সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............ পাসপোর্ট অফিসের অভিজ্ঞতা-১
বছর বত্রিশ/তেত্রিশ আগে যখন প্রথম পাসপোর্ট করিয়েছিলাম-তখন অনেক হ্যাপা পোহাতে হয়েছিল। পেয়েছিলাম বেশুমার যন্ত্রনা। ঘুষ দেবার পরেও তোষামোদ করে পেয়েছিলাম প্রথম পাসপোর্ট। স্টুডেন্ট পেশা বদল করে যখন সার্ভিস পেশা করতে হয়েছিল-তখনও ভোগান্তি কম হয়নি। ব্যাবসায়ীক জীবনে অন্তত ৫ বার নতুন পাসপোর্ট করতে হয়েছে,নবায়ণ করতে একাধিকবার কিন্তু ব্যাক্তিগতভাবে আর কোনোদিন পাসপোর্ট অফিস মাড়াইনি।
কাজটি অনৈতিক হলেও দালালের মাধ্যমেই সম্পন্ন করতে বাধ্য হয়েছি-বিনা হ্যাপায়। একই প্রক্রিয়ায় স্ত্রীর জন্য একাধিকবার এবং সন্তানদের জন্যও একই পদ্ধতিতে কাজ সমাধা করতে বাধ্য হয়েছি। এখন পরিবারের সকলের নতুন এম আর পি পাসপোর্ট নিতে হচ্ছে।
আমি নিজেই দেখেছি জার্মানী, ইংল্যান্ড, ডেনমার্ক, সুইজ্যারল্যান্ড প্রভৃতি নরডিক দেশের সরকারি দপ্তর থেকে সরকারি কাজ সম্পাদন বা ফাইল নিষ্পত্তির বিষয়টি টেলিফোন, ইমেইল বা অন্যভাবে জানানো হয় ক্লায়েন্টকে, এমনকি মামলার ফলাফল বা পরবর্তী তারিখও বাদি-বিবাদিকে জানানো হয় উল্লেখিত পদ্ধতিতে। একবার পত্রিকায় প্রকাশিত এক খবরে জেনেছিলাম, লন্ডনে হাসপাতাল থেকে প্রেরিত অ্যাম্বুলেন্স ট্রাফিক জ্যামে পড়লে ঐ হাসপাতাল থেকেই রোগীকে তাড়াতাড়ি আনার জন্যে পুনরায় পাঠানো হয় 'হেলিকপ্টার অ্যাম্বুলেন্স', যা আমাদের দেশে কল্পনাও করা যায় না।
আমরা যারা বিদেশে গিয়েছি কিংবা শুনেছি এইসব 'গল্প' তাদের মনে সব সময় প্রবল কষ্ট ছিল কিন্তু আশাও ছিল 'এমন সার্ভিস' আমাদের দেশের অফিসগুলোতেও হবে!
আশার কথা বাস্তবায়িত হচ্ছে! তেমনটি হয়েছে আমাদের ঢাকার আগারগাঁয়ের পাসপোর্ট অফিসে। গত ২ মার্চ ঠিকই আমার মোবাইলে চলে এসেছে পাসপোর্ট তৈরি এবং গ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে এসএমএস ঐ পাসপোর্ট অফিস থেকে! যদিও বাংলাদেশের সরকারি দফতরগুলোর সেবা তথা বেহাল দশা আমরা সবাই কমবেশি জানি। ডাকঘরে কিংবা আদালতে গেলে অনেক কর্মচারী মুখ তুলে মানুষের দিকে তাকায় না, কথার উত্তর দেয় না, সেবা প্রদান করা তো দূরের কথা। রাষ্ট্রয়াত্ত কয়েকটি ব্যাংকের সেবা এবংবাংলাদেশস্থ্য স্টান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকেও বর্ণিত দফতরের অনুরূপ আচরণ লক্ষনীয়। পাসপোর্টের ফি কিংবা চালানের মাধ্যমে সরকারি টাকা জমা দিতে গেলে দেখা যায়, ঐসব ব্যাংকের কর্মচারীদের আচরণ নিতান্তই গর্হিত।
যারা বৃটিশ শাসন থেকে পাকিস্তানী এবং বর্তমান স্বাধীন দেশেও নানাভাবে আমলা, পেটি-আমলা তথা দাপ্তরিক শোষণের শিকার হচ্ছেন নানাভাবে প্রতিনিয়ত পদে পদে। বর্তমান সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশের নানা স্বপ্নগাথা শোনালেও প্রায় সব সরকারি দফতরে এখনো অ্যানালগি সিস্টেম ও চিন্তা-চেতনা বহাল তবিয়তে বিদ্যমান। দেশের পাসপোর্ট অফিসগুলো, বিশেষ করে ঢাকার আগারগাঁয়ের পাসপোর্ট দপ্তরের কুখ্যাতি কমবেশি সবার জানা ছিল। দালালদের দৌরাত্ম্যে সাধারণ মানুষ সেখানে ছিল নিতান্তই অসহায়! অতিরিক্ত খরচাপাতি ছাড়া সাধারণ নিয়মে পাসপোর্ট পাওয়া ছিল অনেকটা স্বপ্নের মতো, দেশের সাধারন অসহায় মানুষের কাছে।
এইরকম চিন্তা নিয়েই ভয়ে ভয়ে সম্প্রতি হাজির হলাম ঢাকার আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে স্ত্রী ও দুই পুত্রের পুরনো পাসপোর্টের বদলে নতুন মেশিন রিডাবল পাসপোর্ট প্রাপ্তির জন্যে, যদিও ইন্টারনেট থেকে 'এমআরপি' ফরম ডাউনলোড ও তথ্যাদি জেনে আগেই সবকিছু নিয়ে গিয়েছিলাম সঙ্গে করে।
ওখানে গিয়েই সেনাবাহিনীর সদস্যদের নানাবিধ শৃঙ্খলা, নিয়ম কানুন, লাইন ইত্যাদি দেখে কিছুটা অবাক হলাম। নিয়মানুসারে চেকিংয়ের জন্যে ঢোকানো হলো ৩ নম্বর গেট দিয়ে। পথেই বিভিন্ন টেবিল পেতে বসেছেন সেনা সদস্যরা। তাঁরা প্রাথমিক চেক করে পাঠালেন ভেতরে অন্য কাউন্টারে। সেখান থেকে আবার চেক করে সব ঠিক থাকার পর দেয়া হলো সিরিয়াল নম্বর।
পাঠানো হলো পাশের তৃতীয় তলায়। উপ-পরিচালকের সংশ্লিষ্ঠ ফরমে স্বাক্ষরের পর ছবি, হাতের ছাপ নেয়ার জন্যে পাঠানো হলো পাঁচ তলায়। পঞ্চম তলায় সেনা সদস্যরা সিরিয়াল অনুসারে বসতে দিলেন অপেক্ষাগারে এবং নির্দিষ্ট কাউন্টারে পাঠালেন ক্রমানুসারে। ছবি তুললেন, বায়ো মেট্রিক তথ্যাদি নিলেন কম্পিউটারে অল্প সময়ের ভেতরেই। এট্রির পর তথ্যাদির সঠিকতা যাচাই করতে দিলেন পাসপোর্ট প্রার্থীকে।
সব 'ওকে' হওয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে প্রদান করা হলো 'প্রিন্টিং ডেলিভারি স্নিপ', যাতে বায়ো এনরোলমেন্টের তারিখ ও সময়, কাউন্টার আইডি, এনরোলড আইডি, সম্ভাব্য প্রদানের তারিখ ইত্যাদি স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে মুদ্রিত।
খুব কম সময়ে ও নির্বিঘ্নে সম্পূর্ণ কাজ সম্পন্ন করে বাইরে বের হয়ে শুনি- মাইকে বলা হচ্ছে পাসপোর্ট ডেলিভারি প্রদানের বিভিন্ন নিয়ম কানুন ও পদ্ধতি। বেশ কটি ব্যানার, বোর্ড ও বড় কাগজে ফরম পূরণ, ব্যাংকে টাকা জমা, দালাল বিষয়ে সতর্কীকরণ, হয়রানির প্রতিকার, সমস্যার সমাধান, নতুন পাসপোর্ট গ্রহণের নিয়মাবলি খুব সহজ ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে। সমস্যা হলে সমাধানের জন্যে নির্দিষ্ট নম্বরে কিংবা 'এমআরপি-স্পেস-আইডি নম্বর লিখে ৬৯৬৯ নম্বরে 'এসএমএস' করে জমাকৃত নতুন পাসপোর্টের 'ট্রাকিং' করা যাবে, তাও বড় বড় অক্ষরে সহজ বাংলায় লিখে দেয়া হয়েছে। আবার আবেদনে প্রদত্ত মোবাইল নম্বরে 'এসএমএস' করে তৈরিকৃত পাসপোর্টের খবরও প্রদান করা হচ্ছে বলে মাইকে জানানো হচ্ছে বার বার।
যদিও পাসপোর্ট দেয়ার সম্ভাব্য তারিখ দেয়া ছিল ৫ মার্চ ২০১১ কিন্তু ২ মার্চ ২০১১ তারিখ এসএমএস পেলাম যে, আমাদের পাসপোর্ট তৈরি(উল্লেখ্য,যাদের পুরনো রেগুলার/ভ্যালীড পাসপোর্ট বদলে নতুন পাসপোর্ট নিচ্ছেন এবং পাসপোর্টে স্থায়ী/বর্তমান ঠিকানা পরিবর্তণ হয়নি-তাদের জরুরী পাসপোর্ট নিতে পুলিশ ভেরীভিকেশন দরকার হয়না, ফলে নির্ধারিত সময়ের আগেই তারা নতুন পাসপোর্ট পেতে পারেন)। ৩ মার্চ ২০১১ পাসপোর্ট অফিসে তাৎক্ষণিক চারজনের নির্ভুল, নিখুঁত মেশিন রিডাবল পাসপোর্ট পেয়ে সত্যিই মনে হলো সেনা সদস্যদের দ্বারা পরিচালিত একখণ্ড সৎ কর্মে উদ্দীপ্ত বাংলাদেশ দেখে এলাম। সেনাবাহিনী পরিচালিত কাংখীত বাংলাদেশ খুঁজে পেলাম ২০১১ সালের পাসপোর্ট অফিসে। ধন্যবাদ সেনা সদস্যদের।
এই অফিস হয়তো আমাদের নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে, যার সঙ্গে পুরনো পাসপোর্ট অফিসের কোনো তুলনাই চলে না।
আমাদের সরকারি অন্য অফিসগুলোও অনুকরণ ও অনুসরণ করতে পারে ঢাকার পাসপোর্ট অফিস ও এর কার্যক্রম। এই রকম সেবা কি আমাদের এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরো, কাস্টমস, আয়কর অফিস, সচিবালয়ের সেকশন অফিসারের দপ্তর, আমদানী-রপ্তানী নিয়ন্ত্রকের অফিস, ডাকঘর,কোর্ট পেশকারের দফতর, রেজিস্ট্রেশন, ভূমি অফিস, থানা-পুলিশ এবং জনগণের সঙ্গে প্রতিনিয়ত সম্পৃক্ত দফতরগুলোতে দেয়া যায়?
(এই বিশয়ে আরো একটি ছোট পর্বের জন্য অপেক্ষা করুন)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।