ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ীর মতে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বর্তমানে বড় ধরনের মৌলিক পরিবর্তন ঘটছে। তার দৃষ্টিতে এসব পরিবর্তন বা বিপ্লবের দু'টি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্যনীয়: প্রথমতঃ জনগণের উপস্থিতি এবং দ্বিতীয়তঃ এসব বিপ্লবের ধর্মমুখী প্রবণতা। জনগণ ময়দানে সরাসরি উপস্থিত হলে কোনো শক্তিই তাদের রুখতে পারে না যেমনটি ঘটেছিল ইরানের ইসলামী বিপ্লবে। আরব বিশ্বের সাম্প্রতিক বিপ্লবগুলোতে জুমার নামাজ, জামায়াতে নামাজ আদায়, মহান আল্লাহর নামে শ্লোগান, ধর্মীয় নেতার উপস্থিতি প্রভৃতি লক্ষ্যনীয়। এইসব দেশের জনগণ মনে করে যে তাদের জালেম শাসকরা জাতির মর্যাদা ক্ষুন্ন করেছে।
যেমন, মিশরের হোসনি মুবারক ইসরাইলের পক্ষ নিয়ে গাজা অবরোধ কার্যকর করাসহ নিকৃষ্টতম নানা কাজ করেছিল। গাজার মজলুম জনগণ অবরোধের কারণে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে মিশর সীমান্ত দিয়ে পণ্য আনত। কিন্তু মুবারক তাও বন্ধ করে দেয়ার জন্য এ সব সুড়ঙ্গ পথে ত্রিশ মিটার গভীর ইস্পাতের দেয়াল তৈরি করে। এইসব দেশের অন্য শাসকরাও প্রায় একই চরিত্রের। যেমন, গাদ্দাফি প্রথম দিকে পশ্চিমা বিরোধী ভাব দেখালেও পরে পরমাণু কর্মসূচী বন্ধ করে দেয়াসহ তাদের নানা সেবায় নিয়োজিত হয়।
কিন্তু ইরান শত হুমকি ও বাধা সত্ত্বেও পরমাণু তৎপরতা অব্যাহত ও জোরদার করেছে।
হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী মনে করেন, পশ্চিমারা প্রথমে এসব বিপ্লবের গণজোয়ারে হতভম্ব বা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়ে। তাই এসব গণবিপ্লবের ব্যাপারে তাদের প্রাথমিক অবস্থান ছিল অস্পষ্ট, দ্বিমুখী বা পরস্পরবিরোধী। অবশ্য তার মতে, মার্কিন ও পশ্চিমা সরকারগুলো সব সময়ই স্বৈরশাসকদের সর্বাত্মক মদদ যুগিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত তাদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে চেয়েছে তারা। পরে যখন দেখলো এইসব সেবাদাসদের আর টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয় তখনই তাদের ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
তাই এসব ঘটনায় স্বৈরশাসকদের জন্য বড় শিক্ষা রয়েছে বলে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা মনে করেন। মার্কিন সরকারসহ পশ্চিমারা এসব বিপ্লবে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। মিশর ছিল মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নীতির অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। পাশ্চাত্য কেবল শাসককে বদলিয়ে পুরনো ব্যবস্থাকেই টিকিয়ে রাখতে চাইছে এসব দেশে। কিন্তু মিশর ও তিউনিশিয়ার মত দেশে জনগণ বিপ্লব অব্যাহত রেখে পুরনো সরকারের সবাইকে পদত্যাগে বাধ্য করেছে।
ফলে পাশ্চাত্যের ও মার্কিন সরকারের চক্রান্ত ব্যর্থ হয়েছে। এ অঞ্চলে মার্কিনীদের সিরিজ ব্যর্থতা অব্যাহত থাকবে বলে মনে করেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতার মতে, পাশ্চাত্য দু'টি কৌশল নিয়ে কাজ করছে। প্রথমতঃ এসব বিপ্লবকে পকেটস্থ করা তথা এই দেশগুলোর জনগণকে ধোঁকা দিয়ে সেখানে নিজ পছন্দের লোকদের ক্ষমতায় বসানো এবং দ্বিতীয়তঃ ইরানের মত ধর্মভিত্তিক গণশাসনের দেশে একই ধরনের বিপ্লব ঘটানো। কিন্তু তাদের এ দুই কৌশলই ব্যর্থ হয়েছে।
ইরানের জাগ্রত জনতা ওদের মুখে মুষ্টাঘাত হেনেছে। বিশ্বে প্রকৃত মুনাফিক বা ভন্ড হল মার্কিন সরকার। তারা জনদরদি বলে দাবি করে, কিন্তু বাস্তবে তারা জাতিগুলোর শত্রুদের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সাহায্য দিয়ে এসেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা বলেছেন, তিনি নাকি ইরানি জনগণের সমর্থক। এটা মিথ্যা কথা।
এরা যে কেবল অন্য জাতির প্রতি দয়া দেখায় না তা নয়, নিজ জাতির সাথেও নির্দয় আচরণ করে। ওবামা মার্কিন অস্ত্র কোম্পানিগুলো ও ব্যাংকগুলোকে চালু রাখার জন্য দেশটির দারুন অর্থনৈতিক সংকটের সময়ও জনগণের অর্থ দিয়ে এইসব কোম্পানির পকেট ভরেছেন। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেছেন, গুয়ান্টানামো ও ইরাকের আবু গারিব কারাগারসহ বিভিন্ন নির্যাতন কেন্দ্রে মার্কিনিদের কুকীর্তির ফিরিস্তি খুবই দীর্ঘ। ওবামা বলছেন, ইরানের তেহরানের আযাদি স্কোয়ার কায়েরোর তাহরির স্কয়ারের মত। ঠিকই বলেছেন, ১১ই ফেব্রুয়ারি ইরানের ইসলামী বিপ্লবের বিজয় বার্ষিকীতে প্রতি বছর এখানে লক্ষ লক্ষ ইরানি জনতা ‘যুক্তরাষ্ট্র নিপাত যাক' বলে শ্লোগান দেয়।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতার মতে, মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে ইরানের অবস্থান স্পষ্ট। আর তা হল, ইরানের ইসলামী সরকার জাতিগুলোর অধিকারকে সমর্থন করে। তিনি বলেছেন, "আমরা বিশ্বের যে কোনো অঞ্চলে আধিপত্যকামী ও লুটেরা শক্তিগুলোর বিরোধী। জাতিগুলোও এটাই চায়। ইরান লিবিয়ায় গাদ্দাফির গণহত্যার নিন্দা করে এবং একই সঙ্গে দেশটিতে পাশ্চাত্যের সামরিক হস্তক্ষেপেরও নিন্দা করে।
পশ্চিমা সরকারগুলো লিবিয়ার জনগণের সমর্থক হলে এক মাস ধরে তাদের ওপর গাদ্দাফির গণহত্যায় নীরব দর্শকের ভূমিকা রাখত না, বরং বিপ্লবীদেরকেই অস্ত্র দিত। ওরা এখন তেলের জন্যই সেখানে হস্তক্ষেপ করছে। পাশ্চাত্য ভবিষ্যতে মিশর ও তিউনিশিয়ার বিপ্লবী সরকারকে নিয়ন্ত্রণের জন্যই লিবিয়ায় পা রাখার বা ঘাঁটি গাড়ার চেষ্টা করছে। জাতিসংঘ তাদের সমস্ত অশুভ কাজের সহযোগীতে পরিণত হয়েছে। "
ইরানের সর্বোচ্চ নেতার মতে, বাহরাইনের ঘটনা আরব বিশ্বের অন্য দেশগুলোর মত হওয়া সত্ত্বেও পাশ্চাত্যের প্রচার মাধ্যম ও তাদের সেবাদাসরা বলছে যে, এ দেশের সমস্যা হল শিয়া-সুন্নী দ্বন্দ্বের বিষয়।
বাহরাইনের বেশির ভাগ জনগণ শিয়া মুসলমান হওয়ায় পাশ্চাত্যের দৃষ্টিতে কেউই তাদের সহায়তা করতে পারবে না বা করা উচিত নয়! অথচ মিশরের ও লিবিয়ার গণদাবির সাথে বাহরাইনের গণদাবির কোনো পার্থক্য নেই। গোটা বাইরাইনি জাতি নিজ অধিকারের জন্য আন্দোলন করছে। তারা ভোটের অধিকার ও নির্বাচনের অধিকার চায়। এটা কি কোনো অবৈধ দাবি?
পাশ্চাত্য বলছে, ইরান এই দেশে হস্তক্ষেপ করছে। ইরান বাহরাইনের জনগণের ওপর হত্যাকাণ্ড চালাতে নিষেধ করছে।
নিজ জনগণকে হত্যা না করতে জালেম শাসকের কাছে আহ্বান জানাচ্ছে। এটা কি হস্তক্ষেপ? আর বাহরাইনের রাস্তায় বিদেশী ট্যাংকের প্রবেশ কি হস্তক্ষেপ নয়? ওরা ইরানকে শিয়াদের সমর্থক বলে প্রচার করছে। ইরান গত ৩২ বছর ধরে ফিলিস্তিনি জাতিকে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করেছে। ফিলিস্তিনিরা কি তাহলে শিয়া মুসলমান? শিয়া-সুন্নী বিতর্ক মার্কিন সরকারের ষড়যন্ত্র মাত্র। যারা এ ফাঁদে পড়ছেন ও মার্কিনীদের এসব কথা বিশ্বাস করছেন তাদের কেউ কেউ সরলমনা হলেও তারা আসলে মার্কিনীদেরই সবচেয়ে বড় সেবায় নিয়োজিত।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতার মতে মুসলিম জাতিগুলোকে বিভক্ত করার জন্যই শিয়া-সুন্নী বিরোধের কথা বলা হচ্ছে। ইরানের দৃষ্টিতে লিবিয়া, বাহরাইন, তিউনিশিয়া, মিশর, গাজা ও ফিলিস্তিনের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এ সব দেশের মুক্তিকামী ও ইসলামী জাগরণকে ইরান সমর্থন করে। সৌদি আরব বাহরাইনে সেনা পাঠিয়ে ভুল করেছে বলে হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী মনে করেন। তিনি বলেছেন, "এ ধরনের তৎপরতার মাধ্যমে সৌদি সরকার নিজেকে এ অঞ্চলে ঘৃণিত করছে।
হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মার্কিন সরকার এ অঞ্চলে ঘৃণিত হবার বিষয়টিকে হয়তো গুরুত্ব নাও দিতে পারে। কিন্তু সৌদি সরকার এ অঞ্চলে বসবাস করছে বলে জাতিগুলোর কাছে তারা ঘৃণিত হবে ও তাদের ক্রোধের পাত্রে পরিনত হবে। আর এটা তাদের জন্য বড় ধরনের ক্ষতি। "
ইরানের মতে, ইরানের বর্তমান যুব প্রজন্ম ইসলামী বিপ্লবকে না দেখলেও তারা সে সময়কার ইরানী মুসলমানদের চেয়ে বেশি না হলেও কম বিপ্লবী ও ঈমানী চেতনার অধিকারী নয়
বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।