আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পাখিগল্পঃ দুই শালিক

আপাতত ঘুরপাক খাচ্ছি! দূরে কদম ডালে একটা কোকিল ডাকছে। কিছুক্ষণ কুকু রবে তো কিছুক্ষণ আবার ভিন্ন তালে। উঁচু শিমুল ডালে বসে ঘুঘু ডাকছে। আর বিশালাকার একটা আম গাছে কিছু শালিক সারিবদ্ধভাবে প্রাতকালীন খোশগল্প তথা আমগাছ বৈঠকে ব্যস্ত। পাখিদের আনাগোনা এবং ডাকাডাকির ধরণে অনুমান করা যায় প্রকৃতির বুকে এখন কোন মৌসুম উপস্থিত? শালিকেরা আসন্ন নবান্ন উৎসব কিভাবে উৎযাপন করবে তার একটা লিষ্টি তৈরী করে ফেলেছে।

তাই নিয়ে উৎসব আমেজে হৈচৈ টা একটু বেশী করতেছে। এত আনন্দের ভীড়ে ফুলফুলি নামের শালিকটি মন খারাপ করে একটু দূরে মগডালে বসে আছে। সে একবার আকাশের দিকে আর একবার পাকা ধানক্ষেতের দিকে তাকাচ্ছে। মনে মনে বলছে, হে সৃষ্টিকর্তা! ফসলের ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে আমরা তো মানুষের উপকার করছি। পোকামাকড় খাওয়ার ফলে কৃষকরা সুন্দর ফসল পাচ্ছে।

সেই ফসল কৃষকদের মাধ্যমে বড় সাহেবদের কাছে যাচ্ছে। কৃষকেরা তো আমাদের কোন ক্ষতি করছে না। তবে কেন বড় সাহেবেরা আর তাদের ছেলেরা এত নির্দয়? তোমার কাছে উপযুক্ত বিচার চাই। বিচার চাই। বিচার চাই।

মনটা তার ভীষণ উদাস। উদাস হবেই না বা কেন? এই মৌসুমের মাঝামাঝিতেই স্বামী টুলটুলকে নিয়ে কতই না সুখের সংসার ছিল। সারাদিন আনন্দ ফূর্তি করে লেজ দুলিয়ে ক্ষেতে ক্ষেতে উড়ে বেড়াতো। হরেক ক্ষেতে হরেক পোকা খেত তারা। আহারে! কত সুন্দর হাসের মত নধর কান্তি চেহারাটাই না হয়েছিল টুলটুলুর।

এখন কোথায় কিভাবে না খেয়ে আছে আল্লায় জানে। ফুলফুলির চোখে কাঁদার মত আর অশ্রুও অবশিষ্ট নেই যেন। যত নষ্টের গোড়া বড় সাহেবের ছেলে রাহাত। সে গ্রামে বেড়াতে আসলো একদিন। সাথে কাঠের তৈরী বিশেষ একটা জাদুরবাক্সের মত যন্ত্র নিয়ে এসেছিল।

একদিন আনমনে খাবার খেতে খেতে ধানক্ষেতের আইলে বসানো সেই বিশেষ যন্ত্রটার দিকে নজর গেল। বাক্স দেখে ফুলফুলী আর টুলটুল অবাক নয়নে চেয়ে থাকে। অবাক হওয়ারই কথা। তারা এতদিন তো কত কষ্ট করেই না ধানক্ষেত, পাটক্ষেত আরও কতশত ক্ষেত মারিয়ে খাবার দাবার খাচ্ছিল। আর আজকে কিনা এক বাক্সেই এত্ত খাবার।

অতি উৎসাহী টুলটুল আগ্রহ নিয়ে আগে আগে বাক্সের ফুটো গলে ঢুকে পড়লো। পিছন পিছন ফুলফুলি এগোলো। টুলটুল যেইনা একটা পোকায় ঠোকর দিলো, অমনি বাক্সের ফুটোটা ঝপাত করে বন্ধ হয়ে গেল। ফুটোর ঢাকনার ঝড়ে ফুলফুলির একটা ডানা প্রায় ভেঙ্গে যাওয়ার অবস্থা হলো। আর টুলটুল বাক্সবন্দী হয়ে শহরমূখী হলো।

শুরু হলো ফুলফুলি আর টুলটুলুর জীবনের নতুন অধ্যায়। একদিকে টুলটুল একটা খাঁচায় বন্দী হয়ে জীবন অতিবাহিত করে। সময় করে দিনে তিনবার খাবার জুটছে তার কপালে। সকাল বেলা একটা পাকা কলা। দুপুর বেলা দুধভাত।

আর রাতের বেলা কমলা বা আপেল। কিন্তু সেগুলো ছুঁয়েও দেখছে না সে। বেশীর ভাগ খাবার পাশের বাড়ীর হুলো বিড়ালটা খেয়ে যাচ্ছে। এই কয়েক দিনে বিড়ালটার সাথে বেশ খাতির জমিয়ে ফেলেছে টুলটুল। রাহাত দুপুর বেলা এসে বলো রাহাত ভাই! রাহাত ভাই! করে কথা বলানোর চেষ্ঠা করছে।

রাহাতের উপর উল্টো বিরক্ত হয়ে লেজ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে টুলটুল। হুলো বিড়ালটা প্রতিদিন টুলটুলের খাবারে ভাগ বসাতে আসছে। এতে রাহাতের আম্মা বিরক্ত হয়ে একদিন লাঠি নিয়ে তাড়া করে। এই হুলো বিড়াল যা ভাগ, দূর হ বলে তাড়াতে থাকে। টুলটুল বেশ ভয় পায়।

তার বন্ধুর প্রতি এরকম নির্মম আচরণ দেখে সে ব্যথিত হয়ে উঠে। কথাটা তার মনে গেঁথে যায়। সে আনমনে এই হুলো বিড়াল যা ভাগ, দূর হ বলতে থাকে। পরের দিন রাহাত কাছে এসে কথা বলানোর চেষ্ঠা করে। বলো রাহাত ভাই! বলো রাহাত ভাই।

টুলটুল "এই হুলো বিড়াল যা ভাগ, দূর হ বলে। " বলে ক্ষোভ প্রকাশ করে। পাখির মুখে এত বড় কথা শুনে রাহাত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। বদমাশ, হতচ্ছাড়া এই জন্যই তোকে দুধ কলা দিয়ে পুষতেছি। এই বলে খাঁচাটা ছুড়ে ফেলে।

টুলটুল খাঁচাবন্দী অবস্থায় বাড়ির পাশে ড্রেনের কাছে পড়ে থাকে ঘন্টা দু'য়েক। পাশ দিয়ে যাচ্ছিল হুলো বিড়ালটা। সে বেশ কিছুক্ষণ খাঁচার চারিদিকে ঘুরে পর্যবেক্ষণ করলো। টুলটুল অনেক কাকুতি মিনতি করতে থাকলো। এই হুলো বিড়াল খুলে দেনারে দরজাটা।

হুলো বিড়ালটা সেদিনের সেই তাড়া খেয়ে এখনো গো ধরে বসে আছে। না খুলবো না তোদের বাড়ির গিন্নী বড় দজ্জাল। সে তো দজ্জাল আমিও জানি। তার ছেলেও দজ্জাল। সেই তো আমাকে খাঁচাসহ ছুড়ে ফেলেছে এখানে।

তাই না কি রে? তা নাহলে আমি আবার খাঁচাসহ এখানে আসবো কেমন করে, হুলো বিড়াল? আমার প্রাণের বন্ধু? তা ঠিক তা ঠিক। গালে হাত দিয়ে বিশেষ ভঙ্গিমায় বলতে থাকলো হুলো বিড়ালটা। সবই তো ঠিক আছে। নে এইবার আমার দরজাটা খুলে দে। তোকে ছেড়ে দিলে দুধকলা খাবো কোথায়? তোর কল্যাণেই তো আমার নাদুস নুদুস চেহারাখানা হয়েছে।

পাড়ার বিড়াল বিড়ালীরা তো আমাকে দেখে হিংসে করছে। তাই দেখে খুশীতে বাকুম বাকুম করে বেড়াচ্ছি। টুলটুল বেশ করে বুঝলো, নাছোড়বান্দা হুলো বিড়ালকে বশে আনা বেশ শক্ত। সে একটা ফন্দি আটলো। শোন বন্ধু! খাঁচার দরজা খুলে দিলে তোর জন্য আজকেই অন্নেক অন্নেক টেংরা মাছভাজা নিয়ে আসবো।

টেংরা মাছ ভাজার কথা শুনে হুলো বিড়ালের জিহ্বা বের হয়ে গেল। কত্তদিন যেন সে খায় নাই। সত্যি বলছিস তো? সত্যি বলছি না তো , এমনি এমনি মিথ্যে বলছি? মনে মনে বললো মানুষের সাথে থাকতে থাকতে তোরেও লোভে ধরেছে হুলো বিড়াল। লোভে পাপ পাপে মৃত্যু। আর পাপ বাপকেও ছাড়ে না।

একদিন তার প্রায়শ্চিত্ত হয়ই হয়। যাক শেষ পর্যন্ত দরজাটা খুলে দিলো সে। এখন আমারে টেংরা মাছভাজা দাও। এখন আমারে তাড়াতাড়ি টেংরা মাছ ভাজা এনে দাও বলতে থাকলো। ওদিকে টুলটুল একটা পেয়ারা গাছের ডালে গিয়ে বসলো।

যাক বাঁচা গেল বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সে। কতদিন পর পাখা দুটো ঠিকমত নাড়াতে পারছে। হুলো বিড়ালটা এখনও টেংরা মাছ চাচ্ছে। টেংরা মাছের কাটা শক্ত তাই হুলো বিড়ালের মুখে পড়ুক ছাই। বলে হুলো বিড়ালকে ভেংচি কাটা শুরু করলো টুলটুল।

রাগে গড়গড় করছে হুলো বিড়ালটা। পারলে টুলটুলকে টেংরা মাছের কাবাব বানিয়ে খেয়ে ফেলে। টুলটুল আবারও বলা শুরু করলো: টেংরা মাছের কাটা শক্ত তাই হুলো বিড়ালের মুখে পড়ুক ছাই। হুলো বিড়ালটা এবার মাটিতে শুয়ে গড়াগড়ি করে কাঁদা শুরু করলো। আরও টেংরা মাছ ভাজা চাইবি বল? না আর মাছ চাবো না।

আর জীবনেও আমি টেংরা মাছ ভাজা খাবো না। যা তোকে মাফ করে দিলাম। শুনে হুলো বিড়ালটা দাঁত কেলিয়ে হাসা শুরু করলো। এরপর টুলটুল পাখনা মেললো রাহাতের ঘরে। রাহাত মুখ হা করে শুয়ে নাক ডেকে বেঘোরে ঘুমুচ্ছে।

যাক উপযুক্ত সময়ে ঘরে ঢুকেছি। বলে রাহাতের হা করা মুখে সুরুত করে পায়খানা করে দিল। রাহাতের ঘুমটা গেল ভেঙ্গে। রাগে গজগজ করতে করতে দ্রুত টেবিলের উপর বসা টুলটুলুকে ধরতে গেল। রাহাত একটা হুলো বিড়াল মিউ মিউ করে সারা সকাল বলতে বলতে ফুরুত করে উড়ে গেল টুলটুল।

দুইদিন শহরের আনাচে কানাচে ঘুরে সে। ক্ষিধার চোটে যে দু’একটা পোকা মাকড় খেয়েছে তাও বিস্বাদ লাগলো তার কাছে। মনে মনে বললো এই শহরের মানুষ গুলো নিষ্ঠুর। এখানকার পোকামাকড়েরাও তেতো। তেতো পুরো শহরটা।

তার ফুলফুলির কথা মনে পড়ে গেল। উড়াল দিল উত্তর দিকে। উড়তে উড়তে সেই চিরচেনা এলাকায় এসে উপস্থিত হলো। তার এলাকায় পাখি মহলে আজ আনন্দের দিন। তারা নবান্ন উৎসবে খাবারের তালিকায় বিভিন্ন প্রকারের পোকামাকড়ের পদ সংগ্রহ করেছে।

আজকের উৎসবের প্রধান অতিথি লেজঝোলা টিয়া। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান গাইবে টুপুর। টুপুর হচ্ছে এ অঞ্চলের সবচেয়ে মধুরকন্ঠী কোকিল। সাথে আছে ঘুল্লু ঘুঘু, টুইটার টুনটুনি, বিবি ময়না ও আরও অনেকেই। লাল টুকটুক বুলবুলি বিশেষ নিত্য পরিবেশন করবে।

সাথে নাচবে পেয়ারে অর্থাৎ পায়রা দম্পতি ও চু চিকচিক চড়ুই আর ফুরুত বাবুই। অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল হলুদিয়া ঘাটের প্রাচীন অশ্বথ গাছে। অনুষ্ঠানের এত ভীরের মাঝে ফুলফুলিকে আর খুঁজে পাচ্ছে না টুলটুল। মন খারাপ করে এ গাছে ও গাছে ঘুরে বেড়াচ্ছে সে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল পাশ্ববর্তী একটা আমগাছে।

মন খারাপ করে বসে আছে ফুলফুলি। সে ধপ করে গিয়ে ফুলফুলির সামনে বসে পড়লো। টুলটুলকে দেখে এত দিনের দুঃখ কষ্ট ফুলফুলি যেন এক নিমিষেই ভুলে গেল। টুলটুলের বীরত্বের কাহিনী শুনে ফুলফুলির মন ভাল হয়ে গেল। টুলটুল চোখ পিট পিট করতে করতে জিজ্ঞেস করলো, সাথে ওরা দু’জন আবার কে? কেন গো! তুমি দেখি সব ভুলে বসে আছো? হ্যাগো এত টেনশনের ভীরে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম সবকিছু।

তোমাকে যখন ঐ ষন্ডাটা ধরে নিয়ে গেল। এরপর আমার উপর দিয়ে কত কষ্টটাই না গেল। সুন্দর করে একটা বাসা বানালাম। তাও কালবোশেখীতে গেল ভেঙ্গে। এরপর তাড়াহুড়ো করে একটা বাসা বানিয়ে ওদেরকে কত কষ্টেই না বড় করলাম।

হ্যাগো ওদের কি নাম রেখেছো? ওর নাম ফুলী আর ওর নাম টুলু। নাম শুনে টুলটুল আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল। তাদের দু’জনের নামের সাথে অন্ত্যমিল রেখে কত সুন্দরই না নাম রেখেছে ফুলফুলি। তাদেরকে বুকে টেনে নিল। ডানা দিয়ে ঢেকে পরম মমতায় ঠোট দিয়ে আদর করে দিল।

এরপর টুলটুল বললো, এই বাচ্চারা তোমরা অনুষ্ঠানে যাও, আমরা একটু পরে আসছি। একটু পরে ফুলফুলি আর টুলটুল কাঁধে কাঁধ রেখে হাসি আনন্দে উড়তে উড়তে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলো। ইতোমধ্যে গানের অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। অনেক দিন পর টুলটুলকে দেখে সবার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। তাদের নবান্ন অনুষ্ঠানের আমেজ যেন দ্বিগুন বেড়ে গেল।

টুলটুল হেরে গলায় গাওয়া শুরু করলো: রাহাত একটা হুলো বিড়াল মিউ মিউ করে সারা সকাল। টেংরা মাছের কাটা শক্ত তাই হুলো বিড়ালের মুখে পড়ুক ছাই। এরপর সবাই সমস্বরে গাওয়া শুরু করলো। রাহাত একটা হুলো বিড়াল মিউ মিউ করে সারা সকাল। টেংরা মাছের কাটা শক্ত তাই হুলো বিড়ালের মুখে পড়ুক ছাই।

হাসতে হাসতে এবং নাচতে নাচতে হুটোপুটি খাওয়া শুরু করলো উপস্থিত সকল ছানা পাখি। সাথে অন্যরাও হাসি আর আনন্দে লাফানো শুরু করলো। ছবিসূত্র: নিজস্ব এ্যালবাম। আগে প্রকাশিত আর একটি এরকম টাইপের গল্প । নামধাম: গাঁদা।

ইচ্ছে না করলেও পড়ে দেখতে পারেন ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.