি দেখে নিলয় জিজ্ঞাসা করলো, বাসাটা তোমার খুব পছন্দ হয়েছে, তাইনা ? দামের কথা চিন্তা কোরোনা, আমি অর্ধেকটা পে করতে চাই। এই এলাকাটা আমারও বেশ ভাল লেগেছে। Boston এ এসে যদি তোমার সাথে দেখা না হতো, তাহলে হয়তো এখানে settle করার চিন্তাও করতাম না।
বাসায় ফেরার সময় বাজার করে এনে জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে রাখছি আর নিলয় রান্নার কাজে আমাকে সাহায্য করতে লাগলো। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর আমি Kitchen পরিষ্কার করছি, তখন নিলয় বলে উঠলো, তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে, এখানে এসে বসো।
আমি কাজ শেষ করে বিছানায় এসে বসলাম । আমার খুব tired লাগছিল , মনে হচ্ছিল একটু ঘুমাতে পারলে ভাল হতো। নিলয় আমার পাশে বিছানায় এসে বসলো, তারপর আমার একটা হাত ওর কোলের উপর রেখে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, আমি এখন যেটা বলছি সেটা মন দিয়ে শুনো । আমি কোনো কথাই তোমার কাছে লুকাতে চাইনা । জাপানে থাকাকালীন মা-বাবার পছন্দে আমি বিয়ে করেছিলাম, মেয়েটাও জাপানে পড়াশোনা করেছে ।
চারবছর ছিল আমাদের সংসার । তারপর হঠাৎ একদিন কাজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে গাড়ি accident এ ও মারা যায় । তখন থেকেই আমি সিদ্ধান্ত নেই জাপানে আর থাকবোনা । বিশ্বাস করো, তখন তোমার কথা খুব মনে পড়তো । তারপর বাংলাদেশে গিয়ে আমি তোমাকে খোঁজার চেষ্টাও করেছি ।
এরপর যতদিন পার হয়েছে, নিজের মাঝে তোমার শূন্যতাকে আরও গভীরভাবে feel করতাম । হঠাৎ America তে job এর অফার পেয়ে যাওয়াতে এখানে চলে আসলাম । ভাগ্যে আমাদেরকে আবার দেখা করা লেখা ছিল, নইলে আমিইবা কেন ওইসময় বাসা খুঁজতে রাস্তায় দাঁড়াবো, আর তুমিইবা কেন ওইসময় ওখান দিয়ে যাবা !!! পৃথিবীর এত জায়গা থাকতে আমাদের দেখা হলো কিনা Boston এর এই ছোট্ট শহরে, একে ভাগ্য ছাড়া আর কি বলা যাবে ? এতক্ষণ চুপ করে আমি ওর কথা শুনছিলাম, এরপর আস্তে আস্তে করে ওর কোল থেকে আমার হাতটা সরিয়ে নিলাম, আমার মনের মধ্যে একটা জমাটবাঁধা কষ্ট যেন দলা পাকিয়ে গলার কাছে আটকে থাকলো । আমি কোনো কথায় বলতে পারলাম না । নিলয় এর দিকে তাকিয়ে দেখি, ওর চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে, ও অসহায় ভঙ্গিতে মাথাটা নিচু করে বসে রইলো ।
আমি ওখান থেকে উঠে চলে আসলাম দরজা খুলে বাসার একেবারে বাইরের সিঁড়িতে । বাইরে মেঘলা আকাশ যেন আরও কালোরুপ ধারণ করেছে । যে কোনো সময় বৃষ্টি নামবে । থেমে থেমে ঝড়ো বাতাস আরম্ভ হয়ে গেছে । আর মনের মাঝেও শুরু হয়েছে অন্য এক ঝড় ।
ভেতরটা যেন তোলপাড় করে দিচ্ছে, ওকে যখন থেকে ভালবাসতে শুরু করি তখনকার কথা ভাবছিলাম। দীর্ঘদিন অদেখায় মনের ভেতর আবেগহীনতার যে আবরণ জমেছিল, আবার দেখা হওয়ার পর তা যেন ক্রমেই সরে যাচ্ছিল ওর কাছে আসার আকুলতায় । কিন্তু আজকের এই হঠাৎ ঝড় যেন সবকিছু এলোমেলো করে দিয়ে গেল । আমি সন্ধা পর্যন্ত ওইখানেই বসে রইলাম চুপচাপ । যে ভালোবাসা জাত- ধর্মকে টলাতে পারেনি ও হিন্দু বলে, সেই ভালোবাসা কি এখানেই সমাপ্ত হয়ে যাবে আজকে আমার সামনে উন্মোচিত হওয়া এক গভীর সত্যর মুখোমুখি হয়ে ? কি জানি? আমার মাথায় কিছুই আসছিল না........
চলবে.......
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।