সীমার সাথে আমার দেখা হয়েছিল প্রায় পনেরো বছর আগে, আমার মত করে। এর পরে যে দেখাটা হয়েছিল সেটাকে আমি কখনও মনে করি না, করতে চাইও না।
পনেরো বছর অনেক লম্বা সময়,অন্তত আমার কাছে। এই পনেরো বছরে অনেক কিছু বদলে গেছে। আমি হয়ত বদলে যাই নি।
আমি হয়ত আমিই আছি, আর আমার এই আমি থাকাটাই আজকে আমার সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সীমাও অনেক বদলে গেছে। আজ সে পরিপূর্ণা। সে আজ একজন আদর্শবান মা, সন্তানের প্রতিটি পদক্ষেপে যার তীক্ষ্ণদৃষ্টি। একজন আদর্শ পুত্রবধু, একজন আদর্শ স্ত্রী...
এগুলো একটাও আমার নিজের দেখা না, সব অন্যের শোনা।
আজ পর্যন্ত ওর স্বামীকে ভাল করে দেখিনি। দেখতে চাইও না। নিজের অবচেতন মনকে বারবার বাধা দেওয়া সত্ত্বেও তার সাথে নিজের তুলনা হয়েই যায়। তাই সবসময় আমি ওদের ছায়ারও বিপরীত দিকে যাই। একই শহরে থাকি তবুও ওর সাথে আমার দেখা হয় না।
এই কৃতিত্ব অবশ্যই আমার। পারতপক্ষে যে জায়গাগুলোতে তার থাকার সম্ভাবনা সেই জায়গার কোথাও আমি নেই।
অনেক কাছের মানুষের কাছেও আজ আমি অপরিচিত হয়ে উঠেছি। তবুও অনেকের সাথেই দেখা হয়ে যায়। হালকা গোছের কিছু কথাবার্তা হয়।
সবকিছু জেনেও না জানার ভান করে থাকি, তারাও করে। এই অভিনয় করতে মন্দ লাগে না। মনে হয়, এটাই বাস্তব। বাকী যেটুকু সেটা নিয়ে না ভাবলেও চলে।
সেদিন বিকেলে রাস্তার মোড়ে সিগারেট কিনছি।
হঠাৎ দেখি স্বপ্না, অনেক বছর পর! আমি চট করে দোকান থেকে সরে গেলাম। কিন্তু স্বপ্না আমায় দেখে ফেলল। “বিপ্লব ভাই, অ্যাই বিপ্লব ভাই!” বলে রাস্তার মানুষজনকে অবাক করে আমার কাছে ছুটে এল।
আমি হাসিমুখে বললাম, “কেমন আছ স্বপ্না?”
-“বিপ্লব ভাই, আপনি কোথায় ছিলেন এতদিন? জানেন খোরশেদ আপনাকে কত খুঁজেছে?”
-“কোথায় আবার?” মুখটা হাসি হাসি রাখার চেষ্টা করি।
-“আপনি এরকম কেন?” স্বপ্নার কণ্ঠে অভিমান ধরা পড়ে।
-“খোরশেদ কই?”
-“ও তো ঢাকাতেই আছে, আমি অফিসের ছুটি নিয়ে মার সাথে দেখা করতে এলাম। ” স্বপ্না থামল। আমার মুখের দিকে চেয়ে বলল, “আর আপনি?”
আমি হাসলাম। স্বপ্না আমাকে জোর করে একটা ক্যাফেতে নিয়ে গেল। আমি যেন দেখতে পেলাম আজকের প্রায় চল্লিশ বছরের এই ভদ্রমহিলার পিছনের পঁচিশ বছরের এক ভীত তরুণীর মুখ।
২.
-“দোস্ত, কাজটা করে দে না,” খোরশেদ আমার হাত চেপে ধরে।
-“এখানে আমার লাভ কি?” আমি মুচকি হাসি। হেসে চায়ে চুমুক দেই। ক্যান্টিনের এই চা’টা বেশ ভাল। চা খেতে খেতে খোরশেদের অস্থিরতা উপভোগ করি।
-“তোর কি লাভ মানে?” খোরশেদ ক্ষেপে ওঠে। “বন্ধুর জন্যে একটা কাজ করবি এর মধ্যেও লাভ-লোকসান খুঁজিস? তোকে বলাই ভুল হয়েছে। ”
খোরশেদ চায়ের টেবিল থেকে উঠে যেতে উদ্যত হয়। আমি হাত ধরে টেনে বসাই।
-“শালা, মশকরাও বুঝিস না? আচ্ছা যা করব।
”
-“সত্যি?” খোরশেদের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
-“হ্যাঁ, বন্ধুত্বের খাতিরে এই রিস্ক নিতে রাজি আছি। ” আমি হেসে ওর কাঁধে হাত রাখি।
-“জানতাম দোস্ত, তুই করবি,” খোরশেদ হেসে ফেলে। “শোন, তুই এই মঙ্গলবার সকালে লাবণীর বাসায় যাবি।
ওই যে, স্বপ্নার বান্ধবী। সেখান থেকে স্বপ্নাকে নিয়ে সোজা ট্রেনে উঠবি। প্রায় তিন ঘন্টা লাগবে ময়মনসিংহ আসতে। আমি আমার খালাতো ভাইসহ দাঁড়িয়ে থাকব। ওখান থেকে আমরা কাজী অফিস যাব।
”
-“বাহ! এমনভাবে বললি যেন খুব সহজ, তাই না?” আমি দাঁত কেলিয়ে হাসতে থাকলাম।
-“সোজাই তো! শুধু সাবধানে থাকিস। স্বপ্নার বাবা হেব্বি পাওয়ারফুল লোক। খুব ডেঞ্জারাস। জানতে পারলে মেরে ফেলবে।
”
-“তা তুই ওকে নিয়ে যাস না কেন?”
-“দোস্ত ওটাই করতাম। কিন্তু ওর বাবা আমার পিছনে লোক লাগিয়ে দিয়েছে। এই শহরের কোথাও আমাকে আর স্বপ্নাকে একসাথে দেখলে খবর করে ফেলবে। আমি আজ রাতের ট্রেনেই গ্রামে যাচ্ছি। লাবণীকে চিঠি দিয়েছি।
ও ওদিকের সব দেখবে। ”
খোরশেদ একগাল হেসে বিদায় নেয়। আমি ওর বিয়ের উত্তেজনা দেখতে থাকি।
৩.
-“বিপ্লব ভাই, আমার ভয় করছে। ”
স্বপ্না ফিসফিস করে আমায় কথাটা বলে।
আমি হাসার চেষ্টা করি। বলি, “কিচ্ছু হবে না, আল্লাহ্কে ডাক। ”
ওর ভয় কমল কিনা জানি না, তবে আমার ভয় আরো বেশি করতে লাগল। টিকেটচেকারকে যখন বললাম যে ‘আমি আর আমার স্ত্রীর দুটো টিকেট’ তখন গলাটা কেঁপে উঠেছিল। উনি কিছু সন্দেহ করেননি ঠিকই, তবে এক ভদ্রমহিলা তীক্ষ্ণচোখে আমাদের দেখছিলেন।
আমাদের দেখে অবশ্য স্বামী-স্ত্রীই লাগছিল। ওর বেগুনি শাড়ি আর আমার ইস্ত্রি করা শার্ট-প্যান্টে একটা দম্পতি দম্পতি ভাব আনার চেষ্টা করেছি। কিন্তু মহিলার তীক্ষ্ণদৃষ্টি আমাদের মনে ভয় ধরিয়ে দিল।
-“আপনারা যাবেন কোথায়?” ভদ্রমহিলা আচমকা জিজ্ঞেস করল।
স্বপ্না আমার হাত চেপে ধরে।
আমি যতটুকু স্বাভাবিক থাকা যায় সেভাবে বললাম, “সূত্রাপুর, আপনি?”
ভদ্রমহিলাটা জবাব দিলেন না। আমাদের মনে আরো ভয় ধরে গেল। একেকটা স্টেশন থামে আর আমার মনে হয় এই বুঝি স্বপ্নার লোকজন আমাকে আর স্বপ্নাকে ধরে নিয়ে যায়। খোরশেদ অপেক্ষা করছে ভেবে আরো বিচলিত হয়ে উঠলাম।
এইভাবে প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা পার করলাম।
স্টেশনে থেমে যখন খোরশেদকে দেখলাম তখন যেন আবার জীবন ফিরে পেলাম। সেখান থেকেই কাজী অফিস। বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার প্রশ্নে খোরশেদ বলল বাসায় জানে সে একমাস আগেই বিয়ে করেছে। সেখানে আবার আরেক ভেজাল বাঁধিয়ে রেখেছে। বিয়ে করে সে তার বড়বোনের বাসায় যাবে।
তারপর দেখা যাবে।
কাজী অফিসে বিয়ে পড়ানো হল। আমার দীর্ঘদিনের আপন মানুষটির জীবনের শ্রেষ্ঠ অধ্যায়ের সাক্ষী হলাম। আমার এই সহজ সরল অথচ কুটনামি-বুদ্ধিযুক্ত মানুষটির সাথে জীবনের কত কিছুই না জুড়ে আছে ! ওদের বিয়ে কাজ শেষ হলে খোরশেদকে আমার টিউশানির সব টাকা একটা খামে তুলে দিলাম। বললাম, “দোস্ত্ তোদের বিয়েতে কিছু দিতে পারলাম না...”
খোরশেদ আমায় জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।
স্বপ্নাও আঁচল চাপা দিয়ে মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে রাখল। সেটা ছিল আমার জীবনের একটা শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত....
তাদের নতুন জীবনের শুভকামনা জানিয়ে ফিরে আসলাম। মেসে আসতেই পুলিশ আমায় গ্রেফতার করল। স্বপ্নার বাবা এক মিথ্যে মামলায় আমায় দু মাস জেল খাটাল। জেল থেকে ফিরতেই শুনলাম সীমার বিয়ে হয়ে গেছে।
স্বামীসহ সে তখন বিদেশে...
কিছুই করলাম না। খোরশেদের মা মারা যাওয়ায় নাকি তখন সে ওদিকের সব সামলাচ্ছিল। কিছুই জানে না ওরা। আর ঘাঁটালাম না তাদের। আমার চেনা পরিবেশে আমি নিজেই অপরিচিত হয়ে উঠলাম।
৪.
স্বপ্না অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “বিপ্লব ভাই, সীমার সাথে আপনার আর যোগাযোগ হয়নি?”
আমি মৃদু হাসলাম। তারপর বললাম, “ ও পাঁচবছর পর দেশে ফিরেছিল। হ্যাঁ, সেবার ওর সাথে কথা হয়েছিল।
-“কী বলেছিল?”
-“কী আর বলবে?” আমি সহজ হবার চেষ্টা করলাম, “ ও অনেক কেঁদেছিল। বলল ওকে নাকি বোঝানো হয়েছিল আমি তোমার সাথে পালিয়ে বিয়ে করেছি।
ওর যোগাযোগেরও সুযোগ ছিল না। তাই শেষমেশ ওকে বিয়েতে রাজি হতে হয়েছিল। ”
-“আর?” স্বপ্না ছলছল চোখে আমার দিকে তাকাল।
আমি কিছুক্ষণ চুপ থাকলাম। তারপর দুর্বলভাবে বললাম, “ও বলেছিল ও এখনও আমার কাছে আসতে চায়।
আমি রাজি হয়নি। অনেক বুঝিয়ে ওকে ফিরিয়ে দিয়েছি। ”
-“কেন?” স্বপ্না প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে। “আপনি জানেন আপনার জন্যে আজো আমদের কতটা গ্লানিতে থাকতে হয়? খোরশেদ এখনও নিজেকে এসবের জন্যে দায়ী মনে করে। ”
-“গ্লানি কিসের?” আমি জিজ্ঞেস করি।
স্বপ্না কাঁদতে শুরু করে। আমি বিব্রতবোধ করি। আশেপাশের মানুষজন তাকাতে শুরু করেছে।
স্বপ্না ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে, “আপনি জানেন আব্বা মারা যাওয়ার আগে কী বলেছিল?”
-“কী?”
-“বলেছিল বিপ্লব যাতে আমাকে ক্ষমা করে। ”
আমি বাইরে তাকাই।
আমার প্রিয় এই বিকেলবেলাটা অপরিচিত মনে হয় আমার।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।