তেরোর ব্লগ মানেই হাবিজাবি !! “তোমার প্রিয় ফুল কি?”
-“হুম্মম্মম্মম্ম......বেলী মনে হয়!”
“তা তোমার প্রিয় ফল?”
-“আম!”
“বাহ এক কথাতেই জবাব!”
-“হ্যা!”
“তোমার প্রিয় সিংগার কে?”
-“ঠিক নাই!”
“কোন টাইপ গান?”
-“ঠিক নাই!”
“প্রিয় লেখক?”
-“ঠিক নাই!”
“প্রিয় বই?”
-“ঠিক নাই!”
অবশেষে অয়ন হতাশ হয়ে বললো যে কিছুই ঠিক নাই? আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম, "না। কিছুই ঠিক নাই। এরকম প্রশ্ন করবা না আমাকে। আমার ভালো লাগে না। ভাইভা ভাইভা লাগে।
যারা ভাইভা নেয় তাদের আমি খুব অপছন্দ করি। "
“হুম!”
“রাগ করলা?”
অয়ন না বলে মাথা ঝাকায়। আমি হাসতে থাকি। আমার হাসি দেখে সে অপ্রস্তুত হয়ে মাথা চুলকায়।
আকাশে অনেক মেঘ।
নানান রকমের নানান আকারের। আমার মেঘ দেখতে ভালো লাগে। মেঘেরা এত সুন্দর করে বদলায়,যখন যা ইচ্ছে হতে পারে। আমরা মানুষগুলা এতো বোরিং, বিরক্তিকর। উফ.....এখন সন্ধ্যা হবে।
আকাশ লাল হয়ে আছে। মেঘগুলো ও লাল নীল আকাশী নানা রঙের মাঝে উড়ে বেড়াচ্ছে। অবশেষে বাড়ি ফেরার পালা। আমি বাড়ি ফিরতে একদম ইচ্ছে করে না। আমি খুব ধীরে ধীরে বাড়ি ফিরি।
চাই রাস্তাটা আরো দীর্ঘ হোক। আরো আরো দীর্ঘ। যদি কখনো শেষ না হতো। আমি হাঁটতে থাকতাম তো থাকতামই। আমার পা ব্যাথায় অবশ হয়ে যেতো তাও আমি হাঁটতাম।
কিন্তু রাস্তাটা কেনো জানি কখনোই দীর্ঘ হয় না। দিনকে দিন ক্ষুদ্র হয়ে যাচ্ছে। এখন মনে হয় দু পা হাঁটলেই বাড়ি। তাও আমি হাত পা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়লাম। সেও আসছে সাথে সাথে।
আমি বললাম, "তোমার বাসা তো উলটা দিকে। এইদিকে আসো ক্যান?
সে বললো না মানে একটু আগায় দেই?"
আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, "না দরকার নাই। আমি একলা হাঁটতে পছন্দ করি। "
বলেই হন হন করে হেঁটে চলে আসলাম। কি দরকার মায়া বাড়ানোর।
মায়া খুব বিশ্রী জিনিস। যত দূরে থাকা যায় ততই শান্তি। হাতে এখন কিছু কাজ পড়ে আছে। জরুরী কাজ হলো বাসা দেখা। এ বাসায় আর না।
একটা নতুন বাসা খুঁজে বের করতেই হবে। এই শহরে খালি বাসা পাওয়ার মতো ঝামেলার কিছু নেই। তারপর হু হু করে দাম বাড়ছে সবকিছুর। বাসা ভাড়ার দাম ই বা কম থাকবে কেনো। একটা জরুরী কাজ অবশ্য সারা হয়ে গেলো।
পরশুদিন পরীক্ষা। বই ছিলো না। সে বইটা জোগাড় করে দিলো। বেশ উপকার করেছে আসলে আমার এমন করা উচিত হয় নাই তার সাথে। আমি মানুষটা খুব খারাপ মাঝে মাঝে টের পাই।
খুব বেশি স্বার্থপর।
হাঁটতে হাঁটতে বাসার সামনের গলিটাতে এসে পড়ি। গলির মুখেই বোটকা পঁচা গন্ধ। সবসময় সেখানে বিশ্রী গন্ধ থাকে। এই এলাকার মানুষেরা এতেই অভ্যস্থ হয়ে গেছে।
রাস্তার এখানে সেখানে গর্ত। কাঁদা। আমি গলির মুখে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নেই। ভিতরে যেতে ইচ্ছে করছে না। দেখি ফুটপাথে রতন বসে আছে।
আমাকে দেখে দাঁত বের করে হাসে। আমিও ফুটপাথে বসলাম। সে এলাকার বিখ্যাত পকেটমার। বয়স বেশি না। আমার সাথে তার পরিচয় অনেকদিনের।
আসলে আমি তার মাকে চিনতাম। ওর মা আম্মার কাছে টাকা জমা রাখতেন। আমার আম্মার এই অভ্যাস ভালোই আছে। সে নানান মানুষের জিনিসপত্র জমা রাখে,তাদের সমস্যার কথা বললে গম্ভীর হয়ে চশমা নাকের ডগায় নিয়ে শুনে, উপদেশ দেয়, বুদ্ধি দেয়। যাই হোক সেই মহিলার আঁচল ধরে একদিন রতন আমাদের বাসায় এলো।
হাফপ্যান্ট হাফশার্ট। মাথায় আচ্ছা করে তেল দেয়া রতনকে দেখে আমি ডাক দিলাম। বাচ্চাদের দেখলেই সবার প্রথম প্রশ্ন তোমার নাম কি? আমিও করলাম। সে আস্তে আস্তে বললো রতন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম পড়াশুনার খবর কি? সে মাথা নাড়িয়ে বললো করে না।
আমি রতনকে বলেছিলাম আসতে বইখাতা নিয়ে। রতন অবশ্য এসেছিলো কয়দিন পড়াশুনা করতে। তবে বুঝাই যাচ্ছিলো আগ্রহ নাই তার। বেশিদিন আসে নি। কিন্তু হঠাত করে শুনলাম সে পকেটমার হয়ে গেছে।
সে এখন একটা মানিব্যাগ ঘেটে টাকা পয়সা বের করে মানিব্যাগটা ফেলে দিলো। বুঝলাম বিশাল দাও মেরেছে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আমি একটু পর উঠে পড়লাম।
গলির ভেতরে একটু যাওয়ার পর ই ঝুপ করে বাতি নিভে গেলো সবকিছুর।
কারেন্ট চলে গেছে। এখন এই বিশ্রী কাঁদামাখা রাস্তাতে হাঁটবো কি করে। সামনে বলে কোথায় ম্যানহোল ও একটা খোলা আছে। সেখানে পড়লেই তো ঝুপ। তা কল্পনা করে কেনো জানি হাসি পেলো।
“কি ব্যাপার মিলি?কি হয়েছে?”
পেছন থেকে এই ডাকে আমার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। এই কন্ঠস্বর শুনলে আমার খুব কষ্ট হয়। হাত পা ব্যাথা শুরু করে। অদ্ভুত আসলেই অদ্ভুত। আমি একটা কাশি দিয়ে বললাম, “ম্যানহোলে পড়ে গেছি তো জামিল ভাই তাই একটু হাসি আর কি!”
“সে কি?ব্যাথা পাইছো?”
“নাহ!বাস্তবে পড়ি নাই।
কল্পনায় পড়ছি। চাইলে আপনিও পড়তে পারেন। ব্যাথা লাগবে না গ্যারান্টী!”
“তুমি আমার সাথে মশকরা করো মিলি?”
“নাহ জামিল ভাই। আপনার সাথে আমি কেনো মশকরা করবো!ছি!”
“বুঝলাম। অন্ধকারে বাড়ি যাবা কেমনে?”
“তাও একটা প্রশ্ন!অবশ্য আপনি এসে গেছেন।
আপনি অবশ্যই এর একটা উত্তর বের করে দিতে পারবেন! কি পারবেন না?
“হুম্মম...আসো। আমার মোবাইলে টর্চ লাইট আছে। “
জামিল ভাই এর টর্চ লাইটের আলোতে আমরা খুব সাবধানে হাঁটছি। তাও কেনো জানি মনে হচ্ছে এই বিশ্রী দূর্গন্ধের রাস্তাটাও যদি শেষ না হতো। এই বিদ্যূত ও যদি আজ আর না আসতো।
যাক এতো ভেবে কি হবে। জীবন হচ্ছে এই বিশ্রী দূর্গন্ধময় রাস্তা এখানে এসব কল্পনা মানায় না। ছপাত করে আমার পা কাঁদাতে পড়লো। আমি বলে উঠলাম,
“বালের রাস্তা!”
জামিল ভাই আহহা করে বলে উঠলো। আমি একটু অপ্রস্তুত হলাম।
এভাবে মুখ খারাপ করাটা হয়তো ঠিক হলো না। নিজেকে একটু ভদ্র বানালে কি ক্ষতি হতো। অবশেষে বাসার সামনে এসে দাঁড়ালাম। জামিল ভাই হাঁটতে লাগলেন। উনি আরো সামনে থাকেন।
এই বাসা পালটাতেই হবে তাহলে আর গলির মুখে জামিল ভাই এর সাথে যখন তখন দেখা হবে না। আমারো আর হাত পা ব্যাথা করবে না। ভালো লাগে না দুনিয়াদারী।
দরজা খুলে দিলো আম্মা। আমি পা ঝাড়তে ঝাড়তে ঢুকলাম।
“শালার বালের রাস্তাঘাট। কাঁদায় বাঁচি না। থাকুম না এই বাড়িত। “
আম্মা শান্ত হয়ে বলে, “থাক মা। রাগারাগি করিস না।
প্রতিদিন ই তো করিস। করে কি লাভ। রাস্তা কি ঠিক হবে?”
আমি আস্তে করে বললাম, “কিন্তু আম্মা শান্তি লাগে মনে। গালি দিলে মনে অনেক শান্তি। তুমি যে এতো শান্ত থাকো তোমার মনে কি শান্তি থাকে আম্মা? তোমার চিল্লাইতে ইচ্ছা করে না?”
আম্মা শুধু বলে, “খাবি না?আয় খা।
“
আমি হাত পা ধুতে কলতলায় যাই। কলতলার কোনায় কোনায় শ্যাওলা। খুব সাবধানে পা ফেলতে হয়। হাতমুখ ধুয়ে ফিরে এসে দেখি মা প্লেটে ভাত নিয়ে বসে আছে। আমি বসতে বসতে বললাম, “মন্টি কি করে?”
আম্মা জানালো পড়ে।
সামনে তার বড় পরীক্ষা।
আমিও মাথা নাড়ালাম।
আম্মা আরো বলে, “তোর ও তো সামনে পরীক্ষা রে। তোদের পরীক্ষা। কিছু যে ভালোমন্দ খাওয়াবো তাও পারি না”।
বলে চোখ মুছে।
এই মহিলার কান্না আমি একটু ও সহ্য করতে পারি না। হু হু টাইপ কষ্ট হয়। আমি চুপচাপ ভাত খেতে থাকি। আম্মা এতো ভালো রাঁধে কি করে? মাঝে মাঝে রাতে আম্মার গলা জড়িয়ে ধরে ঘুমোতে ইচ্ছে করে।
কিন্তু বলি না। লজ্জা লাগে মনে হয়। মন্টি টা এখনো আম্মার গলা জড়িয়ে ধরে ঘুমায়। আমি জেগে থাকি। মাঝেমাঝে তাদের ঘুমোনো দেখি।
এরপর কলতলাতে এসে বসি। ভাবতে ভাবতে দেখি কাক ডাকা শুরু হয়ে যায়। আমি দু-তিন ঘন্টার মতো ঘুমিয়ে আবার বের হয়ে পড়ি। কতদিন ঘুমোই না ভালো করে। না ঘুমোলে অবশ্য মাথা ধরে থাকে।
ঝিম ঝিম মাথায় একটা মাতাল মাতাল ঘোরের ভাব আছে। আমার ভালোই লাগে। তবে আজকে কলতলায় বসে বিলাসীতা করলে চলবে না। আজকে হয়তো একটু পড়বো। পড়াশুনাটা যে কেনো করি না ভালো করে।
অথচ এটাই তো দরকার। ধ্যাত।
বই খাতা খোলা রেখে আমি একটা গল্পের কথা ভাবছি। এখন একটা গল্প লিখতে ইচ্ছে করছে। অবশ্য গল্পের থেকে বেশি সংলাপ ই লেখা হয়।
আমি প্রায়ই কল্পনায় জামিল ভাই এর সাথে কথা বলি। নানান কথা সাজাই। মানুষ কবিতা লেখে,গল্প লেখে কিন্তু আমি শুধু সংলাপ লেখি। মাঝে মাঝে কল্পনায় লেখি, মাঝে মাঝে খাতায় লেখি। আগে গল্প লেখলে মন্টিকে পড়তে দিতাম।
কিন্তু আজকাল সংলাপ গুলো মন্টিকে পড়তে দেই না। প্রেম প্রেম গন্ধ আছে। দেখাতে লজ্জা লাগে। আজকে ভাবতে লাগলাম জামিল ভাইকে বলবো, “জামিল ভাই জানেন বেলী ফুল আমার খুব পছন্দ!”
আমি জানি জামিল ভাই বলবে, “হুম। “
আমি বলবো, “আমাকে একদিন অনেক বেলী ফুল এনে দিবেন?”
জামিল ভাই আবার বলবে “হুম।
“
“হ্যা নাকি না?”
“আচ্ছা এনে দিবো। কি করবা তা দিয়ে?”
“রেখে দেবো। পানি ছিটিয়ে রাখবো। গন্ধ ছড়াবে। এরপর খাতার ভাঁজে রেখে দেবো।
আপনার প্রিয় ফুল কি? গোলাপ তাই না?”
“হু”।
“আমিও আপনাকে গোলাপ এনে দিবো। কি গোলাপ দেবো জানেন?”
“কি?”
“কালো গোলাপ!”
“হুম”
“অবাক হলেন?”
“হু”
“আমি একবার শুনেছিলাম কালো গোলাপ মানে ফরএভার মাইন। সুন্দর না কথাটা? হয়তো কথাটা সত্যি না। কিন্তু আমি দেবো।
লাল গোলাপ তো সবাই দেয়। আপনি নিবেন না জামিল ভাই?”
এ পর্যায়ে এসে আমি ভাবনাটা বন্ধ করে দেই। একে তো অতিরিক্ত লেতকা পেতকা প্রেম হয়ে গেছে তার উপর শুধু শুধু ভেবে কি হবে। আমি কোনোদিন জামিল ভাইকে বলতে পারবো না জামিল ভাই কালো গোলাপ নেন। হয়তো বলতে পারবো জামিল ভাই ম্যানহোলে লাফ দেন।
তার উপর কথা হলো বাস্তবতা আগে। এসব পরে। পরীক্ষা দিতে হবে, বের হতে হবে। বাসা খুঁজতে হবে। মন্টিকে অনেক পড়াতে হবে।
চাকরী খুঁজতে হবে,টিউশনি দিয়ে কতদিন। দেশের বাড়ি থেকে জমিজামা থেকে আসা টাকা পয়সাতে সবসময় চলতে চায় না। সেখানে সবাই লুটে পুটে খাচ্ছে হয়তো। কিছু বলতেও পারি না। তাও তো দেখে রাখে।
প্রায়ই তারা আম্মাকে বলে জমি বিক্রি করে দিতে। নানান লোভ দেখায়,বুদ্ধি দেয়। আম্মা মুখ শক্ত করে বলে না,"কখনো না। ওদের বাবা রেখে গেছে আমি তা পরের হাতে যেতে দেবো না। " বাবা কিছু টাকাপয়সা এখানে সেখানে লাগিয়েছিলো তা থেকেও কিছু টাকা আসে।
বাবাটার এতো অভিমান ছিলো। এতো এতো অভিমান নিয়ে বাবা চলে গেলো। বাবা তুমি ক্যান চলে গেলা? আম্মা অনেক কষ্টে আছে। অনেক।
আমারো অনেক অভিমান করতে ইচ্ছে করে।
কিন্তু চাইলেও করতে পারি না। অভিমান কি সবার দ্বারা হয়?
হলের সামনে বই খুলে পড়ছি। দূর থেকে একটা কোকিল টানা ডেকেই চলেছে। এক পর্যায়ে আমি খেপে বললাম, “শালার কোকিল। রং লাগে রঙ?!” তা শুনে পাশের দুইজন হেসে উঠলো।
আমার কথা শুনে ও বলে উঠলো “এমন করো কেন? কোকিল কি দোষ করলো?”
আমি বললাম, “অয়ন কোকিলের হইয়া সাফাই গাইবা না তো। ফালতু একটা পাখি। পরীক্ষার সময় গান শুনায়। বেয়াদপ। “
অয়ন চুপ মেরে যায়।
এই ছেলেটা এতো মিনমিনা ক্যান? একটু পর তার হাতে বইটা দিয়ে বললাম, “ওকে অয়ন। পরীক্ষা শুরু হবে। বইটা নেও। অনেক অনেক ধন্যবাদ। তুমি আমার বিশাল উপকার করছো।
এখন চলো আমরা পরীক্ষা দেই”।
পরীক্ষার এক ঘন্টা যাওয়ার পর আমার হালকা হতাশ লাগলো। কারণ কিছু মনে পড়ছে না। ব্যাপারটা ভালো হলো না। এই অবস্থাতেও আমি জামিল ভাই এর সাথে মনে মনে কথা বলা শুরু করলাম।
“জামিল ভাই বিপদ!”
-“কেনো?”
“প্রশ্ন তো ভালো হয় নাই। খুব খারাপ হইতেছে!”
-“হুম!”
“হুম হুম করেন ক্যান?”
-“কি করবো?”
“বলেন যে ভালো হবে!”
-“আচ্ছা! ভালো হবে!”
"কি ব্যাপার বিড় বিড় করছো কেন? লেখো! সময় বেশি নেই তো। " ম্যামের এই কথায় আমার জ্ঞান আসলো আবার। আমি আবার মাথা নীচু করে লেখা শুরু করলাম। দেখলাম অয়ন আমার দিকে তাঁকিয়ে আছে।
আমি এমন ক্যান? আমি কি অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি?
পরীক্ষা দেয়ার পর অয়ন জিজ্ঞেস করলো, “কেমন দিলা মিলি?”
আমি বললাম, “আমার পরীক্ষা কি কখনো খারাপ হয়?”
“অ!”
ছেলেটা ভয়ংকর বোকা। সে বিশ্বাস করে কেন সবকিছু!
আমি তাই জিজ্ঞাসা করলাম “তোমার কেমন হইলো?”
“এই তো এতো ভালো না। ১০ মার্কস মনে হয় ভুল হতে পারে। “
আমার এই মুহূর্তে অয়নের গালে ঠাস করে একটা থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করছে। ১০ মার্কস ভুল তাও মনে হয়!! আমি যে কত কত মার্কস ছেড়েই বের হয়ে গেলাম।
আমার ওর উপর এত্ত রাগ লাগছে। আমি খুব হিংসুটে মেয়ে। আমি নিজে কিছু পারি না কিন্তু অন্যরা পারলে আমার খুব হিংসে লাগে। আমি ঝিম মেরে হাঁটতে লাগলাম। অয়ন জিজ্ঞেস করলো, “মিলি তুমি কি রাগ করছো?”
আমি মাথা নাড়লাম।
অয়ন বলে, “মিলি কি চলে যাবা?”
আমি বললামম “হু। “
সে ইতস্তত হয়ে বললো, “থাকো না আরেকটু। থাকলে কি হয়?”
আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, “অনেক কিছু হয়! আমার টিউশনি আছে। তোমার মতো তো আমি গায়ে বাতাস লাগায় ঘুরি না। “
অয়ন চুপ করে থাকলো।
আমি ব্যাগ গুছাতে গুছাতে ভাবতে লাগলাম এমন কি বলা ঠিক হলো? সে আমার উপকার করে প্রায়ই। হয়তো ক্লাসের সেই আমার বন্ধু। আমি ওর ভালো পরীক্ষার কথা শুনে ওর সাথে এমন করলাম !! ছি !! আমার মনটা দিন দিন দুষিত হয়ে যাচ্ছে। ভালো কিছু আমি বলতেই পারি না।
“তুমি কি রাগ করলা অয়ন? আমি অনেক খারাপ বুঝলা অয়ন! অনেক খারাপ! যারা আমার সাথে ভালো হয় আমি তাদের সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করি।
“
“আমি জানি! তুমি সবার সাথে এভাবে কথা বলো না। আমার সাথে বলো। আগে রাগ হতো এখন হয় না। হয়তো তুমি অন্য কারো রাগ ও আমার উপর ঝেড়ে ফেলো। ভালোই লাগে বুঝলা।
আমার উপর কেউ রাগ ও ঝাড়ে না তো!”
আমি চুপ করে শুনলাম।
“আচ্ছা তুমি যাও!আরেকদিন থাইকো!”
আমার নিজেকে এখন কিছুটা অপরাধী মনে হচ্ছে। আমরা যাকে দূর্বল পাই তার চিন্তাভাবনা নিয়ে খেলা করা শুরু করি। নাহ ভালো হতে হবে।
টিউশনিটা করে একদিক দিয়ে ভালোই হয়।
বিকেলের নাস্তা হয়ে যায়। আমি মাঝে মধ্যে ভাবি আজকের নাস্তা কি হতে পারে? এসির ঠান্ডা বাতাসে পড়াই। প্রায়ই ইচ্ছে করে বাক্স ভরে ঠান্ডা বাতাস বাসায় নিয়ে যাই। যে মেয়েকে পড়াই সে ভয়াবহ চালু। প্রায়ই উলটাপালটা প্রশ্ন করে।
সেদিন ফট করে জিজ্ঞেস করলো, “আপু তোমার বয়ফ্রেন্ড আছে?”
আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, “পড়ো। আজাইরা জিনিস জিগাবা না। “
সে মাথা দুলাতে দুলাতে বললো, “আমি জানি আছে। তুমি আমাকে বলবা না। আমি ছোট তো তাই”।
আমি ওর কাজকর্ম দেখে হতাশ হয়ে তাঁকিয়ে থাকি। আমি জানি এই মেয়ে আমাকে অনেক পছন্দ করে। আমাকে অন্ধ অনুকরণ ও করে। কিন্তু লুকিয়ে লুকিয়ে করে। আমি যদিও বুঝি,কিছু বলি না।
কিন্তু তার মা আমাকে পছন্দ করে না। আমার ধারনা ওর মা চিন্তায় আছে কি করে আমাকে আউট করবে। মেয়ের জন্য এখনো পারছে না।
সেদিন আমাদের বাসার সামনের রাস্তায় একটা বিড়ালের বাচ্চা পড়ে কাঁদছিলো। মন্টি সেটাকে কোলে করে বাসায় নিয়ে চলে আসলো।
আম্মা খানিকটা বিরক্ত হয়েছে। আমরা তার নাম রাখলাম টুসি। বাবা বিড়াল খুব পছন্দ করতো। আমি বুঝি মন্টি কেনো এনেছে বিড়ালটাকে। আম্মাও বুঝেছে তাই কিছু বলে নাই।
টুসি আজকাল সারা ঘর দৌড়ায়। মন্টি কোথা থেকে জানি একটা বল নিয়ে আসছে। সেটা নিয়েও ছুটাছুটি করে। অবাক করা ব্যাপার টুসি আম্মাকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে। লাফ দিয়ে কোলে মুখ গুজে বসে থাকে।
আম্মা কিছু বলতে গিয়েও বলে না। সেদিন আমি বললাম, "আম্মা বাবা বিড়াল খুব পছন্দ করতো তাই না? আমরাও বিড়াল অনেক পছন্দ করি। আমি মনে হয় বাবার মতো হইছি!"
আম্মা কিছু বলে না।
“আমি বাবার মতোই হইতে চাই!”
আম্মা মুখ কঠিন করে বলে, “না। হবি না।
তোদের বাবা অনেক অভিমানী। অভিমানীদের শুধু কষ্ট পেতে হয়। তুই শক্ত হবি অনেক শক্ত। এতো অভিমান করে কি হবে? তোর বাবার কিছু হইছে? সে একটা মস্ত বোকা। “
আমি চুপ করে থাকি।
ভাবতে থাকি বাবা তুমি একটা মস্ত বড় বোকা।
বাসার সামনে আজকে ময়লা পানিতে সয়লাব। আমি ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছি। আজকে বাসায় বসে থাকা যাবে না। অবশ্য আমার এমনেও বাসায় থাকতে ভালো লাগে না।
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি পালাই বাসা থেকে। একটা রিকশা টুং টাং করতে করতে ভিতরের রাস্তা থেকে আসছে। বাসার সামনে এসে থামলো। জামিল ভাই মাথা বের করে বললো, “কি ব্যাপার মিলি। বের হবা নাকি? আসো তোমারে নামায় দেই!” আমি মাথা নেড়ে রিকশায় উঠে বসলাম।
রিকশাটা চলছে মনে হচ্ছে পালতোলা নৌকায় করে যাচ্ছি। আমি জামিল ভাইকে বললাম, “জামিল ভাই আপনাকে আমি একটা প্রশ্ন করবো আপনি কি এর উত্তর দিতে পারবেন?”
জামিল ভাই কিছু বললো না।
“আচ্ছা থাক আরেকদিন করবো। নয়তো করবো ও না। এত প্রশ্ন করে কি হবে বলেন তাই না?”
“হুম ঠিক!”
“হুম্মম...তবে জামিল ভাই একটা কথা বলি।
আপনি বোকা বোকা মস্ত বোকা। “
অবশেষে রিকশা ভ্রমন শেষ হয়। আমি পালতোলা নৌকা থেকে নেমে পড়লাম। নেমেই সিদ্ধান্ত নিলাম আর জামিল ভাই এর সাথে মনে মনে কথা বলবো না। খাতাটা খাটের নীচে রেখে দেবো।
আর বের ই করবো না। সবকিছুর সীমা থাকা দরকার। কি দরকার মনে মনে কষ্ট পেয়ে। বিলাসী টাইপের কষ্টের খেতা পুড়ি আমি।
“কিরে মিলি কি অবস্থা?”
আমি গম্ভীর হয়ে বললাম এই তো!
“অবশ্য তোর মন এখন ভালো থাকার কথা না।
আমি এরকম রেজাল্ট করলে আমার অবস্থা আরো খারাপ হতো। “ এই বলে মেয়েটা হাসতে লাগলো। আমি চোখ সরু করে মেয়েটার কথা শুনলাম। সে কি ভালো রেজাল্টের আনন্দে কথা গুলিয়ে ফেললো নাকি ইচ্ছে করেই এমন বললো তা বুঝার চেষ্টা করছি। যতদূর মনে পড়ে আমি তার সাথে এমন কিছু করি নি যে এমন কাটা কাটা কথা সে আমাকে বলবে।
হঠাত পিছন থেকে অয়ন ডাক দিলো। মেয়েটা আমাকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে ছুটে গিয়ে অয়নের সাথে কথা বলছে। কি যে হাসি কথায় কথায়। আমি এবার ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। থাক মেয়েটাকে মাফ করে দেয়া যায়।
হিংসায় মানুষ কত কি করে! মেয়েটা হয়তো খারাপ না। দেখতেও ভালো,রেজাল্ট ও ভালো, ফ্যামিলি ও মনে হয় ভালো। অয়নকে বলতে হবে মেয়েটা ভালোই আছে।
অয়ন আমাকে এসে বললো, “মিলি মন ভালো?”
আমি কিছু বললাম না।
“মিলি আইসক্রিম খাবা নাকি ফুচকা খাবা?চলো আজকে খাই!”
“তোমার না কয়দিন আগে অসুখ করলো অয়ন।
তুমি যা তুলতুলে ছেলে অয়ন। পরে রাস্তার খাবার খেয়ে আবার অসুখ বাধাবা। এরপর দোষ আমার। আমি আর দোষের ভাগ নিতে চাই না কিছুর!”
অয়ন মন খারাপ করে বলে, “কিন্তু আমার তো খাইতে ইচ্ছা করে। চলো না!”
অয়নের মন আজকে ভালো।
মন ভালো থাকলে সে অনেক কথা বলে। অবশ্য এমনেও বলে। তবে আজকে মন ভালো তা আমি জানি। অয়নকে এখন কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না। মন টন খারাপ করে ফেলবে।
ফুচকার দোকানের সামনে হঠাত দেখি জামিল ভাই এক মেয়ের সাথে ফুচকা খাচ্ছে। খুব খুশী দুজনেই। আমার ভিতরটা জমে যেতে থাকে। মেয়েটাকেও আমি চিনি খুব ভালো করে। আমাদের এলাকার ই মেয়ে।
অয়ন আমার দৃষ্টি অনুসরন করে নিজেও দেখে। হয়তো বুঝতে পারে। বলে, “থাক মিলি আজকে ফুচকা খাবো না। চলো অন্য কোথাও যাই। “ আমি মাথা নীচু করে থাকি।
কষ্ট হচ্ছে। আমার কি কষ্ট পাওয়া উচিত? মাঝে মাঝে মনে হয় ফালতু কারণে আমি মন খারাপ করি।
গলির মাথায় জামিল ভাই দৌড়াদৌড়ি করছে। আমাকে দেখে দৌড়ে আসলো। মিলি একটা ভালো খবর আছে।
আমি বললাম, “কি?”
জামিল ভাই হাসতে থাকে। আমি বলি, “ঐ নীলুর সাথে আপনের বিয়ে তাই না?”
জামিল ভাই এবার লাজুক হাসি দিতে থাকে। আমি মুখ শক্ত করে বলি, “জামিল ভাই আপনি আমার সাথে আর কোনোদিন কথা বলবেন না। কোনোদিন না। “
দোষটা আমারই।
আর কারো না। সংলাপ গুলো মনে মনে না বলে সামনে বলা উচিত ছিলো। আমি হচ্ছি ভয়ংকর ভীতু মেয়ে। আমি পারি না। আমি কিছুই পারি না।
থাক হুদাই।
আবার উলটোপথে হাঁটা শুরু করলাম। বাসায় এখন যাওয়া অসম্ভব। আমি এলোপাথারী অনেক হাঁটলাম। বহুদিন রতনের দেখা নেই।
হয়তো কোথাও মার খেয়ে মরেই গেছে নয়তো হাসপাতালে নয়তো জেলে। টিউশনি ও চলে গেছে ওটা। ঐ মহিলা অবশেষে আমাকে বের করে দিতে পারলো। মেয়ে অনেক কান্নাকাটি করেও আমাকে রাখতে পারলো না। শুধু কান্নাকাটি করেই তো হবে না পড়াশুনা করতে হবে।
সেটাতেই তো সে গোল্লা। আমি পড়াতেও পারি না।
হাঁটতে হাঁটতে আজকে আসলেই হাত পা অবশ প্রায় । আমি খুব ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরলাম। তখন সন্ধ্যা।
দরজা খোলার সাথে সাথেই মন্টি আপা বলে বিশাল চিতকার। আমি জিজ্ঞাসু ভংগীতে তাঁকিয়ে আছি। আম্মা এসে প্রশ্নের জবাব দিয়ে দিলেন। বললেন টুসির দুইটা বাচ্চা হয়েছে। আম্মার মুখ ও হাসি হাসি।
মন্টি আমার কোমড় ধরে লাফাচ্ছে। এ বাড়িতে বহুদিন আনন্দ আসে না। টুসিকে দেখলাম খুব অহংকারী ভংগীতে বসে আছে। টুসির সামনে যেনো দুই টুকরা আনন্দ চোখ বুঝে মিউ মিউ করছে। এ অবস্থায় মন খারাপ করে রাখা যায় না।
আমার খুশীতে গলা ব্যাথা করছে। আম্মাকে ধরে কাঁদতে লাগলাম। আম্মা আমার মাথায় হাত বুলাতে লাগলো।
সেদিন রাতে আমরা দুজনেই আম্মার গলা জড়িয়ে ঘুমোলাম। আম্মা গভীর রাতে বললো যে আমার খাতাটা সে পড়ে ফেলেছে।
আমি চুপ করে থাকলাম। আম্মা বললো, "অভিমান করছিস বাবু? কষ্ট পাইছিস?"
আমি মাথা নাড়ি। বললাম, “আম্মা সব ঠিক হয়ে যাবে তাই না?”
আম্মা কিছু বলে না। মন্টি ঘুমের মধ্যে হু হা করছে। আমি মনে মনে বলি, “না আম্মা আমি অভিমান করবো না।
একদম করবো না। আমরা সাহসী আম্মার সাহসী বাচ্চা। আমাকে অভিমান করা মানায় না। “
ঠিক করলাম এখন থেকে নিয়মিত ঘুমাবো। অয়নের সাথে ভালো করে কথা বলবো।
নতুন বাসা আবার খুঁজবো। একদিন আমরা ঠিক নতুন একটা বাসাতে যাবো। কেনো জানি আর খারাপ লাগছে না। ভালোই লাগছে। দূর থেকে টুসি ম্যাও ম্যাও করছে।
টুসির বাচ্চাগুলো যেমন টুসির গলা জড়িয়ে ঘুমোচ্ছে,আমরাও তেমন বিড়ালের মতো গুটি সুটি মেরে আম্মার গলা জড়িয়ে ঘুমোতে থাকি। টুসির মতো আম্মাও জেগে থাকে, হয়তো ভাবে যে ধূসর মেঘ একদিন ঠিক কেটে যাবে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।